গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

০৩. মগধের দূত

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মগধের দূত

মহাকবি কালিদাস রঘুর দিগ্‌বিজয় বর্ণনাচ্ছলে যে অমিত-বিক্রম মগধেশ্বরের বিজয়গাথা রচনা করিয়াছিলেন, তাঁহার নাম সমুদ্রগুপ্ত। এক হিসাবে সমুদ্রগুপ্ত আলেকজাণ্ডার অপেক্ষাও শক্তিধর ছিলেন; আলেকজাণ্ডারের সাম্রাজ্য তাঁহার মৃত্যুর পরেই ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত তাঁহার সমুদ্রমেখলাধৃত বিশাল সাম্রাজ্যকে এমন সুকঠিন শৃঙ্খলে বাঁধিয়া দিয়া গিয়াছিলেন যে, তাঁহার বংশধরগণ তিন পুরুষ পর্যন্ত প্রায় নিরুপদ্রবে তাহা ভোগ করিয়াছিলেন, শত বর্ষ মধ্যে সে বন্ধন শিথিল হয় নাই।

গুপ্ত সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরিল সমুদ্রগুপ্তের পৌত্র কুমারগুপ্তের সময়। তখনও সাম্রাজ্য কপিশা হইতে প্রাগ্‌জ্যোতিষ পর্যন্ত বিস্তৃত; কিন্তু বহিরাকৃতি অটুট থাকিলেও গজভুক্ত কপিত্থবৎ অন্তঃশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। যে দুর্দম জীবনশক্তি এই বিরাট ভূখণ্ডকে একত্রীভূত করিয়া রাখিয়ছিল, কালক্রমে জরার প্রভাবে তাহা শ্লথ হইয়া গিয়াছে।

কুমারগুপ্তের দীর্ঘ রাজত্বকালের শেষভাগে উন্মত্ত ঝঞ্ঝাবর্তের মত হূণ অভিযান সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে আঘাত করিল। এই প্রচণ্ড আঘাতে জীর্ণ সাম্রাজ্য কাঁপিয়া উঠিল। কুমারগুপ্ত ভোগী ছিলেন, বীর ছিলেন না। কিন্তু তাঁহার ঔরসে এক মহাবীর পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিল— গুপ্তবংশের শেষ বীর স্কন্দ। তরুণ স্কন্দগুপ্ত তখন যুবরাজ-ভট্টারক পদে আসীন; রাজবংশের চঞ্চলা লক্ষ্মীকে স্থির করিবার জন্য স্কন্দ তিন রাত্রি ভূমিশয্যায় শয়ন করিয়া যুদ্ধযাত্রায় বাহির হইলেন। সেই দিন হইতে ক্ষয়গ্রস্ত পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যকে অটুট রাখিবার অক্লান্ত চেষ্টায় দীর্ঘ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ও সৈন্য শিবিরে যাপন করাই এই ভাগ্যহীন বীরকেশরীর পূর্ণ ইতিহাস।

যুবরাজ স্কন্দ পঞ্চনদ প্রদেশে হূণ অক্ষৌহিণীর সম্মুখীন হইলেন। হিংস্র বর্বর হূণগণ প্রাণপণ যুদ্ধ করিল, কিন্তু অসামান্য রণপণ্ডিত স্কন্দের সহিত আঁটিয়া উঠিল না। তথাপি আশ্চর্য এই যে, তাহারা নিঃশেষে দূরীভূত হইল না। পঞ্চনদ প্রদেশ নদনদী ও পর্বত দ্বারা বহুধা খণ্ডিত; চক্রবর্তী গুপ্তসম্রাটের অধীনে প্রায় পঞ্চাশটি ক্ষুদ্রবৃহৎ সামন্তরাজা ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য রচনা করিয়া এই দেশ শাসন করিতেন। হূণদের আক্রমণে সমস্তই লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছিল, কূলপ্লাবী বন্যায় খড়কুটার সহিত মহীরুহও ভাসিয়া গিয়াছিল। অতঃপর স্কন্দের আবির্ভাবে বন্যার জল নামিল বটে কিন্তু নানা স্থানে আবদ্ধ জলাশয় রাখিয়া গেল। পরাজিত হূণ অনীকিনীর অধিকাংশ দেশ ছাড়িয়া গেল, কতক প্রকৃতি-সুরক্ষিত দুর্গম ভূমি আশ্রয় করিয়া রহিয়া গেল।

কুটিল রোগ যেমন তীব্র ঔষধের দ্বারা বিদূরিত না হইয়া দেহের দুর্লক্ষ্য দুরধিগম্য স্থানে আশ্রয় লয়, কয়েকটা হূণ গোষ্ঠীও তেমনি ইতস্তত সানুসঙ্কট-বন্ধুর স্থানে অধিষ্ঠিত হইল। হয়তো স্কন্দ আরও কিছুকাল এই প্রান্তে থাকিতে পারিলে সম্পূর্ণরূপে হূণ উৎপাত উন্মূলিত করিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি থাকিতে পারিলেন না, সাম্রাজ্যের অপর প্রান্তে গুরুতর অশান্তির সংবাদ পাইয়া তাঁহাকে ফিরিতে হইল। পঞ্চনদ প্রদেশ বাহ্যত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রহিল বটে, কিন্তু ধর্ষিতা নারীর ন্যায় তাহার প্রাক্তন অনন্যপারতা আর রহিল না।

বিটঙ্ক নামক ক্ষুদ্র গিরিরাজ্য এই সময় একদল হূণের করতলগত হইয়াছিল। এই হূণদের প্রধান পুরুষ রোট্ট রাজ্যের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী ধারা দেবী নাম্নী এক কুমারীকে অঙ্কশায়িনী করিয়া নূতন রাজবংশের সূচনা করিয়াছিলেন।

প্রথম সংঘর্ষের বিস্ফুরিত অগ্ন্যুদ্‌গার নিভিয়া যাইবার পর বিজেতা ও বিজিতের মধ্যে বিদ্বেষ-ভাব হ্রাস পাইতে লাগিল। উগ্র হূণ প্রকৃতি পারিপার্শ্বিক প্রভাবের ফলে শান্ত হইয়া আসিল। সর্বাপেক্ষা অধিক পরিবর্তন হইল স্বয়ং মহারাজ রোট্টের। ধারা দেবীর কোমল এবং সহিষ্ণু অন্তরে না জানি কোন অপরিমেয় শক্তি ছিল, তিনি এই দুর্ধর্ষ বর্বরকে সম্পূর্ণ বশীভূত করিলেন। রোট্ট ক্রমশ বুদ্ধের করুণাবাণীর শরণাপন্ন হইলেন, তাঁহার নামের পশ্চাতে ধর্মাদিত্য উপাধি যোজিত হইল। কপোতকূটের যে চৈত্য হূণদের আগমনে ভগ্নস্তূপে পরিণত হইয়াছিল তাহা পুনর্গঠিত হইল।

রোট্ট ধর্মাদিত্যের রাজত্বকালের সপ্তম বর্ষে মহাদেবী ধারা একটি কন্যা প্রসব করিয়া চিরদিনের জন্য তাঁহার পরম সহিষ্ণু কোমল চক্ষু দু’টি মুদিত করিলেন। কিন্তু রোট্ট আর নূতন মহাদেবী গ্রহণ করিলেন না— একটিমাত্র কন্যার নাম রাখিলেন রট্টা যশোধরা।

প্রথম হূণ অভিযানের পর শতাব্দীর একপদ ক্ষয় হইয়া গেল। ওদিকে স্কন্দগুপ্ত পিতার মৃত্যুর পর সম্রাট হইয়াছেন। সাম্রাজ্যের চতুঃসীমা ঘিরিয়া বিদ্রোহ এবং অশান্তির আগুন জ্বলিতেছে; ধীরে ধীরে মগধকে কেন্দ্র করিয়া বহ্নিচক্র সঙ্কুচিত হইতেছে। রাজ্যের অভ্যন্তরেও পুষ্য মিত্রীয়গণ গোপনে মাৎস্যন্যায় ও চক্রান্তের বিষ ছড়াইতেছে। এই বিষবহ্নির মধ্যে স্কন্দ ক্লান্তিহীন নিদ্রাহীনভাবে যুদ্ধ করিয়া ফিরিতেছেন। তাঁহার বিপুল বাহিনী কখনও লৌহিত্যের উপকূলে উপস্থিত হইয়া বিদ্রোহীর অন্তরে আতঙ্ক সঞ্চার করিতেছে, আবার পরদণ্ডেই সেতুবন্ধ অভিমুখে যাত্রা করিয়া শান্তি-সেতু বন্ধনের প্রয়াস পাইতেছে। বর্ষান্তে মহারাজ তাঁহার মহাস্থানীয়ে পদার্পণ করিবার অবকাশ পান না। সচিবগণ পাটলিপুত্রে থাকিয়া যথাসাধ্য রাজকার্য চালাইতেছেন।

সাম্রাজ্যব্যাপী এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে রাজকার্য যে সুচারুরূপে চলিতেছিল না তাহা বলা বাহুল্য। ভূমিকম্পে যখন মাথার উপর গৃহ ভাঙিয়া পড়িতেছে তখন গৃহকোণে রক্ষিত ক্ষুদ্র তৈজস কেহ লক্ষ্য করে না। তুচ্ছ বিটঙ্ক রাজ্যের কথা পাটলিপুত্রের সকলে ভুলিয়া গিয়াছিল; পঁচিশ বৎসরের মধ্যে কেহ তাহার খোঁজ লয় নাই।

রাজ্যের প্রাচীন পুস্তপাল মহাশয়ের মৃত্যু হওয়াতে এক নবীন কর্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন। নবীনতার উদ্যমে তিনি একদিন অক্ষপটল-গৃহের পুরাতন নিবন্ধ পুস্তকাদি ঘাঁটিতে বিটঙ্ক রাজ্যের নাম আবিষ্কার করিলেন। পঁচিশ বৎসর এই রাজ্য হইতে রাজস্ব আসে নাই। রাজ্যটা গেল কোথায়?

বহু নথিপত্র অনুসন্ধানের পর প্রকৃত তথ্য জানা গেল। চিন্তান্বিত নবীন পুস্তপাল মহাশয় দুঃসংবাদটা মহামন্ত্রীর কানে তুলিলেন।

স্কন্দ তখন পাটলিপুত্রে উপস্থিত। সুদূর কেরল দেশে যুদ্ধ করিতে করিতে একটা গুরুতর দুর্যোগের জনশ্রুতি শুনিয়া তিনি ত্বরিতে রাজধানী ফিরিয়াছেন। আবার নাকি হূণ আসিতেছে; লক্ষ লক্ষ শ্বেত হূণ বক্ষু নদী পার হইয়া দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা করিয়াছে। দুইজন চৈনিক শ্রমণ এই সংবাদ লইয়া কপিশায় উপস্থিত হইয়াছিলেন, সেখান হইতে রাজদূত দিবারাত্র অশ্বচালনা করিয়া স্কন্দের নিকট বার্তা আনিয়াছে। কেরল যুদ্ধের ভার কয়েকজন প্রাচীন সেনাপতির উপর অর্পণ করিয়া স্কন্দ পাটলিপুত্রে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন।

মহামন্ত্রী বিটঙ্ক রাজ্যের সংবাদ লইয়া রাজসকাশে উপস্থিত হইলেন— ‘একটা বড় ভুল হইয়াছে। বিটঙ্ক নামক পঞ্চনদ প্রদেশের একটা রাজ্য আমাদের হিসাব হইতে হারাইয়া গিয়াছিল। দেখা যাইতেছে হূণেরা সেটা অধিকার করিয়া বসিয়াছে। পঁচিশ বৎসর তাহারা রাজস্ব দেয় নাই।’

স্কন্দ তখন প্রাসাদের এক বিশ্রাম-কক্ষে একাকী ছিলেন, মণি কুট্টিমের উপর বসিয়া অক্ষবাটের সম্মুখে পার্ষ্টি ফেলিতেছিলেন; মন্ত্রীর কথায় স্বপ্নাতুর চক্ষু তুলিয়া চাহিলেন। স্কন্দের বয়ঃক্রম এই সময় প্রায় পঞ্চাশ বৎসর, কিন্তু বলদৃপ্ত দেহে কোথাও জরার চিহ্নমাত্র নাই; রমণীর ন্যায় কোমল চক্ষু দু’টি যেন সর্বদাই স্বপ্ন দেখিতেছে। তাঁহার সুঠাম দেহ ও লাবণ্যপূর্ণ মুখমণ্ডল দেখিয়া তাঁহাকে পরাক্রান্ত যোদ্ধা বলিয়া মনে হয় না, কবি ও ভাবুক বলিয়া ভ্রম হয়।

স্কন্দ দুই হাতে পার্ষ্টি ঘষিতে ঘষিতে শূন্য দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন— ‘পাশা বলিতেছে এবার হূণকে তাড়াইতে পারিব না। তিনবার পাশা ফেলিলাম, তিনবারই পাশা ঐ কথা বলিল। গুপ্ত সাম্রাজ্য টলিতেছে, ভাঙিয়া পড়িতে আর বিলম্ব নাই।’— তারপর চকিতে সচেতন হইয়া সসম্ভ্রমে বলিলেন— ‘আসন গ্রহণ করুন আর্য।’

মহাসচিব পৃথিবীসেন রাজার সম্মুখস্থ আসনে বসিলেন। অশীতিপর বৃদ্ধ, শুষ্ক দেহ বংশযষ্টির ন্যায় ঋজু ও গ্রন্থিযুক্ত; ইনি একাধারে এই বৃহৎ রাজ্যের মহাসচিব ও মহাবলাধিকৃত; স্কন্দের পিতা কুমারগুপ্তের সময় হইতে অনন্যমনে রাজ্যের সেবা করিয়া আসিতেছেন।

পৃথিবীসেন নীরসকণ্ঠে বলিলেন— ‘কবি কালিদাস একদিন আমাদের বলিয়াছিলেন— পাশার ভবিষ্যদ্বাণী, মদ্যপের প্রতিজ্ঞা ও শত্রুর হাসি যাহারা বিশ্বাস করে তাহার বিচারমূঢ়। — হায় কালিদাস।’ দীর্ঘশ্বাস মোচনপূর্বক স্বর্গত কবির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া মন্ত্রী কহিলেন— ‘এখন এই বিটঙ্ক রাজ্যটা লইয়া কি করা যায়?’

ঈষৎ হাসিয়া স্কন্দ বলিলেন— ‘রাজ্যটা হারাইয়া গিয়াছিল? বিচিত্র নয়। কেরল যুদ্ধে আমার অঙ্গুরীয় হইতে একটি নীলকান্ত মণি কখন খসিয়া গিয়াছিল জানিতে পারি নাই। আজ প্রথম লক্ষ্য করিলাম। এই দেখুন।’ বলিয়া অঙ্গুরীয় দেখাইলেন।

অতঃপর রাজা ও মন্ত্রী মিলিয়া দীর্ঘকাল মন্ত্রণা করিলেন। বিটঙ্ক রাজ্য অবশ্য তাঁহাদের চিন্তার অতি ক্ষুদ্রাংশই অধিকার করিল। অবশেষে স্থির হইল যে হূণ যখন আবার আসিতেছে তখন চতুরঙ্গ বাহিনী লইয়া স্কন্দ তাহাদের আগমপথ রোধ করিবার জন্য এক মাসের মধ্যে পুরুষপুর যাত্রা করিবেন। উপরন্তু পঞ্চনদ প্রদেশের যত সামন্তরাজা আছেন সকলের নিকট অচিরাৎ দূত প্রেরিত হইবে, যাহাতে এই সম্মিলিত সামন্তচক্র হূণদের বিরুদ্ধে ব্যূহরচনা করিয়া স্বরাজ্য রক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকেন। বিটঙ্ক রাজ্যেও মগধের দূত যাইবে; তত্রত্য হূণ রাজাকে মগধের আনুগত্য স্বীকার করিবার আদেশ প্রেরিত হইবে। হূণ যদি স্বীকৃত না হয় তখন স্কন্দ তথায় উপস্থিত হইয়া যথাযোগ্য ব্যবস্থা করিবেন।

সচিব রাজ সন্নিধান হইতে বিদায় লইবার কিয়ৎকাল পরে বিদূষক পিপ্পলী মিশ্র আসিয়া দেখা দিলেন। অতি স্থূলকায় ব্রাহ্মণ, হস্তে একটি বৃহৎ কুষ্মাণ্ড। রাজা দেখিয়া বলিলেন— ‘পিপুল, একি! কুষ্মাণ্ড কেন?’

কুষ্মাণ্ড মহারাজের পদপ্রান্তে রাখিয়া বিদূষক মন্ত্রীর পরিত্যক্ত আসনে বসিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন— ‘মহারাজ, রিক্তপাণি হইয়া রাজ সমীপে আসিতে নাই, ইহাই শিষ্ট নীতি।’

রাজা বলিলেন— ‘ঠিকই হইয়াছে, তোমার বুদ্ধি ও কলেবর দুই-ই কুষ্মাণ্ডবৎ। এটি কোথায় সংগ্রহ করিলে?’

পিপ্পলী বলিলেন— ‘চালে ফলিয়াছিল। ব্রাহ্মণীকে অনেক স্তোক দিয়া বয়স্যের জন্য আনিয়াছি।’

‘ব্রাহ্মণীকে কী স্তোক দিয়াছ?’

‘বয়স্য, ব্রাহ্মণীর একটি অকালকুষ্মাণ্ড ভ্রাতুষ্পুত্র আছে, তাহার বড়ই দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা। এখন মহারাজ যদি তাহাকে কোনও দূর দেশে দূতরূপে প্রেরণ করেন তবেই তাহার সাধ পূর্ণ হয়। আমি মহারাজের নিকট নিবেদন করিব এই স্তোক দিয়া গৃহিণীর কুষ্মাণ্ডটি হস্তগত করিয়াছি।’

রাজা সহাস্যে বলিলেন— ‘ধন্য পিপুল, তোমার বয়স্য-প্রীতি অতুলনীয়। তাহাই হইবে; তোমার ব্রাহ্মণীর ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেশ ভ্রমণে পাঠাইব। এখন এই কুষ্মাণ্ড রন্ধনশালায় প্রেরণ কর।’

কুষ্মাণ্ড স্থানান্তরিত হইলে স্কন্দ বলিলেন— ‘পিপুল, এস পাশা খেলি। আর একবার ভাগ্য পরীক্ষা করিব। তুমি যদি আমাকে পরাজিত করিতে পার, বুঝিব নিয়তির বিধান অলঙ্ঘনীয়।’

পিপ্পলী মিশ্র বলিলেন— ‘বয়স্য, পরাজিত করিতে পারি বা না পারি, নিয়তির বিধান চিরদিনই অলঙ্ঘনীয়। কারণ নিয়তি স্ত্রীজাতি।’

‘দেখা যাক’ বলিয়া স্কন্দ পার্ষ্টি ফেলিলেন।

ইহা আমাদের আখ্যায়িকা আরম্ভ হইবার প্রায় তিন মাস পূর্বের ঘটনা।

অশ্বচোর চিত্রক যে বনের মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেল তাহা নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়, প্রায় ছয় ক্রোশ ভূমির উপর প্রসারিত। বড় বড় গাছ ঘনসন্নিবিষ্ট হইয়া ঊর্ধ্বে মাথা তুলিয়াছে, তাহাদের শাখায় শাখায় জড়াজড়ি, নিম্নে রবিকরবিদ্ধ ছায়ান্ধকার। বনভূমি সর্বত্র সমতল নয়, স্থানে স্থানে উচ্চ হইয়া রুক্ষ উপলাকীর্ণ অঙ্গ প্রকট করিতেছে। কোথাও তরু পরিবেষ্টিত শষ্পাচ্ছাদিত উন্মুক্ত স্থান, কোথাও বা কঠিন রসহীন মৃত্তিকার উপর শুষ্ক কণ্টকগুল্ম; ক্বচিৎ দুই একটি ক্ষীণধারা প্রস্রবণ। এই বনে মৃগ শূকর শশক ময়ূর নানাবিধ শিকার আছে। প্রধান নগরীর উপকণ্ঠে রাজন্যবর্গের মৃগয়ার জন্য এইরূপ ক্রীড়াকানন সযত্নে রক্ষা করিবার রীতি ছিল।

এই বনের মধ্যে প্রায় তিন ক্রোশ পথ তীরবেগে ঘোড়া ছুটাইবার পর চিত্রক বল্‌গার ইঙ্গিতে অশ্বের গতি হ্রাস করিল। বহুদিন চিত্রক ঘোড়ায় চড়ে নাই, তাই ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া বায়ুর খর প্রবাহে তাহার রক্তে গতির হর্ষোন্মাদনা জাগিয়াছিল। সে সহসা মস্তক উৎক্ষিপ্ত করিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল।

কিন্তু পরক্ষণেই সে থামিয়া গেল; দূর হইতে যেন মনুষ্য কণ্ঠের আহ্বান আসিল। অশ্ব একটি নিষ্পাদপ মুক্ত স্থানের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছিল, চকিতে তাহার গতি রোধ করিয়া চিত্রক চারিদিকে চাহিল। দেখিল, মুক্ত ভূমির কিনারায় এক বৃহৎ মধুক বৃক্ষতলে এক ব্যক্তি দাঁড়াইয়া আছে, তাহার পাশে একটি ঘোটক।

এতক্ষণ এই বনে একটি মানুষের সঙ্গেও চিত্রকের সাক্ষাৎ হয় নাই, সে সন্দিগ্ধচক্ষে এই ব্যক্তিকে নিরীক্ষণ করিল। দূর হইতে ভাল দেখা গেল না, তবু বেশভূষা হইতে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলিয়াই মনে হয়। চিত্রক চক্ষুর উপর হস্তাচ্ছাদন দিয়া ভাল করিয়া দেখিল, লোকটি যেই হোক সে একাকী, কাছাকাছি অন্য কেহ নাই। তথাপি চিত্রক ইতস্তত করিল; ভাবিল, পলায়ন করি। কিন্তু ঐ ব্যক্তির সঙ্গেও অশ্ব রহিয়াছে, পলাইলে পশ্চাদ্ধাবন করিতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে কি করিবে স্থির করিতে না পারিয়া চিত্রক ন যযৌ ন তস্থৌ হইয়া রহিল।

এইবার অন্য ব্যক্তি অশ্বের বল্‌গা ধরিয়া তরুমূল হইতে বাহির হইয়া আসিল। তখন চিত্রক দেখিল, অশ্বটি খঞ্জ, তিন পায়ে ভর দিয়া খোঁড়াইয়া চলিতেছে।

ব্যাপার বুঝিয়া চিত্রক অগ্রসর হইয়া গেল। অন্য ব্যক্তি তাহাকে আসিতে দেখিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল, মধুক বৃক্ষের নিকটে উভয়ে মুখোমুখি হইল। কিছুক্ষণ দুইজনে পরস্পর পর্যবেক্ষণ করিল।

চিত্রক দেখিল লোকটির দেহ মেদ-সুকুমার, মুখমণ্ডল গোলাকৃতি, চক্ষুও তদ্রূপ। এক জোড়া সুপুষ্ট গুম্ফ মুখের শোভা বর্ধন করিতেছে বটে, কিন্তু গুম্ফের সুচারু প্রসাধন আর নাই, নানা দুর্যোগের মধ্যে পড়িয়া বিপর্যন্ত হইয়া গিয়াছে। মস্তকে রক্তবর্ণ উষ্ণীষ, পরিধানে হরিদ্রারঞ্জিত বস্ত্র ও অঙ্গাবরণ; উত্তরীয়টি তুম্বের ন্যায় উদর বেষ্টন করিয়া পাশে গ্রন্থিবদ্ধ। কটি হইতে একটি বৃহৎ তরবারি ঝুলিতেছে।

অপরপক্ষে সে ব্যক্তি দেখিল, মহামূল্য সজ্জায় অলঙ্কৃত একটি তেজস্বী অশ্ব, তাহার পৃষ্ঠে বসিয়া আছে দীনবেশী সৈনিক। অশ্ব ও অশ্বারোহীর বেশভূষা সম্পূর্ণ বিপরীত। তাহার ধারণা জন্মিল, অশ্বটি কোনও ধনী ব্যক্তির সম্পত্তি এবং আরোহী এই অশ্বের রক্ষক।

সে বলিল— ‘বাপু, বলিতে পার তোমাদের এই বন্য দেশে কোথাও লোকালয় আছে কিনা?’

চিত্রক বুঝিল লোকটি তাহারই মত এদেশে নবাগত। সে নিশ্চিন্ত হইয়া বলিল— ‘তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?’

লোকটি ঈষৎ রুষ্ট হইল। এই কিঙ্করটা তাহার সহিত সমকক্ষের মত কথা বলে! এ দেশের লোকগুলা কি একেবারেই গ্রাম্য, সম্মানার্হ বিশিষ্ট পুরুষ দেখিলে চিনিতে পারে না? সে গুম্ফ ফুলাইয়া বলিল— ‘কোথা হইতে আসিতেছি সে সংবাদে তোমার প্রয়োজন নাই। এই বন্য রাজ্যে প্রবেশ করিয়া অবধি কেবল পাহাড় পর্বতে বনে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি; মানুষগুলাও এমন অসভ্য যে মাগধী অবহট্‌ঠ ভাষা পর্যন্ত ভাল করিয়া বুঝে না। সাতদিন ধরিয়া যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, এখনও রাজধানী কপোতকূটে পৌঁছিতে পারিলাম না। কাল রাত্রে এক গ্রামে গৃহস্থের কুটিরে আশ্রয় লইয়াছিলাম; প্রাতে উঠিয়া দাসীপুত্রটা কপোতকূটের সিধা পথ দেখাইয়া দিল। সেই অবধি পাঁচটা পাহাড় পার হইয়াছি, কিন্তু এখনও কপোতকূটের দেখা নাই। তারপর গণ্ডের উপর পিণ্ড, এই বনে প্রবেশ করিয়া ঘোড়াটা এক গর্তে পা দিল—’ লোকটি সশব্দ নিশ্বাস ত্যাগ করিল— ‘ঘোড়ার পা ভাঙিয়াছে, সমস্ত দিন পেটে অন্ন নাই; যদি গুরুতর রাজকার্য না থাকিত কোন্‌ কালে এই দেববর্জিত দেশ ছাড়িয়া যাইতাম।’

চিত্রক প্রশ্ন করিল— ‘তুমি কপোতকূটে যাইতে চাও? রাজকার্যে?’

লোকটি গম্ভীরভাবে বলিল— ‘হাঁ, গুরুতর রাজকার্যে। আমার নাম শশিশেখর শর্মা, মগধের রাজ-বয়স্য আমার—, কিন্তু সে যাক। কপোতকূট কি এখান হইতে অনেকদূর?’

পাঠক বুঝিয়াছেন, শশিশেখর শর্মা আর কেহ নয়, বিদূষক পিপ্পলী মিশ্রের ব্রাহ্মণীর ভ্রাতুষ্পুত্র। তাহার প্রশ্নের উত্তরে চিত্রক বলিল— ‘কপোতকূট অনেকদূর, আজ রাত্রে পৌঁছিতে পরিবে না। ঘোড়া থাকিলে পৌঁছিতে পারিতে।’

মগধের রাজদূত চিত্রকের ঘোড়ার পানে লুব্ধনেত্রে চাহিয়া দেখিতেছিল, বলিল— ‘এটি কি তোমার ঘোড়া?’

‘হাঁ।’

শশিশেখর পুরা বিশ্বাস করিল না, কিন্তু অবিশ্বাস করিয়াও কোনও লাভ নাই। সে উৎসুক স্বরে বলিল— ‘তোমার ঘোড়া বিক্রয় করিবে?’

চিত্রক কুঞ্চিত নেত্রে তাহার পানে চাহিল— ‘কত মূল্য দিবে?’

শশিশেখর অশ্বের প্রতি তাকাইয়া গুম্ফের একপ্রান্ত অঙ্গুলি দ্বারা আকর্ষণ করিতে করিতে বিবেচনা করিল, তারপর বলিল— ‘সসজ্জ অশ্বের জন্য পাঁচ কার্ষাপণ দিব।’

চিত্রক ভাবিল, পরের দ্রব্য পরকে বিক্রয় করিয়া যদি পাঁচ কার্ষাপণ পাওয়া যায় মন্দ কি? অপহৃত অশ্ব নিজের কাছে রাখা নিরাপদ নয়, ধরা পড়বার ভয় আছে। কিন্তু চিত্রক দেখিল, রাজদূত মহাশয়ের প্রয়োজনের গুরুত্ব বড় বেশি; প্রয়োজনের অনুপাতে পণ্যদ্রব্যের মূল্য হ্রাসবৃদ্ধি হইয়া থাকে। চিত্রক অবজ্ঞাভরে হাসিয়া বলিল— ‘কার্ষাপণ! এই অশ্বের সজ্জার মূল্যই পাঁচ দীনার। তোমাদের মগধ দেশে সম্ভবত তোমরা গর্দভে আরোহণ করিয়া থাক, তাই অশ্বের মূল্য জান না।’ বলিয়া অশ্বের মুখ ফিরাইয়া প্রস্থানোদ্যত হইল।

শশিশেখর মনে মনে বড়ই ক্রুদ্ধ হইল; কিন্তু এদিকে অশ্বারোহী চলিয়া যায়। শশিশেখর ক্রোধ গলাধঃকরণ করিয়া ডাকিল— ‘শুন শুন। তুমি আমার অসহায় অবস্থা দেখিয়া অনুচিত মূল্য দাবি করিতেছ। পাটলিপুত্রে এরূপ করিলে দুই শত পণ দণ্ড দিতে হইত। কিন্তু অসভ্য বন্য দেশে—, যাক, পাঁচ দীনারাই দিব।’

চিত্রক ফিরিয়া বলিল— ‘পাঁচ দীনার তো সজ্জার মূল্য। অশ্বটি কি বিনা শুল্কে চাও?’

শশিশেখর বড়ই বিপন্ন হইয়া পড়িল। সে অর্থ সম্বন্ধে বিলক্ষণ হিসাবী, অকারণে অর্থব্যয় করিতে তাহার বড়ই অরুচি। অথচ এই অর্থগৃধ্নু রাক্ষসটা সুবিধা পাইয়া তাহার রক্ত শোষণ করিতে চায়। সে অস্থির হইয়া বলিল— ‘আবার অশ্বের মূল্য। পাঁচটি দীনারেও যথেষ্ট হইল না? এটা কি দস্যুর রাজ্য?’

চিত্রক হাসিল— ‘দস্যুর রাজ্যই বটে। — ভাবিয়া দেখ, অশ্বের জন্য আরও পাঁচটি দীনার দিতে পরিবে? না পার— চলিলাম।’

আবার অশ্বারোহী চলিয়া যায়। তখন শশিশেখর বিষণ্ণ স্বরে বলিল— ‘আমি— আমি ছয়টি দীনার এবং এই অশ্বটি তোমাকে দিব, পরিবর্তে তোমার ঘোড়া আমাকে দাও। ইহার অধিক আর আমি দিতে পারিব না।’

‘তোমার অশ্ব লইয়া আমি কি করিব? মৃত গর্দভের মূল্য কি?’

‘মৃত গর্দভ! উহার সামান্য আঘাত লাগিয়াছে মাত্র, দুই দিনেই সারিয়া যাইবে। তখন উহাকে অনেক মূল্যে বিক্রয় করিতে পরিবে।’

চিত্রক দেখিল, মগধের দূত আর বেশি উঠিবে না। তাহার ঘোড়াটি নিতান্ত মন্দ নয়, পায়ের আঘাত অল্প শুশ্রূষাতেই আরোগ্য হইবে। চিত্রকের একটি ঘোড়া থাকিলে ভাল হয়, যোদ্ধার অশ্বই সম্পদ। সে সম্মত হইল।

তখন শশিশেখর কটি হইতে উত্তরীয় খুলিয়া তদভ্যন্তর হইতে একটি থলি বাহির করিল। থলিটি বেশ পরিপুষ্ট। শশিশেখর সঞ্চয়ী ব্যক্তি, বিদেশ যাত্রার পূর্বে নানাবিধ প্রয়োজনীয় বস্তু এই থলিতে ভরিয়া লইয়াছিল। রাজকোষ হইতে প্রাপ্ত স্বর্ণরৌপ্য তো ছিলই, উপরন্তু কড়ি ছিল, প্রসাধনের জন্য চন্দন তিলক ছিল, কঙ্কতিকা ছিল, মুখশুদ্ধির জন্য এলাচ লবঙ্গ হরীতকী ছিল— আরও কত কি! আড়চক্ষে চিত্রকের পানে চাহিয়া শশিশেখর থলির মুখ খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

থলি হইতে দীনার বাহির করিতে গিয়া অসাবধানে কয়েকটি শলাকার ন্যায় ক্ষুদ্র বস্তু মাটিতে পড়িল। চিত্রক সেই দিকেই তাকাইয়া ছিল, এখন দ্রুত অশ্ব হইতে নামিয়া সেগুলি কুড়াইয়া লইল। হাতে তুলিয়া দেখিল, গজদন্তের পার্ষ্টি!

দ্যূতক্রীড়ার দুর্নিবার মোহ আছে। চিত্রক উৎসুক বিস্ময়ে বলিল— ‘দূত মহাশয়, আপনার থলিতে পাশা খেলার পার্ষ্টি দেখিতেছি!’

শশিশেখর কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া বলিল— ‘অক্ষক্রীড়া চতুঃষষ্টি কলার অঙ্গ, পাটলিপুত্রের সজন নাগরিক মাত্রেই পাশা খেলিয়া থাকেন। স্বয়ং পরমভট্টারক—’

চিত্রক বলিল— ‘তুমি আমার সহিত পাশা খেলিবে? ঘোড়া বাজি রহিল, যদি জিতিতে পার, বিনা মূল্যে আমার ঘোড়া পাইবে; আর যদি আমি জিতি, তোমার ঐ খঞ্জ অশ্ব লইব।’

মুহূর্তকাল চিন্তা করিয়া শশিশেখর দেখিল, হারিলে তাহার কোনও ক্ষতি নাই, জিতিলে বিশেষ লাভ— ছয়টি স্বর্ণ দীনার বাঁচিয়া যাইবে। সে বলিল— ‘উত্তম, খেলিব। আমি বর্ণশ্রেষ্ঠ হইলেও দ্বন্দ্বযুদ্ধ বা দ্যূতক্রীড়ায় কেহ আহ্বান করিলে পশ্চাৎপদ হই না।’

তখন দুইজনে, অশ্ব ছাড়িয়া দিয়া, বৃক্ষতলে তৃণের উপর বসিয়া খেলিতে আরম্ভ করিল। অল্পকাল মধ্যেই উভয়ে খেলায় মাতিয়া উঠিল, ক্ষুধা তৃষ্ণা আর রহিল না।

কিন্তু উত্তেজনা মাত্রেরই প্রতিক্রিয়া আছে। খেলা যখন শেষ হইল তখন দেখা গেল শশিশেখরের অশ্বটির স্বত্বাধিকার হস্তান্তরিত হইয়াছে।

ক্ষোভে গুম্ফের প্রান্ত টানিতে টানিতে শশিশেখর বলিল— ‘তুমি নিপুণ ক্রীড়ক বটে। ভাগ্যবলে আমাকে পরাজিত করিয়াছ। আবার খেলিবে?’

চিত্রক বলিল— ‘খেলিব। এবার কি পণ রাখিবে?’

‘এবার তরবারি পণ।’ বলিয়া শশিশেখর কটি হইতে তরবারি খুলিয়া পাশে রাখিল।

চিত্রক বলিল— ‘ভাল, আমি দুটি অশ্বই পণ রাখিলাম।’

শশিশেখর হৃষ্ট হইয়া খেলিতে বসিল। কিন্তু এবারও ভাগ্যলক্ষ্মী তাহার প্রতি বিমুখ হইলেন। তরবারি তুলিয়া লইয়া চিত্রক বলিল— ‘আর খেলিবে?’

যে পরাজিত হয় তাহার খেলিবার ঝোঁক আরও বাড়িয়া যায়; কৃপণও তখন দুঃসাহসী হইয়া উঠে। শশিশেখর আরক্ত নেত্রে চাহিয়া বলিল— ‘খেলিব। তুমি দুইবার জিতিয়াছ বলিয়া কি বার বার জিতিবে?’

‘উত্তম। আমি দুইটি অশ্ব ও তরবারি পণ রাখিলাম। তোমার পণ?’

‘আমার পণ—’ শশিশেখর সহসা থমকিয়া গেল; তাহার মস্তিষ্ক কোটরে ঈষৎ সুবুদ্ধির উদয় হইল। ঘোড়া ও তরবারি তো গিয়াছে, এইভাবে যদি সব যায়?

তাহাকে ইতস্তত করিতে দেখিয়া চিত্রক ব্যঙ্গ করিয়া বলিল— ‘ভয় পাইতেছ?’

সুবুদ্ধিটুকু ভাসিয়া গেল। শশিশেখর ক্রুদ্ধ স্বরে বলিল— ‘ভয়! কোন্‌ অর্বাচীন এমন কথা বলে? আমি যথাসর্বস্ব পণ রাখিয়া খেলিতে পারি। তুমি খেলিবে?’

‘আপত্তি নাই। কিন্তু আপাতত ঐ অঙ্গুরীয় পণ রাখিতে পার।’

শশিশেখর নিজ অঙ্গুরীয়ের পানে চাহিল। মগধের রাজকীয় মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয়, ইহাই বিটঙ্ক রাজসভায় তাহার প্রবেশপত্র। কিন্তু শশিশেখর তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। সে অঙ্গুরীয় খুলিয়া সবেগে ভূমির উপর স্থাপন করিয়া বলিল— ‘তাহাই হোক। এস— এবার দেখিব।’

আবার খেলা আরম্ভ হইল। খেলার ফল কিন্তু ভিন্নরূপ হইল না। খেলার শেষে চিত্রক অঙ্গুরীয়টি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিয়া নিজ তর্জনীতে পরিধান করিল, বলিল— ‘দূত মহাশয়, এবার চলিলাম। আজ সারাদিন আহার হয় নাই, ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে। আমাকেও অনেক দূর যাইতে হইবে।’

এতক্ষণে শশিশেখর একেবারে ফাটিয়া পড়িল; লাফাইয়া উঠিয়া গর্জন করিল— ‘তুই কিতব! হস্তলাঘব করিয়া আমার পণ জিতিয়া লইয়াছিস।’

চিত্রকও বিদ্যুতের মত উঠিয়া দাঁড়াইল। কিতব শব্দটা অক্ষক্রীড়কের পক্ষে অত্যন্ত দূষণীয়। তাহার ললাটের তিলক-চিহ্ন আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল।

কিন্তু পরক্ষণেই তাহার ক্ষিপ্র রোষ অন্তর্হিত হইল। শশিশেখরের মেদ-মসৃণ দেহের উগ্র ভঙ্গিমা দেখিয়া ক্রুদ্ধ শজারুর শল্পকাবৃত বিক্রমের চিত্র স্মরণ হইয়া গেল। সে তাহার স্ফীত-গুম্ফ মুখের পানে চাহিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিল, বলিল— ‘পার্ষ্টি তোমার, আমি হস্তলাঘব করিলাম কিরূপে?’

কথাটা সঙ্গত। যাহার পাশা সে পার্ষ্টির মধ্যে ধাতু প্রবিষ্ট করাইয়া কৈতব করিতে পারে। শকুনি ও পুষ্কর তাহাই করিয়াছিল। কিন্তু শশিশেখরের তাহা বুঝিবার মত মনের অবস্থা ছিল না, সে চিৎকার করিতে লাগিল— ‘তুই ধূর্ত কিতব, কিতবের অসাধ্য কাজ নাই।’

চিত্রক বলিল— ‘ও শব্দ আর ব্যবহার করিও না, বিপদ ঘটিবে। ভাগ্যদেবী তোমার প্রতি বিমুখ তাই তুমি হারিয়াছ। শুন, আর একবার তোমাকে সুযোগ দিতেছি। তুমি এখনি বলিয়াছ যে সর্বস্ব পণ রাখিয়া খেলিতে পার। এস, সর্বস্ব পণ করিয়া খেল, আমিও সর্বস্ব পণ করিতেছি। যদি জিতিতে পার, যাহা কিছু হারিয়াছ সমস্তই ফিরিয়া পাইবে; আমার ঘোড়াও পাইবে। সম্মত আছ?’

শশিশেখর কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া চিন্তা করিল। তাহার সর্বস্বই গিয়াছে, আছে কেবল থলিটি। থলিতে গুটিকয় স্বর্ণ-রৌপ্যের মুদ্রা আছে সত্য, কিন্তু এই নির্জন অরণ্যে সেগুলি কোন্‌ কাজে লাগিবে? ঘোড়া ফিরিয়া পাইলে আশা আছে লোকালয়ে পৌঁছিতে পারিবে, নচেৎ বনে রাত্রিবাস সুনিশ্চিত। বনে নিশ্চয় ব্যাঘ্র তরক্ষু আছে—। আসন্ন রাত্রির কথা ভাবিয়া সহসা তাহার হৃৎকম্প হইল। ইহা যে মৃগয়া-কানন তাহা সে জানিত না।

শশিশেখর আর দ্বিধা করিল না, আবার খেলিতে বসিল। কিন্তু ভাগ্যদেবী সত্যই তাহার উপর রুষ্ট হইয়াছিলেন, সে জিতিতে পারিল না। ক্ষোভে হতাশায় পার্ষ্টি দূরে নিক্ষেপ করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল।

চিত্রক সযত্নে পার্ষ্টিগুলি তুলিয়া লইয়া বলিল— ‘এ পার্ষ্টি এখন আমার। মনে রাখিও তুমি সর্বস্ব হারিয়াছ।’

শশিশেখর উন্মত্ত কণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘তুই চোর তস্কর, কৈতব করিয়া আমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়াছিস।’

চিত্রকের চক্ষু অসি ফলকের ন্যায় তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল— ‘আর যাহা বল আপত্তি নাই, কিন্তু কিতব শব্দ আর উচ্চারণ করিও না। একবার নিষেধ করিয়াছি।’

উন্মত্ত শশিশেখর গর্জন করিয়া বলিল— ‘কিতব! কিতব! কিতব! সহস্রাবার বলিব। আমার হাতে যদি তরবারি থাকিত—’

চিত্রকের নাসা স্ফুরিত হইয়া উঠিল, সে শশিশেখরের তরবারি তাহার দিকে নিক্ষেপ করিয়া বলিল— ‘এই নাও তোমার তরবারি। কি করিবে? যুদ্ধ?’

শশিশেখর তরবারি তুলিয়া লইল। সে বোধহয় কিছু অসিবিদ্যা জানিত, কিন্তু বর্তমান মানসিক অবস্থায় তাহাও বিস্মরণ হইয়াছিল। সে তরবারি ঊর্ধ্বে তুলিয়া চিত্রককে আক্রমণ করিলা।

দুইবার অসিতে অসিতে ঠোকাঠুকি হইল, তারপর শশিশেখরের অস্ত্র ছিটকাইয়া দূরে গিয়া পড়িল।

চিত্রক বলিল— ‘ভাবিয়ছিলাম তোমাকে দয়া করিব, সর্বস্ব লইব না। কিন্তু তুমি আপাত্র। থলি দাও।’

ক্রন্দনোন্মুখ শশিশেখর ফুলিতে ফুলিতে থলি ফেলিয়া দিল।

‘এবার তোমার উষ্ণীষ বস্ত্র ও অঙ্গাবরণ দাও।’

শশিশেখর হতভম্ব হইয়া গেল।

‘অ্যাঁ— তবে কি আমি উলঙ্গ থাকিব?’

চিত্রক হাসিল। ‘সে তুমি জান। আমার সম্পত্তি আমি লইব।’

‘তুই চোর দস্যু তস্কর।’

‘শীঘ্র দাও— নচেৎ কড়িয়া লইব।’

হতভাগ্য শশিশেখর তখন নিরুপায় হইয়া মধুক বৃক্ষের অন্তরালে গেল, বস্ত্রাদি খুলিয়া চিত্রকের দিকে ফেলিয়া দিল। নিষ্ফল ক্রোধের তপ্ত অশ্রুজল তাহার গুম্ফ ভিজাইয়া দিতে লাগিল।

নিজের সমস্ত সম্পত্তি লইয়া চিত্রক অশ্বে চড়িয়া বসিল। শশিশেখরের ঘোড়ার পৃষ্ঠে তরবারির কোষ দ্বারা সবেগে আঘাত করিতেই সে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে পলায়ন করিল। চিত্রক তখন বৃক্ষের কাণ্ড লক্ষ্য করিয়া বলিল— ‘তোমাকে তবু একটা দয়া করিলাম, তোমার তরবারিটা ফেলিয়া গেলাম। যদি নকুল অথবা শশক তাড়া করে, আত্মরক্ষা করিতে পরিবে।’

বেলা তখন পড়িয়া আসিতেছে, সূর্য তরুচূড়া স্পর্শ করিয়াছে। দিক্‌নির্ণয় করিয়া লইয়া চিত্রক সূর্যকে দক্ষিণে রাখিয়া দ্রুতবেগে অশ্ব চালাইল।

শশিশেখর বনের মধ্যেই পড়িয়া রহিল। তাহার বর্তমান অবস্থায় তাহাকে আর পাঠক-পাঠিকার সম্মুখে উপস্থিত করা উচিত হইবে না।

প্রাকার-বেষ্টিত কপোতকূট নগরের উত্তর তোরণের নিকট চিত্রক যখন পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা ঘনীভূত হইয়াছে। তোরণের অনতিদূর পর্যন্ত গিয়া বন শেষ হইয়াছে; এইখানে আসিয়া চিত্রক অশ্ব ছাড়িয়া দিল। তারপর শশিশেখরের বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া, মস্তকে লৌহজালিকের উপর উষ্ণীষ বাঁধিয়া স্বচ্ছন্দ অনুদ্বেগ পদক্ষেপে নগরে প্রবেশ করিল।