০৩. বিষ

বিষ

ক্রায়োজেনিক পাম্পটি চালিয়ে দিয়ে কিম জিবান কাচের ছোট অ্যাম্পুলটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনো একটা ক্ষুদ্রাইভার হাতে একটা স্কু ঘুরিয়েছেন মনে পড়ে না, অথচ গত এক সপ্তাহ থেকে তাঁর ঘরে একটা ছোট কিন্তু জটিল ল্যাবরেটরি বসানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের দশজন সদস্যের একজন হিসেবে তাঁর ক্ষমতার আক্ষরিক অর্থেই কোনো সীমা নেই। মূল কম্পিউটার তাঁর মুখের কথায় এই ল্যাবরেটরির প্রতিটি জিনিস এনে হাজির করেছে। কিন্তু কাচের অ্যাম্পুলটিতে তিনি যে তরল পদার্থটি রাখতে চাইছেন, সেটি কী ভাবে তৈরি করতে হয় সেই তথ্যটি তিনি মুখের কথায় বের করতে পারেন নি। সেজন্যে তাঁকে নিজের হাতে তাঁর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের গোপন সংখ্যাটি মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাতে হয়েছে। পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কেউ সেটি করেছে বলে জানা নেই। এজন্যে তাঁকে সামনের কাউন্সিলে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নিজের হাতে নিজের প্রাণ নেয়ার কথা।

জিন স্থির দৃষ্টিতে কাচের অ্যালটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। হালকা লাল রঙের একটা তরল একফোঁটা একফোঁটা করে কাচের অ্যাম্পলটিতে জমা হচ্ছে। পুরোটুকু ভরে যাওয়ার পর অ্যাম্পুলটির মুখ লেজারের একঝলক আলোতে গলিয়ে বন্ধ করে ফেলার কথা। তিনি কখনো আগে এ ধরনের কাজ করেন নি, তাই নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চান।

অ্যাম্পুলটির মুখ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি সেটা হাতে নেয়ার জন্যে ক্রায়োজেনিক পাম্পটা বন্ধ করে দেন। ভিতরে বাতাসের চাপ স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা খোলার জন্যে হাতল স্পর্শ করামাত্র মূল কম্পিউটারটি আপত্তি জানাল। পৃথিবীতে মাত্র দশজন মানুষকে এই ঢাকনা খোলার অধিকার দেয়া হয়েছে। তিনি সেই দশজন মানুষের একজন। কিম জিবানকে দ্বিতীয়বার তাঁর নিজের হাতে গোপন সংখ্যাটি প্রবেশ করিয়ে কম্পিউটারকে জানাতে হল। বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা এবার সহজেই খুলে আয়) জিবানের হাত অল্প অল্প কাঁপতে থাকে, তিনি সে অবস্থাতেই সাবধানে অ্যালতি তুলে নেন। তিনি এখন তাঁর জীবনের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি করবেন। তাঁর হাতে কাচের অ্যাম্পুলটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে এই তরল পদার্থটি বাতাসে মিশে গিয়ে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মেরে ফেলবে। মাত্র তিন ধরনের ভাইরাস এই বোনাসিয়াস থেকে রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ লন। কিম জিবান হেঁটে ঘরের মাঝখানে আসেন, তাঁর হাত তখনো অল্প অল্প কাঁপছে, তিনি ভালো করে অ্যাম্পুলটি ধরে রাখতে পারছেন না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রাণ তিনি এখন হাতে ধরে রেখেছেন, কিম জিবান অবাক হয়ে ভাবলেন, এত বড় ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ কি কখনো অর্জন করেছিল?

 

নীষ কিম জিবানের ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করেন, ঘরাট অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করতেই অন্ধকারে এক কোনা থেকে জিবান বললেন, নীষ, বাতি জ্বালিও না। একটু পরেই দেখবে চোখ অন্ধকারে সয়ে যাবে।

বাজে কথা বলো না—নীষ বাতি জ্বালালেন, আমার অন্ধকার ভালো লাগে না।

জিবান চোখ কুঁচকে নীষের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর মুখে আশ্চর্য একটা হাসি। নীষ বেশি অবাক হলেন না। কিম জিবান বরাবরই খেয়ালি মানুষ, এরকম একজন খেয়ালি মানুষকে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য করা হয়েছে, সেটাই আশ্চর্য! নীষ বললেন, কী ব্যাপার জিবান, আমাকে ডেকেছ কেন?

জিন কথা না বলে ঘরের কোনায় তাঁর ছোট ল্যাবরেটরি দেখালেন, নীষ বিস্মিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যান, কী ব্যাপার জিবান, তুমি ডিষ্টিলেশান কমপ্লেক্স দিয়ে কী করছ?

জিবান মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, তুমি পৃথিবীর প্রথম পাঁচজন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন–

কথাটি সত্যি তাই নীষ প্রতিবাদ না করে পরের অংশটক শোনার জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন। জিবান বললেন, তুমিই বল আমি কী করছিলাম।

নীষ মিনিট দুয়েক ডিস্টিলেশান কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কম্পিউটারের মনিটরে বার দুয়েক টোকা দিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন, তখন তিনি ঘুরে জিবানের দিকে তাকিয়েছেন, তাঁর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। নীষ কথা বলতে পারছিলেন না, বারকয়েক চেষ্টা করে কোনোতাবে বললেন, তুমি—তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। তুমি কাচের অ্যালে লিটুমিন বোনাসিয়াস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।

জিবান পকেট হাতড়ে অ্যাম্পুলটি বের করে তাঁকে দেখালেন। আতঙ্কে নীষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, মনে হতে থাকে তাঁর হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে, এই কাচের অ্যালটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ শেষ হয়ে যাবে। জিবান তখনো হাসিমুখে নীষের মুখের জিকে তাকিয়ে আছেন, আস্তে আস্তে তাঁর হাসি আরো বিস্তৃত হয়ে ওঠে, তিনি হঠাৎ অবহেলার ভঙ্গিতে অ্যাম্পুলটি নীষের দিকে ছুড়ে দেন।

নীষ পাগলের মতো লাফ দিয়ে অ্যাম্পুলটি ধরার চেষ্টা করলেন। হাত ফসকে সেটি পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটি ধরে ফেলেছেন। হাতের মুঠোয় রেখে তিনি বিস্ফারিত চোখে আঙ্গুলটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর সমস্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। নীষ ধীরে ধীরে জিবানের মুখের দিকে তাকালেন।

জিবানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, তাঁর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, আলটি ফিরিয়ে দাও।

না।

জিন ডুয়ার খুলে ভিতর থেকে একটা বেঢপ রিভলবার বের করলেন, আমাকে ফিরিয়ে দিলে আলটি রক্ষা পাবার সম্ভাবনা বেশি, তোমাকে গুলি করলে অ্যাম্পুলটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে যেতে পারে।

জিনা তুমি—

অ্যাম্পুলটি ফিরিয়ে দাও।

নীষ কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যাম্পুলটি ফিরিয়ে দিলেন। জিবান অ্যালটি টেবিলের উপর রেখে নীষ কিছু বোঝার আগে ট্রিগার টেনে সেটিকে গুলি করে বসেছেন।

প্রচণ্ড শব্দ হল ঘরে, কাচের অ্যাম্পুলটি ছিটকে গিয়ে দেয়ালে আঘাত খেয়ে মেঝেতে এসে পড়ে এক কোনায় গড়িয়ে যায়। নীষ বিস্মিত হয়ে দেখেন—অ্যাম্পুলটি ভাঙে নি, সেটির গায়ে একটু দাগ পর্যন্ত নেই। তিনি ঘুরে জিবানের দিকে তাকান, জিবানের মুখে আবার সেই ছেলেমানুষি হাসি ফিরে এসেছে। বেঢপ রিভলবারটি ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললেন, তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে দুঃখিত নীষ, কেন জানি একটু মজা করার ইচ্ছে হল। এটি আমার এক শ উনিশ নম্বর গুলি, আমি এটাকে গত ছত্রিশ ঘণ্টা থেকে ভাঙার চেষ্টা করছি।

নীষ কোনোমতে একটা চেয়ার ধরে বসে পড়েন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলেন, তুমি বলতে চাও এটি সাধারণ কাচ, অথচ–

হ্যাঁ, যেই মুহূর্তে এর ভিতরে বোনাসিয়াস ঢোকানো হয়েছে, এটা আর ভাঙা যাচ্ছে না। একটু থেমে যোগ করলেন, কেউ-একজন পৃথিবীর মানুষকে মরতে দিতে চায় না।

নীষ কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যাম্পলটা তুলে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জিবান।

বল।

তুমি কী ভাবে জানলে এরকম হবে?

জানতাম না, তাই তো পরীক্ষাটা করতে হল।

যদি তোমার অনুমান ভুল হত, যদি—

হয় নি তো।

যদি হত? যদি–

আহ! ছেলেমানুষি করা ছাড়, জিবান হাত নেড়ে নীষকে থামিয়ে দেন। নীষ সাবধানে কাচের অ্যাম্পুলটিকে টোকা দিয়ে বললেন, তুমি কেমন করে সন্দেহ করলে যে এরকম হতে পারে?

আমার সৌর তেজস্ক্রিয়তার উপরে প্রবন্ধটার কথা মনে আছে?

যেটা পরে ভুল প্রমাণিত হল? তুমি যে-পরিমাণ সৌর তেজস্ক্রিয়তা দাবি কর, সেটি সত্যি হলে পৃথিবী গত শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যেত।

হ্যাঁ। কিন্তু আমার হিসেবে কোনো ভুল ছিল না, আমি এখনো আমার কোনো গবেষণায় কোনো ভুল করি নি।

তাহলে–

আমি খুঁজে বের করেছি, একটা আশ্চর্য উপায়ে মহাজাগতিক মেঘ এসে সময়মতো তেজস্ক্রিয়তাটুকু শুষে নিয়েছিল, কী ভাবে সেটা সম্ভব হল কেউ জানে না। তখন আমার প্রথম সন্দেহ হয় যে, কোনো-একজন বা কোনো দল আমাদের উপর চোখ রাখছে।

এ-ধরনের আরো ঘটনা আছে?

অসংখ্য। আমি মূল কম্পিউটার দিয়ে গত তিন শ বছরের প্রায় ধ্বংস ঘটনাগুলি দেখছিলাম। সাতানব্বই সালে পৃথিবীর দুটি বড় বড় নির্বোধ দেশ একজন আরেকজনকে ধ্বংস করার জন্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। কোনো-একটি অজ্ঞাত কারণে একটি মিসাইলও মাটি ছেড়ে উপরে ওঠে নি।

আশ্চর্য।

হ্যাঁ, একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রীন হাউস এফেক্ট-এর জন্যে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমস্ত পৃথিবী ডুবে যাবার কথা ছিল। কোনো-এক অজ্ঞাত কারণে সে-সময়ে হঠাৎ কএ পৃথিবীর সমস্ত সবুজ গাছপালা সালোকসংশ্লেষণে দ্বিগুণ পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা শুরু করায় পৃথিবী রক্ষা পেয়েছে।

নীষ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি এটা জানতাম।

তুমি নিশ্চয়ই কিনিকা ধূমকেতুর কথা পড়েছ? সেটি পৃথিবীকে আঘাত করে কক্ষচ্যুত করে ফেলার মতো বড় ছিল। কিন্তু ইউরেনাসের কাছে এক আশ্চর্য কারণে সেটি বিস্ফোরিত হয়ে গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। গত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে একটা আশ্চর্য রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়, এতে মানুষের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ হয়ে যেত। রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিজে থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল।

আশ্চর্য।

হ্যাঁ, এরকম অসংখ্য আশ্চর্য ঘটনা আছে, মূল কম্পিউটার সেগুলি খুঁজে বের করছে। তুমি দেখতে চাইলে দেখতে পার। জিবান হাত দিয়ে মনিটরকে স্পর্শ করামাত্র কম্পিউটারটি দেয়ালে ঘটনাগুলো লিখতে লিখতে হালকা স্বরে পড়তে থাকে। জিবান বললেন, সবগুলো শুনতে চাইলে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে, সব মিলিয়ে এরকম প্রায় ছয় শ ঘটনা আছে।

নীষ মিনিট দশেক দেখেই কম্পিউটারটিকে থামিয়ে দিলেন। তাঁর দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছে। তিনি জিবানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তার মানে তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলে?

হা। এই কাচের অ্যাম্বুলটা ভাঙার চেষ্টা করে এখন পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়েছি। এখন আমি জানি এবং তুমিও জান, কেউ-একজন আমাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।

তার মানে–

তার মানে আমরা একটা ল্যাবরেটরির ছোট ছোট গিনিপিগ। আমাদের দিয়ে কেউ একজন একটা পরীক্ষা করেছে। যে বা যারা এই পরীক্ষাটা করছে, তারা লক্ষ রাখছে নির্বোধ গিনিপিগগুলো যেন কোনোভাবে মারা না যায়।

নীষের নিজেকে একটা নির্বোধ মনে হল, তবু তিনি প্রশ্নটা না করে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী পরীক্ষা করছি?

জিবান আবার হাসলেন, বললেন, আমরা কোনো পরীক্ষা করছি না, আমাদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে।

সেটি কি?

আমি এখনো নিশ্চিত জানি না সেটি কী। এই মুহূর্তে মূল কম্পিউটার সেটি বের করার চেষ্টা করছে। পৃথিবীতে মানুষের যত অবদান, সবগুলোকে নিয়ে সে একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করছে। লক্ষ করছে তার ভিতরে কোনো লুকানো সাদৃশ্য আছে কি না, কোনোভাবে সেগুলো অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কি না। অসংখ্য রাশিমালা নিয়ে অনেক জটিল হিসেব করতে হচ্ছে বলে কম্পিউটারের এত সময় লাগছে। কাল ভোরের আগে উত্তর বের করার কথা, কিন্তু আমি মোটামুটি জানি, উত্তর কী হবে। তুমিও নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছ।

হ্যাঁ। নীষ মাথা নাড়লেন, জ্ঞান-সাধনা?

ঠিক বলেছ। মানব জাতির ইতিহাস হচ্ছে তার জ্ঞান সাধনার ইতিহাস, অথচ কী লজ্জার কথা, সেটি আসলে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ।

নীষ হঠাৎ মাথা তুলে বললেন, আমাকে তুমি এটা জানিয়েছ কেন? নিজের অজ্ঞাতেই তার কণ্ঠে ক্ষোভ ফুটে ওঠে।

আমি ছাড়াও আরো কেউ এটা জানুক।

কেন?

আমার যদি কোনো কারণে মৃত্যু হয়, অন্তত আরেকজন মানুষ এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে।

নীষ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে একা বসে খানিকক্ষণ ভাবতে হবে। আমি যাই।

যাও।

নীষ দরজার কাছ থেকে ঘুরে এসে জিবানকে বললেন, এই অদৃশ্য শক্তি, যারা আমাদের ব্যবহার করছে, তারা তোমাকে মেরে ফেলল না কেন? যেই মুহূর্তে তোমার মাথায় সন্দেহটুকু উঁকি দিয়েছে–

আমি নিজেও এটা নিয়ে ভেবেছি, হয়তো তাদের চিন্তাধারা আর আমাদের চিন্তাধারার তুলনা করা যায় না। হয়তো আমরা যেভাবে ভাবি, আমাদের যে ধরনের যুক্তিতর্ক, তাদেরটা সে রকম নয়, অন্যরকম অনেকটা যেন মানুষ আর পিঁপড়া। আমি যদি অনেকগুলো পিঁপড়াকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করি আর হঠাৎ দেখি একটা পিঁপড়া বোকার মতো একটা কাজ করছে, যেটা দিয়ে অন্য সবগুলো পিঁপড়া মারা যাবে, আমি তখন কী করব? আমি সেই পিঁপড়াটাকে বোকার মতো কাজ করতে দেব না। কিন্তু পিঁপড়াটাকে তো মেরে ফেলব না, সেটাকে ছেড়ে দেব। নির্বোধ প্রাণী, ওকে মেরে লাভ কি?

নীষ চিন্তিত মুখে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, শুনলেন, জিবান ক্ষোতের সাথে বলছেন, আমার দুঃখ, কেউ-একজন আমাকে নির্বোধ হিসেবে জানে!

 

নীষ সারা রাত তাঁর বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। কিম জিবানের সাথে কথা বলার পর হঠাৎ তাঁর সমস্ত জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে। সারা জীবন জ্ঞানের অন্বেষণে কাটিয়েছেন, অজানাকে জানার যে-অদম্য তাড়না তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটি কোনো-এক বুদ্ধিমান প্রাণীর নির্দেশ। এই সত্যটি তিনি কোনোমতে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর কাছে এই জীবনের আর কোনো মূল্য নেই। তিনি দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন।

নীষের মাথায় হঠাৎ একটি প্রশ্ন জেগে ওঠে। এই যে বুদ্ধিমান প্রাণী, যারা মানবজাতিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে, তারা ঠিক কী ভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে? নীষ আজীবন ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা চর্চা করে এসেছেন, মহাজাগতিক সংঘর্ষ কেন্দ্র তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা, কোনো জটিল পরীক্ষা করায় তাঁর যে অচিন্তনীয় ক্ষমতা রয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই। তিনি নিজেকে সেই অদৃশ্য বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে কল্পনা করলেন, তিনি যদি মানবজাতির সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন, তা হলে তিনি কী করতেন? ধরা যাক তিনি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা প্রাণী, মানুষের আচার-ব্যবহার চিন্তাধারা যুক্তিতর্ক সবকিছু ভিন্ন। তিনি সেটা বোঝেন না, তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব না। পিঁপড়া যেরকম কীটপতঙ্গের তুলনায় বুদ্ধিমান। কিন্তু মানুষ কখনো পিঁপড়ার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে না, অনেকটা সেরকম। তিনি এরকম অবস্থায় মানুষের সাথে কী ভাবে যোগাযোগ রাখতেন?

কেন? এ তো খুবই সহজ। নীষ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন, মানুষের মতো কাউকে পাঠানো হবে, সে মানুষের সাথে মানুষের মতো থাকবে, তার ভিতর দিয়ে সব খোঁজ খবর নেয়া হবে।

নীষ উত্তেজিত হয়ে পায়চারি শুরু করেন, কে সে মানুষ, কোথায় আছে সে? নীষের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, নিশ্চয়ই সেই মানুষ সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকবে, এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কী আছে? দশজন সদস্যের সবাইকে তিনি চেনেন, সবার সাথে ঘনিষ্ঠতা নেই, থাকা সম্ভবও নয়, কিন্তু সবাইকে খুব ভালো করে চেনেন। এদের মাঝে কে হতে পারে? মহামান্য লী? অসাধারণ প্রতিভাবান গণিতবিদ রু লুকাস? জীববিজ্ঞানী রুখ কিংবা শান সোয়ান? নাকি জ্যোতির্বিদ পল কুম? কে হতে পারে?

কী আশ্চর্য! নীষ ভাবলেন, আমি মূল কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করি না কেন? মূল কম্পিউটারে প্রত্যেকের জীবন-ইতিহাস আছে। একনজর দেখলেই বেরিয়ে পড়বে।

নীষ ছটে বসার ঘরে গেলেন। মনিটরকে স্পর্শ করে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিলের দশজন সদস্যের জীবন-ইতিহাস জানতে চাইলেন মূল কম্পিউটারের কাছে। মূল কম্পিউটার আপত্তি জানাল, এটি গোপনীয়। তিনি জানতে চাইলে তাকে তার গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতে হবে। নীষ ধীরে ধীরে নিজের গোপন সংখ্যা প্রবেশ করালেন। এর জন্যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে তাঁকে নিজের হাতে নিজের প্রাণ নিতে হবে, কিন্তু একবারও তাঁর সে-কথাটি মনে হল না। নীষ একজন একজন করে প্রত্যেকের জীবন-ইতিহাস দেখতে থাকেন। তাঁর নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসে। হাত অল্প কাঁপছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিন্তু তিনি জানেন, আজ তিনি বের করবেন কে সেই লোক। কে সেই আশ্চর্য বুদ্ধিমান-জগতের গুপ্তচর।

 

বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ পরিষদের জরুরি সভা বসেছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানী গোলটেবিল ঘিরে বসেছেন। তাঁদের মুখে মৃদু হাসি, তাঁরা নিচু স্বরে গন্ধ করছেন, এই মুহূর্তে তাঁদের সারা পৃথিবীতে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে, তাই এই অভিনয়টুকুর প্রয়োজন। কিছুক্ষণের মাঝেই কোয়ার্টজের দরজাটি বন্ধ হয়ে তাঁদের সারা পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলল। সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা গম্ভীর হয়ে সোজা হয়ে বসলেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সভার কোনো নিয়ম নেই, মহামান্য লী সভাপতি হিসেবে এটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার চেষ্টা করেন। আজ তিনিই সবার আগে কথা বললেন, তোমরা সবাই জান, গত ছত্রিশ ঘণ্টায় মূল কম্পিউটারে তিনবার গোপন সংখ্যা প্রবেশ করানো হয়েছে। জিবান দুর্বার, নীষ একবার।

আমার মনে হয়—জীববিজ্ঞানী রুখ বললেন, গোপন সংখ্যা প্রবেশ করানোর নিয়মটি তুলে দিতে হবে। জিবান সেটি যে-জন্য ব্যবহার করেছ—

রুখকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জিবান বললেন, তোমরা এক সেকেন্ড থেকে আমাকে কথা বলতে দেবে?

রুখ আবার শান্ত স্বরে বললেন, আমার মনে হয়, যখন একজন কথা বলছে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরেকজনের অপেক্ষা করা উচিত। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য হিসেবে–

ধেত্তেরি তোমার সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদ। জিবান টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বললেন, আমার কথা আগে শেষ করতে দাও। তিনি পকেট থেকে একগাদা কাগজ বের করে টেবিলের মাঝখানে ছুড়ে দিয়ে বললেন, এখানে সবকিছু লেখা আছে, দেখতে চাইলে দেখতে পার, কিন্তু এখন খামোকা সময় নষ্ট না করে আমার কথা শোন। আমি কিছুদিন থেকে সন্দেহ ছিলাম মানবজাতি আসলে এক ধরনের উন্নত প্রাণীর লাবরেটরি পরীক্ষা। গতকাল আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি, যে-পরীক্ষা করে সন্দেহ মিটিয়েছি সেটি খুব সহজ, তোমরাও দেখতে পার। জিৰান পকেট থেকে লিটুমিন বোনাসিয়াসের অ্যাম্পলটা বের করলেন, এই বিষ দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব, পাতলা একটা কাচের অ্যাম্পুলে আছে, টাকা লাগালেই ভেঙে যাবার কথা। কিন্তু এটাকে ভাঙা সম্ভব না, কেউ-একজন এটাকে ভাঙতে দিচ্ছে না, তোমরা চেষ্টা করে দেখতে পার। জিবান অ্যাম্পুলটা টেবিলের উপর ছুড়ে দিলেন, সবাই রুদ্ধশ্বাসে অ্যাম্পুলটিকে লক্ষ করে, অ্যালটি সত্যি ফেটে না গিয়ে একটি রবারের বলের মতো বারকয়েক লাফিয়ে টেবিলের মাঝখানে স্থির হয়ে যায়।

মাহামান্য লী হাত বাড়িয়ে অ্যালটি তুলে নেন, চোখের কাছে নিয়ে সেটিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে পাশে বসে থাকা শান সোয়ানের হাতে দেন। একজন একজন করে সবাই অ্যাম্পুলটি দেখেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই, জিবান সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, এই প্রাণী আমাদের ব্যবহার করছে জ্ঞান সংগ্রহের জন্যে। আমি নিজেও তাই সন্দেহ করেছিলাম, আজ ভোরে মূল কম্পিউটারও তার গবেষণা শেষ করে আমাকে এটা জানিয়েছে। তোমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে আমি তার রিপোর্ট পাঠিয়েছি, ইচ্ছে হলে দেখতে পার। জিবান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার কথা শেষ, এখন তোমাদের যা ইচ্ছে হয় কর।

সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। মহামান্য লী আস্তে আস্তে বললেন, তার মানে আমাদের এই জ্ঞান-সাধনা–

বাজে কথা! সব ওদের একটা ল্যাবরেটরি পরীক্ষা। আমরা মানুষেরা যে সৃষ্টির পর থেকে শুধু জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করছি, তার কারণ, কেউ একজন আমাদের বলে দিয়েছে, এটা কর। কী লজ্জার কথা। মানুষের আসল ব্যবহার কী, কে জানে।

সবাই একসাথে কথা বলার চেষ্টা করে, নীষের গলা সবচেয়ে উপরে উঠে সবাইকে থামিয়ে দেয়। নীষ বললেন, জিবান আমাকে ব্যাপারটি বলার পর থেকে আমি বের করার চেষ্টা করছিলাম সেই উন্নত প্রাণী মানুষের সাথে কী ভাবে যোগাযোগ রাখে। আপনারা চিন্তা করলে নিজেরাই বের করতে পারবেন, সবচেয়ে সহজ হয়। মানুষের চেহারার একটা-কিছু তৈরি করে মানুষের মাঝে ছেড়ে দিলে। যেহেতু আমাদের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিল নামে একটা সংগঠন রয়েছে, কাজেই আমার ধারণা, মানুষের চেহারার সেই উন্নত প্রাণীদের গুপ্তচর এই বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকবে।

বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্যরা ভয়ানক চমকে নীষের মুখের দিকে তাকালেন। মহামানা লী বললেন, তুমি বলতে চাও–

নীষ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করে আমি গতরাতে আপনাদের সবার জীবন-ইতিহাস, আপনাদের ব্যক্তিগত দিনলিপি পড়েছি, আমি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আমার ধারণা ছিল আমি সেখান থেকে বের করতে পারব, কারণ আমি ধরে নিয়েছিলাম, যে উন্নত প্রাণীদের গুপ্তচর, সে নিজে সেটি জানে। কিন্তু সেটা সত্যি নয়।

জিন অধৈর্য হয়ে বললেন, তুমি কি শেষ পর্যন্ত বের করতে পেরেছ?

হ্যাঁ।

কে সেই লোক?

আমি।

ঘরের ভিতরে বাজ পড়লেও কেউ বুঝি এত অবাক হত না। কয়েক মুহূর্ত লাগে সবার ব্যাপারটি বুঝতে। জিবান কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি কী ভাবে জান তুমিই সেই লোক? হয়তো তুমি ভুল করেছ, হয়তো

নীষ ম্লান মুখে হাসলেন, আমি নিজেও তাই আশা করছিলাম। কিন্তু আমিই আসলে সেই গুপ্তচর, আমাকে দিয়েই সেই উন্নত প্রাণী পৃথিবীর খোঁজখবর নেয়। বিশ্বাস কর তোমরা, আমি নিজে সেটা জানতাম না। যখন জেনেছি, নিজেকে এত অপরাধী মনে হয়েছে যে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।

নীষ নিজের শার্ট খুলে দেখালেন, বুকে গুলির দাগ, রক্ত শুকিয়ে আছে। বললেন, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে দুটি গুলি পাঠিয়েছি, কিন্তু তবু আমি মারা যাই নি। সেই উন্নত প্রাণী যতক্ষণ না চাইলে আমি মারা যেতে পারব না, আমাকে বুকে গুলি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। নয় আস্তে আস্তে নিজের চেয়ারে বসলেন, মাথা নিচু করে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আস্তে আস্তে তিনি টেবিলে মুখ ডেকে হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।