০৩. প্রত্যাক্ষানুভূতিই ধর্ম

ভক্তের পক্ষে এই-সকল শুষ্ক বিষয় জানার প্রয়োজন—কেবল নিজ ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করার জন্য। এতদ্ব্যতীত উহাদের আর কোন উপযোগিতা নাই, কারণ তিনি এমন এক পথে চলিয়াছেন যাহা শীঘ্রই তাঁহাকে যুক্তির অস্পষ্ট ও চিত্তচঞ্চলকারী রাজ্যের সীমা ছাড়াইয়া প্রত্যক্ষানুভূতির রাজ্যে লইয়া যাইবে; তিনি শীঘ্রই ঈশ্বরকৃপায় এমন এক অবস্থায় উপনীত হন, যেখানে পাণ্ডিত্যাভিমানিগণের শুষ্ক যুক্তি অনেক পশ্চাতে পড়িয়া থাকে, আর বুদ্ধির সাহায্যে অন্ধকারে বৃথান্বেষণের পরিবর্তে প্রত্যক্ষানুভূতির উজ্জ্বল দিবালোক প্রকাশিত হয়। তিনি তখন বিচার বা বিশ্বাস কিছুই করেন না, তিনি প্রত্যক্ষ অনুভব করেন। তিনি আর তর্ক করেন না, উপলব্ধি করেন। আর এই ভগবানকে দেখা, তাঁহাকে উপলব্ধি করা ও তাঁহাকে সম্ভোগ করা কি তর্কবিচার হইতে উচ্চতর নয়? শুধু তাই নয়, অনেক ভক্ত আছেন, যাঁহারা ভক্তিকে মুক্তি হইতেও বড় বলিয়াও বর্ণনা করিয়াছেন। আর ইহা কি আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ প্রয়োজনও নয়? এমন লোক জগতে আছেন, তাঁহাদের সংখ্যাও অনেক, যাঁহারা স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, যাহা কিছু মানুষকে সুখ দিতে পারে—তাহারই বাস্তবিক প্রয়োজন ও উপকারিতা আছে; ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল, আত্মা এবং এইরূপ অন্যান্য বিষয়গুলি কোন কাজের নয়, কারণ এগুলি দ্বারা টাকাকড়ি বা দৈহিক সুখ পাওয়া যায় না। এরূপ লোকের মতে যে-সকল পদার্থে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ না হয়, সেগুলির কোন প্রয়োজন নাই। যাহার যে-বিষয়ে যেমন অভাববোধ, তাহার প্রয়োজনবোধও সেই বিষয়ে তদনুরূপ। সুতরাং যাহারা পান, ভোজন, অপত্য-উৎপাদন ও তারপর মৃত্যু—ইহার উপর আর উঠিতে পারে না, তাহাদের পক্ষে লাভ-বোধ কেবল ইন্দ্রিয়ের সুখে। তাহাদের হৃদয়ে উচ্চতর বিষয়ের জন্য সামান্য ব্যাকুলতা জন্মিতেও অনেক জন্ম লাগিবে। কিন্তু যাঁহাদের নিকট আত্মার উন্নতি-সাধন ঐহিক জীবনের ক্ষণিক সুখ অপেক্ষা অধিকতর মূল্যবান্ বোধ হয়, যাঁহাদের চক্ষে ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি কেবল অবোধ শিশুর ক্রীড়ার মত মনে হয়, তাঁহাদের নিকট ভগবান্ ও ভগবৎ-প্রেমেই মানবজীবনের সর্বোচ্চ ও একমাত্র প্রয়োজন বলিয়া বিবেচিত হয়। ঈশ্বরেচ্ছায় এই ঘোর ভোগলিপ্সাপূর্ণ জগতে এইরূপ মানুষ এখনও কয়েকজন জীবিত আছেন।

পূর্বেই বলিয়াছি, ভক্তি পরা ও গৌণী—এই দুই ভাগে বিভক্ত; ‘গৌণী’ অর্থাৎ সাধন ভক্তি, ‘পরাভক্তি’ উহারই পূর্ণ বা চরম অবস্থা। ক্রমশঃ বুঝিতে পারিব, এই ভক্তিমার্গে অগ্রসর হইতে হইলে সাধনাবস্থায় কতকগুলি বাহ্য সহায় না লইলে চলে না। বাস্তবিক সকল ধর্মের পৌরাণিক ও রূপক ভাগই প্রথমাবস্থায় উন্নতিকামী আত্মাকে ভগবানের দিকে অগ্রসর হইতে সাহায্য করে। আর ইহাও একটি বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয়—যাহাদের ধর্মপ্রণালী পৌরাণিকভাববহুল ও অনুষ্ঠানপ্রচুর, সেই-সকল সম্প্রদায়েই বড় বড় ধর্মবীর জন্মিয়াছিলেন। যাহা কিছু কবিত্বময়, যাহা কিছু সুন্দর, যাহা কিছু মহান্, যাহা কিছু ভগবৎ-পথে স্খলিতচরণে অগ্রসর সুকুমার মনের দৃঢ় অবলম্বন-স্বরূপ, সেই ভাবগুলিকে যে-সকল শুষ্ক গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্মপ্রণালী একেবারে উৎপাটন করিয়া ফেলিতে চায়—যে-সকল ধর্মপ্রণালী আধ্যাত্মিক হর্ম্যের ছাদের অবলম্বন স্তম্ভগুলিকে পর্যন্ত ভাঙিয়া ফেলিতে চেষ্টা করে এবং সত্যসম্বন্ধে অজ্ঞান ও ভ্রমপূর্ণ ধারণা লইয়া যাহা কিছু জীবনপ্রদ, যাহা কিছু মানবহৃদয়ে ক্রমবর্ধমান আধ্যাত্মিক জীবনরূপ চারাগাছটির গঠনোপযোগী উপাদান, সেগুলি পর্যন্ত দূর করিয়া দিতে চায়, দেখিতে পাওয়া যায়—সেই-সকল ধর্ম শীঘ্রই একটি আধারে, শব্দরাশি ও তর্কাভাসের একটি কাঠামোতে পর্যবসিত হইয়াছে। হয়তো একটু সামাজিক আবর্জনা-দূরীকরণ বা তথাকথিত সংস্কার-প্রিয়তার আভাসযুক্ত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে।

যাহাদের ধর্ম এইরূপ, তাহাদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে জড়বাদী; তাহাদের ঐহিক ও পারত্রিক জীবনের লক্ষ্য কেবল ভোগ; উহাই তাহাদের মতে মানবজীবনের সর্বস্ব। মানুষের ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অভিপ্রেত রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার রাখা প্রভৃতি কার্যই২০ ইহাদের মতে মানব-জীবনের সর্বস্ব। এই অজ্ঞান ও গোঁড়ামির অদ্ভুত মিশ্রণের অনুগামিগণ যত শীঘ্র তাহাদের স্বরূপ প্রকটিত করিয়া বাহির হয় এবং নাস্তিক জড়বাদীদের দলে যোগ দেয়—ইহাই তাহাদের করা উচিত—ততই সংসারের মঙ্গল। একবিন্দু ধর্মানুষ্ঠান ও অপরোক্ষানুভূতি রাশি রাশি বাক্‌প্রপঞ্চ ও মূর্খ-সুলভ ভাবোচ্ছ্বাস অপেক্ষা সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ। অজ্ঞান ও গোঁড়ামির এই শুষ্ক ধূলিময় ক্ষেত্রে একজন—মাত্র একজন অমিততেজা ধর্মবীর জন্মিয়াছেন, দেখাও তো! না পার, চুপ করিয়া থাক, হৃদয়ের দরজা-জানালা খুলিয়া দাও, সত্যের বিমল আলোক প্রবেশ করুক, তত্ত্বদর্শী সেই ভারতীয় সাধুগণের পদতলে বালকের ন্যায় বসিয়া শোন, তাঁহারা কি বলিতেছেন।


২০ ইষ্টাপূর্ত