৩য় অধ্যায়
পিতৃশত্রুনাশে অশ্বত্থামার যুক্তি
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! তখন মহাবীর অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্যের সেই ধর্ম্মার্থযুক্ত বাক্য-শ্রবণে শোকানলে দগ্ধ হইয়া ক্রূরভাবে তাঁহাকে ও কৃতবর্ম্মাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, হে বীরদ্বয়। ব্যক্তিমাত্রেরই বুদ্ধিবৃত্তি পৃথক পৃথক্। সকলেই অন্য অপেক্ষা আপনাকে সমধিক বুদ্ধিমান জ্ঞান করিয়া নিরন্তর আত্মবুদ্ধির প্রশংসা ও পরবুদ্ধির নিন্দা করে। এক এক বিষয়ে যাহাদের বুদ্ধির ঐক্য হয়, অন্য অন্য বিষয়ে তাহাদিগেরই বুদ্ধি পরস্পর নিতান্ত বিপরীত হইয়া উঠে। মনুষ্যগণের চিত্তবৈচিত্র্যই বুদ্ধিবৈচিত্র্যের কারণ। সুবিজ্ঞ বৈদ্য যেমন ব্যাধি নির্ণয় করিয়া রোগশান্তির নিমিত্ত বুদ্ধি-প্রভাবে যথাবিধি ঔষধ নির্ণয় করেন, তদ্রূপ অন্যান্য মানবগণও স্বীয় স্বীয় কার্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত যথোপযুক্ত বুদ্ধি আশ্রয় করিয়া উপায় নির্ধারণ করিয়া থাকে। অনেক মনুষ্যের বুদ্ধির ঐক্য হওয়া দূরে থাকুক, এক ব্যক্তির বুদ্ধিও সকল সময়ে সমান থাকে না। দেখ, মনুষ্য যৌবনকালে যে বুদ্ধি প্রভাবে বিমোহিত হয়, প্রৌঢ়াবস্থায় তাহার আর সে বুদ্ধি থাকে না এবং প্রৌঢ়াবস্থায় যে বুদ্ধির প্রাদুর্ভাব হয়, বৃদ্ধাবস্থা উপস্থিত হইলে সে বুদ্ধি একেবারে তিরোহিত হইয়া যায়। হে ভোজরাজ! বিষয়, দুঃখ বা অধিক সম্পদের সময় মনুষ্যের বুদ্ধি বিকৃত হইয়া থাকে। মনুষ্যমাত্রেই আপনার বুদ্ধি অনুসারে কাৰ্য্য নিশ্চয় করিয়া তাহাতে প্রবৃত্ত হয়। সুতরাং বুদ্ধিকেই কার্য্যের উদ্যোগকারিণী বলিতে হইবে। লোকে মারণাদি কাৰ্য্য অতি উৎকৃষ্ট বিবেচনা করিয়াই প্রীতমনে সেই সকল নিন্দনীয় কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। ফলতঃ সকল লোকই স্ব স্ব বুদ্ধিপ্রভাবে বিবিধ কার্য্য নির্ণয় করিয়া তাহার অনুষ্ঠান করে।
আজ বিষম দুঃখপ্রভাবে আমার যেরূপ বুদ্ধি উপস্থিত, তাহা আপনাদের নিকট ব্যক্ত করিলাম। আমি স্থির করিয়াছি যে, ঐরূপ কাৰ্য্য করিলেই আমার শোক বিনষ্ট হইবে। দেখ, প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রজাগণের সৃষ্টি ও তাহাদিগের ভিন্ন ভিন্ন কার্য্য নির্ণয় পৃথক পৃথক্ বর্ণে পৃথক পৃথক্ গুণ নিয়োজিত করিয়াছেন। তিনি ব্রাহ্মণে বেদ, ক্ষত্রিয়ে তেজ, বৈশ্যে দক্ষতা ও শূদ্রে সর্ব্ববর্ণের অনুকূলতা প্রদান করিয়াছেন। অতএব অদান্ত [অসংযমী] ব্রাহ্মণ, নিস্তেজ ক্ষত্রিয়, অদক্ষ বৈশ্য ও প্রতিকূলাচারী শূদ্র সকলের নিকটই অসাধু ও নিন্দনীয় বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। আমি সুপূজিত, ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি বটে, কিন্তু ভাগ্যদোষে আমাকে ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম আশ্রয় করিতে হইয়াছে। যদি আমি ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম অবগত হইয়া ব্রাহ্মণধর্ম্ম আশ্রয়পূর্ব্বক শান্তভাব অবলম্বন করি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমাকে নিন্দনীয় হইতে হইবে। আমি দিব্যাস্ত্র ও দিব্য শরাসন গ্রহণ করিয়াছি, সুতরাং পিতৃবধের প্রতিকার না করিলে জনসমাজে কিরূপ বাক্যস্ফূৰ্ত্তি হইবে? অতএব আজ আমি নিশ্চয়ই ক্ষাত্রধর্ম্মানুসারে পিতা ও রাজা দুর্য্যোধনের পদবীতে পদাপর্ণ করিব। আজ ব্যায়ামপরিশ্রান্ত পাঞ্চালগণ জয়লাভে প্রফুল্ল হইয়া কবচ পরিত্যাগপূর্ব্বক বিশ্বস্তচিত্তে নিদ্রাগত হইলে আমি রাত্রিযোগে শিবিরাভ্যন্তরে গমনপূর্ব্বক দেবরাজ যেমন দানবদল দলন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তাহাদিগকে সংহার করিব। আজ ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি বীরগণ অনলদগ্ধ অরণ্যের ন্যায় বিনষ্ট হইবে। আজ আমি পশুসূদন পিনাকপাণি রুদ্রের ন্যায় পাঞ্চালগণমধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাদের ও পাণ্ডবদের প্রাণ সংহারপূর্ব্বক শান্তিলাভ করিব। আজ আমি পাঞ্চালগণের শরীর ভূমণ্ডল পরিবৃত করিয়া পিতার ঋণ পরিশোধ করিব। আজ পাঞ্চালগণ দুৰ্য্যোধন, কর্ণ, ভীষ্ম ও আমার পিতার পথে পদার্পণ করিবে। আমি আজ পশুহন্তা শিবের ন্যায় রজনীযোগে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিপাতিত করিয়া নিশিত খড়্গাঘাতে পাঞ্চালরাজ ও পাণ্ডবগণের নিদ্রিত সন্তান-সন্ততির ও তৎপক্ষীয় সৈন্যসমুদয়ের প্রাণসংহার পূর্ব্বক কৃতকাৰ্য্য ও সুখী হইব।’