[‘ইণ্ডিয়া’, লণ্ডন, ১৮৯৬]
লণ্ডনের ইহা মরসুমের সময়। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁহার মত ও দর্শনে আকৃষ্ট অনেক ব্যক্তির সমক্ষে বক্তৃতা করিতেছেন ও তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। স্বামীজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাঁহার সামরিক বাসস্থান দক্ষিণ বেলগ্রেভিয়াতে গেলাম। ভারতের আবার ইংলণ্ডকে বলিবার কি আছে, জানিবার জন্য আমার আগ্রহ হইল।
স্বামীজী শান্তভাবে বলিলেন—ভারতের পক্ষে এখানে ধর্মপ্রচারক-প্রেরণ কিছু নূতন ব্যাপার নহে। যখন বৌদ্ধধর্ম নবীন তেজে উঠিতেছিল—যখন ভারতের চতুষ্পার্শ্বস্থ জাতিগুলিকে তাহার কিছু শিখাইবার ছিল, তখন সম্রাট অশোক চারিদিকে ধর্মপ্রচারক পাঠাইলেন।
‘আচ্ছা, এ কথা কি জিজ্ঞাসা করিতে পারি, কেন ভারত ঐরূপে ধর্মপ্রচারক-প্রেরণ বন্ধ করিয়াছিল, আবার কেনই বা এখন আরম্ভ করিল?’
‘বন্ধ করিবার কারণ—ক্রমশঃ স্বার্থপর হইয়া ভারত এই তত্ত্ব ভুলিয়া গিয়াছিল যে, আদানপ্রাদান-প্রণালীক্রমেই ব্যক্তি এবং জাতি উভয়েই জীবিত থাকে ও উন্নতি লাভ করে। ভারত চিরদিন জগতে একই বার্তা বহন করিয়াছে; ভারতের বার্তা আধ্যাত্মিক। অনন্ত যুগ ধরিয়া অন্তরের ভাবরাজ্যেই তাহার একচেটিয়া অধিকার; সূক্ষ্ম বিজ্ঞান, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র—ইহাতেই ভারতের বিশেষ অধিকার। প্রকৃতপক্ষে আমার ইংলণ্ডে প্রচারকার্যে আগমন—ইংলণ্ডের ভারত-গমনেরই ফলস্বরূপ। ইংলণ্ড ভারতকে জয় করিয়া শাসন করিতেছে, তাহার পদার্থবিদ্যা নিজের ও আমাদের কাজে লাগাইতেছে। ভারত জগৎকে কি দিয়াছে ও কি দিতে পারে, মোটামুটি বলিতে গিয়া আমার একটি সংস্কৃত ও একটি ইংরেজী বাক্য মনে পড়িতেছে।
কোন মানুষ মরিয়া গেলে আপনারা বলেন, সে আত্মা পরিত্যাগ করিল (He gave up the ghost); আর আমরা বলি, সে দেহত্যাগ করিল। আপনারা বলিয়া থাকেন, মানুষের আত্মা আছে, তাহা দ্বারা আপনারা যেন অনেকটা ইহাই লক্ষ্য করিয়া থাকেন যে, শরীরটাই মানুষের প্রধান জিনিষ। কিন্তু আমরা বলি, মানুষ আত্মাস্বরূপ—তাহার একটা দেহ আছে। এগুলি অবশ্য জাতীয় চিন্তাতরঙ্গের উপরিভাগের ক্ষুদ্র বুদ্বুদমাত্র, কিন্তু ইহাই আপনাদের জাতীয় চিন্তাতরঙ্গের গতি প্রকাশ করিয়া দিতেছে।
‘আমার ইচ্ছা হইতেছে, আপনাকে শোপেনহাওয়ারের ভবিষ্যদ্বাণীটি স্মরণ করাইয়া দিই যে, অন্ধকার যুগের (Dark Ages) অবসানে গ্রীক ও ল্যাটিন বিদ্যার অভ্যুদয়ে ইওরোপে যেরূপ গুরুতর পরিবর্তন উপস্থিত হইয়াছিল, ভারতীয় দর্শন ইওরোপে সুপরিচিত হইলে সেইরূপ গুরুতর পরিবর্তন আসিবে। প্রাচ্যতত্ত্ব-গবেষণা খুব প্রবল বেগে অগ্রসর হইতেছে।
সত্যান্বেষিগণের সমক্ষে নূতন ভাবস্রোতের দ্বার উন্মুক্ত হইতেছে।
’
‘তবে কি আপনি বলিতে চান, ভারতই অবশেষে তাহার বিজেতাকে জয় করিবে?’
‘হাঁ, ভাবরাজ্যে। এখন ইংলণ্ডের হাতে তরবারি—সে এখন জড়জগতের প্রভু, যেমন ইংরেজের আগে আমাদের মুসলমান বিজেতারা ছিলেন। সম্রাট আকবর কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন হিন্দুই হইয়া গিয়াছিলেন। শিক্ষিত মুসলমানদের সঙ্গে—সুফীদের সঙ্গে—হিন্দুদের সহজে প্রভেদ করা যায় না। তাহারা গোমাংস ভক্ষণ করে না এবং অন্যান্য নানা বিষয়ে আমাদের আচার ব্যবহারের অনুসরণ করিয়া থাকে। তাহাদের চিন্তাপ্রণালী আমাদের দ্বারা বিশেষভাবে অনুরঞ্জিত হইয়াছে।’
‘তাহা হইলে আপনার মতে—দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইংরেজের অদৃষ্টেও ঐরূপ হইবে? বর্তমান মুহূর্তে ঐ ভবিষ্যৎ কিন্তু অনেক দূরে বলিয়াই বোধ হয়।’
‘না, আপনি যতদূর ভাবিতেছেন, ততদূর নয়। ধর্মবিষয়ে হিন্দু ও ইংরেজের ভাব অনেক বিষয়ে সদৃশ। আর অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের সঙ্গে যে হিন্দুর ঐক্য আছে, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ রহিয়াছে। যদি কোন ইংরেজ শাসনকর্তার (Civil Servant) ভারতীয় সাহিত্য, বিশেষতঃ ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকে, তবে দেখা যায়, উহাই তাঁহার হিন্দুর প্রতি সহানুভূতির কারণ। ঐ সহানুভূতির ভাব দিন দিন বাড়িতেছে। কতকগুলি লোক যে এখনও ভারতীয় ভাবকে অতি সঙ্কীর্ণ—এমন কি, কখনও কখনও অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখিয়া থাকে, কেবল অজ্ঞানই যে তাহার কারণ, ইহা বলিলে কিছুমাত্র অন্যায় বলা হইবে না।’
‘হাঁ, ইহা অজ্ঞতার পরিচায়ক বটে। আপনি ইংলণ্ডে না আসিয়া যে আমেরিকায় ধর্মপ্রচারকার্যে গেলেন, ইহার কারণ কি বলিবেন?’
‘সেটি কেবল দৈবঘটনা মাত্র—বিশ্বধর্ম-মহাসভা লণ্ডনে না বসিয়া চিকাগোয় বসিয়াছিল বলিয়াই আমাকে সেখানে যাইতে হইয়াছিল। কিন্তু বাস্তবিক লণ্ডনেই উহার অধিবেশন হওয়া উচিত ছিল। মহীশূরের রাজা এবং আর কয়েকজন বন্ধু আমাকে সেখানে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিরূপে পাঠাইয়াছিলেন। আমি সেখানে তিন বৎসর ছিলাম—কেবল গত বৎসর গ্রীষ্মকালে আমি লণ্ডনে বক্তৃতা দিবার জন্য আসিয়াছিলাম এবং এই গ্রীষ্মেও আসিয়াছি। মার্কিনেরা খুব বড় জাত—উহাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমি তাহাদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাসম্পন্ন—তাহাদের মধ্যে আমি অনেক সহৃদয় বন্ধু পাইয়াছি। ইংরেজদের অপেক্ষা তাহাদের কুসংস্কার অল্প, তাহারা সকল নূতন ভাবকেই ওজন করিয়া দেখিতে বা পরীক্ষা করিতে প্রস্তুত—নূতনত্ব সত্ত্বেও উহার আদর করিতে প্রস্তুত। তাহারা খুব অতিথিপরায়ণ। লোকের বিশ্বাসপাত্র হইতে সেখানে অপেক্ষাকৃত অল্প সময় লাগে। আমার মত আপনিও আমেরিকার শহরে শহরে ঘুরিয়া বক্তৃতা করিতে পারেন—সর্বত্রই বন্ধু জুটিবে। আমি বষ্টন, নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, বাল্টিমোর, ওয়াশিংটন, ডেসমোনিস, মেমফিস এবং অন্যান্য অনেক স্থানে গিয়াছিলাম।
’
‘আর প্রত্যেক জায়গায় শিষ্য করিয়া আসিয়াছেন?’
‘হাঁ, শিষ্য করিয়া আসিয়াছি—কিন্তু কোন সমাজ গঠন করি নাই। উহা আমার কাজের অন্তর্গত নহে। সমাজ বা সমিতি তো যথেষ্টই অছে। তা ছাড়া সম্প্রদায় করিলে উহা পরিচালনার জন্য আবার লোক দরকার—সম্প্রদায় গঠিত হইলেই টাকার প্রয়োজন, ক্ষমতার প্রয়োজন, মুরুব্বির প্রয়োজন। অনেক সময় সম্প্রদায়সমূহ প্রভুত্বের জন্য চেষ্টা করিয়া থাকে, কখনও কখনও অপরের সহিত লড়াই পর্যন্ত করিয়া থাকে।’
‘তবে কি আপনার ধর্মপ্রচারকার্যের ভাব সংক্ষেপে এইরূপ বলা যাইতে পারে যে, আপনি বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করিয়া তাহারই প্রচার করিতে চাহেন?’
‘আমি প্রচার করিতে চাই—ধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব, ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠানগুলির যাহা সার, তাহাই আমি প্রচার করিতে চাই। সকল ধর্মেরই একটা মুখ্য ও একটা গৌণ ভাগ আছে। ঐ গৌণভাগগুলি ছাড়িয়া দিলে যাহা থাকে, তাহাই সকল ধর্মের প্রকৃত ভিত্তিস্বরূপ, উহাই সকল ধর্মের সাধারণ সম্পত্তি। সকল ধর্মের অন্তরালে ঐ একত্ব রহিয়াছে—আমরা উহাকে গড্, আল্লা, যিহোবা, আত্মা, প্রেম—যে কোন নাম দিতে পারি। সেই এক সত্তাই সকল প্রাণীর প্রাণরূপে বিরাজিত—প্রাণিজগতের অতি নিকৃষ্ট বিকাশ হইতে সর্বোচ্চ বিকাশ মানব পর্যন্ত সর্বত্র। আমরা ঐ একত্বের দিকেই সকলের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করিতে চাই, কিন্তু পাশ্চাত্যে—শুধু পাশ্চাত্যে কেন, সর্বত্রই লোকে গৌণবিষয়গুলির দিকেই বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়া থাকে। লোকে ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠানগুলি লইয়া অপরকে ঠিক নিজের মত কাজ করাইবার জন্যই পরস্পরের সহিত বিবাদ এবং পরস্পরকে হত্যা পর্যন্ত করে। ভগবদ্ভক্তি ও মানব-প্রীতিই যখন জীবনের সার বস্তু, তখন এইসকল বাদ-বিসংবাদকে কঠিনতর ভাষায় নির্দেশ না করিলেও আশ্চর্য ব্যাপার বলিতে হয়।’
‘আমার বোধ হয়, হিন্দু কখনও অন্য ধর্মাবলম্বীর উপর উৎপীড়ন করিতে পারে না।’
‘এ পর্যন্ত কখনও করে নাই। জগতে যত জাতি আছে, তাহার মধ্যে হিন্দুই সর্বাপেক্ষা পরধর্মসহিষ্ণু। হিন্দু গভীর ধর্মভাবাপন্ন বলিয়া লোকে মনে করিতে পারে যে, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ব্যক্তির উপর সে অত্যাচার করিবে। কিন্তু দেখুন, জৈনেরা ঈশ্বর-বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক বলিয়া মনে করে, কিন্তু এ পর্যন্ত কোন হিন্দুই জৈনদের উপর অত্যাচার করে নাই। ভারতে মুসলমানেরাই প্রথমে পরধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধে তরবারি গ্রহণ করিয়াছিল।’
‘ইংলণ্ডে এই অদ্বৈত মতবাদ কিরূপে প্রসার লাভ করিতেছে? এখানে তো সহস্র সহস্র সম্প্রদায়।’
স্বাধীন চিন্তা ও জ্ঞানের বৃদ্ধির সঙ্গে ধীরে ধীরে ঐগুলি লোপ পাইবে। উহারা গৌণবিষয় অবলম্বনে প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য স্বভাবতই চিরকাল থাকিতে পারে না। ঐ সম্প্রদায়গুলি তাহাদের উদ্দেশ্য সাধন করিয়াছে। ঐ উদ্দেশ্য—সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের ধারণানুযায়ী সঙ্কীর্ণ ভ্রাতৃভাবের প্রতিষ্ঠা। এখন ঐ-সকল বিভিন্ন ব্যক্তি-সমষ্টির মধ্যে যে ভেদরূপ প্রাচীর—ব্যবধান আছে, সেগুলি ভাঙিয়া দিয়া ক্রমে আমরা সর্বজনীন ভ্রাতৃভাবে পৌঁছিতে পারি। ইংলণ্ডে এই কাজ খুব ধীরে ধীরে চলিতেছে, তাহার কারণ সম্ভবতঃ এখনও উপযুক্ত সময় উপস্থিত হয় নাই। কিন্তু তাহা হইলেও ধীরে ধীরে এই ভাব প্রসারিত হইতেছে। ইংলণ্ডও ভারতে ঐ কাজে নিযুক্ত রহিয়াছে, আমি আপনার দৃষ্টি সেইদিকে আকর্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। আধুনিক জাতিভেদ ভারতের উন্নতির একটি বিশেষ প্রতিবন্ধক। উহা সঙ্কীর্ণতা ও ভেদ আনয়ন করে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিতর একটা গণ্ডী কাটিয়া দেয়। চিন্তার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উহা চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাইবে।’
‘কিন্তু কতক ইংরেজ—আর তাঁহারা ভারতের প্রতি কম সহানুভূতিসম্পন্ন নন, কিম্বা উহার ইতিহাস সম্বন্ধে খুব অজ্ঞ নন—জাতিভেদকে মুখ্যতঃ কল্যাণকর বলিয়াই মনে করেন। লোকে সহজেই বেশী রকম ইওরোপীয়-ভাবাপন্ন হইয়া যাইতে পারে। আপনিই আমাদের অনেকগুলি আদর্শকে জড়বাদাত্মক বলিয়া নিন্দা করেন।’
‘সত্য। কোন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিই ভারতকে ইংলণ্ডে পরিণত করিতে ইচ্ছা করেন না। দেহের অন্তরালে যে চিন্তা রহিয়াছে, তাহা দ্বারাই এই শরীর গঠিত হইয়াছে। সুতরাং সমগ্র জাতিটি জাতীয় চিন্তার বিকাশমাত্র, আর ভারতে উহা সহস্র সহস্র বৎসরের চিন্তার বিকাশ-স্বরূপ। সুতরাং ভারতকে ইওরোপীয়-ভাবাপন্ন করা এক অসম্ভব ব্যাপার এবং উহার জন্য চেষ্টা করাও নির্বোধের কাজ। ভারতে চিরদিনই সামাজিক উন্নতির উপাদান বিদ্যমান ছিল; যখনই শান্তিপূর্ণ শাসনপ্রণালী স্থাপিত হইয়াছে, তখনই উহার অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। উপনিষদের যুগ হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমাদের সকল বড় বড় আচার্যই জাতিভেদের বেড়া ভাঙিবার চেষ্টা করিয়াছেন। অবশ্য মূল জাতিবিভাগকে নহে, উহার বিকৃত ও অবনত ভাবটাকেই তাঁহারা ভাঙিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। প্রাচীন জাতিবিভাগে অতি সুন্দর সামাজিক ব্যবস্থা ছিল—বর্তমান জাতিভেদের মধ্যে যেটুকু ভাল দেখিতে পাইতেছেন, তাহা সেই প্রাচীন জাতিবিভাগ হইতেই আসিয়াছে। বুদ্ধ জাতিবিভাগকে উহার প্রাচীন মৌলিক আকারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ভারত যখনই জাগিয়াছে, তখনই জাতিভেদ ভাঙিবার প্রবল চেষ্টা হইয়াছে। কিন্তু আমাদিগকেই চিরকাল এ কাজ করিতে হইবে—আমাদিগকেই প্রাচীন ভারতের পরিণতি ও ক্রমবিকাশ-কল্পে নূতন ভারত গঠন করিতে হইবে; যে-কোন বৈদেশিক ভাব ঐ কাজে সাহায্য করে, তাহা যেখানেই পাওয়া যাক না কেন, তাহা নিজের করিয়া লইতে হইবে। অপরে কখনও আমাদের হইয়া ঐ কাজ করিতে পারিবে না। সকল উন্নতিই ব্যক্তি বা জাতি-বিশেষের ভিতর হইতে হওয়া প্রয়োজন। ইংলণ্ড কেবল ভারতকে তাহার নিজ উদ্ধার-সাধনে সাহায্য করিতে পারে—এই পর্যন্ত! আমার মতে যে-জাতি ভারতের গলা টিপিয়া রহিয়াছে, তাহার নির্দেশে যে-উন্নতি হইবে, তাহার কোন মূল্য নাই। ক্রীতদাসের ভাবে কার্য করিলে অতি উচ্চতম কার্যেরও ফলে অবনতিই ঘটিয়া থাকে।’
‘আপনি কি ভারতের জাতীয় মহাসমিতি আন্দোলনের (Indian National Congress Movement) দিকে কখনও মনোযোগ দিয়াছেন?’
‘আমি যে ও-বিষয়ে বিশেষ মন দিয়াছি, বলিতে পারি না। আমার কার্যক্ষেত্র অন্য বিভাগে। কিন্তু আমি ঐ আন্দোলন দ্বারা ভবিষ্যতে বিশেষ শুভফল লাভের সম্ভাবনা আছে মনে করি এবং অন্তরের সহিত উহার সিদ্ধি কামনা করি। ভারতের বিভিন্ন জাতি লইয়া এক বৃহৎ জাতি বা নেশন গঠিত হইতেছে। আমার কখনও কখনও মনে হয়, ভারতের বিভিন্ন জাতি ইওরোপের বিভিন্ন জাতি অপেক্ষা কম বিচিত্র নয়। অতীতে ইওরোপের বিভিন্ন জাতি ভারতীয় বাণিজ্য-বিস্তারের জন্য বিশেষ প্রয়াস পাইয়াছে, আর এই ভারতীয় বাণিজ্য জগতের সভ্যতা-বিস্তারের একটি প্রবল শক্তিরূপে কাজ করিয়াছে। এই ভারতীয় বাণিজ্যাধিকার-লাভ মনুষ্যজাতির ইতিহাসে একরূপ ভাগ্যচক্র-পরিবর্তনকারী ঘটনা বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। আমরা দেখিতে পাই, ওলন্দাজ, পোর্তুগীজ, ফরাসী ও ইংরেজ ক্রমান্বয়ে উহার জন্য চেষ্টা করিয়াছে। ভিনিসবাসীরা প্রাচ্যদেশে বাণিজ্য-বিস্তারে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া সুদূর পাশ্চাত্যে ঐ ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করাতেই যে আমেরিকার আবিষ্কার হইল, ইহাও বলা যাইতে পারে।’
‘ইহার পরিণতি কোথায়?’
‘অবশ্য ইহার পরিণতি হইবে ভারতের মধ্যে সাম্যভাব-স্থাপনে, সকল ভারতবাসীর ব্যক্তিগত সমান অধিকারলাভে। জ্ঞান কয়েকজন শিক্ষিত ব্যক্তির একচেটিয়া সম্পত্তি থাকিবে না, উহা উচ্চশ্রেণী হইতে ক্রমে নিম্নশ্রেণীতে বিস্তৃত হইবে। সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষা-বিস্তারের চেষ্টা চলিতেছে, পরে বাধ্য করিয়া সকলকে শিক্ষিত করিবার বন্দোবস্ত হইবে। ভারতীয় সর্বসাধারণের মধ্যে নিহিত অগাধ কার্যকরী শক্তিকে ব্যবহারে আনিতে হইবে। ভারতের অভ্যন্তরে মহতী শক্তি নিহিত আছে, উহাকে জাগাইতে হইবে।
’
‘প্রবল যুদ্ধকুশল জাতি না হইয়া কি কেহ কখনও বড় হইয়াছে?’ স্বামীজী মুহূর্তমাত্র ইতস্ততঃ না করিয়া বলিলেন, ‘হাঁ, চীন হইয়াছে। অন্যান্য দেশের মধ্যে আমি চীন ও জাপানে ভ্রমণ করিয়াছি। আজ চীন একটা ছত্রভঙ্গ দলের মত হইয়া দাঁড়াইয়াছে; কিন্তু উন্নতির দিনে উহার যেমন সুশৃঙ্খল সমাজ-ব্যবস্থা ছিল, আর কোন জাতির এ পর্যন্ত সেরূপ হয় নাই। অনেক বিষয়—যেগুলিকে আমরা আজকাল ‘আধুনিক’ বলিয়া থাকি, চীনে শত শত—এমন কি বহু সহস্র বৎসর ধরিয়া সেগুলি প্রচলিত ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রতিযোগিতা-পরীক্ষার কথা ধরুন।’
‘চীন এমন ছত্রভঙ্গ হইয়া গেল কেন?’
‘কারণ, চীন তাহার সামাজিক প্রথা অনুযায়ী মানুষ তৈয়ার করিতে পারিল না। আপনাদের একটা চলিত কথা আছে যে, পার্লামেণ্টের আইনবলে মানুষকে ধার্মিক করিতে পারা যায় না। চীনারা আপনাদের পূর্বেই ঐ কথা ঠেকিয়া শিখিয়াছিল। ঐ কারণেই রাজনীতি অপেক্ষা ধর্মের আবশ্যকতা গভীরতর। কারণ ধর্ম ব্যবহারিক জীবনের মূলতত্ত্ব লইয়া আলোচনা করে।’
‘আপনি যে ভারতের জাগরণের কথা বলিতেছেন, ভারত কি সে-বিষয়ে সচেতন?’
‘সম্পূর্ণ সচেতন। সকলে সম্ভবতঃ কংগ্রেস আন্দোলনে এবং সমাজসংস্কার-ক্ষেত্রে এই জাগরণ বেশীর ভাগ দেখিয়া থাকে, কিন্তু অপেক্ষাকৃত ধীরভাবে কাজ চলিলেও ধর্মবিষয়ে ঐ জাগরণ বাস্তবিকই হইয়াছে।’
‘পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দেশের আদর্শ এতদূর বিভিন্ন। আমাদের আদর্শ—সামাজিক অবস্থার পূর্ণতা-সাধন বলিয়াই বোধ হয়। আমরা এখন এই-সকল বিষয়ের আলোচনাতেই ব্যতিব্যস্ত রহিয়াছি, আর প্রাচ্যবাসিগণ সেই সময়ে সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহের ধ্যানে নিযুক্ত। সুদান-যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যের ব্যয়ভার কোথা হইতে নির্বাহ হইবে, এই বিষয়ের বিচারেই এখানে পার্লামেণ্ট ব্যস্ত। রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভদ্র সংবাদপত্র-মাত্রেই সরকারের অন্যায় মীমাংসার বিরুদ্ধে খুব চীৎকার করিতেছে, কিন্তু আপনি হয়তো ভাবিতেছেন, ও-বিষয়টা একেবারে মনোযোগেরই যোগ্য নয়।’
স্বামীজী সম্মুখের সংবাদপত্রটি লইয়া এবং রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের কাগজ হইতে উদ্ধৃতাংশসমূহে একবার চোখ বুলাইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু আপনি সম্পূর্ণ ভুল বুঝিয়াছেন। এ বিষয়ে আমার সহানুভূতি স্বভাবতই আমার দেশের সহিত হইবে। তথাপি ইহাতে আমার একটি সংস্কৃত প্রবাদ মনে পড়িতেছেঃ হাতী বেচিয়া এখন আর অঙ্কুশের জন্য বিবাদ কেন? ভারতই চিরকাল দিয়াই আসিতেছে। রাজনীতিকদের বিবাদ বড় অদ্ভুত। রাজনীতির ভিতর ধর্ম ঢুকাইতে এখনও অনেক যুগ লাগিবে।’
‘তাহা হইলেও উহার জন্য অতি শীঘ্র চেষ্টা করা তো আবশ্যক?’
‘হাঁ, জগতের মধ্যে বৃহত্তম শাসনযন্ত্র সুমহান্ লণ্ডনের হৃদয়ের কোন ভাববীজ রোপণ করা বিশেষ প্রয়োজন বটে। আমি অনেক সময় ইহার কার্যপ্রণালী পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকি—কিরূপ তেজের সহিত ও কেমন সম্পূর্ণভাবে অতি সূক্ষ্মতম শিরায় পর্যন্ত উহার ভাবপ্রবাহ ছুটিয়াছে! উহার ভাববিস্তার—চারিদিকে শক্তিসঞ্চালনপ্রণালী কি অদ্ভুত! ইহা দেখিলে সমগ্র সাম্রাজ্যটি কত বৃহৎ ও উহার কার্য কত গুরুতর, তাহা বুঝিবার পক্ষে সাহায্য হয়। অন্যান্য বিষয়-বিস্তারের সহিত উহার ভাবও ছড়াইয়া থাকে। এই মহান্ যন্ত্রের কেন্দ্রে কতকগুলি ভাব প্রবেশ করাইয়া দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন, যাহাতে অতি দূরবর্তী দেশে পর্যন্ত ঐগুলি সঞ্চারিত হইতে পারে।’