০৩. ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত

ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত আমি দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলাম। কেন দক্ষিণ দিকে সেটা আমি নিজেও জানি না, কিন্তু প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমি যখন ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে সূর্যকে অস্ত যেতে দেখেছি তখন হঠাৎ হঠাৎ অনুভব করেছি দক্ষিণ দিক থেকে একটা কোমল বাতাস বইছে–হঠাৎ করে আমার শরীর জুড়িয়ে এসেছে। হয়তো দক্ষিণ দিকে সুন্দর কিছু আছে, কোমল কিছু আছে, আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।

আমি পাথুরে রাস্তায় পা টেনে টেনে হাঁটছি। ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, মনে হচ্ছে একেবারে হাড়ের ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু করে দিয়েছে। কে জানে আমাকে যে ব্যাগটি দিয়েছে তার মাঝে কোনো গরম কাপড় আছে কি না–কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সেটা খুলে দেখার ইচ্ছে করছে না। কনকনে শীতে দুই হাত ঘষে ঘষে শরীরকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করতে করতে আমি মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকি। আমি একটা ঘোরের মাঝে আছি, আমার কী হবে আমি জানি না। এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক সেটা নিয়ে ভাবতেও চাইছে না–যতদূর সম্ভব দূরে সরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারছি না। এক শ কিলোমিটার দূরত্ব বলতে কতটুকু দূরত্ব বোঝানো হয় আমি জানি। কিন্তু অন্ধকারে, একটি ধ্বংসস্তূপে আচ্ছন্নের মতো হেঁটে হেঁটে সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে কত সময় লাগবে আমি জানি না। আমি এই মুহূর্তে কিছু ভাবতেও চাই না, কিছু জানতেও চাই না, শুধু দুঃস্বপ্নের মতো একটা ঘোরের মাঝে শরীর টেনে টেনে হেঁটে যেতে চাই। ক্লান্তিতে দেহ অবসন্ন হয়ে আসছে, পা আর চলতে চায় না, মাথা ভারি, চোখ জ্বালা করছে, মুখে একটা বিস্বাদ অনুভূতি কিন্তু আমি তবু থামলাম না, মাথা নিচু করে সামনে হেঁটে যেতে থাকলাম।

যখন অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠল আমি আর হেঁটে যেতে পারলাম না, বড় একটা কংক্রিটে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। ক্লান্তিতে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে এসেছে। পায়ের কাছে ব্যাগটা রেখে আমি মাথা হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করি। সবকিছু কী অর্থহীন মনে হতে থাকে। কেন আমি এভাবে ছুটে যাচ্ছি? কোথায় ছুটে যাচ্ছি?

আমি দীর্ঘ সময় সেখানে পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। যেখানে বসে আছি জায়গাটি একটি কারখানার ধ্বংসস্তূপ। কিসের কারখানা কে জানে। বড় বড় লোহার সিলিন্ডার ভেঙে পড়ে আছে। পিছনে রং ওঠা বিবর্ণ দেয়াল, তার মাঝে থেকে কঙ্কালের মতো ধাতব বিম বের হয়ে এসেছে। মরচে ধরা বিবর্ণ যন্ত্রপাতি। ধুলায় ধূসর। এক পাশে বড় একটি ঘর, ছাদ ভেঙে পড়ে আছে। অন্য পাশে কংক্রিটের দেয়াল আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে। সব মিলিয়ে সমস্ত এলাকাটিতে একটি মন খারাপ করা দৃশ্য। সমস্ত পৃথিবী এখন এ রকম অসংখ্য ছোট ছোট মন খারাপ করা দৃশ্যের একটি মোজাইক। মানুষ কেমন করে এ রকম একটি কাজ করতে পারল?

আমি পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটি টেনে এনে খুলে ভিতরে তাকালাম। একটি গরম কাপড় এবং কিছু খাবার ও পানীয়। ছোট একটি শিশিতে কিছু ওষুধ। একটা ছোট চাকু এবং সৌর ব্যাটারিসহ একটা ছোট ল্যাম্প। আমি খাবারগুলো থেকে বেছে বেছে ছোট চতুষ্কোণ এক টুকরা খাবার বেছে নিয়ে সেটা চিবোতে থাকি। বিস্বাদ খাবার খেতে কষ্ট হয় কিন্তু আমি জানি জোর করে খেতে পারলে সাথে সাথে শরীরে শক্তি ফিরে পাব। সত্যি তাই, একটু পরেই আমার ক্লান্তি কেটে যায়, আমি শক্তি অনুভব করতে থাকি। শরীরের অবসাদ ঝেড়ে ফেলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। কেন জানি না ফ্যাক্টরিটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে হল। এক পাশে যেতেই হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। কিসের শব্দ এটা? পারমাণবিক বিস্ফোরণে কোনো প্রাণী বেঁচে গিয়েছে?

আবার হল শব্দটি। কিছু একটা নড়ছে। আমি কৌতূহলী হয়ে সাবধানে এগিয়ে গেলাম। ফ্যাক্টরির বড় গেটটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটা বড় লোহার বিমের নিচে একটা রবোট চাপা পড়ে আছে। একটু পরে পরেই সেটা হাত নাড়ছে, চোখ ঘোরাচ্ছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে। অত্যন্ত নিচু শ্রেণীর রবোট, বুদ্ধিবৃত্তি প্রায় জড় পদার্থের মতো। রবোটটি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে বলল, ভেতরে ঢোকার জন্যে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। আপনার পরিচয়পত্র জনাব–

মূর্খ রবোটটি এখনো জানে না সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ আগে!

আমি আবার হাঁটতে থাকি। শুনতে পেলাম পিছন থেকে সেটি আবার বলল, আপনার পরিচয়পত্র জনাব। আপনার পরিচয়পত্র?

.

কিছুক্ষণের মাঝেই চারদিক অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধ্বংসস্তূপ ধাতব জঞ্জাল সূর্যের প্রখর আলোতে যেন ধিকিধিকি করে জলছে। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার মাঝে আমি পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত দূরে সরে যেতে হবে।

ঘণ্টা তিনেক পরে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে গেছে। সম্ভবত এখন আমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়া উচিত, কিন্তু আমার সাহস হল না। গ্রুস্টান যদি এক ডজন অনুসন্ধানী রবোট আমার পিছনে লেলিয়ে দেয় আমাকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। যেভাবে সম্ভব আমাকে এক শ কিলোমিটার দূরে। চলে যেতে হবে। ঘণ্টায় আমি যদি ছয় থেকে সাত কিলোমিটার হাঁটতে পারি তাহলে। কমপক্ষে পনের ঘণ্টা একটানা হেঁটে যেতে হবে। সব মিলিয়ে অনেক দূর বাকি। একটা বাই ভার্বাল হলে চমৎকার হত কিংবা একটা শক্তিশালী ভারবাহী রবোট। এক সময়ে এই ব্যাপারটি কী সহজই না ছিল আর এখন সেটি কী ভয়ঙ্কর কঠিন!

আমি জোর করে আমার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলি। এখন আর কোনো চিন্তা নয়, ভাবনা নয়, সমস্ত চেতনায় এখন শুধু একটি ব্যাপার, আমাকে সরে যেতে হবে। দূরে সরে যেতে হবে। যত দূর সম্ভব। যেভাবে সম্ভব।

সারাদিন আমি বিচিত্র সব এলাকার মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলাম। কখনো এ রকম এলাকার মাঝে আমি একা একা হেঁটে যাব কল্পনা করি নি। দীর্ঘ সময়ে কোনো লোকালয় বা বসতি দূরে থাকুক একটি ছোট জীবিত প্রাণীও চোখে পড়ে নি। একটি ধসে যাওয়া যোগাযোগ কেন্দ্রে কিছু সশস্ত্র রবোটের দেখা পেয়েছিলাম, তারা সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া যোগাযোগ কেন্দ্রটিকে পাহারা দিচ্ছে। আমি খুব সাবধানে তাদের এড়িয়ে গেলাম, কপোট্রনে কী নির্দেশ দেয়া আছে জানি না, দেখামাত্র আমাকে গুলি করে দিতে পারে। একটি গুদামঘরের কাছে আরো কয়েকটি রবোট দেখতে পেলাম, মনে হল তাদের কপোট্রনে খুব বড় ধরনের বিভ্রান্তি। বিশাল একটি লোহার রড নিয়ে তারা মহা আনন্দে একে অন্যকে আঘাত করে যাচ্ছে। আমি তাদেরকেও সাবধানে পাশ কাটিয়ে গেলাম।

বেলা ডুবে যাবার পর আমি আবিষ্কার করলাম আমার গায়ে আর বিন্দুমাত্র জোর অবশিষ্ট নেই। আমার এখন বিশ্রাম নেয়া দরকার। অন্ধকার গভীর হয়ে গেলে আমি সম্ভবত আশ্রয় নেবার ভালো জায়গা খুঁজে পাব না। আমি আশপাশে তাকিয়ে একটি বড় দালান খুঁজে পেলাম। উপরের অংশটুকু ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু নিচের কয়েকটি তালা মনে হয় এখনো অক্ষত আছে। দরজাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ, খুলতে পারলাম না, একটি জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে হল। বাইরে সবকিছু ধুলায় ধূসর কিন্তু ভিতরে মোটামুটি পরিষ্কার। একটা টেবিল ঠেলে কোয়ার্টজের একটা জানালার নিচে নিয়ে এলাম, রাতে যদি বিষাক্ত বৃশ্চিক বের হয়ে আসে টেবিলের উপরে উঠতে পারবে না। অসম্ভব খিদে পেয়েছে, ব্যাগ খুলে এক টুকরা খাবার মুখে দেব দেব করেও দিতে পারলাম না, পানীয়ের বোতল থেকে এক ঢোক পানীয় খেয়ে টেবিলটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। পানীয়টাতে কী আছে জানি না কিন্তু অনুভব করি সারা শরীরে একটা সতেজ ভাব ছড়িয়ে পড়ছে। আমি চোখ বন্ধ করে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার ঘুম ভাঙল একটি মৃদু শব্দে। শব্দটি কী আমি ধরতে পারলাম না কিন্তু হঠাৎ করে আমি পুরোপুরি জেগে উঠলাম। আমি নিঃশব্দে শুয়ে থেকে ঘরের মাঝখানে তাকাই, কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে ঘরে নক্ষত্রের একটা ক্ষীণ আলো এসে ঢুকেছে তার মাঝে আবছা দেখা যাচ্ছে ঘরের মাঝখানে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ামূর্তিটি এক পা এগিয়ে এল, সাথে সাথে পা ফেলার এক ধরনের ধাতব শব্দ শুনতে পেলাম। এটি একটি রবোট। যেহেতু আমাকে খুঁজে এই ঘরে এসে ঢুকেছে নিশ্চয়ই এটি একটি অনুসন্ধানী রবোট, গ্রুস্টান পাঠিয়েছে আমাকে গুলি করে শেষ করার জন্যে। নিশ্চয়ই রবোটটির হাতে রয়েছে এটমিক ব্লাস্টার। নিশ্চয়ই সেটা এখন আমার দিকে তাক করে রয়েছে, অন্ধকারে আমি দেখতে পাচ্ছি। না। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে–কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে থাকে।

আমি অন্ধকারে আবছা ছায়ামূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, ছায়ামূর্তিটি আরো এক পা এগিয়ে এল। হঠাৎ করে তার কপাল থেকে এক ঝলক আলো বের হয়ে আসে, প্রখর আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়, আমি হাত দিয়ে আমার চোখ আড়াল করার চেষ্টা করলাম। রবোটটি আরো এক পা এগিয়ে এল, আমাকে হত্যা করার জন্যে তার এত কাছে আসার সত্যি কোনো প্রয়োজন নেই।

মহামান্য কুশান।

আমি হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলাম, লাফিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কে?

আমি ক্রিশি।

ক্রিশি! আমি আনন্দে চিৎকার করে লাফিয়ে নেমে এসে ক্রিশিকে জড়িয়ে ধরলাম, মনে হল হঠাৎ করে আমি বুঝি আমার হারিয়ে যাওয়া কোনো আপনজনকে খুঁজে পেয়েছি!

ক্রিশি আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বলল, মহামান্য কুশান, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি মানুষের অর্থহীন মানবিক উচ্ছ্বাস অনুভব করতে পারি না।

জানি ক্রিশি। জানি। তুমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে, আমি ভাবছিলাম তুমি বুঝি কোনো অনুসন্ধানী রবোট, আমাকে মারার জন্যে এসেছ!

আমি আপনাকে মারার জন্যে আসি নি। ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে আমি কখনোই হত্যা করব না।

শুনে খুব খুশি হলাম! এখন বল তুমি কেমন করে আমাকে খুঁজে পেয়েছ?

ব্যাপারটি কঠিন নয়। আমি জানতাম আপনি দক্ষিণ দিকে যাবেন।

কেমন করে জানতে?

আপনাকে আমি দক্ষিণের বাতাস নিয়ে একদিন গান গাইতে শুনেছি। আমার বিবেচনায় সেটি উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গীত নয় কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টা

ভণিতা রেখে আসল কথাটি বল

কাজেই আমি ধরে নিয়েছি আপনি দক্ষিণ দিকে যাবেন। আপনি তাড়াতাড়ি এক শ কিলোমিটার সরে যাবার জন্যে চেষ্টা করবেন সোজা যেতে এবং সূর্যকে ব্যবহার করে আপনার দিক ঠিক করবেন–কাজেই আপনার গতিপথ হবে ত্রুটিপূর্ণ। আমি তাই সম্ভাব্য ত্রুটিপূর্ণ পথগুলোতে হেঁটে হেঁটে আপনাকে খুঁজেছি। বিস্ফোরক ফ্যাক্টরির গেটে আটকা পড়া একটি রবোট আমাকে সাহায্য করেছে–

ওই মূর্খ রবোটটা? যে পরিচয়পত্র চাইছে?

হ্যাঁ, কিন্তু সে মূর্খ নয়। বিস্ফোরকের মূল উপাদান সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান রয়েছে।

রবোটের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে এই গভীর রাতে আমি ক্রিশির সাথে তর্ক করতে রাজি নই। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিশি, আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?

দশমিক শূন্য শূন্য তিন।

সেটা কতটুকু?

তুলনা করার জন্যে বলা যায় একটি উঁচু বিল্ডিং থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য দুই।

হুম। আমি অকারণে বাম গার্লটি নির্মমভাবে চুলকাতে চুলকাতে বললাম, তার মানে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি নয়।

না, মহামান্য কুশান।

আমি যদি মরে যাই তখন তুমি কী করবে?

আপনার মৃতদেহ যথাযযাগ্য মর্যাদার সাথে সমাহিত করব।

সেটা কী রকম?

ক্রোমিয়ামের একটা বাক্সে করে মাটির নিচে রেখে দেব। উপরে একটা প্রস্তর ফলকে লিখব–এখানে কুশান কিশুনুক চিরনিদ্রায় শায়িত।

আমি তোমার কথা শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম, ক্রিশি

আপনি কি আরো কিছু চান?

না। আমি একটু হেসে বললাম, তারপর তুমি কী করবে?

আমি আমার পারমাণবিক ব্যাটারির যোগাযোগ ছিন্ন করে নিজেকে অচল করে দেব।

ব্যাপারটি এই ধরনের নিম্নশ্রেণীর রবোটের কপোট্রনে প্রোগ্রামিঙের অংশ কিন্তু তবু আমি একটু অভিভূত হয়ে পড়ি। সারা পৃথিবীতে অন্তত একটি বস্তু রয়েছে যেটা আমার জন্যে যথেষ্ট অনুভব করে। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ক্রিশি, তুমি যখন এসেছ আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

অবশ্যি মহামান্য কুশান। আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?

প্রথমে দরকার খাবার এবং পানীয়।

আপনি নিশ্চয়ই যে খাবার মুখে দিয়ে খাওয়া হয় সেই খাবারের কথা বলছেন, সরাসরি ধমনীতে যে খাবার দেয়া হয় সেই খাবার নয়?

না, আমি সেরকম খাবারের কথা বলছি না। আমি মুখে দিয়ে খাবারের কথা বলছি।

আমি সেরকম খাবার খুঁজে বের করব। আপনাকে খুঁজে বের করার সময় আমি খাবার প্রস্তুত করার একটা ফ্যাক্টরি দেখেছি। ভেঙেচুরে গেছে কিন্তু ভিতরে হয়তো খাবার পাওয়া যাবে।

চমৎকার! আর পানীয়?

সেটা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। আমি কোনো পানীয় প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরি দেখি নি।

খুঁজে বের করতে হবে, যেভাবে সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে।

ক্রিশি তার যান্ত্রিক মুখে একাগ্রতার একটা ছাপ ফোঁটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি অবশ্যি চেষ্টা করব।

ক্রিশি।

বলুন।

আমি নরম গলায় বললাম, তুমি এসেছ তাই আমার খুব ভালো লাগছে।

শুনে খুব খুশি হলাম।

ক্রিশি।

বলুন।

তুমি খুশি হলে তার অর্থ কী? রবোট কেমন করে খুশি হয়?

ক্রিশি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, রবোট খুশি হওয়ার অর্থ কপোট্রনের তৃতীয় প্রস্থচ্ছেদে বড় মডিউলের সাতাশি নম্বর পিনের ভোল্টেজের পার্থক্য চুয়াল্লিশ মিলি ভোল্টের কম।

ও আচ্ছা।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে চতুষ্কোণ এক টুকরা খাবার বের করে খেতে শুরু করি। ক্রিশির সাথে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় এতক্ষণ টের পাই নি, হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছি ভীষণ খিদে পেয়েছে। খেতে খেতে আমি ক্রিশির দিকে তাকাই, নির্বোধ চতুর্থ শ্রেণীর একটা রবোট অথচ তার জন্যে আমি বুকের ভিতর এক ধরনের মমতা অনুভব। করছি। কিছুক্ষণ আগেও বুকের ভিতরে যে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা এবং গম্ভীর হতাশা ছিল হঠাৎ করে সেটা কেটে গেছে, আমি হঠাৎ করে এক ধরনের শক্তি অনুভব করছি! তুচ্ছ চতুর্থ শ্রেণীর একটি রবোটের জন্যে?

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ক্রিশি আমার মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছে। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে বলল, শুভ সকাল মহামান্য কুশান।

শুভ সকাল।

আপনি কি ভালো করে ঘুম থেকে উঠেছেন?

হ্যাঁ, আমি ভালো করে ঘুম থেকে উঠেছি।

আপনি যখন ঘুমিয়েছিলেন আমি তখন খাবারের ফ্যাক্টরি থেকে ঘুরে এসেছি।

চমৎকার!

ফ্যাক্টরিতে কিছু জিনিস পেয়েছি যেটাকে জৈবিক মনে হয়েছে।

সত্যি?

হ্যাঁ, আপনার জন্যে একটু নমুনা এনেছি।

আমি উঠে বসে বললাম, দেখি কী নমুনা।

ক্রিশি তার বুকের মাঝে একটা ছোট বাক্স খুলে তার মাঝে থেকে কয়েকটা ছোট ছোট চৌকোনো খাবার বের করে দিল। আমি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম কিছু শুকনো প্রোটিন। ক্রিশির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, ক্রিশি, তুমি দারুণ কাজ করে ফেলেছ। সত্যি সত্যি কিছু প্রোটিন বের করে ফেলেছ! কতটুকু আছে সেখানে?

বার হাজার তিন শ নয় কিউবিক মিটার। এক অংশ থেকে এক ধরনের বায়বীয় গ্যাস বের হচ্ছে। তার রং সবুজাভ হলুদ।

তার মানে পচে গেছে।

সেই অংশে ছয় পা–বিশিষ্ট তিন মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এক ধরনের প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শুধু পচে যায় নি, পোকা হয়ে গেছে।

প্রাণীটিকে দেখে উচ্চ শ্রেণীর প্রোটিন বলে মনে হল।

তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু আশা করছি আমার সেটা খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে না। চল ফ্যাক্টরিটা গিয়ে দেখে আসি।

চলুন

আমি আমার ব্যাগটা হাতে নিয়ে ক্রিশির পিছু পিছু হাঁটতে থাকি।

.

বিধ্বস্ত খাবারের ফ্যাক্টরিতে সত্যি সত্যি বাক্স বোঝাই খাবার পাওয়া গেল। বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু তার মাঝেও খুঁজে ক্রিশি অনেকগুলো বাক্স নামিয়ে আনল। যার মাঝে এখনো প্রচুর শুকনো খাবার রয়ে গেছে। আমি বেছে বেছে কিছু খাবার তুলে নিলাম, শেষ হয়ে গেলে আবার এখানে ফিরে আসা যাবে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে পানীয়, আমার কাছে যেটুকু আছেটা দিয়ে সপ্তাহ খানেকের বেশি চলবে বলে মনে হয় না।

সারাদিন হেঁটে ঠিক দুপুরবেলা বিশ্রাম নিতে বসেছি। সূর্য ঠিক মাথার উপরে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ধংসস্তূপ ধিকিধিকি করে জ্বলছে। আমি বড় একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে তার ছায়ায় বসে আছি। ক্রিশি আমার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার ভিতর থেকে ছোট গুঞ্জনের মতো শব্দ হতে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিসের শব্দ ওটা ক্রিশি?

গরম খুব বেশি। কপোট্রন শীতল রাখার জন্যে ক্রায়োজেনিক কুলার চালু হয়েছে।

তোমার ভিতরে ক্রায়োজেনিক কুলার আছে আমি জানতাম না।

ক্রিশি কোনো কথা না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি দেখলাম গরমে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে।

ব্যাপারটি প্রথমে আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল না কিন্তু হঠাৎ করে আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, চিৎকার করে বললাম, ক্রিশি!

কী হয়েছে মহামান্য কুশান?

তোমার কপালে ঘাম।

ঘাম?

কাছে আস, আমি তার কপাল স্পর্শ করি, তার মাথা হিমশীতল।

আমি আনন্দে চিৎকার করে বললাম, ইয়া হু!

আপনি অর্থহীন শব্দ করছেন মহামান্য কুশান।

হ্যাঁ। তুমি জান আমাদের পানীয়ের সমস্যা মিটে গেছে।

মিটে গেছে?

হা। বাতাসে সব সময় জলীয় বাষ্প থাকে। কোনোভাবে সেটাকে ঠাণ্ডা করলেই পানি বের হয়ে আসবে। তুমি যখন ক্রায়োজেনিক কুলার দিয়ে তোমার কপোট্রন শীতল করেছ তোমার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে সেখানে জলীয় বাষ্প বিন্দু বিন্দু পানি হয়ে জমা হয়েছে। আমাদের যখন পানির দরকার হবে তুমি কিছু একটা ঠাণ্ডা করতে শুরু করবে–সাথে সাথে সেখানে পানি জমা হবে।

ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, পদ্ধতিটি প্রাচীন, এটি শক্তির বিশাল অপচয় এবং সময়সাপেক্ষ। এই পদ্ধতিতে খাবার পানি বের করা বর্তমান প্রযুক্তির অপব্যবহার

তুমি চুপ কর ক্রিশি! আমাকে এখন প্রযুক্তির অপব্যবহারের ওপর বক্তৃতা দিও না। আগে বেঁচে থাকা তারপর অন্য কিছু। আমার আগেই এটা চিন্তা করা উচিত ছিল। আসলে সমস্যাটা কোথায় জান?

কোথায়?

গ্রুস্টান আমাদের সাধারণ বিজ্ঞানও শেখাতে চায় না। আমরা বলতে গেলে কিছুই জানি না। নিজে থেকে বেঁচে থাকার কিছুই আমরা জানি না। গত দুই দিন একা একা থেকে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বিশেষ কঠিন নয়। তুমি কী বল ক্রিশি

আমি আপনার সাথে পুরোপুরি একমত নই।

কেন?

আপনার খাবার ও পানীয়ের সমস্যা মিটে গেছে কিন্তু আরো বড় বড় সমস্যা রয়েছে।

কী সমস্যা?

বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর বাতাসে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তা। মানুষের বসতিতে বাতাস পরিশুদ্ধ করা হয়, এখানে কোনো পরিশোধর নেই। আপনি প্রত্যেকবার নিশ্বাস নিয়ে বুকের ভিতর তেজস্ক্রিয় বস্তু জমা করছেন। আপনার মৃত্যুর কারণ হবে বায়ুমণ্ডলের তেজস্ক্রিয়তা।

আমি এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক নিয়ে ক্রিশির কথা শুনতে থাকি। রবোট না হয়ে মানুষ হলে সম্ভবত এই কথাগুলোই আরো সুন্দর করে বলতে পারত। আমি ব্যাগ থেকে পানীয়ের বোতলটি বের করে এক ঢোক খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিশি–

বলুন। বাতাসে কতটুকু তেজস্ক্রিয়তা–সেটা দিয়ে আমি কবে নাগাদ মারা যাব? হিসেব করে বের করতে পারবে?

পারব মহামান্য কুশান।

বের কর দেখি।

ক্রিশি তার শরীরের যন্ত্রপাতি বের করে কিছু একটা পরীক্ষা করে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, মহামান্য কুশান।

বল। কিছু একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে।

কী ঘটেছে?

বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। মানুষের বসতিতে পরিশুদ্ধ বাতাস আর এই বাতাসে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।

আমি চমকে উঠলাম, কী বললে তুমি? কী বললে?

বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ দশমিক শূন্য শূন্য দুই রেম।

গ্রুস্টান আমাদের মিথ্যে কথা বলে আটকে রেখেছে! সে কখনো চায় নি আমরা বসতি থেকে বের হই।

মহামান্য গ্রুস্টান সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলা অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ। তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা জানেন যেটা আমরা জানি না।

ছাই জানে।

মহামান্য গ্রুস্টান সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলা

আমি ধমক দিয়ে ক্রিশিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, চুপ করবে তুমি?

ক্রিশি চুপ করে গেল।

আমি বুক ভরে কয়েকবার নিশ্বাস নিলাম। পৃথিবী তার নিজস্ব উপায়ে তার প্রকৃতিকে আবার মানুষের বাসের উপযোগী করে তুলছে? আমি চারদিকে তাকাই, কী কদর্য ধ্বংসস্তূপ! একদিন আবার এই ধ্বংসস্তূপে নতুন জীবন গড়ে উঠবে? রাস্তার পাশে ঘাস, দুপাশে বড় বড় গাছ, গাছে পাখি। ঢালু উপত্যকায় ছোট ছোট বাসা, সেখানে মানুষ। বাইরে শিশুরা খেলছে। আবার হবে সবকিছু?

আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকি। ক্রিশি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। সে কি আমার উত্তেজনা অনুভব করতে পারছে?

আমি নরম গলায় বললাম, ক্রিশি।

বলুন মহামান্য কুশান।

আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত?

আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন কিন্তু আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা আটচল্লিশ দশমিক দুই!

চমৎকার! আমি ভেবেছিলাম শতকরা আশি ভাগের উপরে হবে।

না। এখন আপনার প্রাণের ঝুঁকি আসবে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে।

কোথা থেকে?

রবোট।

আমি অবাক হয়ে বললাম, রবোট?

হ্যাঁ, চারদিকে অসংখ্য নিয়ন্ত্রণহীন রবোট ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে পেলে তারা সম্ভবত আপনাকে হত্যা করবে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তারা কেন খামাখা আমাকে হত্যা করবে? আমি কী করেছি।

তাদের যুক্তিতর্ক আমার অনুভবের সীমার বাইরে।

আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমাকে এখন কী করতে হবে জান ক্রিশি?

কী?

বহুদূরে মানুষের একটা বসতি খুঁজে বের করতে হবে। সেখানে গিয়ে আবার নূতন করে জীবন শুরু করতে হবে।

সেটি অত্যন্ত অবিবেচনার কাজ হবে মহামান্য কুশান।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

গ্রুস্টান পৃথিবীর প্রত্যেকটা লোকালয়ে আপনার পরিচিতি পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাইকে বলে দিয়েছে আপনি মানবসভ্যতাবিরোধী একজন দুষ্কৃতকারী। সবাইকে বলেছে আপনাকে দেখামাত্র যেন হত্যা করা হয়।

তুমি–তুমি আগে আমাকে এ কথা বল নি কেন?

আপনি আমাকে আগে জিজ্ঞেস করেন নি।

আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক গভীর শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। বিশাল এই ধ্বংসস্তূপে, জঞ্জাল, আবর্জনায়, নিয়ন্ত্রণহীন রবোটদের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে একা একা বেঁচে থাকতে হবে? আমি একা একা ঘুরে বেড়াব একটা নিশাচর প্রাণীর মতো? একটা জড়বুদ্ধি রবোট হবে আমার কথা বলার সঙ্গী? আমার একমাত্র আপনজন?।

আমি এক গভীর বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম।