ভোরবেলা জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে চোখে, কাকাবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে ভারী নরম, নীলচে আলো। সূর্য ওঠার আগে এইরকম রং হয়, তারপর এই আলো হবে সোনালি। অনেক রকম পাখি ডাকছে, আর সেই সব ডাক ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে দুটো মোরগের কোঁকর-কো, কোঁকর-কোঁ। কী গলার জোর ওদের!
কাকাবাবুর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। উঠে চোখমুখ ধুয়ে তিনি জামা-প্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়লেন। এখানে এসেও তিনি মর্নিং ওয়াকের অভ্যেসটা ছাড়বেন কেন?
সন্তু আর জোজোকে তিনি ডাকলেন না। এ-বাড়ির অন্য কেউও এখনও জাগেনি মনে হয়। কোথাও কোনও শব্দ নেই।
কী চমৎকার ফুরফুরে বাতাস। বাতাস এসে যেন গা জড়িয়ে আদর করছে। কলকাতায় বৃষ্টি হলেও এখানে বৃষ্টি নেই। তবে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। বেলা বাড়লেই গরম হবে।
লাল রঙের রাস্তা। দূরে পাহাড়ের রেখা। এই সময় রাস্তায় মানুষজন থাকার কথা নয়। তবু দুধওয়ালা কিংবা বাগানের মালির মতো কেউ যাচ্ছে। সাইকেলে। তারা কৌতূহলে কাকাবাবুকে ফিরে ফিরে দেখছে। এদিকে সকলেই সকলকে চেনে। ক্রাচ বগলে এই নতুন মানুষটি কে, তারা ভাবছে।
কাকাবাবু সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে, এক-একটা বড় বাড়ির ভগ্নস্তূপ। গেটে এখনও নাম লেখা আছে। এককালের বিখ্যাত সব বাঙালির নাম। তখনও বাঙালিরা এত গরিব হয়ে যায়নি। কিছু কিছু বাঙালি লেখাপড়া শিখে, ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক টাকা উপার্জন করতেন। কত শখের এই সব বাড়ি। এখন অনেক বাড়িরই দরজা-জানলা খুলে নিয়ে গিয়েছে চোরেরা।
কালকের সেই ভূতের বাড়িটা কোন দিকে, তা কাকাবাবু বুঝতে পারছেন। অবশ্য অনেক ভাঙা বাড়িকেই রাতে ভূতের বাড়ি বলে মনে হতে পারে।
একটা কোকিল ডাকছে, খুব কাছেই। কিন্তু পাখিটাকে দেখা যাচ্ছে না। কোকিল সব সময় পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকে যে, দেখতে পাওয়া খুব শক্ত। কাকাবাবু তবু উঁকিঝুঁকি মেরে সামনের গাছগুলো দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন।
হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন বলল, স্যার, উইল ইউ হেল্প মি?
কাকাবাবু চমকে উঠে দেখলেন, একটি অল্পবয়সি ছেলে, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স হবে, প্যান্ট-শার্ট পরা, পাতলা চেহারা। কাঁধে একটা ব্যাগ।
কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে ইংরেজিতে বলল, স্যার, একটু হেল্প করবেন? আমি একটা ঠিকানা খুঁজছি।
কাকাবাবু বললেন, আমি তো এখানে নতুন এসেছি, অনেক কিছুই চিনি না।
ছেলেটি বলল, দেখুন, এই কাগজটায় লেখা আছে।
কাকাবাবু কাগজটা নিলেন। খুব বিচ্ছিরি হাতের লেখা। জড়ানো জড়ানো। তবু কষ্ট করে পড়বার চেষ্টা করলেন। নিয়ার নাটোর প্যালেস। হাউজ অফ বাদশা। বিগ গার্ডেন। মিস্টার রাজা…
আর পড়তে পারলেন না। এর মধ্যেই ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে অনেক লম্বা পাকানো নাইলনের দড়ি বের করে ফস করে কাকাবাবুর গলায় একটা ফস পরিয়ে দিল। এত তাড়াতাড়ি সে কাজটা সেরে ফেলল যে, কাকাবাবু বাধাও দিতে পারলেন না।
কাকাবাবু বললেন, এ কী?
ছেলেটি হি হি হি হি করে হেসে উঠল। তার গলার আওয়াজ বাচ্চা ছেলেদের মতো। হাসতে হাসতে সে বলল, ছি ছি ছি, মিস্টার রায়চৌধুরী, আজ থারটি এপ্রিল। আজ থেকে ডেথ-ডেথ খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে, মনে নেই? আপনার সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
দড়িটা খানিকটা লম্বা করে সে কাকাবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে গেল একটা ভাঙা বাড়ির পিছন দিকে। রাস্তার লোকজন কেউ দেখতে পাবে না তাদের।
ফাঁসটা এমন আঁট হয়ে গিয়েছে যে, কাকাবাবুর দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ছেলেটা আবার ব্যঙ্গের সুরে বলল, আপনি এত সহজে ধরা দিলেন? ভেবেছিলাম, কয়েকটা দিন অন্তত লড়াই করতে পারবেন। বাঙালিরা কি লড়াই করতে ভুলে গিয়েছে? এই বাঙালিদের মধ্যেই তো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জন্মেছিলেন?
কাকাবাবু অতি কষ্টে খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে?
ছেলেটি বলল, আমি কর্নেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট। এই যাঃ, কর্নেল বলে ফেললাম! যাক গে, এখন আপনি জানলেও ক্ষতি নেই। আর তো বেঁচে থাকবেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা!
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল কোথায়? ছেলেটি বলল, তা জেনে আপনার কী লাভ? বুঝতেই পারছেন, আপনাকে আমি এখনই মেরে ফেলতে পারি। আপনার পকেটে রিভলভার আছে জানি। কিন্তু আপনি পকেটে হাত ঢোকাবার চেষ্টা করলেই আমি দড়িতে একটা হ্যাঁচকা টান দেব। সঙ্গে সঙ্গে আপনার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আপনার গলায় যে ফসটি দিয়েছি, ওতে একটা মেটাল রিং আছে। সেটা আপনার গলায় কেটে বসে যাবে। আর এই যে দড়িটা দেখছেন, এটাও নাইলন আর মেটাল মেশানো। স্বয়ং ভীম এলেও এটা ছিড়তে পারবে না। এই ফাঁস আমরা সার্কাসের বাঘ-সিংহের গলায় পরাই।
কাকাবাবু বলতে চাইলেন, তুমি বুঝি সার্কাসে কাজ করো? কিন্তু
বলতে পারলেন না। গলায় খুব লাগছে।
ছেলেটি আবার বলল, একটা গাড়ি আসবে, তার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি আপনাকে এখানে মেরে ফেললেই ঝামেলা চুকে যেত। কিন্তু কর্নেল, মানে ধ্যানচাঁদ, নিজের হাতে আপনাকে শাস্তি দিতে চান।
কাকাবাবু খুব চেষ্টা করে ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, আমি তোমার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নই। আমার কফি খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।
ছেলেটি দারুণ অবাক হয়ে বলল, কফি? আপনার আর জীবনে কফি খাওয়া হবে না। বললাম তো, আপনার আয়ু আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে দ্যাখো! তিনি একটা ক্রাচ উঁচু করে তার গায়ের একটা বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা লকলকে ছুরি। সেটা দড়িটায় ছোঁয়ানো মাত্রই কচাত করে কেটে গেল। প্রায় চোখের নিমেষে, একটুও ঘষতে হল না।
টাল সামলাতে না পেরে ছেলেটি চিত হয়ে পড়ে গেল।
কাকাবাবু তার বুকে অন্য ক্ৰাচটা চেপে ধরে বললেন, নোড়ো না। দেখলে তো, ভীমও যে-দড়ি ছিড়তে পারে না, এ-যুগের অস্ত্র দিয়ে কত তাড়াতাড়ি সে দড়ি কাটা যায়? সাধারণ ছুরির চেয়ে এই ছুরিটায় ধার এক হাজার গুণ বেশি।
ছেলেটির চোখ দুটো প্রায় ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে। যে-দড়ি বাঘ-সিংহ ছিড়তে পারে না, একটা ছুরি দিয়ে এক মুহূর্তে সেটা কাটা হয়ে গেল!
কাকাবাবু গলার ফাঁসটা খানিকটা আলগা করে নিয়ে বললেন, তুমি সার্কাসে কাজ করো। তোমার নাম কী?
ছেলেটি বলল, বলব না। বেশি কথার দরকার নেই। আপনি আমাকে খুন করুন। আই অ্যাম রেডি।
কাকাবাবু বললেন, কেন, মারব কেন? এত সুন্দর একটা সকাল, এর মধ্যে খুনোখুনির কথা ভাবতে তোমাদের লজ্জা করে না?
ছেলেটি বলল, এই খেলায় কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট যদি হেরে যায়, তাকে মেরে ফেলার নিয়ম আছে। আপনিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখতে পারেন। কিল মি। আমি হেরে গিয়েছি, আমাকে খতম করে দিন।
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, চোপ! সার্কাসে চাকরি করছিলে, তা ছেড়ে এই বাজে খেলায় যোগ দিতে তোমাকে কে বলেছে? কত টাকা পাবে? উঠে দাঁড়াও! কাকাবাবু ক্রাচটা তার বুকের উপর থেকে সরিয়ে নিলেন।
সে জেদির মতো বলল, না, উঠব না। এখানেই আমার ডেডবডি পড়ে থাকবে।
কাকাবাবু আবার ধমক দিয়ে বললেন, ওঠো বলছি!
সে বলল, না উঠলে আপনি কী করবেন? মারবেন তো? মারুন! হেরে গিয়ে আমি দয়া চাই না।
কাকাবাবু বললেন, তুমি কী চাও বা না চাও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। মানুষ খুন করা আমার কাজ নয়। তুমি যদি না ওঠো, তা হলেও আমি তোমায় প্রাণে মারব না। পায়ে গুলি করব। তুমি চিরকাল খোঁড়া হয়ে থাকবে আমার মতো। সেটা ভাল হবে?
ছেলেটি এবার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল।
কাকাবাবু বললেন, যাও, তোমার কর্নেল ধ্যানচাঁদকে গিয়ে বলো, আজই এই খেলা শেষ করে দিতে। ওর ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমি মোটেই দায়ী নই। তবু আমি হাজারবার ক্ষমা চাইতে রাজি আছি।
ছেলেটি বলল, ওসব বলে আর লাভ নেই। একবার এ-খেলা শুরু হলে হেস্তনেস্ত না হলে থামে না। কর্নেল আপনাকে খুন করবেনই। আপনি যদি আমাকে আজ ছেড়েও দেন, তা হলেও আমি আবার আপনাকে মারবার চেষ্টা করব।
কাকাবাবু বললেন, এ যে দেখছি, মহা পাজি ছেলে। তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তবে একটুআধটু শাস্তি তো দেওয়া যেতেই পারে। আমার একটা নিয়ম আছে, যে আমার গায়ে হাত তোলে, তাকে আমি কিছু না-কিছু শাস্তি দিই। তুমি আমার গলায় ফাঁস পরিয়েছ, তার জন্য তোমাকে দু-তিনটে থাপ্পড় অন্তত খেতেই হবে। তিনি ছেলেটির চুলের মুঠি চেপে ধরলেন। তারপর তাকে থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। চেয়ে রইলেন তার চোখের দিকে। গলার আওয়াজ শুনেই তার একটু সন্দেহ হয়েছিল, এখন ওর চোখ দুটো দেখে কাকাবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, ছেলে তো নয়, এ যে দেখছি একটি মেয়ে!
সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, হ্যাঁ, মেয়ে, তো কী হয়েছে? মেয়েরা অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারে না? মেয়েরা এখন সব পারে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। মেয়েরা সব পারে। এমনকী, মানুষ খুন করতেও পারে। কিন্তু আমি এখনও ওল্ড ফ্যাশৰ্ড। আমি মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে পারি না। তোমাকে যে দু-তিনটে থাপ্পড় মারব ভেবেছিলাম, তা তো আর হচ্ছে না। তা হলে কি আমি তোমায় এমনি এমনি ছেড়ে দেব?
মেয়েটি বলল, থাপ্পড় মারতে পারবেন না কেন? মারুন। তারপর আমিও আপনার নাকে এখন একটা ঘুসি মারব?
ওরে বাবা, তেজ আছে দেখছি! শোনো, আমি তোমার সম্পর্কে কী ঠিক করলাম। যদি আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও, তা হলে তোমাকে এখনই ছেড়ে দেব। আর যদি উত্তর না দিতে চাও, তা হলে আমার গলার ফাসটা খুলে তোমার গলায় পরিয়ে দেব, তারপর তোমাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে আমি চলে যাব। কোনটা চাও?
আপনার কী প্রশ্ন, শুনি আগে।
তোমার নাম কী? তুমি আমার নাম জানো। অথচ আমি তোমার নাম জানি না, এতে কথাবার্তা বলা যায় না।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার আপত্তি নেই। আমার নাম লায়লা।
সুন্দর নাম। তুমি ছেলে সেজে এসেছ কেন?
বেশ করেছি। অনেক মেয়েই তো আজকাল প্যান্ট-শার্ট পরে।
তুমি সার্কাসে কাজ করো?
করতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি।
সার্কাসের কাজ ছেড়ে তুমি এই কর্নেল ধ্যানচাঁদের সঙ্গে কুৎসিত কাজে যোগ দিয়েছ কেন? সে তোমাকে বেশি টাকা দিচ্ছে?
টাকার জন্য নয়। উনি একসময় আমার মাকে একটা খুব বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন।
তোমার মাকে বাঁচিয়েছেন, সেটা খুব ভাল কাজ। মহৎ কাজ। কিন্তু কেউ একটা মহৎ কাজ করার পর যদি একটা খুব খারাপ কাজ করে, কোনও মানুষকে মারতে চায়, তা হলে সে আরও খারাপ লোক হয়ে যায়। মানুষের প্রাণ বাঁচানোই মানুষের মতো কাজ, আর বিনা কারণে কাউকে খুন করলে সে আর মানুষ থাকে না। জঙ্গলের হিংস্র পশুদের সঙ্গে তার তফাত কী?
আপনাকে আর উপদেশ ঝাড়তে হবে না। শুনুন মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি আজ আমাকে ছেড়ে দিলেন কিংবা দয়া করলেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমি যে-কোনও জায়গায়, আবার আপনাকে ধরব। আপনাকে মেরে ফেলা হবেই, এটা সোজাসুজি বলে দিলাম। এটাই আমার ডিউটি।
ঠিক আছে, আবার চেষ্টা করে দেখো। সেবারেও যদি না পারো, তখন আমি তোমাকে ধরে ফেললে, কিন্তু আর ছাড়ব না। তখন তোমার হাত-পা বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটা সার্কাসের দলে ভরতি করে দেব। সেখানে তুমি দড়ির উপর ডিগবাজি খাবে। সেখান থেকে যাতে তুমি পালাতে না পারো, সে ব্যবস্থাও করা হবে। এখন যাও, দৌড়োও! আমার চোখের সামনে আর থেকো না!
লায়লা সত্যিই এক দৌড় লাগিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল একটা বাড়ির আড়ালে।
কাকাবাবু এবার খুব সাবধানে গলার ফসটা খুললেন। জিনিসটা খুবই সাংঘাতিক। দড়ির মধ্যে আবার একটা লোহার রিং, তাতে আবার খাঁজকাটা। দড়িটা ধরে জোরে টানলেই গলার মধ্যে একেবারে চেপে বসে যাবে। এই জিনিসটা কাকাবাবু সঙ্গে নিয়ে যেতে চান না। সন্তুদের কাছে ধ্যানচাদের হুমকির কথা কিছুই বলেননি। আজ সকালের এই ঘটনার কথাও তিনি চেপে যাবেন। ওরা এখানে বেড়ানো আর ভূত নিয়ে মজা করার মেজাজে আছে। কী দরকার তা নষ্ট করার!
এটা এখানে ফেলে গেলেও কেউ না-কেউ পেয়ে যাবে। সে এটা ব্যবহারও করতে পারে। কাকাবাবু ফাঁসটা হাতে নিয়ে ফিরতে লাগলেন। আসবার পথে তিনি একটা বড় পুকুর দেখেছিলেন। সেটার কাছে এসে কাকাবাবু খুব টিপ করে ফাসটা ছুড়ে দিলেন। পুকুরের ঠিক মাঝখানে সেটা ঝুপ করে পড়েই ড়ুবে গেল। যাক। নিশ্চিন্ত।
সন্তু, জোজোরা জেগে উঠেছে এর মধ্যে। বাইরের বারান্দায় বসেছে চা নিয়ে।
কাকাবাবু ঘড়ি দেখলেন। পৌনে আটটা, ঠিক পনেরো মিনিট দেরি হয়েছে। তার কফি খাওয়ার। ওই লায়লা নামের মেয়েটির জন্য। কী সাংঘাতিক তেজি মেয়ে। কাকাবাবু তেজি মেয়েদেরই পছন্দ করেন। এইরকম তেজি মেয়ে কত রকম দারুণ দারুণ কাজ করতে পারে। তার বদলে খুনোখুনির খেলায় মেতেছে, এটা খুব দুঃখের ব্যাপার।
জোজো একটা টোস্টে জ্যাম মাখাতে মাখাতে বলল, কাকাবাবু, আপনার দেরি দেখে আমরা ব্রেকফাস্ট শুরু করে দিয়েছি।
কাকাবাবু বললেন, বেশ করেছ। এবার আমার কফি দিতে বলো।
জোজো বলল, কাকাবাবু, আমরা সবাই আজকাল বলি ব্রেকফাস্ট। এর কি কোনও বাংলা নেই? সন্তু বলছে, জলখাবার। কিন্তু জলখাবার তো স্ন্যাক্স, বিকেলেও খাওয়া যায়। ব্রেকফাস্ট কিন্তু একেবারে ঠিক ঠিক। সারারাত তো আমরা না খেয়ে থাকি, তাই সকালের প্রথম খাবারটা উপোস ভাঙা।
কাকাবাবু বললেন, ব্রেকফাস্টের আর-একটা বাংলা আছে। প্রাতরাশ। সেটা ঠিক চলে না। হিন্দিতে বলে ছোটা হাজরি। মানে দুপুরেরটা বড় খাবার, সকালেরটা ছোট।
সন্তু বলল, জোজো সকালেই বড় খাবার খেয়ে নেয়। এর মধ্যেই পাঁচটা টোস্ট, দুটো কলা, ডবল ডিমের অমলেট খেয়ে ফেলেছে। দুটো সন্দেশ বাকি আছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অমলেট মানে সেই এগ পাউডার নাকি?
জোজো বলল, না, না, এখানে ফ্রেশ ডিম আছে। এখন পাউডারের দরকার হবে না।
বারান্দায় উঠে এসে চেয়ারে বসে পড়ে কাকাবাবু বললেন, আমার বাবার মুখে শুনেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সত্যিই এগ পাউডার পাওয়া যেত। যেসব মিলিটারি পাহাড়ে-জঙ্গলে যুদ্ধ করতে যেত, তারা আর সেখানে ডিম পাবে কোথায়? তাই এগ পাউডার গুলে খেত!
জোজো সন্তুর দিকে ফিরে বলল, দেখলি, দেখলি!
সন্তু বলল, আমরা তো আর যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। শিমুলতলায় অনেক ডিম পাওয়া যায়।
বাদশা নিজেই কফি নিয়ে এল কাকাবাবুর জন্য। তারপর বলল, আজ দুপুরে গিরিডি বেড়াতে যাবেন? সুন্দর জায়গা। কয়েকটা ঝরনা আছে। একসময় আমাদের বাঙালিদের খুব প্রিয় জায়গা ছিল গিরিডি। রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু, আরও অনেকে ওখানে গিয়ে থাকতেন।
কাকাবাবু বললেন, ওদের জিজ্ঞেস করো।
সন্তু বলল, আজ না। আজ আমরা শুধু ভূত দেখব। বেড়াতে যাব। কাল।
বাদশা বলল, প্রতিদিনই যে ও-বাড়িতে ভূতের উপদ্রব হয়, তা নয়। এক-একদিন কিছুই হয় না।
জোজো বলল, বাদশাদা, তুমি কখনও নিজের চোখে ভূত দেখেছ? বাদশা বলল, না, তা দেখিনি। তবে নানারকম আওয়াজ শুনেছি, তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
জোজো বলল, কীরকম আওয়াজ? কীরকম?
বাদশা বলল, যেমন ধরো, একটা মেয়ের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। আমি টর্চ জ্বেলে সারা বাড়ি খুঁজে দেখেছি, কোথাও কোনও মেয়ে নেই, কেউ নেই, তবু কান্নার শব্দ। আবার কখনও কারা যেন বেশ কাছে। দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। তখন কিন্তু ভয় করে সত্যি। এই দ্যাখো, বলতে বলতে আমার রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, এক-এক সময় ভয় পেতেও তো ভাল লাগে। জীবনে কখনও ভয় পাওয়ার কিছু নেই, দুঃখের কান্না নেই। সে তো খুব একঘেয়ে ব্যাপার।
বাদশা বলল, কাকাবাবু, পটনা থেকে আমি ডিটেকটিভ এজেন্সির তিন জন লোক আনিয়েছি। তারা আজ দিনেরবেলা সারা বাড়ি সার্চ করে দেখবে। কোথাও কেউ লুকিয়ে আছে কিনা। সন্ধের পর মেন গেটের বাইরে বসে তারা পাহারা দেবে, যাতে কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে। এর পরেও যদি অলৌকিক কিছু দেখা যায় কিংবা শোনা যায়, তা হলে তো মানতেই হবে?
কাকাবাবু শুধু বললেন, হুঁ।
বাদশা জিজ্ঞেস করল, আপনি হু বললেন কেন? আপনিও তা হলে মেনে নেবেন?
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার মানা কিংবা না মানায় কী আসে যায়?
বাদশা বলল, বাঃ, আপনি বিখ্যাত রাজা রায়চৌধুরী। আপনি কত অত্যাশ্চর্য সমস্যা সম্ভ করেছেন। বিদেশেও লোকে আপনার নাম জানে।
কাকাবাবু বললেন, আমি যে ভূতের ব্যাপারেও এক্সপার্ট, তা তো জানতাম না। কতকাল ধরে ভূতের গল্প চলে আসছে, কত লোক ভূত দেখেছে নিজের চোখে, এর মধ্যে আমার একার কথার কী দাম আছে? আচ্ছা ধরো, আজ প্রমাণিত হয়ে গেল যে, ওই বাড়িতে ভূতটুত কিংবা অলৌকিক কিছু আছে। তখন তুমি কী করবে?
বাদশা বলল, হিন্দুরা এইসব বাড়িতে কী সব পুজোটুজো করে। তাতে নাকি অপদেবতা চলে যায়। আমি তো মুসলমান হয়ে পুজো করতে পারব না। আমি সেরকম অবস্থায় বাড়িটা বেচে দেব। আমার আর সস্তার দরকার নেই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বাদশা, তুমি কখনও যাত্রা-থিয়েটারে অভিনয় করেছ?
একটু চমকে গিয়ে বাদশা বলল, হঠাৎ এ-কথাটা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কাকাবাবু বললেন, হঠাৎই মনে এল। তোমার চেহারা বেশ সুন্দর, গলার আওয়াজও ভাল। তুমি থিয়েটার-সিনেমায় অ্যাক্টিং করলে বেশ নাম করতে পারতে। আজকাল তো টিভিতেও কত রকম সিরিয়াল হয়, তাতেও অনেকে চান্স পায়।
বাদশা বলল, না, কাকাবাবু! কয়েকজন আমাকে বলেছে সিনেমায় নামতে। কিন্তু ওসব দিকে মন দিলে আমার ব্যাবসার বারোটা বেজে যেত। তবে, কলেজে পড়ার সময় দু-একবার থিয়েটার করেছি।
জোজো বলল, বাদশাদা, সিনেমা-টিভিতে অ্যাক্টিং না করে ক্যাসেট, টিভি সেট বিক্রি করে।
সন্তু বলল, ক্যাসেটের কথা ভুলে যা। এখন ডিভিডির যুগ।
কাকাবাবু বললেন, সত্যিই আশ্চর্য, তাই না? একটা ছোট্ট পাতলা ডিস্ক, তাতে পুরো একটা সিনেমা ভরা থাকে। কত দৃশ্য, কত ক্যারেক্টার, কত মারামারি, দুঘণ্টা ধরে ওইটুকু ডিস্ক চালিয়ে সব দেখা যায়।
বাদশা বলল, আজ দুপুরে কোনও সিনেমা দেখবেন? আমার কাছে অনেক সিডি আছে।
কাকাবাবু বললেন, তা দেখা যেতে পারে। যা গরম পড়ছে, দুপুরে আর বাইরে বেরোনো যাবে না।