এই অঞ্চলের পুলিশের বড়কর্তার নাম সুলতান আলম। তাঁর চেহারাটা দেখার মতো। ছফুটের বেশি লম্বা, তেমনই স্বাস্থ্যবান, বেশ ফরসা গায়ের রং। তাঁর গোঁফটা কাকাবাবুর চেয়েও অনেক বেশি মোটা আর দুদিকে সূচলো, মাথার চুল থাক থাক করা।
তাঁকে দেখলে ইতিহাস বইয়ের কোনও ছবির কথা মনে পড়ে।
তিনি কর্নেলসাহেবকে আগে থেকেই চেনেন। কাকাবাবুর নাম শোনার পর খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী? মানে, আপনি কি সেই রাজা রায়চৌধুরী?
কাকাবাবু একটু হেসে বললেন, সেই মানে কী?
সুলতান আলম বললেন, আপনি আরকিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খুব বড় অফিসার ছিলেন না একসময়?
কাকাবাবু বললেন, সে অনেক দিন আগেকার কথা।
সুলতান আলম বললেন, আপনার কি সেলিম রহমান নামে কাউকে মনে আছে? আপনার আন্ডারে কাজ করতেন?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বেশ মনে আছে। সে খুব আমুদে লোক ছিল আর ভাল গান গাইত।
সুলতান বললেন, সেই সেলিম রহমান আমার মামা। তাঁর কাছে। আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনিই তো সম্রাট কনিষ্কর মুন্ডু খোঁজার জন্য কাশ্মীরের সোনমার্গ গিয়েছিলেন।
জোজো বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাকাবাবু ইজিপ্টের ফেমাস পিরামিডের মধ্যেও ঢুকেছিলেন।
সন্তু চোখ দিয়ে জোজোকে বকুনি দেওয়ার চেষ্টা করল। কাকাবাবু এসব বলা পছন্দ করেন না।
সুলতান এবার কর্নেলের দিকে ফিরে বললেন, কী কর্নেলসাহেব, কী দেখলেন এখানে? সত্যি সত্যি বাঘ এসেছিল?
কর্নেল বললেন, এখন আর অবিশ্বাস করা যাচ্ছে না। একটা রামছাগলকে থাবা মেরেছে। দুটো হাঁসও নিয়ে গিয়েছে।
জোজো বলল, একটা চোরও এসেছিল। বিস্কুট আর দুধ চুরি করেছে।
সুলতান একটু অবাক হয়ে বললেন, চোর? চোরের সঙ্গে বাঘের কী সম্পর্ক?
জোজো বলল, চোর আর বাঘটা একসঙ্গে এসেছিল!
এটাকে একটা হাসির কথা মনে করে পুলিশসাহেব হা হা করে হাসলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন বাড়িটার কাছে।
ছাগলটা এখনও ছটফট করছে আর প্রচণ্ড জোরে চাচাচ্ছে। একটুক্ষণ সেটার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বললেন, এমনভাবে কামড়েছে, এ প্রাণীটা তো আর বাঁচবে না মনে হচ্ছে। শুধু শুধু আর একে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
কোমর থেকে রিভলভারটা বের করে তিনি একবার মাত্র গুলি চালালেন। ছাগলটা সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল।
কয়েকজনের অনুরোধ শুনে সুলতান পাশের দোকানটাও দেখতে গেলেন। ভাঙা জানলা আর ভিতরের জিনিসপত্র ছড়ানো উঁকি মেরে দেখলেন শুধু। তারপর জনতাকে বললেন, এখানে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে হল্লা করার দরকার নেই। এখনই দারোগাবাবু আসছেন আরও পুলিশ নিয়ে। তারা পাহারা দেবে। আপনারা ভয় পাবেন না, বাড়ি যান। সামান্য একটা বাঘ, কালকেই আমরা ওকে ধরে ফেলব।
কাকাবাবুদের কাছে ফিরে এসে তিনি বললেন, পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ব্যাপারইনা ঘটে। মাণ্ডুতে বাঘ?বুঝলেন, কর্নেল, আমি আগে বিশ্বাসই করিনি। আমার তো এখানে থাকার কথা নয়। আমি গতকালই এসেছি এক আত্মীয়র বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে। একজন যে-ই খবর দিল, অমনই আমি নিজের চোখে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি ছুটে এলাম। এসব ব্যাপার নিয়ে তো আমার মাথা ঘামাবার কথা নয়। স্থানীয় পুলিশ ভার নেবে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকদের ডাকতে হবে। আমি এসেছি শুধু নিজের কৌতূহলে।
কর্নেল বললেন, এটা টুরিস্ট সিজন। বাঘের ভয়ে যদি সব টুরিস্ট পালিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু লোকজনদের খুব ক্ষতি হবে। বাঘটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরে ফেলা দরকার।
সুলতান বললেন, ধরে ফেলাটা সহজ নয়। বরং মেরে ফেলা সহজ। কিন্তু বাঘ মারা যে এখন নিষেধ? আগে ধরারই চেষ্টা করতে হবে। সেটা বনবিভাগের দায়িত্ব।
কর্নেল বললেন, এ ব্যাপারে আমি বনবিভাগকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি বোধহয়।
সুলতান বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে যখন দেখাই হয়ে গেল, চলুন না, কোথাও বসে গল্প করি। এই কর্নেলের বাড়িতেই যাওয়া যেতে পারে। উনি খুব ভাল রান্না করেন, চটপট অনেক কিছু বানিয়ে ফেলতে পারেন। আপনার সঙ্গের ছেলে দুটিকে বরং ঘরে ফিরে যেতে বলুন। ওরা যদি ভয় পায়, আমার বডিগার্ড সঙ্গে যেতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, ওরা ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। আপনারাই বরং আমাদের গেস্টহাউসে চলুন। আমি অন্য কোথাও গেলে আমাকে তো আবার পৌঁছে দিতে আসতে হবে কাউকে।
একটু পরে সবাই চলে এলেন গেস্টহাউসে। বসা হল ডাইনিং রুমের একটা টেবিলে। বাইরেটা আজও অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু শোনা যাচ্ছে ঝরনার জলের শব্দ।
সুলতান আলম কাকাবাবুকে বললেন, আপনাকে এই ছোট্ট জায়গায় দেখতে পাব, এটা আশাই করিনি। এখানেও কি কোনও রহস্যের সন্ধানে এসেছেন নাকি? খুব পুরনো জায়গা, কোথাও কোনও গুপ্তধন টুপ্তধন থাকতেও পারে।
কাকাবাবু বললেন, না, না, ওসব কিছুনা। আমি এসেছিলাম উজ্জয়িনীতে একটা কাজে। আমার ভাইপো সন্তু আর তার বন্ধু জোজো আমার সঙ্গে অনেক জায়গায় যায়। তাই ভাবলাম, ওদের এই মাণ্ডু জায়গাটাও দেখিয়ে নিয়ে যাই। কয়েকদিন থাকার পক্ষে তো এটা খুব সুন্দর জায়গা।
সুলতান বললেন, তা ঠিক। উজ্জয়িনীতে আপনার কী কাজ ছিল?
কাকাবাবু বললেন, সেটাও ঠিক কাজ বলা যায় না। আসল কারণটা শুনলে আপনারা হাসবেন।
সন্তু আর জোজোর মুখে এর মধ্যেই হাসি ফুটে উঠেছে।
কর্নেল বললেন, শুনি, শুনি, আসল কারণটা শুনি।
কাকাবাবুবললেন, উজ্জয়িনীতে আমার এক পিসিমা থাকেন। পিসেমশাই হাইকোর্টের জজ ছিলেন, মারা গিয়েছেন অনেক দিন। আর পিসিমাও ছিলেন এক কলেজের অধ্যক্ষা, তাও রিটায়ার করেছেন বহু বছর আগে, এখনও নানারকম কাজটাজ করেন।
সুলতান জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম আপনার পিসিমার?
কাকাবাবু বললেন, সুপ্রভা রায়। চেনেন?
সুলতান ভুরু উঁচিয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি? সুপ্রভা রায়কে এ তল্লাটে কে না চেনে? সবাই তাঁকে ডাকে বড়কাদিদি। গরিব মানুষদের জন্য অনেক কিছু করেন, বস্তির ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখান। কত বয়স হবে এখন, এইট্টি ফাইভ? তবু সারাদিন ব্যস্ত। তবে মহিলার খুব কড়া মেজাজ। একবার আমাকেও ডেকে খুব ধমকে ছিলেন।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার পিসিমা খুব মেজাজি মানুষ। তিনি একটা টেলিগ্রাম পাঠালেন, আমি আর কতদিন বাঁচব ঠিক নেই। রাজা, তোকে একবার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, তুই শিগগিরই এখানে চলে আয়। তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথাও আছে। সেই টেলিগ্রাম পেয়ে আমি ভাবলাম, সত্যিই তো পিসির অনেক বয়স হয়েছে, কখন কী হয় ঠিক নেই। একবার দেখা করাই উচিত। তাই চলে এলাম।
সুলতান বললেন, কিন্তু সুপ্রভা রায়ের তো কোনও অসুখবিসুখ করেনি? তিনদিন আগেও আমি দেখেছি, একটা বস্তির মধ্যে হেঁটে-হেঁটে ওষুধ বিলি করছেন।
কাকাবাবু বললেন, আমিও এসে দেখলাম, পিসিমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই আছে। এই বয়সেও যথেষ্ট পরিশ্রম করতে পারেন। যাই হোক, তবু দেখা হয়ে গেল। এমনিতে তো আর এদিকে আসা হয় না। সন্তুদের এখন কলেজ ছুটি, ওরাও কোথাও বেড়াতে যেতে চাইছিল।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, উনি আপনাকে জরুরি কথা কী বললেন?
কাকাবাবু হেসে বললেন, সেটাও এমন কিছু জরুরি নয়। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হারে রাজা, তুই কি আর বিয়ে করবি না? আমি বললাম, না পিসিমা, আমারও তো যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছে, আর আমি বিয়ের ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যাব না! তা শুনে পিসিমা বকুনি দিয়ে বললেন, ঝঞ্ঝাট আবার কী? বিয়ে মানে কী ঝঞ্ঝাট! এই বয়সেও অনেকের বিয়ে হয়।
সুলতান বললেন, ঠিকই তো বলেছেন বড়কাদিদি। আপনার বয়সে অনেক মানুষের বিয়ে হয়। বলুন, পাত্রী দেখব নাকি?
কাকাবাবু বললেন, মাথা খারাপ! ওসবের আর প্রশ্নই ওঠে না। যাই হোক, খানিকক্ষণ বকাঝকার পর পিসিমা বললেন, শোন, আমার এই যে বাড়ি, বাগান, ব্যাঙ্কের সব টাকাপয়সা, এই সব আমি রামকৃষ্ণ মিশনের নামে উইল করে দিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ে নেই, তোদেরও এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। কিন্তু কয়েকজনের নামে কয়েকটা জিনিস আমার কাছে আছে। যেমন, আমার শাশুড়িমা একটা খুব দামি হিরের আংটি আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, এটা রাজার বিয়ের সময় তার বউকে দিবি। সেই আংটিটা আমার কাছে রয়ে গিয়েছে। তুই বিয়ে করলি না, এখন সেই আংটি নিয়ে আমি কী করব? সেটা তোকে নিতে হবে। আমি বললাম, পিসি, আমি তো আংটি পরি না। ওটা নিয়ে আমি কী করব? তুমি আংটিটাও দান করে দাও। তাতে পিসি বললেন, আমার শাশুড়িমা তোর নাম করে রেখে গিয়েছেন। তা আমি কী করে অন্য লোককে দেব? ওটা তোকে নিতেই হবে! জোর করে সেটা তিনি আমায় গছিয়ে দিলেন।
কর্নেল বললেন, তা হলে তো স্যার, ওই আংটির জন্যই আপনার একটা বিয়ে করে ফেলা উচিত।
কাকাবাবু বললেন, যা বলেছেন! ও আংটি আমি সন্তুকে দিয়ে দেব ঠিক করেছি!
সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আমিও আংটি পরি না। আমি আংটি চাই, আংটি চাই না!
কর্নেল বললেন, তুমি পরবে না। তোমার তো একসময় বিয়ে হবে, তোমার বউ পরবে!
সন্তু তবু বলল, না, আমি আংটিফাংটি চাই না।
সুলতান বললেন, এ যে দেখছি একটা আংটি-সমস্যা হয়ে গেল! যাই হোক, দামি আংটি বলছেন, সাবধানে রাখবেন। এখানে তো চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছে।
কর্নেল বললেন, আংটিটা চুরি গেলে আংটি-রহস্য নামে বেশ একটা গল্প হয়ে যাবে।
জোজো বলল, আংটি-রহস্য নিয়ে সত্যজিৎ রায় গল্প লিখে ফেলেছেন। আর সে গল্প জমবে না।
সুলতান বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, যখন এখানে এসেই পড়েছেন, তখন এই বাঘের রহস্যটা সমাধান করে দিন। শহরের মতো জায়গায় বাঘ ঢুকবে কেন?
কাকাবাবু বললেন, না, না, এর মধ্যে আমি নেই। বাঘের রহস্য সমাধান করার ক্ষমতাই আমার নেই। বাংলায় একটা কথা আছে, বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা। আমি সেধে সেধে সে ঘা করতে চাই না। আপনারাই কিছু করুন, আমরা গল্প শুনব।
সুলতান বললেন, আমার বাবা চারখানা বাঘ মেরেছিলেন। আমিও বাঘ শিকার করতে পারি। কিন্তু ফাঁদ পেতে বাঘ ধরা আমার দ্বারা হবে না। কাল আমি উজ্জয়িনী ফিরে যাচ্ছি। কর্নেলসাহেব যা করার করবেন।
কর্নেল বললেন, বাঘের কথাটা প্রথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু বছর পাঁচেক আগে নাকি এরকম একটা বাঘ ঢুকে পড়েছিল মাণ্ডুতে। সেবারে দুজন মানুষকেও মেরেছিল। তাই এখানকার লোক বাঘের কথা শুনলেই এত ভয় পায়।
সুলতান বললেন, মাস দুয়েক আগে ধার শহরেও একটা বাঘ এসেছিল নাকি। গুজব কি না জানি না। একটা মোষ আর একটা শুয়োর মেরেছিল। কিন্তু কেউ বাঘটাকে স্বচক্ষে দেখেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, ঘটনাটা আমারও কানে এসেছে। তবে তখন আমার গুজব বলেই মনে হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, সেটাও সত্যি হতে পারে। এদিকে তো অনেক ছোট ছোট পাহাড় আর কিছু কিছু জঙ্গলও আছে। জন্তু-জানোয়ার অনেক কমে গিয়েছে, বড় জানোয়ার কিছু নেই-ই বলতে গেলে। তবু দু-একটা বাঘ-ভালুক থেকে যেতেও পারে।
সুলতান বললেন, বাঘের দেখা না পাওয়া গেলেও ভালুক তো এখনও আছে যথেষ্ট। আমি নিজেও তিন-চারবার দেখেছি। বুনো ভালুক শহরে ঢোকে। না। কিন্তু হাইওয়ের উপরে এসে পড়ে কখনও কখনও!
কর্নেল বললেন, জন্তু-জানোয়ার যে কখন কোথায় হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাবে, তার কোনও ঠিক নেই। আপনার মনে আছে, গতবছর ঠিক এই সময় উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের সামনে হঠাৎ একটা মস্ত বড় পাইথন ধরা পড়েছিল। অত বড় সাপটা ওখানে এল কী করে বলুন তো?
সুলতান বললেন, সাপ যে কোথায় কী করে ঢুকে পড়ে, তা বলা মুশকিল। একবার ইন্দোরে আমাদের বাড়ির বেডরুমে একটা সাপ দেখেছি!
কর্নেল বললেন, ছোটখাটো সাপ সুড়ুত করে ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু অত বড় একটা পাইথন, কোথা থেকে এল, কেউ দেখতে পেল না?
সুলতান বললেন, আকাশ থেকে তো পড়েনি, নিশ্চয়ই শিপ্রা নদীর পানিতে ভেসে এসেছে। খুব বন্যার সময় বাঘও ভেসে আসতে পারে।
কর্নেল বললেন, এখন তো সেরকম কোনও বন্যা হয়নি। তা ছাড়া, পাহাড়ের উপর দিকে তো বন্যা হতে পারে না, বন্যা হয় নীচের দিকে।
সুলতান বললেন, যাই হোক, দেখতে হবে, এই বাঘটা যাতে মানুষ না মারে। মানুষ মারলেই খবরের কাগজে হইচই পড়ে যাবে।
একটু পরে আজ্ঞা ভঙ্গ হল।
কর্নেল আর সুলতান আলম চলে যাওয়ার পর মান্টো সিংহ এসে বলল, সাহাব, আজ অনেক দোকান বন্ধ ছিল, তাই মুরগি পাওয়া যায়নি। আপনাদের আজ নিরামিষ খেতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, তাতে কোনও আপত্তি নেই। বেগুন আছে তো? বেগুনভাজা করে দাও!
জোজো জিজ্ঞেস করল, আন্ডা হ্যায় তো? অমলেট করকে দেও।
মান্টো সিংহ বলল, আন্ডা ভি নেহি। আলুভাজা হবে।
জোজো বলল, বাঘটা তো মহাপাজি! ওর জন্য আমাদের নিরামিষ খেতে হবে? আর ও নিজে দিব্যি হাঁসের মাংস খাবে?
সন্তু বলল, আমাদের কী সুবিধে বল তো! আমরা নিরামিষও খেতে পারি, আবার মাছ-মাংসও ভাল লাগে। বাঘ-সিংহরা নিরামিষ খেতে জানেই না!
পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সূর্য দেখাই গেল না। বৃষ্টি কখনও বেশ জোরে, কখনও টিপিটিপি। দুপুরবেলা কিছুক্ষণের জন্য থামলেও আবার শুরু হল ঝমঝমিয়ে।
এরকম বৃষ্টিতে বাইরে বেরোনোই যায় না। কাকাবাবু বই পড়েই কাটিয়ে দিলেন সারাদিন। সন্তু আর জোজো অনেকটা সময়ই বসে রইল জানলার ধারে। বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসাভাবে দেখা যাচ্ছে খাদের উলটো দিকের পাহাড়টা।
নির্মল আর জয়ন্তী রায়দের আজ ফিরে যাওয়ার কথা। একটা গাড়ি ভাড়া করা আছে। কিন্তু সেই গাড়িটা আসছে না। ওঁরা ছটফট করছেন। টিটো সেজেগুজে একেবারে রেডি। সে সন্তু আর জোজোর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, বৃষ্টির সময় বাঘেরা কী করে?
সন্তু বলল, বৃষ্টিতে ভিজলেই বাঘেদের সর্দি হয়। তাই ওরা গুহার মধ্যে বসে থাকে।
জোজো বলল, বসে থাকে না, শুয়ে থাকে। গান গায়।
চোখ বড় বড় করে টিটো জিজ্ঞেস করল, বাঘেরা গান করতে পারে?
জোজো বলল, হ্যাঁ। আমি শুনেছি। আমি ওদের একটা গান জানি। শুনবে?
টিটো লাফাতে লাফাতে বলল, শুনব, শুনব!
জোজো সুর করে গাইতে লাগল,
হালুম হুম হা গোঁ গোঁ গোঁ
এ্যারর ব্র্যার ঘ্রার ওয়াম হোঁ হোঁ
হালুম হুম হা…
এই সময় ভাড়ার গাড়িটা এসে গেল। বৃষ্টি এখনও পড়ছে।
টিটো কিন্তু এখন আর যেতে চায় না। সে বাঘের গান আরও শুনবে। সে জোজোকে আঁকড়ে ধরে রইল। শেষ পর্যন্ত তাকে জোর করেই তোলা হল গাড়িতে।
ওরা চলে যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, জোজো, তুই বাঘের এই গানটা এইমাত্র বানালি? না, আগেই তৈরি ছিল?
জোজো বলল, এইমাত্র বানালুম!
সন্তু বলল, সুরটুর দিয়ে? সত্যি, এটা তোর অদ্ভুত ক্ষমতা। তোর গল্পগুলোও।
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, গল্প নয়। আমি যা বলি, তা সব সত্যি ঘটনা।
সন্ধের পর কর্নেলসাহেব কাকাবাবুকে ফোন করে বললেন, আজ সারাদিন বেরোননি তো? বেরোবেন কী করে? পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানোও ডেঞ্জারাস। আমিও তাই বেরোইনি। তবে, আজ সারাদিন এখানে কী ঘটেছে, তা শুনেছেন?
কাকাবাবু বললেন, না, শুনিনি। মান্টো সিংহকে অনেকক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। কিছু ঘটেছে নাকি?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। এই বৃষ্টির মধ্যেও বাঘটা বেরিয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? কেউ দেখেছে?
কর্নেল বলল, পুলিশের খবর অনুযায়ী, দুজন দেখেছে। বাঘটা একটা খামারবাড়িতে ঢুকে একটা মোষকে অ্যাটাক করেছিল। মোষটা বাঁধা ছিল, বেশ বড় মোষ, তারও তো গায়ে বেশ জোর, বাঘটা তাকে মারতে পারেনি, খানিকটা মাংস খুবলে নিয়েছে। সে-বাড়ির মালিক উপরের জানলা দিয়ে বাঘটাকে দেখতে পেয়েও ভয়ে নীচে নামেনি। কাছাকাছি আরও একটা বাড়ির গোয়ালঘরে ঢুকে বাঘটা একটা বাছুরকে মেরেছে। সেখানে একজন বুড়ি তখন গোয়ালঘরেই ছিল, সে আহত হয়েছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বুড়িকেও কামড়েছে নাকি?
কর্নেল বললেন, না। আপনি তো জানেন, এদিককার বাঘ ম্যানইটার হয়। সাধারণত মানুষকে অ্যাটাকও করে না। বুড়িটা হয়তো অত সামনাসামনি বাঘ দেখে ভয়ের চোটেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। পড়ে গিয়ে তার মাথায় চোট লেগেছে।
কাকাবাবু বললেন, সেটা হওয়াই সম্ভব।
কর্নেল বললেন, আজও একটা দোকানঘর ভেঙে চুরি হয়েছে। কিন্তু চোর টাকাপয়সা কিছু নেয়নি। নিয়েছে বিস্কুট আর গুঁড়ো দুধের টিন।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? বাঘের চেয়ে এই চোরটাই দেখছি বেশি ইন্টারেস্টিং। বাঘ জন্তু-জানোয়ার মারবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু একটা চোর টাকাপয়সা খোঁজে না, শুধু দু-এক প্যাকেট বিস্কুট আর দুধ চুরি করে। এ কি কেউ কখনও শুনেছে? আর এই চোর কি বাঘের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়?
কর্নেল বললেন, সত্যি, এ ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। শুনুন, সেই বুড়ি বলেছে, বাঘ একটা নয়, দুটো।
কাকাবাবু বললেন, অ্যাঁ এর মধ্যে আবার বেড়ে গেল?
কর্নেল বললেন, বুড়ির কথা কতটা বিশ্বাস করা যায়, জানি না। ভয়ের চোটে চোখে ডাল্ট দেখতে পারে। তবে বুড়ি জোর দিয়ে বলেছে, একটা বড় বাঘ, তার সঙ্গে একটা ছোট বাঘ। তার মানে বাঘের সঙ্গে তার বাচ্চা। বাঘ কি তার বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে লোকালয়ে এসে হামলা করে? নাকি বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে আসে?
কাকাবাবু বললেন, আমি বাঘ সম্পর্কে অতশত জানি না। বাঘের বাড়ি কীরকম হয়, তাও দেখিনি।
কর্নেল বললেন, যাই হোক, শুনুন স্যার। এখানকার বনবিভাগের এক অফিসারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, সামনের পাহাড়টায় একবার তল্লাশ করতে যাব, সম্ভবত বাঘটা ওখানেই ডেরা বেঁধেছে। আপনারা সঙ্গে যেতে চান?
কাকাবাবু বললেন, অবশ্যই যেতে চাই। আজ রাত্তিরেই যাওয়া হবে?
কর্নেল বললেন, না। এখন গিয়ে লাভ নেই। বৃষ্টি থেমে আসছে। খুব ভোরবেলা বেরোব। আপনাদের আমার গাড়িতে তুলে নেব। তা হলে ছেলে দুটোকে বলুন। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে।