অতঃপর কিরীটীর মুখেই শোনা বর্তমান কাহিনীর আদিপর্বটা হচ্ছে:
বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাধেশ রায়, যার মাসিক আয় কমপক্ষে আট থেকে দশ হাজার টাকা, তাঁরই একমাত্র মাতৃহারা পুত্র নব্য ব্যারিস্টার, বাপেরই জুনিয়ার অশোক রায়। এবং কিরীটীর বর্ণিত কাহিনীটা তাঁরই সম্পর্কে।
বছর তিনেক হবে মাত্র অশোক রায় বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসে বাপের জুনিয়র হিসেবেই আদালতে যাতায়াত শুরু করেছেন।
এবং বাপের তদ্বিরে ও চেষ্টায় আয়ও হতে শুরু করেছে।
বুদ্ধিদীপ্ত, স্মার্ট এবং অত্যন্ত ভদ্র প্রকৃতির ছেলেটি। দেখতে-শুনতেও সুপুরুষ। এখনও বিবাহ করেননি। তবে গুজব শোনা যাচ্ছে হাই-সোসাইটি-গার্ল, বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট স্বর্গীয় ডাঃ অমল সেনের সুন্দরী তরুণী কন্যা মিত্রা সেনের সঙ্গে নাকি কিছুদিন যাবৎ একটা ঘনিষ্ঠতা দেখা দিয়েছে অশোক রায়ের।
সেই সূত্র ধরেই অভিজাত মহলে এমন কথাও কানাকানি চলেছে যে, এতকাল পরে সত্যি সত্যি নাকি বোহেমিয়ান মিত্রা সেন ঘব বাঁধবেন কিনা সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করেছেন।
মিত্রার বাবা ডাঃ অমল সেন, ডি.এ.সি. একদা ইণ্ডিয়ান এড়ুকেশন সার্ভিসে ছিলেন, রিটায়ার করে আবার সরকারী বিশেষ একটি দপ্তরেই আরও বেশি মাহিনায় নতুন পোস্টে দিল্লীতে জয়েন করেছিলেন কিন্তু বেশিদিন তাঁর সে চাকরি করবার সুযোগ হয়নি। গত বৎসর মারা গিয়েছেন হঠাৎ রক্তচাপের ব্যাধিতে স্ট্রোক হয়ে।
এবং মৃত্যুকালে তিনি বেশ একটামোটা টাকার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স ও কলকাতার উপরে বালিগঞ্জ অঞ্চলে চমৎকার একখানা বাড়ি রেখে গিয়েছেন।
তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে ঐ মিত্রা।
মিত্রাই সবার কনিষ্ঠ।
ডাঃ সেনের দুই ছেলেই অর্থাৎ মিত্রার দুই দাদা একজন নামকরা অধ্যাপক ও একজন ইনজিনীয়র বড় চাকুরে। বাপের সঞ্চিত অর্থ তো ছিলই, নিজেরাও বেশ ভালই অথোপার্জন করেন দুই ভাইই। কাজেই সংসারে সচ্ছলতার অভাব নেই। মিত্রার আট বৎসর বয়সের সময় তার মা মারা যায়। বর্তমানে মিত্রার বয়স ত্রিশ হলেও প্রায় কাছাকাছি, যদি কেউই সে সংবাদটি জানে না। কারণ দেখলেও বোঝবার উপায় নেই। মিত্রা এম. এ. পাস। দেকতে বা তার গাত্রবর্ণ যাই হোক না কেন, চোখেমুখে চলনে-বলনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে তার। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছিপছিপে মেয়েটি হাই-সোসাইটির মধ্যমণি হিসাবে বিরাজ করছে অনেক দিন ধরে। বৌদিরাও মিত্রাকে ভালবাসে এবং তার দাদারাও মিতা বলতে অজ্ঞান। স্নেহে একেবারে অন্ধ। বালিগঞ্জে লেক টেরেসে বৈকালী সাঞ্জ ক্লাবের সঙ্ঘমিত্রা মিত্রা সেন। তাছাড়া কোন এক বেসরকারী কলেজের অধ্যাপিকাও। বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাবের মেম্বার হচ্ছে অভিজাত ধনী সম্প্রদায়ের ছেলে ও মেয়েরা।
সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রবেশ সেখানে অসম্ভব, কারণ চাঁদের হার প্রতি মাসে একশতর নিচে নয়।
তরুণ ব্যারিস্টার অশোক রায় ঐ বৈকালী সঙ্ঘের একজন নিয়মিত সত্য। কোর্ট হতে ফিরে সন্ধ্যার পর নিজের গাড়ি নিয়ে সে বের হয়ে যায়, ফেরে কোন রাতেই সাড়ে এগারোটার আগে নয়। অশোক রায় সম্পর্কে খোঁজ করতে করতেই সব জানা গিয়েছে।
অশোক রায় ঘটিত ব্যাপারটা অবশ্য কিরীটীর মুখেই আমার শোনা এবং বলাই বাহুল্য বিচিত্রও। বিখ্যাত ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের সঙ্গে বছর চারেক আগে কিরীটীর একটা জাল দলিলের মামলার ব্যাপারে আলাপ-পরিচয় হয় এবং ক্রমে সেই আলাপ-পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। পূর্বেই বলেছি ঘটনার আদিপর্বটা কিরীটীর মুখ থেকেই শোনা, তাই কিরীটীর জবানিতেই বলছি:
সন্ধ্যার দিকে একদিন রাধেশ রায় আমাকে ফেন করলেন: রহস্যভেদী, কাল সন্ধ্যার পর এই ধরুণ গোটা আট-নয়ের সবয় আপনি ফ্রি আছেন কি?
কেন বলুন তো? আসুন না। অনেককাল দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। একসঙ্গে ডিনার খাওয়া যাবে আর গল্পসল্পও করা যাবে।
ব্যারিস্টার রাধেশ রায় যে কি ব্যস্ত মানুষ তা আমার অজানা নয়। রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তাঁর চেম্বারে মক্কেলের ভিড় থাকে আর রাত্রেও বারোটা-একটা পর্যন্ত লাইব্রেরি ঘরে বসে তিনি নিয়মিত পড়াশুনা করেন।
তাই হাসতে হাসতে বললুম, ব্যাপার কি বলুন তো? ভূতের মুখে রাম-নাম!
না, না, আসুন না—সত্যিই just a social call! ফোনেই বললেন রাধেশ রায়। কিন্তু বিশ্বাস হল না সম্পূর্ণরূপে ব্যারিস্টারের কথাটা।
যা হোক পরের দিন ঠিক রাত নটায় বালিগঞ্জ প্লেসে রাধেশ রায়ের বিরাট ভবনের সামনে গাড়ি থেকে নামলাম।
চেম্বারে প্রবেশ করে দেখি সব চেয়ার খালি, আশ্চ! কেবল আবেশ রায়ের পাসোন্যাল টাইপিস্ট হিমাংশু একা আপন মনে বসে খটখট করে কি সব টাইপ করে চলেছে মেশিনে।
হিমাংশুঁকেই প্রশ্ন করলাম; ব্যারিস্টার সাহেব কোথায়?
হিমাংশু টাইপ করা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনিই কি মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
বসুন—পরক্ষণে সে ভিতরে গিয়ে কলিংবেল টিপতেই ভিতর থেকে একজন উর্দিপরা বেহারা এসে দাঁড়াল।
হিমাংশু তাকে আমার আসবার সংবাদ সাহেবকে দিতে বলল।
মিনিট পাঁচেক বাদে ব্যারিস্টার সাহেবের খাস ভৃত্য কানু এসে বললে, সাহেব আপনাকে উপরে যেতে বললেন, চলুন।
চল।
কানুকে অনুসরণ করে পুরু কার্পেট মোড়া সিঁড়ি অতিক্রম করে দোতলায় টানা বারান্দার শেষ ও দক্ষিণ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইতিপূর্বেও বাড়িতে গেলে ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে বাইরের ঘরে বসেই গল্পসল্প হত। উপরে উঠলাম এই প্রথম।
দরজার পর্দা তুলে কানু আহ্বান জানাল, আসুন।
ব্যারিস্টার সাহেবের শয়নকক্ষ। মেঝেতে পুরু নরম কার্পেট এবং ঘরে বহু মূল্যবান সব আসবাবপত্র, রুচি ও আভিজাত্যের চমৎকার সমম্বয় সর্বত্র।
ঘরের সংলগ্ন একটি চারিদিকে খোলা ছাদের মত জায়গা। মাথার উপরে অবশ্য খানিকটা আচ্ছাদন আছে। চারিদিকে ফুলের, পাতাবাহারের ও পামট্রির টব বসান। ছোটখাটো একটা নাশারী বললেও চলে।
একধারে একটি সুদৃশ্য গোল টেবিল, তার পাশে দুটি গদি-আঁটা চেয়ার। এখামা মাত্র খালি এবং অন্য একটিতে বসে আছেন ব্যারিস্টার সাহেব স্বয়ং।
টেবিলের উপরে সাদা দুধের মত ডোমে ঢাকা একটি বৈদ্যুতিক টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। মধ্যিখানে একটি ২৩ অংশ পূর্ণ ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট স্কচ হুইস্কির কালো রঙের বোতল, সোডা সাইফন, একটি খালি পেগ গ্লাস ও পূর্ণ একটি পেগ গ্লাস।
পদশব্দে ব্যারিস্টার মুখ তুলে তাকালেন, আসুন রহস্যভেদী, বসুন।
তারপরেই কানুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, কানু, বাইরের দরজায় বসে থাক। যতক্ষণ না ডাকি তোকে, এদিকে আসবার দরকার নেই।
আচ্ছা। কানু জবাব দেয়।
হ্যাঁ, কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে ফোন এলে হিমাংশুই ধরবে—সে আমার লাইব্রেরি ঘরে আছে।
কানু চলে গেল।
মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে ব্যারিস্টার সাহেবের দিকে তাকালাম।
পরিধানে সাদা ফ্লানেলের পায়জামা ও ডিপ কালো রঙের কিমনো।
শোনা যায় প্রথম যৌবনে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন নাকি রাধেশ রায়। এখনও অবশ্যি বয়স হলেও সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। উজ্জ্বল গৌর গাত্র-বর্ণ। প্রশস্ত কপাল। মাথার দুপাশে একটু টাক পড়েছে। রগের দু-একটা চুলে পাক ধরেছে। খড়ের মত উন্নত নাসা। দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ। কঠিন ধারালো চিবুক।
মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো, চোখেসোনার ফ্রেমে প্যাঁসনে।
আমাকে কিছু না বললেও তাঁর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকতেই বুঝতে কষ্ট হল না সমগ্র সেই মুখখানা ব্যেপে পড়েছে যেন কিসের একটা চিন্তার সুস্পষ্ট ছায়া।
Have a peg-রাধেশ রায় বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে।
দিন তবে ছোট একটা, জবাব দিলাম।
রাধেশ রায় নিজেই শূন্য পেগ গ্লাসটিতে লিকার ঢেলে সোডা সাইফনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
সোডা আমিই মিশিয়ে নিলাম।
Best of luck!
পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে দুজনেই আমরা গ্লাসে চুমুক দিলাম। মিনিট পাঁচ-সাত তারপর নিঃশব্দেই কেটে গেল।
মাঘের মাঝামাঝি হলেও শীতের তীব্রতা তেমন অনুভূত হয় না। ঝিরঝিরে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। মিশে আছে বায়ুতরঙ্গে মিষ্টি ফুলের নাম-না-জানা একটা পাতলা গন্ধ।
টেবিল-ল্যাম্পের আলো উপবিষ্ট ব্যারিস্টারের চোখে মুখে কপালে এসে পড়েছে। হাতদুটো কোলের উপরে ভাঁজ করা।
বসবার ভঙ্গিটা যেন কেমন শিথিল অসহায় বলে মনে হয়।
বুঝতে পারছিলাম, রাধেশ রায় আজ রাত্রে বিশেষ কিছু বলবার জন্যই এভাবে আমায় ডেকে এনেছেন। কিন্তু যে কারণেই হোক সংকোচ বোধ করছেন। চেষ্টা করেও যেন সংকোচ বা দ্বিধাটুকু কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। আমিও তাঁকে সময় দিতে লাগলাম। যা বলবার উনি নিজে থেকেই বলুন। সংকোচ ওঁর কেটে যাক। বলতেই যখন চান। ওদিকে তাঁর গ্লাস নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, আবার গ্লাস ভর্তি করে নিলেন।
দ্বিতীয় গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেটে নিয়ে এবারে আমার দিকে তাকালেন, তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললেন, রহস্যভেদী, আপনার তীক্ষ্ণ বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুভূতির উপরে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। বুঝতে পারছি না ঠিক তবে মনে হচ্ছে something somewhere wrong! To tell you frankly, I want your help!
কি ব্যাপার? মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম।
You know my son অশোক! Recently I dont know why but I feel much worried about him!
একটু বেশ আশ্চর্য হয়েই রাধেশ রায়ের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর একটু থেমে মৃদুকণ্ঠে বললাম, কি ব্যাপার বলুন তো? আমি তো যতদূর শুনেছি আজকাল অশোকবাবু বেশ promising in the Bar—কতকটা যেন আশা দেবারই চেষ্টা করি।
হ্যাঁ হ্যাঁ—তা জানি। কিন্তু সব কথা বলবার আগে একটা কথা আপনাকে আমি বলতে চাই মিঃ রায় বিশেষ করে শেষের দিকে একটু যেন থেমেই কথাগুলো বললেন ব্যারিস্টার।
বলুন? ওঁর মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করি।
সব কথা বলবার আগে যে কথা বিশেষ করে বলতে চাই মিঃ রায়, অশোক যেন এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কিছু না জানতে পারে। আশা করি বুঝতেই পারছেন, সে আমার একমাত্র ছেলে। মা নেই, বড় অভিমানী।
সংকোচটা যেন ব্যারিস্টার সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
নিশ্চিন্ত থাকুন। আশ্বাস দিই ব্যারিস্টারকে।
অবশ্য সেটা আমি জানি বলে আপনাকেই আমি এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য ডেকে এনেছি মিঃ রায়।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেল। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।
কেবল ব্যারিস্টার সাহেব মধ্যে মধ্যে পেগ-গ্লাসটা তুলে চুমুক দিতে লাগলেন নিঃশব্দে। মুখ দেখে বোঝা যায় অন্যমনস্ক হয়ে বুঝি কি ভাবছেন। মনে মনে নিজেকেই নিজে যেন যাচাই করে চলেছেন।
অশোক কয়েক মাস ধরে দেখছি যেন একটু বেশি খরচ করছে! হঠাৎ আবার ব্যারিস্টার সাহেব কথা বললেন।
তা অল্প বয়েস; বিয়ে-থা করেননি, যথেষ্ট ইনকাম করেন, কোনো liabilities-ও নেই—তাছাড়া এই তো খরচ করবার সময়। হাসতে হাসতে জবাব দিই।
বাধা দিলেন ব্যারিস্টার, না না—ঠিক তা নয় মিঃ রায়। যতই খরচ করুক সে, তিন-চার হাজার টাকা একজনের মাসে pocket expense—একটু কি বেশিই বলে মনে হয় না আপনার?
তিন-চার হাজার! এবারে সত্যি বিস্ময়ের পালা আমার।
হ্যাঁ। না হলে আর বলছি কি? আমার আর অশোকের অ্যাকাউন্ট অবশ্য আলাদা। জীবনে স্বাবলম্বনের চিরদিন আমি বিশেষ পক্ষপাতী তাই তার নামে বিলেত থেকে সে ফিরবার পরই হাজার পঞ্চাশ টাকা দিয়ে starting একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। তার কাছ থেকে কোনদিনই কোন কিছু আমি আশা ও করি না এবং তার রোজগার ও খরচ সম্পর্কেও কোনদিন খোঁজ-খবর নেবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। কিন্তু মাত্র দিন আষ্টেক আগে হঠাৎ ভুল করে, just by mistake, তার ব্যাঙ্কের একখানা চিঠি আমি খুলতেই ব্যাপারটা আমার নজরে পড়ল।
কি রকম?
তাই তো বলছি।
আমি আবার ব্যারিস্টার সাহেবের মুখের দিকে তাকালাম।
রাধেশ রায় আবার বলতে শুরু করলেন যেন একটু থেমেই, একসঙ্গে গত তিন মাসের statement of account এসেছে
অশোকই মনে হয় চেয়ে পাঠিয়েছিল ব্যাংকে। এবং just out of curiosity সেই statement of account-টা দেখতে গিয়েই নজরে পড়ে গেল আমার প্রত্যেক মাসে সে প্রায় তিন-চার হাজার করে টাকা ড্র করেছে। এবং গত প্রত্যেক মাসের দশ তারিখে একটা করে আড়াই হাজার টাকার self-draw আছে। আমি তো চমকে গেলাম। প্রত্যেক মাসে তার এত অর্থের কি প্রয়োজন থাকতে পারে? আর প্রত্যেক মাসের দশ তারিখে ঐ আড়াই হাজার টাকাই বা draw করা হচ্ছে কেন? ব্যারিস্টার বলতে বলতে থামলেন বোধ হয়। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবার জন্যই।
কোনো heavy insure বা payment-ও তো থাকতে পারে। বললাম আমি।
Nothing of that kind! ওর কোন insure-ই নেই। যা হোক—কেমন মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মিঃ ওয়াটসন আমার বিশেষ বন্ধু ও অনেক দিনের পরিচিত। Irang him up। সে যা বললে, তাতে বিস্ময় যেন আরও বাড়ল। সে বললে, গত এক বৎসর ধরেই নাকি অশোক প্রতি মাসের দশ তারিখে নিজে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ঐ আড়াই হাজার টাকা self-cash করে নিয়ে আসে।
হুঁ।
বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কি রকম delicate! যা হোক আমি দুটো দিন ব্যাপারটা নিজে নিজেই ভাববার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো conclusion-এই পৌঁছতে পারলাম না। যতই আমার সন্দেহ বাড়তে লাগল, সেই সঙ্গে ঔৎসুক্যও বাড়তে লাগল। যদিও ব্যাপারটা বিশ্রী, তবু তলে তলে গোপনে আমি তার উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না রেখে থাকতে পারিনি।
ব্যারিস্টার সাহেব তাঁর বক্তব্য শেষ করে নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, মিঃ রায়, বুঝতে পারলেন কিছু?
সাগ্রহে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম আবার।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ কেটে গেল। তারপরই আমি এবারে প্রশ্ন করলাম, এমনও তো হতে পারে তাঁর কোনো প্রাইভেট লোক বা কাউকে তিনি ঐ টাকাটা দিয়ে থাকেন, মানে বলছিলাম কি কোনো সৎ প্রতিষ্ঠানে হয়ত বা সাহায্য করে থাকেন।
ব্যারিস্টার আমার প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। সম্মুখে টেবিলের উপরে রক্ষিত এবং ক্ষণপূর্বে নিঃশেষিত পেগ-গ্লাসটার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন শুধু স্তব্ধ হয়ে।
কিছুক্ষণ আবার স্তব্ধভাবে কেটে গেল।
ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করলেন ব্যারিস্টার, সে রকম কিছুই না। বলে একটু চুপ করে থেকে পুনরায় শুরু করলেন, কয়েকটা ব্যাপারকে জীবনে আমি নিরতিশয় ঘৃণা করে এসেছি মিঃ রায়। অন্যের চিঠি লুকিয়ে পড়া, অন্যের গতিবিধির উপরে আড়াল থেকে গোপনে গোপনে নজর রাখা ও অন্যের ব্যাপারে অকারণ মাথা ঘামানো। পর তো কথাই নেই, এমন কি নিজের স্ত্রী-পুত্রের বেলাতেও না। কিন্তু এমনই দুর্দৈব যে, অশোক, আমার নিজের সন্তানের বেলায় তাই আমাকে করতে হল। এ যে আমার পক্ষে কত বড় লজ্জা ও দুঃখের কারণ হয়েছে মিঃ রায়, তা আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।
বেদনায় ও গ্লানিতে মনে হল ব্যারিস্টারের কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন বুজে আসছে। আর কেউ না হলেও আমি বুঝেছিলাম সমস্ত ব্যাপারটা ব্যারিস্টার রায়ের পক্ষে কতখানি বেদনার কারণ হয়েছে। এবং শুধু বেদনাই নয়, তাঁকে কতখানি সেই সঙ্গে বিচলিতও করেছে।
শূন্য পেগ-গ্লাসটায় কিছুটা আবার লিকার ঢেলে এবং তাতে সোড়া মিশিয়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে, এ মাসের দশ তারিখে আর নিজের কৌতূহলকে চেপে রাখতে পারলাম না। আমার এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, রুচি ও নীতি-বোধকে একপাশে ঠেলে রেখেই বেলা দশটা বাজবার কিছু আগে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক দশটায় দেখলাম অশোকের গাড়ি এসে ব্যাঙ্কের দরজার সামনে দাঁড়াল।
অশোক নিজেই ড্রাইভ করছিল। আর তার পাশে উপবিষ্ট দেখলাম একটি নারী।
নারী!
অর্ধস্ফুট ভাবে আপনা হতেই যেন কথাটা আমার কণ্ঠ হতে বের হয়ে এল।
হ্যাঁ। কিন্তু তার মুখ দেখতে পেলাম না। মাথায় অল্প ঘোমটা টানা। কেবল একখানা চুড়ি-পরা হাত গাড়ির দরজার উপরে ন্যস্ত দেখতে পেলাম দূর থেকে। অশোক গাড়িটা এমন ভাবে পার্ক করে রেখেছিল আর আমার ট্যাক্সি এমন জায়গায় ছিল যে সেখান থেকে গাড়ির সামনের দিকটায় নজর পড়ে না। কেবল একটা সাইড দেখা যায় মাত্র। লজ্জায় ও সংকোচে গাড়ি থেকে নামতে পারলাম না। ভূতগ্রস্তের মতই গাড়ির মধ্যে বসে রইলাম আমি। মিনিট কুড়ি বাদে ব্যাঙ্ক থেকে অশোক বের হয়ে এল এবং গাড়িতে উঠে, স্পষ্ট দেখলাম, পার্শ্বে উপবিষ্ট সেই মেয়েটির হাতে নোটের বাণ্ডিলগুলো তুলে দিল। তারপর উটো পথে গাড়িটা বের হয়ে গেল।
গাড়িটা ফলো করলেন না কেন?
না, তা করিনি। ঘটনাটা আমাকে এমন বিল ও বিমূঢ় করে ফেলেছিল যে ঠিক ঐ সময়টাতে, যখন খেয়াল হল অশোকের গাড়ি আশেপাশে কোথায়ও নেই। তারপর দুটো দিন কেবল ভাবতে লাগলাম। আমার কেস-পত্র সব কোথায় পড়ে রইল। তৃতীয় দিনে অশোক যখন সন্ধ্যার পর চেম্বারে কেস সেরে রাত সাড়ে আটটায় বের হল তাকে ফলো করলাম ট্যাক্সি নিয়ে। কানুকে দিয়ে আগেই ডাকিয়ে এনে তার মধ্যে বসে অপেক্ষা করছিলাম গেটের অদূরে। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাবটা সম্পর্কে কিছু জানেন মিঃ রায়, মানে নাম শুনেছেন ক্লাবটার কখনও?
জানি, শুনেছি। লেক টেরেসে তো?
হ্যাঁ। সেখানে গিয়ে ঢুকল অশোক। রাত সাড়ে এগারোটায় বের হল ক্লাব থেকে। আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম এত রাত্রে ক্লাব থেকে বের হয়ে বাড়ি না ফিরে সে চলেছে পার্ক সার্কাসের দিকে।
পার্ক সার্কাসের দিকে? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই।
হ্যাঁ। এবারে তার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে।
অত রাত্রে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারে?
হ্যাঁ। তবে বাইরের দরজা তো বন্ধ ছিল; দোতলায় চেম্বারের ঘরেওকোনো আলোজ্বলছিল। সব অন্ধকার।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের সঙ্গে শুনেছি নার্সিং হোমও আছে, এমনও তো হতে পারে যে, অশোকবাবুর কোনো জানাশুনা রোগী নার্সিং হোমে ছিল, তাকেই তিনি দেখতে গিয়েছিলেন!
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? হতে পারে নার্সিং হোম, তাই বলে ওটা তো আর দেখা করতে যাবার সময় নয় ঐ মাঝরাত্রে! তাছাড়া সব দিক এই কদিন ধরে ভেবেচিন্তেই শেষ পর্যন্ত আপনার পরামর্শ নেওয়া স্থির করেই আপনাকে ডেকেছি মিঃ রায়। যাক শুনুন, অশোক গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে কলিং বেলের বোতাম টিপতেই কে যেন এসে দরজা খুলে দিল। অশোক ভেতরে প্রবেশ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর?
আধ ঘণ্টা বাদে অশোক চেম্বার থেকে বের হয়ে এল। তারপর অবিশ্যি সে বাড়ির দিকেই গাড়ি চালাল। তারপর তিন রাত অশোককে আমি গোপনে ফলো করেছি এবং প্রত্যেক বারেই দেখেছি সে বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাব থেকে বের হয়ে সোজা পার্ক সাকাসে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারেই যায়। শুধু এই নয়, আজ ছ-সাত মাস থেকেই লক্ষ্য করছি অশোকের কথায়বাতায়, তার চালচলনে, ব্যবহারে, এমন কি চেহারাতেও যেন একটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। অমন চমৎকার, উজ্জ্বল চেহারা ছিল ওর; যেন একটা কালো ছায়া পড়েছে তার ওপরে। সমস্ত দিন কেমন ঝিম মেরে থাকেমনে হয় যেন খুব ক্লান্ত। চিরদিন যে হাসিখুশী হৈ-হুল্লা করে চলত, সে যেন হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। অথচ রাত্রে ফেরবার পর যতক্ষণ
ঘুমোয় পাশের ঘর থেকে শুনি কখনও গুনগুন করে গান গাইছে বা শিস দিচ্ছে। একেবারে অন্য প্রকৃতির। কতবার ভেবেছে ওকে ডেকে খোলাখুলি সব জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু লজ্জা ও সংকোচ এসে বাধা দিয়েছে। ভেবে ভেবে যখন কোনো আর কূল-কিনারা পাচ্ছি না, হঠাৎ মনে পড়ল আপনার কথা। I am sure মিঃ রায়, এর পেছনে কোন একটা গোলমাল আছে। Somewhere something wrong! অশোক my only son। একমাত্র ছেলে ওই আমার। যেমন করে যে উপায়েই হোক এই দুশ্চিন্তা থেকে আপনি আমায় বাঁচান, মিঃ রায়। বলতে বলতে ব্যারিস্টার কিরীটীর একটা হাত চেপে ধরলেন। আবেগে ও উত্তেজনায় তাঁর ধৃত মুষ্টিটা যেন কাঁপছে থরথর করে তখন। চোখের কোলে অশ্রু।
ব্যস্ত হবেন না ব্যারিস্টার। কয়েক দিন সময় দিন; আর আমাকে একটু ভাবতে দিন।
কিন্তু একটা কথা, ও যেন ঘুণাক্ষরেও না কিছু সন্দেহ করে।
ভয় নেই আপনার। নিশ্চিন্ত থাকুন। দু-পাঁচ দিনের মধ্যেই আপনার সঙ্গে আমি দেখা করব।