০৩. বিষয়বস্তু
যজুর্বেদ-সংহিতা সাধারণভাবে প্রধান সামূহিক যজ্ঞ অর্থাৎ শ্রৌতযাগগুলির বিবরণ দিয়েছে – তবে, এছাড়াও এতে সামাজিক উৎপাদন ও গাৰ্হস্থ্য আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বিবরণও কিছু রয়েছে। সংহিতার দুই-তৃতীয়াংশ সুনির্দিষ্ট যজুৰ্বেদীয় মন্ত্রের উদাহরণ : অবশিষ্ট অংশের প্রায় অর্ধেক প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণত বা আংশিকভাবে ঋগ্বেদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তবে, ঋগ্বেদের বিন্যাসক্রম সেখানে অনুসৃত হয় নি, বিশৃঙ্খলভাবে মন্ত্রগুলি একত্র সংকলিত হয়েছে মাত্র। উল্লেখ্য যে, কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতা এবং শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় ঋগ্বেদের উদ্ধৃতিগুলি বিশুদ্ধতমভাবে সংরক্ষিত হলেও মৈত্রায়ণী এবং কাঠকী-কপিষ্ঠল সংহিতায় কিন্তু এক ধরনের উদ্ধৃতি যথেচ্ছভাবে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। কখনও কখনও ঋগ্বেদ-সংহিতাকে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করা হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক পা সঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবেই সেই সব মন্ত্রাংশকে পরিবর্তিত করা হয়েছে। স্পষ্টতই সংহিতা-রচনার সৃজনশীল পর্যায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যখন নূতন নূতন যজ্ঞানুষ্ঠান আবিষ্কৃত হচ্ছিল, তখন আবৃত্তি বা গানের জন্য নূতন সংহিতার যোগান দেওয়া সম্ভবপর ছিল না। তাই পূর্ব-প্ৰযুক্ত প্রাচীনতর উপাদান এই সব নবোদ্ভাবিত যজ্ঞের ক্ষেত্রে পুনরায় ব্যবহৃত হতে লাগল, কখনও কখনও প্রসঙ্গের সঙ্গে তার সম্পর্কও আর রইল না। ফলে, এই পর্যায়ে সংহিতার পাঠ ও প্রয়োগের মধ্যে প্রচুর অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে।
যজুর্বেদ-সংহিতায় নিম্নোক্ত যজ্ঞসমূহ বিবৃত হয়েছে–দর্শপূৰ্ণমাস, হবির্যজ্ঞ, পশুযাগ, বাজপেয়, রাজসূয়, দীক্ষণীয়েষ্টি, সোমযাগ, সৌত্রামণী, প্রবাির্গ্য, অগ্নিচয়ন, অশ্বমেধ ও পুরুষমেধ। এদের মধ্যে অধিকাংশই আর্যদের ভারতভূমিতে বসতি স্থাপনের পরবর্তীকালে পরিকল্পিত হয়েছিল বলে এতে বহুতর পুরোহিতের অংশগ্রহণের অবকাশ আছে। পরিশীলিত সূক্ষ্মতা এবং সীমাহীন প্ৰায়োগিক জটিলতাও তাই এগ্রন্থে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। যজুৰ্বেদ সংহিতা রচনার পশ্চাতে সক্রিয় প্রেরণা সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ; যজ্ঞের সংখ্যা যখন বহুগুণ বধিত হল। তখন আনুষ্ঠানিক অনুপুঙ্খণ্ডলির বিস্তায় অনিবাৰ্থ হয়ে উঠল যাতে তৎকালীন নির্দিষ্ট সামাজিক পরিস্থিতিতে এরা শুধু গ্ৰহণযোগই নয়, অবশ্যপালনীয়ও হয়ে উঠে। আবার কাহিনী বা বিবৃতিমূলক সূক্তগুলি স্পষ্টতই সংহিতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে মেলে না। বস্তুতঃ, কৃষ্ণ-যজুর্বেদ এজন্যই অনন্য কেননা অন্য তিনটি সংহিতায় প্রার্থনা ও প্রশস্তিবাচক মন্ত্র থাকলেও কৃষ্ণ-যজুর্বেদে আমরা প্রথম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের নিকট যজ্ঞের তাৎপৰ্যঠিক কি এবং কেন সেগুলি অনুষ্ঠেয় তার ইঙ্গিত পাই। ফলে, আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর বিচারে কৃষ্ণ-যজুর্বেদ স্পষ্টতই ব্ৰাহ্মণ-গ্ৰন্থসমূহের পূর্বগামী।