অনেকে মনে করেন, প্রাণায়াম শ্বাসপ্রশ্বাসের কোন ব্যাপার, বাস্তবিক তাহা নয়। প্রকৃতপক্ষে শ্বাসপ্রশ্বাসের সহিত ইহার সম্বন্ধ অতি অল্পই। প্রকৃত প্রাণায়াম-সাধন করিতে হইলে অনেকগুলি ক্রিয়ার মধ্য দিয়া যাইতে হয়, শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়া সেগুলির একটি। প্রাণায়ামের অর্থ প্রাণের সংযম। ভারতীয় দার্শনিকগণের মতে সমগ্র জগৎ দুইটি উপাদানে নির্মিত। তাহাদের মধ্যে একটির নাম ‘আকাশ’। এই আকাশ একটি সর্বব্যাপী সর্বানুস্যূত সত্তা। যে-কোন বস্তুর আকার আছে, যে-কোন বস্তু অন্যান্য বস্তুর মিশ্রণে উৎপন্ন, তাহাই এই আকাশ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। এই আকাশই বায়ুরূপে পরিণত হয়, ইহাই তরল পদার্থের রূপ ধারণ করে, ইহাই আবার কঠিনাকার প্রাপ্ত হয়; এই আকাশই সূর্য, পৃথিবী, নক্ষত্র, ধূমকেতু প্রভৃতি রূপে পরিণত হয়। সর্বপ্রাণীর শরীর-পশুশরীর, উদ্ভিদ্ প্রভৃতি যে-সকল রূপ আমরা দেখিতে পাই, যে-সকল বস্তু আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করিতে পারি, এমন কি জগতে যে-কোন বস্তু আছে, সে-সকলই আকাশ হইতে উৎপন্ন। এই আকাশকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করিবার উপায় নাই; ইহা এত সূক্ষা যে, ইহা সাধারণের অনুভূতির অতীত। যখন ইহা স্থূল হইয়া কোন আকার ধারণ করে, আমরা তখনই ইহাকে অনুভব করিতে পারি। সৃষ্টির আদিতে একমাত্র আকাশই থাকে। আবার কল্পান্তে সমুদয় কঠিন তরল ও বায়বীয় পদার্থ-সবকিছুই আকাশে লয় প্রাপ্ত হয়। পরবর্তী সৃষ্টি আবার এইরূপে আকাশ হইতে উৎপন্ন হয়।
কোন্ শক্তির প্রভাবে আকাশ এইপ্রকারে জগৎরূপে পরিণত হয়? প্রাণের শক্তিতে। যেমন আকাশ এই জগতের অনন্ত সর্বব্যাপী উপাদান, প্রাণও সেইরূপ এই জগতের অনন্ত সর্বব্যাপী প্রকাশিকা শক্তি। কল্পের আদিতে ও অন্তে সব বস্তুই আকাশে পরিণত হয়, জগতের সব শক্তিই আবার প্রাণে লয় পায়; পরকল্পে আবার এই প্রাণ হইতেই সব শক্তির বিকাশ হয়। এই প্রাণই গতিরূপে প্রকাশ পাইতেছে, এই প্রাণই মাধ্যাকর্ষণ অথবা চৌম্বক শক্তিরূপে প্রকাশ পাইতেছে। এই প্রাণই স্নায়ু-শক্তিপ্রবাহরূপে (nerve current), চিন্তাশক্তিরূপে ও দৈহিক সমুদয় ক্রিয়ারূপে প্রকাশিত হইয়াছে। চিন্তাশক্তি হইতে আরম্ভ করিয়া নিম্নতম শক্তি পর্যন্ত সবকিছুই প্রাণের বিকাশমাত্র। বাহ্য ও অন্তর্জগতের সকল শক্তি যখন তাহাদের মূলাবস্থায় গমন করে, তখন তাহাদের সমষ্টিকেই ‘প্রাণ’ বলে। যখন অস্তি বা নাস্তি কিছুই ছিল না, যখন তমোদ্বারা তমঃ আবৃত ছিল, তখন কি ছিল?১ এই আকাশই গতিশূন্য হইয়া অবস্থিত ছিল। প্রাণের গতি রুদ্ধ ছিল, কিন্তু তখনও প্রাণের অস্তিত্ব ছিল।
১ নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীম্-ইত্যাদি
তম আসীৎ তমসা গুঢ়মগ্রে প্রকেত-ইত্যাদি। ঋগ্বেদ সংহিতা, ১০ম মণ্ডল
আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারাও জানিতে পারি যে, জগতে যত কিছু শক্তির বিকাশ হইয়াছে, তাহাদের সমষ্টি চিরকাল সমান থাকে, ঐ শক্তিগুলি কল্পনান্তে শান্ত ভাব ধারণ করে-অব্যক্ত অবস্থায় গমন করে, পরকল্পের আদিতে উহারাই আবার ব্যক্ত হইয়া আকাশের উপর আঘাত করিতে থাকে। এই আকাশ হইতে বিবিধ রূপ বিকশিত হয়; আর আকাশ পরিণামপ্রাপ্ত হইতে আরম্ভ করিলে এই প্রাণও নানাপ্রকার শক্তিরূপে পরিণত হইয়া থাকে। এই প্রাণের প্রকৃত তত্ত্ব জানা এবং উহাকে নিয়ন্ত্রিত করিবার চেষ্টাই প্রাণায়ামের প্রকৃত অর্থ।
এই প্রাণায়ামে সিদ্ধ হইলে আমাদের নিকট অনন্ত শক্তির দ্বার খুলিয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ মনে কর, কোন ব্যাক্তি এই প্রাণের বিষয় সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিলেন এবং উহাকে জয় করিতেও সক্ষম হইলেন, তাহা হইলে জগতে এমন কি শক্তি আছে, যাহা তাঁহার আয়ত্ত না হয়? তাঁহার আজ্ঞায় সূর্য-নক্ষত্র স্থানচ্যুত হয়, ক্ষুদ্রতম পরমাণু হইতে বৃহত্তম সূর্য পর্যন্ত তাঁহার বশীভূত হয়, কারণ তিনি প্রাণকে জয় করিয়াছেন। এইরূপ শক্তিলাভ করা প্রাণায়াম-সাধনের লক্ষ্য। যখন যোগী সিদ্ধ হন, তখন প্রকৃতিতে এমন কোন বস্তু নাই, যাহা তাঁহার বশে না আসে। যদি তিনি দেবতাদিগকে আসিতে আহ্বান করেন, তাঁহারা তাঁহার আজ্ঞামাত্রেই তৎক্ষণাৎ আগমন করেন; মৃতব্যক্তিদিগকে আসিতে আজ্ঞা করিলে তাহারা তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয়। প্রকৃতির সব শক্তিই ক্রীতদাসের মতো তাঁহার আদেশ পালন করে। অজ্ঞলোকেরা যোগীর এই-সকল কার্যকলাপ দেখিয়া বলে, এগুলি অলোকিক। হিন্দুমনের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তাহারা যে-কোন তত্ত্ব আলোচনা করুক না কেন, অগ্রে উহার ভিতর হইতে যতদূর সম্ভব একটি সাধারণ ভাবের অনুসন্ধান করে, উহার মধ্যে যাহা কিছু খুঁটিনাটি আছে, সেগুলি রাখিয়া দেয় পরে মীমাংসার জন্য। বেদে এই প্রশ্ন পুনঃপুনঃ জিজ্ঞাসিত হইয়াছে, ‘এমন কি বস্তু আছে, যাহা জানিলে সবকিছু জানা যায়?’১ এইরূপে আমাদের সব শাস্ত্র, সব দর্শন-যে-বস্তুকে জানিলে সবকিছু জানা যায়, সেই বস্তুকে নির্ণয় করিতেই ব্যস্ত। যদি কেহ জগতের তত্ত্ব একটু একটু করিয়া জানিতে চায়, তাহা হইলে তো অনন্ত সময় লাগিবে; কারণ তাহাকে এক এক কণা বালুকাকে পর্যন্ত পৃথক্ ভাবে জানিতে হইবে। তথাপি সে সবকিছু জানিতে পারে না। তবে কিভাবে জ্ঞানলাভ সম্ভব? এক-একটি বিষয় পৃথক্ পৃথক্ জানিয়া মানুষের সর্বজ্ঞ হইবার সম্ভাবনা কোথায়? যোগীরা বলেন, এই সমস্ত বিশেষ অভিব্যক্তির অন্তরালে এক সাধারণ ভাব রহিয়াছে। উহাকে ধরিতে পারিলেই সবকিছু আয়ত্ত করা যায়। এইভাবেই বেদে সমগ্র জগৎকে এক পূর্ণ সত্তায় পর্যবসিত করা হইয়াছে। যিনি এই ‘সৎ’-স্বরূপকে ধরিয়াছেন, তিনিই সমগ্র জগৎকে বুঝিতে পারিয়াছেন। এইভাবেই সমুদয় শক্তিকে এক প্রাণরূপ সাধারণ শক্তিতে পর্যবসিত করা হইয়াছে। সুতরাং যিনি ‘প্রাণ’কে ধরিয়াছেন, তিনি জগতে যতকিছু মানসিক বা দৈহিক শক্তি আছে, সবকিছুকেই ধরিয়াছেন।
১ ‘কস্মিন্নুভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতি?’-মুন্ডক উপ, ১।৩
যিনি প্রাণকে জয় করিয়াছেন, তিনি শুধু নিজের মন নয়, সকলের মন জয় করিয়াছেন। তিনি নিজ দেহ ও অন্যান্য যত দেহ আছে, সবই জয় করিয়াছেন, কারণ প্রানই সমুদয় শক্তির মূল।
কিভাবে এই প্রান নিয়ন্ত্রিত হইবে, ইহাই প্রাণায়ামের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই প্রাণায়ামের যত কিছু সাধন ও উপদেশ আছে, সকলেরই সেই এক উদ্দেশ্য। প্রত্যেক সাধকই-যে যেখানে আছে, সেখান হইতেই সাধন আরম্ভ করিবে, তাহার খুব নিকটে যাহা কিছু আছে, সবই জয় করিতে শিক্ষা করা উচিত। জগতের সকল বস্তুর মধ্যে দেহই আমাদের সর্বাপেক্ষা সন্নিহিত, আবার মন তাহা অপেক্ষাও সন্নিহিত। যে প্রাণ জগতের সর্বত্র ক্রিয়া করিতেছে, তাহার যে অংশ এই শরীর ও মন চালাইতেছে, সেই প্রাণটুকু আমাদের সর্বাপেক্ষা সন্নিহিত। যে ক্ষুদ্র প্রাণতরঙ্গ আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিরূপে পরিচিত, তাহা আমাদের পক্ষে অনন্ত প্রাণসমুদ্রের সর্বাপেক্ষা নিকরবর্তী তরঙ্গ। এই ক্ষুদ্র তরঙ্গ জয় করিতে পারিলে আমরা সমগ্র প্রাণসমুদ্র জয় করিবার আশা করিতে পারি। যে যোগী এ-বিষয়ে কৃতকার্য হন, তিনি সিদ্ধিলাভ করেন, তখন আর কোন শক্তিই তাঁহার উপর প্রভুত্ব করিতে পারে না। তিনি প্রায় সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ হন। আমরা প্রত্যেক দেশেই এরূপ কিছু কিছু সম্প্রদায় দেখিতে পাই, যাহারা কোন না কোন উপায়ে এই প্রাণকে জয় করিবার চেষ্টা করিয়াছে। এই দেশেই (আমেরিকায়) আমরা মনঃ-শক্তি দ্বারা আরোগ্যকারী (mind-healer), বিশ্বাসের দ্বারা আরোগ্যকারী (faith-healer), প্রেত-তত্ত্ববিৎ (spiritualist), ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্টিস্ট (Christian Scientist), সন্মোহন-বিদ্যাবিৎ (hypnotist) প্রভৃতি সম্প্রদায় দেখিতে পাই। এই মতগুলি বিশেষরূপে বিশ্লেষণ করিলে দেখিতে পাইব যে, এগুলির মূলে রহিয়াছে প্রাণশক্তির নিয়ন্ত্রণ-তাহারা এ-কথা জানুক বা নাই জানুক। তাহাদের সব মতের মূলে একই জিনিস রহিয়াছে। তাহারা সকলে একই শক্তি লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে, তবে অজ্ঞাতসারে-এইমাত্র। তাহারা হঠাৎ যেন একটি শক্তি আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে, কিন্তু সেই শক্তির স্বরূপ না জানিয়া অজ্ঞাতসারেই উহা ব্যবহার করিতেছে। যোগী ঐ শক্তিরই পরিচালনা করেন। উহা প্রাণেরই শক্তি।
এই প্রাণই সকল প্রাণীর অন্তরে জীবনীশক্তিরূপে রহিয়াছে। চিন্তাই প্রাণের সূক্ষাতম ও উচ্চতম ক্রিয়া; চিন্তার যতটুকু আমরা দেখিয়া থাকি, সেইটুকু উহার সব নয়। চিন্তার প্রকারভেদ আছে। সহজাত-জ্ঞান (instinct) অথবা জ্ঞান-শূন্য চিন্তাও আছে, তাহা আমাদের নিম্নতম কার্যক্ষেত্র। একটি মশক দংশন করিলে আমার হাত স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া উহাকে আঘাত করিবে। উহাকে মারিবার জন্য হাত উঠাইতে নামাইতে আমার বিশেষ কিছু চিন্তার প্রয়োজন হয় না। ইহা চিন্তারই এক প্রকার অভিব্যক্তি। শরীরে জ্ঞান-সাহায্য-বিরহিত প্রতিক্রিয়া-মাত্রেই (Reflex action১) চিন্তার এই স্তরের অন্তর্গত।
১ বাহিরের কোনরূপ উত্তেজনায় শরীরের কোন যন্ত্র সময়ে সময়ে জ্ঞানের কোন সহায়তা না লইয়া আপনি কার্য করে. সেই কার্যকে reflex action বলে।
চিন্তার আর একটি স্তর আছে, উহাকে সজ্ঞান (Conscions) বলা যাইতে পারে। আমি যুক্তিতর্ক করি, বিচার করি, চিন্তা করি, কতকগুলি বিষয়ের দুইদিক আলোচনা করি, কিন্তু ইহাই শেষ নয়; আমরা জানি, যুক্তিবিচার সীমাবদ্ধ। যুক্তি আমাদিগকে কিছুদূর পর্যন্ত লইয়া যাইতে পারে, তারপর আর পারে না। যে স্থানটুকুর ভিতর উহা ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহা অতি সঙ্কীর্ণ। কিন্তু সেই সঙ্গে ইহাও দেখিতে পাই, নানাবিধ বিষয় বাহির হইতে ভিতরে আসিয়া পড়িতেছে। ধূমকেতুর মতো কতকগুলি বিষয় কখন কখন ভিতরে আসিয়া পড়ে। ইহাও নিশ্চিত যে, অনেক তত্ত্ব ঐ সীমার বহির্দেশ হইতে আসিতেছে, বিচার-শক্তি কিন্তু ঐ সীমা ছাড়াইয়া যাইতে পারে না। ঐ যে বিষয়গুলি এই ক্ষুদ্র গন্ডির ভিতর আসিয়া অনধিকার প্রবেশ করিতেছে, সেগুলির কারণ অবশ্য ঐ সীমার বাহিরে অবস্থিত; আমাদের বিচারযুক্তি সেখানে পৌঁছিতে পারে না। কিন্তু যোগীর বলেন, ইহাই যে আমাদের জ্ঞানের চরম সীমা, তাহা কখনই হইতে পারে না। মন আরও উচ্চতর ভূমিতে-জ্ঞানাতীত ভূমিতে বিচরণ করিতে পারে। যখন মন সমাধি-নামক পূর্ণ একাগ্র ও জ্ঞানাতীত অবস্থায় আরূঢ় হয়, তখন উহা যুক্তির সীমার বাহিরে চলিয়া যায় এবং সহজাতজ্ঞান ও যুক্তির অতীত বিষয়সকল প্রত্যক্ষ করে। শরীরের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শক্তিগুলি প্রাণেরই বিভিন্ন অভিব্যক্তি; ঠিক পথে পরিচালিত হইলে ঐগুলি মনকে প্রেরণা দেয় এবং উচ্চতর অবস্থায় অর্থাৎ জ্ঞানাতীত ভূমিতে লইয়া যায়, এবং মন সেখান হইতে কার্য করিতে থাকে।
বিশ্বে অস্তিত্বের প্রত্যেক স্তরেই এক অখন্ড বস্তু রহিয়াছে। প্রাকৃতিক দিক দিয়া দেখিতে গেলে এই বিশ্বজগৎ এক ও অখন্ড। তোমার সহিত সূর্যের কোন প্রভেদ নাই। বৈজ্ঞানিক তোমাকে বুঝাইয়া দিবেন, এক বস্তুর সহিত অপর বস্তুর ভেদ একটি কল্পনা মাত্র।এই টেবিল ও আমার মধ্যে যথার্থ কোন ভেদ নাই। টেবিলটি অনন্ত জড়রাশির এক বিন্দু, আর আমি উহার অপর বিন্দু। প্রত্যেক সাকার বস্তুই যেন এই অনন্ত জড়সাগরের এক-একটি আবর্ত। আবর্তগুলি আবার একটিও স্থির থাকে না। কোন স্রোতস্বিনীতে লক্ষ লক্ষ আবর্ত রহিয়াছে, প্রতিটি আবর্তে প্রতি মুহূর্তেই নূতুন জলরাশি আসিতেছে, কিছুক্ষণ ঘুরিতেছে, আবার অপর দিকে চলিয়া যাইতেছে এবং নূতন জলকণাসমূহ তাহার স্থান অধিকার করিতেছে। সমগ্র বিশ্বজগৎও এইরূপ নিয়ত পরিবর্তনশীল জড়রাশি-মাত্র, যাবতীয় বস্তু উহারই মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবর্তস্বরূপ। কিছু জড়রাশি একটি আবর্তের মধ্যে প্রবেশ করিল-ধর মানবদেহে-কিছুদিন ঐ আবর্ত ঘুবিয়া, পরিবর্তিত হইয়া, বাহির হইয়া আর একটি আবর্তে প্রবেশ করিল-এবার হয়তো কোন জন্তুর দেহে, কয়েক বৎসর পরে খনিজপদার্থ-নামে আর একপ্রকার আবর্তে প্রবেশ করিল। ক্রমাগত পরিবর্তন! কোন কিছুই স্থির নয়। আমার শরীর, তোমার শরীর বলিয়া বাস্তবিক কোন বস্তু নাই, ঐরূপ বলা কেবল কথার কথা মাত্র। এক বিরাট জড়রাশির একটি বিন্দুর নাম চন্দ্র, আর একটি বিন্দুকে বলা হয় সূর্য, কোন বিন্দু মনুষ্য, কোন বিন্দু পৃথিবী, কোন বিন্দু বা উদ্ভিদ্, অপর কোন বিন্দু হয়তো একটি খনিজ পদার্থ।
ইহাদের একটিও সর্বদা একভাবে থাকে না, সকল বস্তুই সর্বদা পরিবর্তিত হইতেছে; জড়ের একবার সংশ্লেষণ, আবার বিশ্লেষণ, চলিতেছে। মন বা অন্তর্জগৎ সম্বন্ধেও এই একই কথা। জগতের সমুদয় বস্তুই ‘ইথার’ হইতে উৎপন্ন, সুতরাং ইহাকেই সমুদয় জড়বস্তুর প্রতিনিধিরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। প্রাণের সূক্ষ্মতর স্পন্দনশীল অবস্থায় এই ‘ইথার’-কেই মনেরও প্রতিনিধি বলা যাইতে পারে। তথাপি ‘ইথার’ এক অখন্ড জড়বস্তুরূপেই থাকিবে। যদি সেই সূক্ষ্ম স্পন্দনের স্তরে উপনীত হইতে পারো, তবে অনুভব করিবে-সমগ্র জগৎ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম স্পন্দনে সংগঠিত। কখন কখন কোন ঔষধের শক্তিতে আমরা ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে থাকিয়াও ঐরূপ অবস্থায় নীত হই। তোমাদের মধ্যে অনেকের স্যার হাম্ফ্রি ডেভির (Sir Humphrey Davy) বিখ্যাত পরীক্ষার কথা মনে থাকিতে পারে। হাস্যজনক বাষ্প (Laughing gas) তাঁহাকে অভিভূত করিলে তিনি স্তব্ধ ও নিস্পন্দ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন; পরে তিনি বলেন, সমগ্র জগৎ ভাবরাশির সমষ্টিমাত্র। কিছুক্ষণের জন্য স্থূলকম্পনগুলি (gross vibration) যেন থামিয়া গিয়াছিল, কেবল সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কম্পনগুলি-যেগুলিকে তিনি ‘ভাবরাশি’ বলিয়া অভিহিত করেন শুধু সেইগুলিই তাঁহার অনুভূতিতে বর্তমান ছিল। তিনি চতুর্দিকে কেবল সূক্ষ্ম কল্পনাগুলি দেখিতে পাইতেন। সবকিছু চিন্তারূপে পরিণত হইয়াছিল। তাঁহার নিকট সব যেন এক মহা ভাবসমুদ্রে পরিণত হইয়াছিল। সেই মহাসমুদ্রে তিনি ও চরাচর জগতের প্রত্যেকেই যেন এক-একটি ক্ষুদ্র ভাবাবর্ত।
এইরূপে আমরা চিন্তাজগতেও এক অখন্ড ভাব দেখিলাম, অবশেষে যখন আমরা সেই আত্মাকে লাভ করি, তখন অনুভব করি-সেই আত্মাই এই অখন্ড ‘এক’। সর্বপ্রকার স্থূল ও সূক্ষ্ম জড়ের স্পন্দনের অতীত-গতির ঊর্ধ্বে সেই এক অখন্ড সত্তা বিরাজ করিতেছেন। এমন কি, এই পরিদৃশ্যমান গতিসমূহের মধ্যেও-শক্তির বিকাশসমূহের মধ্যেও এক অখন্ড ভাব বিদ্যমান। এ-সকল তথ্য এখন আর অস্বীকার করা যায় না। আধুনিক পদার্থ-বিজ্ঞানও প্রমাণ করিয়াছে যে, এই বিশ্বে শক্তিসমষ্টি সর্বত্র সমান। আবার ইহাও প্রমাণিত হইয়াছে যে, শক্তিসমষ্টি দুই ভাবে অবস্থান করে-কখন স্তিমিত বা অব্যক্ত, পরে ব্যক্ত অবস্থায় উহা এই-সকল নানাবিধ শক্তির আকার ধারন করে, আবার শান্ত অব্যক্ত রূপ প্রাপ্ত হয়, আবার ব্যক্ত হয়। এইরূপে উহা অনন্তকাল ধরিয়া কখন বিকশিত, কখন বা সঙ্কুচিত ভাব ধারণ করিতেছে। পূর্বেই বলা হইয়াছে-এই শক্তিরূপী প্রাণের নিয়ন্ত্রণের নামই প্রাণায়াম।
ফুসফুসের গতিতেই প্রাণের প্রকাশ স্পষ্টরূপে দেখিতে পাওয়া যায়। উহাতেই প্রাণের ক্রিয়া সহজে বোঝা যায়। ফুসফুসের গতি বন্ধ হইলে দেহের সকল ক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁহারা নিজেদের এমনভাবে শিক্ষিত করেন যে, তাঁহাদের ফুসফুসের গতি রুদ্ধ হইয়া গেলেও শরীর জীবিত থাকে।
এমন অনেক লোক আছেন, যাঁহারা শ্বাসপ্রশ্বাস না লইয়া কয়েক মাস মাটির নীচে নিজেকে চাপা দিয়া জীবিত থাকিতে পারেন। সূক্ষ্মতর শক্তির কাছে যাইতে হইলে স্থূলতর শক্তির সাহায্য লইতে হয়। এইরূপে ক্রমশঃ সূক্ষ্মতম শক্তি লাভ করিতে করিতে শেষে আমরা চরম লক্ষ্যে উপনীত হই। যত প্রকার ক্রিয়া আছে, তন্মধ্যে ফুসফুসের ক্রিয়াই অতি সহজে প্রত্যক্ষ হয়। উহা যেন যন্ত্রমধ্যস্থ গতিনিয়ামক চক্ররূপে অপর শক্তিগুলি চালাইতেছে। প্রাণায়ামের প্রকৃত অর্থ-ফুসফুসের এই গতি নিয়ন্ত্রিত করা; এই গতির সহিত শ্বাসযন্ত্রও জড়িত। শ্বাসপ্রশ্বাস যে এই গতি উৎপন্ন করিতেছে, তাহা নয়, বরং এই গতিই শ্বাসপ্রশ্বাস উৎপন্ন করিতেছে। এই বেগই পাম্পের মতো বায়ুকে ভিতরের দিকে আকর্ষণ করিতেছে। প্রাণ এই ফুসফুসকে চালিত করিতেছে। এই ফুসফুসের গতি বায়ুকে আকর্ষণ করিতেছে। তাহা হইলে বুঝা গেল, প্রাণায়াম শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রিয়া নয়। যে পেশী-শক্তি ফুসফুসকে সঞ্চালন করিতেছে, তাহাকে বশে আনাই প্রাণায়াম। যে শক্তি স্নায়ু-মন্ডলীর ভিতর দিয়া মাংশপেশীতে যাইতেছে এবং পেশীর মাধ্যমে ফুসফুসকে সঞ্চালন করিতেছে, তাহাই প্রাণ; প্রাণায়াম-সাধনে এই প্রাণকেই বশে আনিতে হইবে। যখনই প্রাণ নিয়ন্ত্রিত হইবে, তখনই আমরা দেখিতে পাইব-শরীরের মধ্যে প্রাণের অন্যান্য সমুদয় ক্রিয়াই আমাদের আয়ত্তে আসিয়াছে। আমি নিজেই এমন সব লোক দেখিয়াছি, যাঁহারা তাঁহাদের শরীরের পেশীগুলি বশে আনিয়াছেন অর্থাৎ ইচ্ছামত সেগুলি চালনা করিতে পারেন। কেনই বা না পারিবেন? যদি কতকগুলি পেশী আমার ইচ্ছা অনুসারে সঞ্চালিত হয়, তবে প্রত্যেকটি পেশী ও স্নায়ু আমি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারির না কেন? ইহাতে অসম্ভব কি আছে? এখন আমাদের এই নিয়ন্ত্রণ-শক্তি লোপ পাইয়াছে, আর ঐ পেশীগুলি স্বয়ংক্রিয় হইয়া পড়িয়াছে। আমরা ইচ্ছামত কর্ণ সঞ্চালন করিতে পারি না, কিন্তু আমরা জানি যে পশুরা ঐরূপ করিতে পারে। এই শক্তি চালনা করি না, বলিয়াই আমাদের এ শক্তি নাই। ইহাকেই পূর্বপুরুষদের গুণদোষের পুনরাবির্ভাব (atavism) বলা হয়।
আর ইহাও আমরা জানি, যে শক্তি এখন অব্যক্ত ভাব ধারণ করিয়াছে, তাহাকে আবার ব্যক্তাবস্থায় আনা যায়। খুব দৃঢ় পরিশ্রম ও অভ্যাসের দ্বারা আমাদের শরীরস্থ অনেক সুপ্ত শক্তিকে পুনরায় আমাদের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বশবর্তী করা যাইতে পারে। এইভাবে বিচার করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, শরীরের প্রত্যেক অংশকেই সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন করা কিছু মাত্র অসম্ভব নয়, বরং খুব সম্ভব। যোগী প্রাণায়ামের দ্বারা ইহা করিয়া থাকেন। তোমরা হয়তো যোগশাস্ত্রের অনেক গ্রন্থে পড়িয়া থাকিবে যে, শ্বাসগ্রহণের সময় সমগ্র শরীর ‘প্রাণ’-এর দ্বারা পূর্ণ কর। ইংরেজী অনুবাদে প্রাণ-শব্দের অর্থ করা হইয়াছে শ্বাস। ইহাতে তোমরা সহজেই জিজ্ঞাসা করিতে পারো, ‘শ্বাসের দ্বারা সমুদয় শরীর পূর্ণ করিব কিরূপে?’ ইহা অনুবাদকেরই দোষ। শরীরের প্রত্যেকটি অংশই প্রাণ অর্থাৎ এই জীবনীশক্তি দ্বারা পূর্ণ করা যাইতে পারে; আর যখনই তুমি এরূপ করিতে পারিবে, তখনই সমগ্র শরীর তোমার বশে আসিবে।
দেহে অনুভূত সকল ব্যাধি, সকল দুঃখ সম্পূর্ণরূপে আয়ত্তে আসিবে। শুধু তাই নয়, তুমি অপরের শরীরও নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিবে। পৃথিবীতে ভাল মন্দ সবই সংক্রামক। তোমার শরীরে যদি কোন এক বিশেষ ভাবের উত্তেজনা থাকে, অপরের ভিতরও সেই ভাবের প্রবণতা দেখা দিবে। যদি তুমি সবল ও সুস্থ হও, তোমার নিকটস্থ ব্যক্তিদের মধ্যেও সুস্থ ও সবল ভাব আসিবে। তুমি যদি রুগ্ন বা দুর্বল হও, তবে দেখিবে তোমার স্পন্দন অপরের ভিতর সঞ্চারিত হইয়া যাইবে। যখন একজন অপরকে রোগমুক্ত করিবার চেষ্টা করে, তখন প্রথমে তাহার ভাবটি এইরূপ হয় যে, আমার স্বাস্থ্য অপরে সঞ্চারিত করিয়া দিব। ইহা এক প্রকার আদিম চিকিৎসা-প্রণালী। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে একজন আর একজনের দেহে স্বাস্থ্য সঞ্চারিত করিয়া দিতে পারেন। খুব বলবান্ ব্যাক্তি যদি কোন দুর্বল লোকের সঙ্গে সর্বদা বাস করে, তাহা হইলে সেই দুর্বল ব্যক্তি জানুক বা না জানুক কিঞ্চিৎ পরিমাণে সবল হইবেই হইবে। যখন এই প্রক্রিয়া জ্ঞাতসারে করা হয়, তখন ইহার ফল অপেক্ষাকৃত ত্বরান্বিত ও ভাল হইয়া থাকে। আর এক প্রকার আরোগ্য-প্রণালী আছে, তাহাতে স্বয়ং খুব সুস্থকায় না হইলেও একজন অপরের শরীরে স্বাস্থ্য সঞ্চারিত করিয়া দিতে পারেন। এরূপ ক্ষেত্রে ঐ আরোগ্যকারীর প্রাণের উপর প্রভুত্ব কিছুটা বেশী। তিনি কিছুক্ষণের জন্য নিজ প্রাণ উচ্চতর স্পন্দনবিশিষ্ট অবস্থায় উন্নীত করিয়া অপরের শরীরে ঐ স্পন্দন সঞ্চারিত করিতে পারেন।
অনেকস্থলে প্রক্রিয়াটি দূর হইতেও সংসাধিত হইয়াছে। বাস্তবিক দূরত্বের অর্থ যদি ক্রমবিচ্ছেদ (break) হয়, তবে দূরত্ব বলিয়া কিছু নাই। এমন দূরত্ব কোথায় আছে, যেখানে পরস্পরের কিছুমাত্র সম্বন্ধ-কিছুমাত্র যোগ নাই? সূর্য ও তোমার মধ্যে বাস্তবিক কি কোন ক্রমবিচ্ছেদ আছে? এক অবিচ্ছিন্ন অখন্ড বস্তু রহিয়াছে-তুমি তাহার এক অংশ, সূর্য তাহার আর এক অংশ। নদীর এক অংশ ও অপর অংশের মধ্যে কি ক্রমবিচ্ছেদ আছে? তাহা হইলে শক্তি একস্থান হইতে অপর স্থানে ভ্রমণ করিতে পারিবে না কেন? ইহার বিরুদ্ধে তো কোন যুক্তিই দেওয়া যাইতে পারে না। দূর হইতে রোগ আরোগ্য করার ঘটনাগুলি সম্পূর্ণ সত্য। এই প্রাণকে বহুদূরে সঞ্চারিত করা যাইতে পারে, তবে অবশ্য এমন হইতে পারে যে, এ-বিষয়ে একটি ঘটনা যদি সত্য হয়, তবে শত শত ঘটনা কেবল জুয়াচুরি। লোকে এই আরোগ্য-প্রাণালীকে যত সহজ ভাবে-তত সহজ নয়। অধিকাংশ স্থলে দেখা যাইবে যে, আরোগ্যকারী মানব-দেহের স্বাভাবিক সুস্থতার সুযোগ লইতেছেন। জগতে এমন কোন রোগ নাই যে, সেই রোগে আক্রান্ত হইয়া সব লোকই মারা পড়ে। এমন কি, বিসূচিকা-মহামারিতেও যদি কিছুদিন শতকরা ৬০ জন মরে, তবে দেখা যায়, ক্রমশঃ এই মৃত্যুর হার কমিয়া শতকরা ৩০ হয়, পরে ২০তে দাঁড়ায়, অবশিষ্ট সকলে রোগমুক্ত হয়। এলোপ্যাথ চিকিৎসক আসিলেন, বিসূচিকা-রোগগ্রস্ত ব্যক্তিগণকে চিকিৎসা করিলেন, তাঁহার ঔষধ দিলেন।
হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক আসিয়া তাঁহার ঔষধ দিলেন হয়তো এলোপ্যাথ অপেক্ষা অধিকসংখ্যক রোগী আরোগ্য করিলেন, কারণ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক রোগীর শরীরে কোন গোলযোগ না বাধাইয়া প্রকৃতিকে নজের ভাবে কাজ করিতে দেন। বিশ্বাসবলে আরোগ্যকারী আরও রোগী আরোগ্য করিবেন, কারণ তিনি নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করিয়া বিশ্বাসবলে রোগীর সুপ্ত প্রাণশক্তিকে জাগাইয়া দেন।
কিন্তু বিশ্বাসবলে রোগ-আরোগ্যকারীদের সর্বদাই একটি ভুল হইয়া থাকে-তাঁহারা মনে করেন, সাক্ষাৎভাবে বিশ্বাসই মানুষকে রোগমুক্ত করে। বাস্তবিকপক্ষে কেবল বিশ্বাসই যে একমাত্র কারণ, তাহা বলা যায় না। এমন সব রোগ আছে, যেগুলির সর্বাপেক্ষা খারাপ লক্ষণ এই-রোগী নিজে আদৌ মনে করে না যে, তাহার সেই রোগ হইয়াছে। রোগীর নিজের রোগহীনতা সম্বন্ধে অতীব বিশ্বাসই তাহার রোগের একটি প্রধান লক্ষণ, সচরাচর ইহা আশু মৃত্যুরই সূচনা করে। এ-সকল স্থলে কেবল বিশ্বাসেই রোগ আরোগ্য হয়-এ তত্ত্ব খাটে না। যদি বিশ্বাসেই রোগ আরোগ্য হইত, তাহা হইলে এই-সকল রোগীও আরোগ্য লাভ করিত; প্রাণের শক্তিতেই রোগ নিরাময় হইয়া থাকে। যে পবিত্রাত্মা পুরুষ নিজ প্রাণ নিয়ন্ত্রণ করিয়াছেন, তিনি ইহাকে এক নির্দিষ্ট কম্পনের অবস্থায় লইয়া গিয়া অপরের মধ্যে সেই প্রকার কম্পন সঞ্চারিত ও জাগ্রত করিতে পারেন। প্রতিদিনের ঘটনা হইতেই এই বিষয়ের প্রমাণ পাইতে পারো। আমি বক্তৃতা দিতেছি, বক্তৃতা দিবার সময় কি করিতেছি? আমি আমার মনকে একপ্রকার কম্পনের অবস্থায় আনিতেছি; এবং এই-বিষয়ে আমি যতই কৃতকার্য হইব, তোমরা ততই আমার বাক্য দ্বারা প্রভাবিত হইবে। তোমরা সকলেই জানো, বক্তৃতা দিতে দিতে আমি যেদিন খুব মাতিয়া উঠি, সেদিন আমার রক্তৃতা তোমাদের বেশী ভাল লাগে, আর আমার উৎসাহ অল্প হইলে আমার বক্তৃতা শুনিতে তোমাদেরও তত ভাল লাগে না।
জগৎ-আলোড়নকারী তীব্র-ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষগণ নিজেদের প্রাণ এক অতি উচ্চ কম্পনের অবস্থায় উন্নীত করিতে পারেন; প্রাণ এত অধিক শক্তিসম্পন্ন হয় যে, উহা অন্যকে মুহূর্তমধ্যে স্পর্শ করে, সহস্র সহস্র লোক তাঁহাদের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং জগতের অর্ধেক লোক তাঁহাদের ভাবানুসারে ভাবিত হইয়া থাকে। জগতের মহাপুরুষগণ সকলেই প্রাণ জয় করিয়াছিলেন। এই প্রাণসংযমের বলে তাঁহারা প্রবল-ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ইয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রাণকে উচ্চতম কম্পনের অবস্থায় উন্নীত করিয়াই তাঁহারা জগতের উপর প্রভাব বিস্তার করিবার শক্তি লাভ করেন। জগতে যতপ্রকার শক্তির বিকাশ দেখা যায়, সবই প্রাণের সংযম হইতে উৎপন্ন। মানুষ ইহার গোপন তথ্য না জানিতে পারে, কিন্তু ইহাই একমাত্র ব্যাখ্যা। তোমার শরীরে এই প্রাণশক্তির সরবরাহ কখন এক দিকে বেশী, অন্য দিকে কম পড়িয়া যায়-সাম্য নষ্ট হইয়া যায়, প্রাণের অসামঞ্জস্যেই রোগের উৎপত্তি। অতিরিক্ত প্রাণটুকু সরাইয়া যেখানে প্রাণের অভাব হইয়াছে, সেখানকার অভাব পুরণ করিতে পারিলেই রোগ আরোগ্য হয়।
কোথায় অধিক, কোথয় বা অল্প প্রাণশক্তি আছে, ইহা জানাও প্রাণায়ামের অঙ্গ। অনুভবশক্তি এত সূক্ষ্ম হইবে যে, মন বুঝিতে পারিবে-পায়ের আঙ্গুলে বা হাতের আঙ্গুলে যতটুকুপ্রাণ আবশ্যক তাহা নাই এবং ঐ প্রাণের অভাব পূরণ করিবার শক্তিও মনের থাকিবে। প্রাণায়ামের এইরূপ নানা অঙ্গ আছে। ঐগুলি ধীরে ধীরে ও ক্রমশঃ শিক্ষা করিতে হইবে। ক্রমে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, বিভিন্নরূপে প্রকাশিত প্রাণকে সংযত করা এবং চালনা করাই রাজযোগের একমাত্র লক্ষ্য। যখন কেহ নিজের সব শক্তিকে সংহত করিয়াছে, তখন সে নিজ দেহস্থ প্রাণকেই আয়ত্ত করিয়াছে। যখন কেহ ধ্যান করে, সে প্রাণকেই সংযত করিতেছে, বুঝিতে হইবে।
মহাসমুদ্রে পর্বততুল্য বৃহৎ তরঙ্গসমূহ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ, আরও ক্ষুদ্রতর তরঙ্গসমূহ, আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদ্বুদও রহিয়াছে। কিন্তু এই-সকলের পশ্চাতে এক অনন্ত মহাসমুদ্র; ঐ ক্ষুদ্র বুদ্বুদটি একদিকে অনন্ত সমুদ্রের সহিত, আবার অন্যদিকে সেই বৃহৎ তরঙ্গটিও সেই মহাসমুদ্রের সহিত সংযুক্ত। এইরূপে সংসারে কেহ বা মহাপরুষ কেহ বা ক্ষুদ্র জল-বুদ্বুদতুল্য সামান্য ব্যক্তি, কিন্তু সকলেই সেই অনন্ত মহাশক্তি-সমুদ্রের সহিত সংযুক্ত। এই মহাশক্তিতে জীবমাত্রেরই জন্মগত অধিকার। যেখানেই জীবনীশক্তির প্রকাশ, সেখানেই পশ্চাতে অনন্ত শক্তির ভান্ডার রহিয়াছে। একটি ক্ষুদ্র ছত্রাক (fungus)-হয়তো এত ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম যে, অণুবীক্ষণযন্ত্র দ্বারা উহা দেখিতে হয়-তাহা হইতে আরম্ভ কর, দেখিবে অনন্ত শক্তির ভান্ডার হইতে ক্রমশঃ শক্তি সংগ্রহ করিয়া সেটি আর এক আকার ধারণ করিতেছে। কালে উহা উদ্ভিদ্রূপে পরিণত হইল, উহাই আবার একটি পশুর আকার ধারণ করিল, পরে মনুষ্যরূপ ধারণ করিয়া অবশেষে ঈশ্বরে পরিণত হয়। অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মে এই ব্যাপার ঘটিতে লক্ষ লক্ষ বর্ষ অতীত হয়। কিন্তু এই সময়ই বা কি? সাধনার বেগ ও গতি বৃদ্ধি করিয়া দিলে সময়ের সংক্ষেপ হইতে পারে। যোগীরা বলেন, যে কার্য করিতে সাধারনভাবে অধিক সময় লাগে, কার্যের বেগ বৃদ্ধি করিয়া দিলে তাহাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হইতে পারে। মানুষ এই বিশ্বের অনন্ত শক্তিরাশি হইতে ধীরে ধীরে শক্তি সংগ্রহ করিয়া চলিতে পারে। এভাবে চলিলে একজনের দেবত্ব লাভ করিতে হয়তো লক্ষ বৎসর লাগিবে। আরও উচ্চাবস্থা লাভ করিতে হয়তো পাঁচ লক্ষ বৎসর লাগিবে। আবার পূর্ণ বা সিদ্ধ হইতে আরও পাঁচ লক্ষ বৎসর লাগিবে। উন্নতির বেগ বাড়াইলে এই সময় সংক্ষিপ্ত হইয়া আসিবে। যথেষ্ট চেষ্টা করিলে ছয় মাসে অথবা ছয় বৎসরে সিদ্ধিলাভ না হইবে কেন? যুক্তি দ্বারা ইহা বুঝা যায়। কোন বাষ্পীয়যন্ত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ কয়লা দিলে প্রতি ঘন্টায় দুই মাইল করিয়া যাইতে পারে; আরও অধিক কয়লা দিলে আরও শীঘ্র যাইবে। এইরূপে তীব্রসংবেগসম্পন্ন১ হইলে জীবাত্মা এই জন্মেই মুক্তিলাভ করিতে না পারিবে কেন? সকলেই শেষে মুক্তিলাভ করিবে, ইহা আমরা জানি।
১ যোগসুত্র, ১।২১
কিন্তু এতদিন অপেক্ষা করিব কেন? এই ক্ষণেই, এই শরীরেই-এই মানুষ্যদেহেই মুক্তিলাভ করিতে কেন না সমর্থ হইবে? এই অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত শক্তি আমি এখনই লাভ করিব না কেন?
আত্মার উন্নতির বেগ বৃদ্ধি করিয়া কিরূপে অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিলাভ করা যাইতে পারে, ইহাই যোগবিজ্ঞানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সকল মানুষ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়া, একটু একটু অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে প্রকৃতির অনন্ত শক্তিভান্ডার হইতে শক্তি গ্রহন করিবার ক্ষমতা বৃদ্ধি করিয়া কিরূপে শীঘ্র সিদ্ধিলাভ করা যায়, যোগীরা তাহারই উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে। জগতের সকল মহাপুরুষ-সাধু ও সিদ্ধপুরুষ কি করিয়াছন? এক জীবনেই তাঁহারা মানবজাতির সমগ্র জীবন যাপন করেন, সাধারণ মানুষের পূর্ণত্ব লাভ করিতে যে দীর্ঘকাল লাগে, সেই কাল তাঁহারা এই জীবনেই অতিক্রম করেন। এক জন্মেই তাঁহারা নিজেদের সিদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহারা আর কিছুই চিন্তা করেন না, অন্য কোন ভাবের জন্য একমুহূর্ত সময় কাটান না। এইরূপেই তাঁহাদের সময় সংক্ষিপ্ত হয়। একাগ্রতা বলিতে বুঝায়-শক্তিসঞ্চয়ের ক্ষমাতাবৃদ্ধি; এইভাবেই সময় সংক্ষিপ্ত করা হয়। রাজযোগ-বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেয়-কিভাবে এই একাগ্রতা-শক্তি করা যায়।
প্রাণায়ামের সহিত প্রেততত্ত্বের সম্বন্ধ কি? প্রেততত্ত্ব প্রাণায়ামেরই এক প্রকার শক্তি বিকাশ। যদি ইহা সত্য হয় যে, পরলোকগত আত্মার অস্তিত্ব আছে, আমরা শুধু উহাদিগকে দেখিতে পাই না, তাহা হইলে ইহাও খুব সম্ভব যে, এখানেই হয়তো শত শত লক্ষ লক্ষ আত্মা রহিয়াছে, যাহাদিগকে আমরা দেখিতে, অনুভব করিতে বা স্পর্শ করিতে পারি না। আমরা হয়তো সর্বদাই তাহাদের শরীরের মধ্য দিয়া যাতায়াত করিতেছি। আর ইহাও খুবই সম্ভব যে, তাহারাও আমাদিগকে দেখিতে বা কোনরূপে অনুভব করিতে পারে না। ইহা-একটি বৃত্তের ভিতর আর একটি বৃত্ত, একটি জগতের ভিতর আর একটি জগৎ। যাহারা এক ভূমিতে (Plane) থাকে, তাহারাই পরস্পরকে দেখিতে পায়। আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়-বিশিষ্ট প্রাণী, আমাদের প্রাণের স্পন্দন এক বিশেষ স্তরের। তাহাদের প্রাণের স্পন্দন একই প্রকারের, তাহারাই পরস্পরকে দেখিতে পাইবে। কিন্তু যদি এমন কোন প্রাণী থাকে যাহাদের প্রাণ অপেক্ষাকৃত উচ্চস্পন্দনশীল, তাহাদিগকে আমরা দেখিতে পাইব না। আলোকের তীব্রতা অতিশয় বর্ধিত হইলে আমরা উহা দেখিতে পাই না, কিন্তু অনেক প্রাণীর চক্ষু এরূপ শক্তিসম্পন্ন যে, তাহারা ঐরূপ আলোকও দেখিতে পায়। আবার যদি আলোকের স্পন্দন অতি মৃদু হয়, তখনও উহা আমরা দেখিতে পাই না, কিন্তু পেচক বিড়ালাদি জন্তুগণ উহা দেখিতে পায়। আমাদের দৃষ্টির সীমা এই প্রাণস্পন্দনের একটি স্তরেই অবস্থিত। অথবা বায়ুরাশির কথা ধর; বায়ু স্তরে যেন সজ্জিত রহিয়াছে। এক স্তরের উপর আর এক স্তর বায়ু স্থাপিত। পৃথিবীর নিকটবর্তী যে স্তর, তাহা উপরের স্তর অপেক্ষা অধিক ঘন; আরও উর্ধ্বদেশে যাইলে দেখিতে পাওয়া যায়, বায়ু ক্রমশঃ পাতলা হইতেছে।
অথবা সমুদ্রের দৃষ্টান্ত লও; সমুদ্রের যতই গভীর হইতে গভীরতর স্তরে যাইবে, জলের চাপ ততই বাড়িতে থাকিবে। যে-সকল জন্তু সমুদ্রতলে বাস করে, তাহারা কখনই উপরে আসিতে পারে না, কারণ আসিলেই খন্ডখন্ডরূপে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে।
সমগ্র জগৎকে ‘ইথার’-এর একটি সমুদ্ররূপে চিন্তা কর। প্রাণের শক্তিতে যেন উহা স্পন্দিত হইতেছে, বিভিন্ন গ্রামে স্পন্দিত হইয়া উহা যেন স্তরে স্তরে অবস্থিত। যে কেন্দ্র হইতে স্পন্দন আরম্ভ হইয়াছে, তাহা হইতে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই সেই স্পন্দন মৃদুভাবে অনুভূত হয়। কেন্দ্রের নিকট স্পন্দন অতি দ্রুত। এক-এক প্রকারের স্পন্দনে এক-একটি স্তর। তারপর মনে কর, এই-সকল স্পন্দনের স্তর বিভিন্ন সমতলে বিন্যস্ত হইল-লক্ষ লক্ষ যোজন বিস্তৃত একটি স্তর, আবার লক্ষ লক্ষ যোজন বিস্তৃত আর একটি উচ্চতর স্পন্দনের স্তর এইরূপ চলিতে থাকবে। এইভাবে চিন্তা করিলে দেখা যাইবে যে, যাহারা এক স্তরে বাস করে, তাহারা পরস্পরকে চিনিতে পারে, কিন্তু তাহা অপেক্ষা নিম্ন বা উচ্চ স্তরের জীবদিগকে চিনিতে পারিবে না। তথাপি যেমন আমরা অণুবীক্ষণ ও দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আমাদের দৃষ্টির সীমা বাড়াইতে পারি, সেইরূপ আমরা মনকে বিভিন্ন প্রকার স্পন্দনবিশিষ্ট করিয়া অপর স্তরের সংবাদ অর্থাৎ সেখানে কি হইতেছে, জানিতে পারি। মনে কর, এই গৃহেই এমন কতকগুলি প্রাণী আছে, যাহাদের আমরা দেখিতে পাইতেছি না। তাহারা প্রাণের এক প্রকার স্পন্দনের ও আমরা আর এক প্রকার স্পন্দনের ফলস্বরূপ। মনে কর, তাহারা অধিক স্পন্দনবিশিষ্ট ও আমর অপেক্ষাকৃত অল্প স্পন্দনশীল। তাহারা প্রাণ-রূপ মূলবস্তু হইতে গঠিত, আমরাও তাই। সকলেই এক প্রাণ-সমূদ্রেরই বিভিন্ন অংশ মাত্র, তবে বিভিন্নতা কেবল স্পন্দনের বেগে। যদি মনকে দ্রত স্পন্দনবিশিষ্ট করিতে পারি, সঙ্গে সঙ্গে আমার স্তর পরিবর্তিত হইবে, আমি আর তোমাদিগকে দেখিতে পাইব না, তোমরা আমার সন্মুখ হইতে অন্তর্হিত হইবে ও অপরে আবির্ভূত হইবে। তোমাদের মাধ্যে অনেকেই হয়তো জানো যে, এই ব্যাপার সত্য। মনকে উচ্চতর স্পন্দনের স্তরে উন্নীত করাকেই যোগশাস্ত্রে এক কথায় ‘সমাধি’ বলা হয়। এ-সকল উচ্চতর স্পন্দনের অবস্থাকে, মনের অতিচেতন স্পন্দনকে ‘সমাধি’ নামক একটি শব্দের অন্তর্ভূক্ত করা হয়; সমাধির নিম্নতর অবস্থাতেই ঐ-সব প্রেতাত্মা প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করা যায়। সমাধির সর্বোচ্চ অবস্থায় আমরা সত্যস্বরূপকে দর্শন করি, তখন আমরা দেখিতে পাই, কি উপাদানে এই সব নানা স্তরের জীব গঠিত। ‘একটি মৃৎপিন্ডকে জানিলে জগতের সকল মৃত্তিকাই জানা হইয়া যায়।’
এইরূপে আমরা দেখিতে পাই যে, প্রেততত্ত্ববিদ্যায় যেটুকু সত্য আছে, তাহাও এই প্রাণায়ামের অন্তর্ভূক্ত। এইরূপ যখনই দেখিবে, কোন এক দল বা সম্প্রদায় কোন অতীন্দ্রয় রহস্যবিদ্যা বা গুপ্ততত্ত্ব আবিষ্কার করিবার চেষ্টা করিতেছে, তখনই বুঝিবে তাহারা প্রকৃতপক্ষে কিছু পরিমাণে এই রাজযোগই সাধন করিতেছে, প্রাণসংযমের চেষ্টা করিতেছে।
যেখানেই কোনরূপ অসাধারণ শক্তির বিকাশ হইয়াছে, সেখানেই দেখিবে-এই প্রাণের অভিব্যক্তি। জড়বিজ্ঞানগুলিও প্রাণায়ামের অন্তর্ভূক্ত করা যাইতে পারে। বাষ্পীয় যন্ত্রকে কে চালিত করে? প্রাণই বাষ্পের মধ্য দিয়া উহাকে চালাইয়া থাকে। তড়িৎ প্রভৃতির যে অত্যদ্ভুত ক্রিয়াসমূহ দেখা যাইতেছে, এগুলি প্রাণশক্তি ব্যতীত আর কি হইতে পারে? পদার্থ-বিজ্ঞানই বা কি? উহা বাহ্য উপায়ে অনুষ্ঠিত প্রাণায়াম-বিজ্ঞান। প্রাণ যখন মনঃশক্তিরূপে প্রকাশিত হয়, তখন মানসিক উপায়েই উহাকে নিয়ন্ত্রিত করা যাইতে পারে। প্রাণায়াম-বিজ্ঞানের যে অংশে প্রাণের স্থূল প্রকাশগুলিকে বাহ্য উপায়ের দ্বারা জয় করিবার চেষ্টা করা হয়, তাহাকে পদার্থ-বিজ্ঞান বলে। আর প্রাণায়ামের যে অংশে মনঃশক্তিরূপ প্রাণের বিকাশগুলিকে মানসিক উপায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করা হয়, তাহাকেই ‘রাজযোগ’ বলে।