প্ৰচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে জেগে উঠলাম। কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি? মনে করতে পারছি না। হয়তো দেখেছি। দুঃস্বপ্ন প্রায় সময়ই মনে থাকে না, কিন্তু তার প্রভাব মানুষকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৩৩৬.৭২৫২, এই ঘড়ি আমার কাছে এখনো অর্থহীন। শুধু জানি এই ঘড়ি মহাকাশযানের সময় বলছে। ৩৩৬.৭২৫২ ঘণ্টা আগে মহাকাশযান যাত্রা শুরু করেছে। যাত্রা শুরুর সময় ছিল শূন্য ঘণ্টা। এখানে আরো দুটি ঘড়ি আছে। একটিতে দেখান হচ্ছে পৃথিবীর সময়। সেখানে সময় প্রসারণ বা ডাইলেশনের ব্যাপারগুলি হিসাবের মধ্যে ধরা আছে। আমি সেই হিসাব বুঝি না। অবশ্যি বোঝবার চেষ্টাও করি না। কারণ ঘড়ির সময় বোঝা বা বোঝার চেষ্টা করা এখানে অর্থহীন। যেই মুহূর্তে হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়া হবে সেই মুহূর্তেই সময় অদ্ভুতভাবে জট পাকিয়ে যাবে। সেই জটের অর্থ উদ্ধার করা মানুষের পক্ষে এখনো সম্ভব হয় নি।
আমি বিছানা ছেড়ে নামলাম। তৃষ্ণা পেয়েছিল কয়েক ঢোক পানি খেলাম। অস্বস্তিটা কমল না, বরং বেড়ে যেতে লাগল। যেন বিরাট কিছু হতে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কিছু। নিজেকে একটু হালকা হালকাও লাগছে। কৃত্রিম উপায়ে মহাকাশযানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তৈরি করা হয়। এখানে ওজন শূন্যতা নেই। কিন্তু নিজেকে হালকা লাগছে কেন? আমি সুইচ টিপে তিশকে ডাকলাম। উদ্বিগ্ন গলায় বললাম, কিছু হয়েছে নাকি তিশ।
তিশ বলল, কী হবে?
আমার কী কারণে যেন খুব অস্বস্তি লাগছে।
এরকম সবারই মাঝে মাঝে লাগে। একে বলে গতিজনিত শারীরিক বিপর্যয়। আমাদের গতিবেগ এখন ৩,৪৩C, অর্থাৎ আলোর গতিবেগের প্রায় তেতাল্লিশ শতাংশ। গতিবেগ যখন ০-৬০ হবে বা তার চেয়ে বেশি হবে তখন শারীরিক বিপর্যয় শুরু হবে। হট বিট দ্রুত কমতে থাকবে, ব্লাড প্ৰেশার কমবে, বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং গায়ের তাপমাত্রা প্রায় সাত ডিগ্রীর মতো কমে যাবে। ভয়ের কিছু নেই, ওষুধপত্রের ভালো ব্যবস্থা আছে। আমি কি তোমাৱজন্যে ডাক্তার রোবটকে খবর দেব?
না।
আমাদের এই ডাক্তার রোবট মনোবিশ্লেষণের ব্যাপারেও এক জন বিশেষজ্ঞ। আমার মনে হয় তোমার উচিত তার সঙ্গে কথা বলা।
তুমি বিদেয় হও। তিশকে বিদেয় দিয়ে আমার অস্বস্তি আরো দ্রুত বাড়তে লাগল। যতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এই প্রথম বার মনে হল আমরা একটা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছি। কোনো এক আকৰ্ষণী শক্তির মধ্যে পড়ে গেছি–যার শক্তি অকল্পনীয়। আমার মনে হল মহাকাশযানের প্রতিটি পরমাণুর ওপর এই শক্তির অশুভ ছায়া পড়েছে। এই শক্তি যেন নিয়তির মতো অমোঘ। এর হাত এড়াবার কোনো উপায় নেই। অথচ মহাকাশযানের সব কিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে মনে হচ্ছে। আমার মাথার ওপর বিন্দুর মতো একটি আলো জ্বলছে, যার মানে মহাকাশযানে কোন যান্ত্রিক ক্ৰটি নেই। প্রতিটি যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে। তা তো হতে পারে না।
আমি নিজের ঘর ছেড়ে বেরুম। হলঘরে মিনিট খানেক কিংবা তার চেয়েও কিছু কম সময় দাঁড়িয়ে ভাবলাম কী করা উচিত। একবার মনে হল। আমার কিছুই করার নেই, যা হবার হোক। আমি বরং আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। এই ভাবনা দীর্ঘস্থায়ী হল না। আমি রওনা হলাম জন বরগের ঘরের দিকে। আগে থেকে যোগাযোগ না করে তাঁর ঘরে যাবার নিয়ম নেই, কিন্তু ততটা সময় মনে হচ্ছে আমার হাতে নেই।
আমি কি আসতে পারি জন বরগ?
এক মুহূর্তের জন্যে জন বরগের চোখে বিরক্তির ছায়া পড়ল। তিনি সেই বিরক্তি মুছে ফেলে বললেন, নিশ্চয়ই। যদিও মহাকাশ নীতিমালায় আপনি তা পারেন না। তবে সব নীতিমালা সব সময় প্রযোজ্য নয়। আপনি কেমন আছেন?
ভালো।
বসুন। মহাকাশের দৃশ্য দেখুন। আমি বেশির ভাগ সময় ভিউ প্যানেলের সামনে বসে কাটাই। বাইরের ছবি দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়।
আমি একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
বলুন।
আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে মনে হচ্ছে। বিরাট একটা বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মহাকাশযানের গতিবেগ আলোর গতিবেগের চল্লিশ শতাংশেরও বেশি। সেই বেগ ক্রমেই বাড়ছে। এই অবস্থায় শারীরিক কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। এবং তখন যা করতে হয়, তা হচ্ছে একজন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। মিশন প্রধানের কাছে নয়।
আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমার মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শক্তিধর কিছু তার দিকে আমাদের টানছে। এর শক্তি অকল্পনীয়, সীমাহীন। আমার মনে হচ্ছে একে এড়াবার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই।
জন বরগ হেসে ফেললেন। এক জন বয়স্ক লোকের মুখে শিশুদের মতো কথা শুনলে আমরা যে রকম করে হাসি, অবিকল সে রকম প্রশ্ৰয়মাখানো হাসি। জন বরগ হাসতে হাসতেই বললেন, মহাকাশযান সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই বলেই এ রকম উদ্ভট কথা আমাকে বলতে এসেছেন।
আমি কোনো উদ্ভট কথা বলছি না।
আপনি খুবই উদ্ভট কথা বলেছেন এবং তা বুঝতে পারছেন না। ইএসপি ক্ষমতা বা ঐ জাতীয় হাবিজাবি আমাকে বলতে আসবেন না। মহাকাশযান ইএসপি ক্ষমতার ওপর চলে না, ফলে বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং তথ্যের ওপর। আপনার জানা নেই যে এই মহাকাশযানের এক পার্স দূরত্ব পর্যন্ত যে কোনো জায়গার অতি সূক্ষ্মতম পরিবর্তনের হিসেবও রাখা হয়। ধরা যাক, কোনো কারণে আমরা একটা নিউট্রন স্টারের কাছাকাছি চলে এলাম। নিউট্রন স্টারের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হচ্ছে দানবীয় শক্তি, কিন্তু এই শক্তিও আমাদের কিছু করতে পারবে না। কারণ হাইপার স্পেস ডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি মহাকাশযানের আছে গ্র্যাভিটি ফ্লাস্ক তৈরির ক্ষমতা। এই গ্র্যাভিটি ফ্লাঙ্কের কারণে আমরা শুধু নিউট্রন স্টার নয়, ব্ল্যাক হোলের খল্পর থেকেও নির্বিঘ্নে বের হয়ে আসতে পারি। এখন কি আপনার মনের অস্বস্তি দূর হয়েছে?
না।
এখনো যদি অস্বস্তি দূর না হয়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। আপনি ডাক্তার রোবটের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সে আপনাকে ট্রাংকুইলাইজার ধরনের কিছু দেবে। তাই খেয়ে শুয়ে পড়ুন।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। তার ঠিক সঙ্গে সঙ্গে মাথার ওপরে নীলবাতি নিভে গেল। সেখানে জ্বলল হলুদ বাতি, যার মানে সতর্ক অবস্থা। হলুদ বাতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লালবাতি জ্বলল। লালবাতি মানে হচ্ছে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। আমি নিশ্চিত জানি এই লালবাতি নিতে গিয়ে দুটি লাল বাতি জ্বলবে, যার মানে চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতি। তারপর জ্বলবে তিনটি লালবাতি, যার অর্থ আমরা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
ইন্টারকমে কম্পিউটার সিডিসির ধাতব গলা শোনা গেল। সে অত্যন্ত স্পষ্ট করে যে সংবাদ দিল তা হচ্ছে :
বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আমরা অজানা একটি শক্তিশালী আকর্ষণী বলয়ের ভেতর পড়ে গিয়েছি। আকর্ষণী শক্তির ধরন, গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য আমাদের কাছে নেই বলে ঠিক এই মুহূর্তে কিছু করা যাচ্ছে না। তবে অতি দ্রুত তথ্যসংগ্রহ করা হচ্ছে। মিশন প্রধান জন বরগ। একটি জরুরি তভা ডেকেছেন। সভা এক্ষুণি শুরু হবে। সেই সঙ্গে মিশন প্রধান জন বরগ মহাকাশযানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। আমার বক্তব্য শেষ হল।
আমি সভাকক্ষের দিকে এগুলাম। ঘর ছেড়ে যাবার আগে শেষ বারের মতো কালাম। আমি জানি এই ঘরে আর ফিরে আসব না। কেমন যেন মায়া লাগছে। অল্প কিছু দিন মাত্ৰ কাটিয়েছি, অথচ তাতেই কেমন মায়া জন্মে গেছে।
ঘরে লাল বাতি এখনো জ্বলছে। একটি মাত্র বাতি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বাতিটি এখনো জ্বলে নি। তবে জ্বলবে। আমি তা রক্তের প্রতি কণিকায় অনুভব করছি।
তিশ এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। সে বিষন্ন গলায় বলল, সভা শুরু হয়ে গেছে, আপনার যাওয়া দরকার।
আমি হালকা গলায় বললাম, কী হবে সভায় গিয়ে? তিশ ক্লান্ত গলায় বলল, মনে হচ্ছে কিছু হবে না। ঠিক তখন দ্বিতীয় লাল বাতিটি জ্বলল এর মানে চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতি।