০৩. পাঁচ ছয় কাঠি গোটাকয়

০৩. পাঁচ ছয় কাঠি গোটাকয়

অ্যামবেরিওটিসের মৃত্যুর একদিন পর পোয়ারো জ্যাপের কাছ থেকে ফোন পেলেন জ্যাপ কর্কশ স্বরে বললেন–

মি. পোয়ারো সব ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করুন।

আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মি. জ্যাপ।

 আমি বলছি, হেনরি আত্মহত্যাই করেছেন। খুন হননি, মোটিভ খুঁজে পেয়েছি।

-যেমন?

–অ্যামবেরিওটিসের মৃত্যুর পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট আমার হাতে এসে গেছে। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন ও কোকেনের প্রয়োগে তার মৃত্যু হয়েছে। এটা তার হার্টে প্রতিক্রিয়া করেছে। আর তাতেই তিনি মারা যান। গতকাল তিনি তার শরীর খারাপের কথা বলেছিলেন আমাকে। তখন আমি তা আমলই দিইনি। ভেবেছিলাম আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আপনি জানেন অ্যাড্রিনালিন ও কোকেনের মিশ্রণে ইঞ্জেকশান তৈরি হয়। তাঁর সেই ইঞ্জেকশান দাঁতের ডাক্তাররা মাড়ীতে দিয়ে থাকেন ফলে ওই জায়গাটা অবশ হয়ে যায়। এতে দাঁতের যে কোনো রোগের চিকিৎসা করার সুবিধা হয়। মর্লে ভুল করেছিলেন এবং সেই ভুলটাও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই, বাস্তবের মুখোমুখি যাতে দাঁড়াতে না হয় তিনি নিজেকে গুলি করে শেষে করে দিয়েছেন।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন যে পিস্তল তার নিজের নয় সেটা দিয়ে?

–হয়তো ওটা তার নিজেরই। তার পরিচিত জনদের কাছে তিনি গোপন করেছিলেন। এমন তো কত কথাই অজানা থাকে। পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন–হ্যাঁ, এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। জ্যাপ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন–এই যুক্তিটা আপনি মেনে নিয়েছেন নিশ্চয়ই?

পোয়ারো বললেন–বন্ধু, এটা আমার মনঃপূত হল না। এই ইঞ্জেকশান অনেক রোগীর সহ্য হয় না। অ্যাড্রিনালিনে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়। কোকেনের মিশ্রণে তা আরও মারাত্মক হয়। তবে ডাক্তার বা দাঁতের ডাক্তাররা সেজন্য আত্মহত্যা করে না!

অবশ্যই নয়, তবে আপনি যা অকাট্য যুক্তি দেখাচ্ছন তা সাধারণ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেক্ষেত্রে সকলকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় না। রোগীদের শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে মি. মর্লে ওষুধের পরিমাণ বেশি দিয়েছিলেন। অতএব মর্লে নিশ্চিত ভুল করেছিলেন। তবুও বলব এটা ভুলই। এটা অপরাধ নয়।

-না, তা বলছি না। কিন্তু এতে তার পশার কমে যেত। কোনো রোগীই আর তার কাছে ভয়ে আসবে না। হেনরি খুব অনুভূতিপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তাই ভুলটা বুঝতে পেরে নিজেকেই দায়ী করেছেন। বাঁচার অন্য কোনো পথ নেই ভেবেই এহেন আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

তবুও পোয়ারো বাধা দিয়ে বললেন–মর্লে কি তাহলে এ সম্পর্কে কিছু লিখে রেখে যেতেন না? অন্তত তার বোনের উদ্দেশ্যে কিছু লিখতে পারনে? জ্যাপ হেসে বললেন, বুঝতে পারছি। আপনি কোনো খুনের ঘটনাকে খুন বলেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। আর এই সন্দেহ আমিই আপনার মাথায় ঢুকিয়েছি, স্বীকার করছি। মনে রাখবেন, এর । অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে।

–হুঁ, তা থাকতে পারে। আমিও ভেবেছি এ বিষয়ে, তবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপাতদৃষ্টিতে ধরলে মর্লেকে অ্যামবেরিওটিস গুলি করে খুন করেছেন। তারপর তিনি হোটেলে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন অ্যাড্রিনালিন ও কোকেন মিশ্রিত ওষুধ দিয়ে। যা তিনি মর্শের ঘর থেকে চুরি করেছিলেন। যদি আপনি এটা ভেবে থাকেন, তাহলে আমি বলব এ একেবারে অন্যায়। আমি ইয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, গ্রীসে তার একটি ছোট হোটেল ছিল কোনো একসময়। তারপর তিনি রাজনীতিতে আসেন। জার্মানি ও ফ্রান্সে গুপ্তচরবৃত্তি করে বেশ কিছু টাকা কামিয়েছেন। লোককে ব্ল্যাকমেল করতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। গত বছর ভারতে গিয়ে সেখানকার ধনী লোকেদের টাকাপয়সা সম্পত্তি বেদখল করেছিলেন। তিনি একজন দুষ্কৃতি জেনেও প্রমাণের অভাবে তাকে বেশিদিন জেলবন্দী করা যায়নি। এক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটতে পারে। কোনো বিষয় নিয়ে মর্লেকে ব্ল্যাকমেল করতেন। মলেও সুযোগ পেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় তার মাড়িতে ওষুধ দিয়েছিলেন এতে লোকটার কিছু না হলেও মর্শে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তাই অনুশোচনায় নিজেই নিজেকে দায়ী করেছিলেন এই জঘন্য কাজের জন্য। এবং নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে সরে গেছেন। তবে মর্লেকে আমি খুনি বলছি না। ভুলের বশবর্তী হয়ে তিনি এই কাজ করেছেন। আমার মতের সঙ্গে একমত হয়েছে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারও।

পোয়ারো নরম সুরে বললেন–বুঝতে পারছি।

জ্যাপ বললেন–হয়তো আমি আপনাকে হতাশ করেছি। তবুও এবারের মতো আপনি ক্ষমা করে দেবেন, বন্ধু। জ্যাপ ফোন ছেড়ে দিতে পোয়ারো তার প্রিয় টেবিলের সামনে গিয়ে বসলেন। তিনি আধুনিক ডিজাইনের আসবাবপত্র বেশি পছন্দ করতেন। তার টেবিলটিও চমৎকার সাজানো। সেই টেবিলের ওপর একটা চার কোনা কাগজ রাখা ছিল। তাতে মর্লের সব রোগীদের নাম ঠিকানা লেখা ছিল। যেমন–

হাওয়ার্ড রেইকস? এই নামটার পাশে শুধু জিজ্ঞাসা চিহ্ন। নিচে উদ্ধৃতি দেওয়া একটি লাইন। কিন্তু এসে অসম্ভব!??

একটু গ্যাপ রেখে আবার লেখাঃ

অ্যামবেরিওটিস। গুপ্তচরবৃত্তি পেশা। সেই কারণে গতবছর ভারতে যান এবং ইংল্যাণ্ডে এখন এসেছেন। দাঙ্গা বাধাতে ওস্তাদ। এজেন্ট হিসেবে কমিউনিস্টে যোগ দিয়েছিলেন। একটু খালি জায়গার পর লেখাঃ

ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। মর্লের অপছন্দের পাত্র। সম্প্রতি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু কেন? এরকুল পোয়ারোর মাথার মধ্যে এইসব প্রশ্নের উত্তর পাক খাচ্ছিল। বাইরে জানালার সামনে একটি কাঠ ঠোকরা পাখি ঠোঁট দিয়ে ঠকঠক আওয়াজ করছিল। তিনি ওই কাগজে আরও কিছু লিখলেন : হেনরি মর্লের দন্ত চিকিৎসালয়। অফিস ঘর। কার্পেটের ওপর একটা দাগ। সম্ভাবনাময়।

শেষ লেখাটা নিয়ে তিনি অনেক ভাবনা চিন্তা করলেন। অবশেষে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন এবং টুপি ও ছড়ি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। এরকুল পোয়ারো মেট্রেরেলে চড়ে এলেন ইলিং ব্রডওয়ে স্টেশনে। সেখান থেকে পাড়ি দিলেন তার গন্তব্যে। এসে পৌঁছলেন ৮৮ ক্যাসলগার্ডেনস রোডে। ইতিমধ্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় পার হয়েছে। বাড়িটা ছোট। সামনে সুদৃশ্য বাগান। পোয়ারো গতোক্তি করলেন, চমৎকার পরিকল্পনা, তারিফ করতেই হবে!

এই চমকপ্রদ বাড়ির মালিক মি. বার্নেস, তিনি তাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসালেন।

মি. বার্নেস ঘরের ভেতর এলেন, পোয়ারো সন্ধানী চোখে জরিপ করলেন তাঁকে। ছোটখাটো চেহারার মানুষ। কেশবিহীন মাথা। চোখে চশমা। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে দুটি চোখের তারা। ভদ্রলোকের হাতে রয়েছে তার দেওয়া কার্ডটি।

মি. বার্নেস হাসি মুখে বললেন–আপনিই মঁসিয়ে পোয়ারো? আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।

পোয়ারো লজ্জিত হয়ে বললেন–না জানিয়ে হঠাৎ এসে পড়ার জন্য আমি লজ্জিত ও দুঃখিত, মি. বানেস।

না, না, এভাবে বলবেন না। এখন পৌনে সাতটা বাজে। কাউকে বাড়িতে পাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। দয়া করে আপনি বসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। বোধ হয় আপনি ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট সম্পর্কিত কিছু উত্তর খুঁজতে এখানে এসেছেন? আমি আপনাকে অনেক তথ্য দিতে পারব আশা করি।

পোয়ারো বললেন–আপনার অনুমান সঠিক। তবে আমি যে মি. মর্লের মৃত্যুর কথা বলতে এসেছি তা আপনি বুঝলেন কি করে?

বার্নেস হেসে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি স্বরাষ্ট্র দপ্তরে উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলাম। যদিও অতি সম্প্রতি আমি অবসর গ্রহণ করেছি–তবুও আমার বুদ্ধি এখনও ভোতা হয়ে যায়নি। কোনো গোপনীয়তা থাকলে পুলিশের কাছে না গিয়ে গোয়েন্দাদের কাছেই যাওয়া উচিত, ঠিক বলিনি?

পোয়ারা বললেন–এতে গোপনীয়তার কি আছে? ভদ্রলোক চশমা খুলে হাতে রাখলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বসলেন। বললেন–সিক্রেট সার্ভিসে কেউ চুনো পুঁটির খোঁজ করে না, তাদের খোঁজ নিতে অনেক সময় পুঁটিমাছের দ্বারস্থ হতে হয়।

দেখছি আমার চেয়ে আপনার পারিপার্শ্বিক জ্ঞান অনেক বেশি, মি. বার্নেস। আসলে আমি কিছু জানি না। কেবল দুয়ে দুয়ে চার করার চেষ্টা চালাচ্ছি।

সেই দুইটা কি?

মি. বার্নেস তীক্ষ্ণস্বরে জবাব দিলেন অ্যামবেরিওটিস। আপনি নিশ্চয়ই ভোলেন–নি, মিনিট কয়েকের জন্যে হলেও আমাকে তার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি আমাকে কোনো দিন দেখেননি এবং চেনেন না। কিন্তু আমি ওর সম্পর্কে সবই জানি। তিনি এদেশে কেন এসেছিলেন তাও বলতে পারি।

-কেন? পোয়ারোর ছোট্ট প্রশ্ন।

–এদেশে আমাদের মানুষ হিসেবে অনেকে পছন্দ করেন না। রক্ষণশীলতাই আমাদের ধর্ম। আমরা যতই আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারের সমালোচনা করি না কেন নতুন কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সাহস পাই না। বিদেশীদের এখানেই গাত্রদাহ। তাদের কষ্ট। তারা মনে মনে ভাবে ইংল্যাণ্ডের মতো ধনী দেশ ইউরোপের আর কোথাও নেই। তাই আমাদের দেশকে বিপদে ফেলতে পারলে তাদের আনন্দ হবে। তার জন্য প্রয়োজন ইংল্যাণ্ডের ভিত ধরে নাড়া ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। কিন্তু কাজটা খুবই কঠিন। কেন না এর শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মতো মানুষ।

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন মি. বার্নেস। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের চরিত্র এমন যিনি সর্বদা নিজের সীমার মধ্যে বিচরণ করেন। তা তার কাছে যত টাকা থাকুক কেন। অকারণ ব্যয় তিনি পছন্দ করেন না। তাই তার ধারণা দেশের সব মানুষের উচিত তার মতো জীবন যাপন করা। আর সেই কারণেই কেউ কেউ চাইছে মি. ব্লাস্টকে সরিয়ে দিতে।

–আশ্চর্য!

মাথা নেড়ে মি. বার্নেস বললেন–আশ্চর্যই বটে। একদল মানুষ নতুন পৃথিবী গড়ার রঙিন স্বপ্ন দেখছে। কুৎসিত চেহারার, কদাকার মনের একদল মানুষ আছে যারা বিদেশী ভাষায় তর্ক করতে ভালোবাসে। তৃতীয় আরেকদল আছে যারা কেবল কথা বলতে পটু। তবে এদের মধ্যে একটা মতের মিল তা হল ব্লাস্টকে সরে যেতে হবেই।

পোয়ারো মনযোগ সহকারে বার্নেসের কথা শুনছেন। বার্নেস থামতেই বলে উঠলেন, তারপর। বার্নেস পাবার শুরু করলেন–পুরানো নিয়মকানুন ভেঙে ফেলার মূলে আছে টোরি, রক্ষণশীল, পোড় খাওয়া মানুষ ও লোভী ব্যবসাদাররা। হয়তো এরা সবাই ঠিক। আমরাও স্থির বিশ্বাস পুরনো নীতি পাল্টে এমন কিছু করতে হবে–যেটা মানুষের উপকারে লাগবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে বাড়িটা ধ্বংস হয়ে যায়। আর ওই বাড়ির ভিত হচ্ছেন ব্লাস্ট। তাই ওরা চাইছে ব্লাস্টের ক্ষতি করতে। আমি নিশ্চিত জানি গতকাল সকালে ওরা তাকে খতম করার চেষ্টায় ছিল। এ চেষ্টা ওরা এর আগেও করেছিল, পারেনি।

বার্নেস একটু থেমে দম নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন। আমি তিন জনের কথা বলছি। একজন খ্যাতিমান চ্যান্সেলর আর এক্সরে করে দ্বিতীয়জন দূরদশী উৎপাদক এবং তৃতীয়জন উৎসাহী তরুণ রাজনীতিক। অবশ্য আজ এরা কেউই নেই। সবাই মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর পেছনে যাদের হাত ছিল তারা হলেন একজন সার্জন ও অন্যজন ডাক্তার, সার্জেনের ভুল চিকিৎসার জন্য প্রথমজন অপারেশন টেবিলে মারা যান। দ্বিতীয়জন মারা যান ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতার কারণে। তৃতীয় জন মারা যান গাড়ি চাপা পড়ে। সেই দোষী সার্জন বর্তমানে একটি গবেষণাগারের মালিক। ডাক্তার অবসর গ্রহণ করে একটি চমৎকার হয়টর গড়ে তুলেছেন। আমরা সবাই জানি প্রত্যেক জীবিকায় লোভের হাতছানি আছে, বেশির ভাগ মানুষ তাতে সাড়া দেয়। তবে মর্শে সে ধরনের লোভী ছিলেন না। এটা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।

আপনি কি ভাবছেন ঘটনাটা এই রকমই কিছু? পোয়ারো জানতে চাইলেন।

মি. বার্নেস চশমা মুছতে মুছতে বললেন–হ্যাঁ, তাই। এইসব মানুষদের ধরা কঠিন। এদের বাঁচানোর মতো বড় বড় চাই আছে। এটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন, দাঁতের ডাক্তারের চেয়ারে বসলে সব মানুষই নিজেকে অসহায় বোধ করেন। এই অভিজ্ঞতা আপনার এর আগে অবশ্যই হয়েছে। তারা মর্লেকে একটা কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। মর্লে সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। এছাড়া মর্লে তাদের বিষয়ে অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলেন। সেই কারণে মর্লেকে তাদের হাতে মরতে হল।

–পোয়ারোর চোখে প্রশ্ন ঝিলিক দিল–তা হবে, তারা কারা?

তারা হল সেই দল যারা এসবের পিছনে আছে। অবশ্য এদের একজন নেতা আছে। সেই আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে।

কে সে? আপনি কি তাকে চেনেন?

–আন্দাজ করতে পারি। তবে আমার আন্দাজ ভুলও হতে পারে।

 –আপনি কি রেইলির কথা ভাবছেন?

–আপনি ঠিক ধরেছেন। আমার মনে হয় মর্লেকে দিয়ে ওরা কাজটা করাতো না। কাজটা করতে রেইলি। মলে শুধু রোগীকে রেইলির হাতে তুলে দিতেন। আর ওই দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হতেন বিখ্যাত ব্যাঙ্কার অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট। হতভাগ্য দাঁতের ডাক্তার মর্লে নিজের দোষ কবুল করতেন আদালতে এবং দুঃখ প্রকাশ করতেন। যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। পরে পেশা থেকে অবসর নিয়ে অন্যত্র কোনো ব্যবসা ফেঁদে বসতেন। হাজার হাজার পাউণ্ড আয় করে সম্পত্তির পরিমাণ বাড়াতেন। এটা কোনো গল্প কথা নয়, এটাই বাস্তবচিত্র।

–আপনার মত যদি মেনে নিই তাহলেও অ্যামবেরিওটিস যে এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, তার প্রমাণ কি?

–তা আমি বলতে পারব না। তবে দলের হয়ে কাজ করত এতে আমি নিশ্চিত। আর মর্লেকে ফাঁসানো হয়েছে।

–আপনার সন্দেহ ঠিক হলে এরপরের ঘটনা কি হতে পারে তাও আপনি জানেন?

মি. বার্নেস শান্ত ধীর স্থির হয়ে বললেন–ওরা আর একবার চেষ্টা করবে। ওদের হাতে সময় কম। এ ব্যাপারে পুলিশকে সন্দেহের বাইরের মানুষদের ওপরও নজর রাখতে বলুন। তার নিজের পরিজনরা, পুরোনোদিনের চাকররা, ডাক্তারখানায় যে ওষুধ বানায় তাকে, যে মদের জোগান দেয় তাকেও সন্দেহের তালিকায় রাখুন। ব্লাস্টকে খুন করার বিনিময়ে বহু কোটি টাকা পাওয়া যাবে। যা দিয়ে সারা জীবন স্বচ্ছন্দে কাটানো যাবে।

–এতটা হবে আশা করেন?

–এর থেকে বেশি কিছুও হতে পারে। প্রথম থেকেই রেইলির কথা আমার মাথায় ছিল। আইরিশ বিপ্লববাদী ব্যক্তিত্ব বলে?–না, তা নয়। মর্লের ঘরের কার্পেটের একটা দাগ আমাকে প্রথম দিন থেকেই ভাবচ্ছে। মনে হয় সেটা মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ। কোনো রোগীর মলেকে গুলি করার ইচ্ছে থাকলে তাহলে সে সেটা সার্জারিতে করতে পারত, টেনে নেবার দরকার হত না। আর এর থেকে আমার সন্দেহ তীব্র হয় যে সার্জারিতে না করে অফিস ঘরেই তাকে গুলি করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় খুনি বাইরের কেউ নয়, তার বাড়িরই কেউ।

মি. বার্নেস উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন–নিখুঁত আপনার কল্পনাশক্তি।

এরকুল পোয়ারোর যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বার্নেসের সঙ্গে করমর্দন করে বললেন আমার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ। তদন্তের খাতিরে প্রয়োজন পড়লে আপনাকে ডেকে পাঠাব। এরকুল পোয়ারো এবার এলেন প্লেনগাউরি কোর্ট হোটেলে। সেখানে মিস সেইনসবারি সীলের সঙ্গে দেখা করেন। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। পরদিন। সকাল বেলা। চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপকে পোয়ারো ফোন করলেন।–গুড মর্নিং বন্ধু। আজই তো ইনকোয়েস্ট, তাই না?

-হ্যাঁ, আপনি আসছেন নিশ্চয়?

–ইচ্ছে নেই, প্রয়োজনে লাগবে না বলে? আপনারা মিস সেইনসবারি সীলকে ডেকে পাঠিয়েছেন, আশা করি?

না, ডাকছি না। তিনি আমাদের কোনো উপকারে লাগছেন না।

–কেন? তার কাছ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি, তাই?

–না, আর তা পেতে আমরা আগ্রহী নই।

–আমি অবাক করা একটা খবর জানাই আপনাকে, মিস সীল নৈশভোজের আগে প্লেনগাউরি হোটেল ছেড়ে চলে যায়। আর ফিরে আসেননি।

তবে কি তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন?

অকাট্যে ব্যাখ্যা চাই।

মি. জ্যাপের কণ্ঠস্বরে চিন্তার ছাপ। তিনি বললেন–কেন তিনি গা ঢাকা দেবেন? আমরা তাকে সন্দেহ করিনি। তাঁকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করিনি। কলকাতায় আমরা টেলিগ্রাম করেছিলাম। তার উত্তরও পেয়েছি। গত তিন বছর ধরে তিনি ওখানে বাস করছেন। উনি আমাদের যেসব কথা বলেছেন তা সব সত্যি। বিয়ে নিয়ে একটু বিভ্রাট ঘটেছিল। তিনি একটি হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন। দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। তাই কয়েক বছরের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মিশনারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এমন একজন মহিলার দ্বারা খুন করা সম্ভব নয় বলেই আমি ভেবেছি। আর এটাও হতে পারে হোটেলটা ওর ভাল লাগেনি, তাই তিনি চলে গেছেন।

তার সব মালপত্র হোটেলের ঘরে রয়ে গেছে। কিছুই তিনি নিয়ে যাননি, পোয়ারো জানালেন।

–তিনি কখন বেরিয়েছেন?

–পৌনে সাতটা নাগাদ। হোটেলের কর্মচারীরা এ বিষয়ে কোনো আলোকপাত করতে পেরেছে?

–তারা খুব উদ্বিগ্ন। ম্যানেজার মহিলা ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছেন। ওরা পুলিশে খবর দিয়েছে।

না, কোনো মহিলা এক রাত বাইরে কাটাতে পারেন। আবার ফিরে আসতেও পারেন। এসে যদি দেখেন তার অনুপস্থিতির জন্য পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন না। তিনি ক্ষুদ্ধই হবেন। ম্যানেজার মিসেস হ্যারিসন খুব করিৎকর্মা মহিলা। তিনি সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছেন তাকে খুঁজতে;এমনকি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছেন। যদি কোন দুর্ঘটনার কারণে মিস সীল হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি পুলিশ ডাকবেন বলে মনস্থির করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ওখানে গিয়ে উপস্থিত হই। আমাকে সামনে দেখে তিনি খুশি হলেন। আমাকে যা যা ঘটেছে সব খুলে বললেন। আমি তাকে পরামর্শ দিই একজন পুলিশ অফিসারকে জানানোর জন্য।

–হুম। জ্যাপের গলায় উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে। তিনি বললেন, দেখছি কি করা যায়। সকালটা ইনকোয়েস্টের জন্য ব্যস্ত থাকব। পরে প্লেনগোরি কোর্ট হোটেলে যাব আমি।

চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ ও এরকুল পোয়ারো প্লেনগোরি হোটেলে হাজির। তারা ড্রইং রুমে ম্যানেজার মিসেস হ্যারিসনের জন্য অপেক্ষারত। হঠাৎ জ্যাপ প্রশ্ন করলেন–কী অদ্ভুত ব্যাপার? মহিলা কেন পালাতে গেলেন বলুন তো?

পোয়ারো হেসে বললেন–তাহলে ব্যাপারটা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে তো, বন্ধু?

 ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন মিসেস হ্যারিসন। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি সজল নয়নে বলতে লাগলেন, কেন যে মিস সীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেটা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না আমরা। কি যে হল তার। কোনো দুর্ঘটনা? এদিক ওদিক লোক পাঠিয়েছি খবরের জন্যে কিন্তু কেউ তার সন্ধান আনতে পারেনি। খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আরামপ্রিয়ও বটে।

জ্যাপ অনুরোধের সুরে বললেন–দয়া করে আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা মিস সীলের ঘরটি দেখতে পারি, মিসেস হ্যারিসন। ম্যানেজার ভদ্রমহিলা ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন স্বচ্ছন্দ্যে যেতে পারেন।

জ্যাপ ও পোয়ারো এলেন যে ঘরে মিস সীল থাকতেন। তাদের দুজোড়া চোখ লাটুর মতো ঘরের চারদিকে ঘুরে গেল। ঘরের এককোণে দুটো সুটকেস রয়েছে। রয়েছে একটি দেয়াল আলমারী। তাতে রাখা আছে বেশ কিছু চটকদার। পোশাক বিছানার ওপর পড়েছিল রাত পোশাক। ড্রেসিংটেবিলের তলায় দেখা যাচ্ছে কয়েক জোড়া জুতো। একজোড়া অক্সফোর্ডের, দুজোড়া ভেড়ার চামড়ার তৈরি, মার্টিনের একজোড়া নতুন জুতো রয়েছে। এসব দেখতে দেখতে পোয়ারো ভাবছিলেন ভদ্রমহিলা বেরোনোর আগে জুতোর ছেঁড়া বকলেসটা সেলাই করিয়েছেন কিনা।

জ্যাপ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার টেনে খুললেন। তার মধ্যে কিছু চিঠিপত্র ছিল। তিনি সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। এরকুল পোয়ারো কয়েকটা ড্রয়ার খুলে দেখার চেষ্টা করলেন। তার একটিতে ভর্তি কিছু পশমী অন্তর্বাস আর একটিতে রয়েছে এক জোড়া পুরনোমোজা।

জ্যাপ প্রশ্ন করলেন–কিছু কি পেলেন? না বৃথাই পরিশ্রম হল?

পোয়ারো ওই মোজা জোড়া হাতে নিয়ে বললেন–সস্তা রেশমী জিনিস, দাম হবে জোর দুশিলিং। লম্বায় ন’ ইঞ্চির মতো।

জ্যাপ বললেন আমার অবস্থাও ওই একইরকম। এই ড্রয়ার থেকে পাওয়া গেল ভারত থেকে আসা দুটি চিঠি, দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানের দুখানা রসিদ। মহিলার চরিত্রে কোনো কলঙ্ক নেই। সবই স্বচ্ছ নির্মল।

পোয়ারো বিমর্ষভাবে মন্তব্য করলেন কিন্তু পোশাকের ক্ষেত্রে কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন।

জ্যাপ বললেন–সম্ভবতঃ পোশাককে ভোগের উপকরণ হিসেবেই দেখেন তিনি। জ্যাপ তাঁর নোটবইতে দুটো ঠিকানা লিখে নিলেন। হ্যাঁম্পস্টেডের ঠিকানা। শুনেছি এদের সঙ্গে মিস সীলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এদের কাছ থেকে কিছু খবর পাওয়ার আশা আছে।

প্লেনগোরি কোর্ট হোটেল থেকে তেমন কিছু উত্তেজক তথ্য পেলেন না জ্যাপ ও পোয়ারো। কেবল তিনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার বন্ধু মিসেস বোলিথোর সঙ্গে দেখা করে গেছেন। বলে গেছেন, ডিনারের আগেই তিনি ফিরবেন। প্লেনগেরি কোর্টে একটি প্রথা চালু আছে। সেটি হল কেউ বাইরে খাবার খেলে তা আগে জানাতে হবে। মিস সীল কিন্তু তা করেননি। এর থেকে প্রমাণিত হয়, তাঁর ফিরে আসার কথা মাথায় ছিল। অথচ তিনি ক্রনওয়েল স্ট্রীটে গিয়ে আত্মগোপন করেন।

জ্যাপ ও পোয়ারো ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছলেন ওয়েস্ট হ্যামস্টেডেঠিকানাটা মিস সেইনসবারি সীলের ঘর থেকে পাওয়া গিয়েছিল। একটি চিঠিতে ঠিকানাটি উল্লিখিত ছিল। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। বাড়িটিও বেশ মনোরম গথিকে তৈরি। এই বাড়ির বাসিন্দারা হলেন অ্যাডমস পরিবারের সদস্যরা। এদের মার্জিত ভদ্র ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করে। যৌথ পরিবার। বহু বছর ভারতে বসবাস করেছিলেন। মিস সীলের সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। তবে কোনো উপকার করার আশ্বাস পাওয়া গেল না তাদের থেকে।

কিছু দিন ধরেই সেইসবরি সীল ওয়েস্ট হ্যামস্টেডে যান নি। ইস্টারের ছুটিতেও যাননি। অন্তত এক মাস তাদের সঙ্গে মিস সীলের যোগাযোগ বন্ধ। তারা জানতে পেরেছেন ওই সময়ে তিনি রাসেল স্ট্রীটের একটি হোটেলে থাকতেন। মিসেস অ্যাডামস সেখানকার ঠিকানা দিলেন। এছাড়া তার কয়েকজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ার বন্ধুরও ঠিকানা পাওয়া গেল অ্যাডামস পরিবার থেকে। তারা থাকেন ট্ৰীথ্যাসে।

পোয়ারো ও জ্যাপ এবার চললেন ট্ৰীথ্যাসের পথে। দেখা করলেন মিস সীলের পরিচিতজনদের সঙ্গে। কিন্তু তাদের কাছ থেকেও মিস সীলের কোন হদিশ পেলেন না তারা। অন্তত এমন একটা কু যেটা তাদের কাজে সাহায্য করতে পারে। জ্যাপ হতাশা হয়ে বললেন–আর একটাই জায়গা আছে মিস সীলের যাবার মতো। পোয়ারো আশ্চর্য হয়ে বললেন–সেটা কোথায়?

–হাসপাতালে চলুন সেখানে একবার যাওয়া যাক। সেখানে গিয়েও তাদের নিরাশ হতে হল। কারণ সেদিন হাসপাতালে সেরকম কোন মানুষকে আনা হয়নি। এ যেন কর্পূরের মতো উড়ে যাওয়া, কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে বসে আছেন তিনিই জানেন!

পরদিন সকাল। এরকুল পোয়ারো হাজির হলেন হাবোর্ন প্যালেস হোটেলে, মি. হাওয়ার্ডের আস্তানা। তিনি ভাবলেন ইনিও না অদৃশ্য হয়ে যান। পোয়ারো জানতে পারলেন মি. হাওয়ার্ড হোটেলেই আছেন এবং তিনি প্রাতরাশে ব্যস্ত।

অনাহূতের মতো এরকুল পোয়ারোকে দেখে হাওয়ার্ড রেইকস অস্তুষ্ট হলেন। আগেকার সেই খুনীসুলভ ভাবটা ছিল না। তবুও তিনি বিরক্তি সহকারে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আমার এখানে?

এরকুল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বললেন–বসতে পারি?

রেইকস সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন অবশ্যই বসবেন। ভালো করে বসুন। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। পোয়ারো চেয়ারে বসার পর মি. হাওয়ার্ড প্রশ্ন করলেন আমার কাছে আপনার কি দরকার? আশা করি আপনি আমায় ভোলেন নি, মি. রেইকস?

–কোনো দিন আপনাকে দেখেছি বলে আমার মনে পড়েছে না, মঁসিয়ে পোয়ারা।

–এত ভুলো মন আপনার তা আমি বিশ্বাস করি না। তিনদিন আগে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমরা পাঁচ মিনিটের মতো একসঙ্গে ছিলাম। দন্ত চিকিৎসক হেনরী মর্লের ওয়েটিং রুমে।

দ্রুত যেন কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল ভদ্রলোকের চোখে মুখে। অবশ্য তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। তাঁর কথাতেও আবেগ ফুটে উঠল। নিজেকে সংযত করে বললেন–বলুন, আপনার কি বলার আছে?

পোয়ারো এতক্ষণ রেইকসকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। তিনি নিশ্চিত এতক্ষণে লোকটিকে হাতের মুঠোয় আনা গেছে। বোঝা যাচ্ছে তিনি বিপদে পড়েছেন। উদ্ধত চোয়াল রক্তিম দুটি চোখ দেখে মনে হল ঠিক যেন প্রতিহিংসাপরায়ণ এক জন্তু। রেইকস গম্ভীর স্বরে বললেন–আমাকে এসব বাজে কথা বলে কি প্রমাণ করতে চাইছেন আপনি? আমি এসেছি এখানে বলে আপনি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন দেখছি।

–আপনার পরিচয় এখনও দেননি মশাই।

দুঃখিত। বলে পোয়ারো তাঁর নাম ঠিকানা লেখা একটি কার্ড রেইকসের হাতে দিলেন। রেইকস কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলেন তারপর কার্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন–ও! আপনিই তাহলে এরকুল পোয়ারো। বেসরকারী সখের গোয়েন্দা। এই পেশায় আপনার সুখ্যাতি আছে। তবে যাদের প্রচুর টাকা আছে তারাই আপনাকে ডেকে পাঠান। নিজেদের কুকীর্তি চাপা দেবার জন্য আপনাকে ব্যবহার করে।

পোয়ারো স্বর নরম করে বললেন–আপনার কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি পান করুন।

মি. রেইকস ঈষৎ ঝুঁকে বসে বললেন–আপনার মতলব কি বলুন তো মশাই? কোনো মতলবই নেই, আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।

ব্যাঙ্গের সুরে রেইকস বললেন–ওহ, তাই বুঝি? তাহলে বলবো আপনি মুখের স্বর্গে বাস করেন। যারা আপনাকে অর্থ দিয়ে নিযুক্ত করেছেন তাদের কাছেই যাওয়া উচিত আপনার। আপনাকে টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ আমার নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো। পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন–টাকা দিয়ে কেউ আমাকে কাজে লাগান নি। রেইকস অবাক হয়ে বললেন–সে কি মশাই, একথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?

পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, বিশ্বাস করা অথবা না করা আপনার ব্যাপার। তবে এটাই সত্যি আমাকে কেউ টাকা দেয়নি এখনও। নিছক কৌতূহল মেটাতে এখানে আসা। তাহলে সেদিন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন কেন? সেও কি কৌতূহল মেটাতে যাওয়া?

পোয়ারা হেসে বললেন মি. রেইকস, আপনি এত জানেন আর এটা জানেন না দন্ত চিকিৎসকের কাছে মানুষ কেন যায়?

–তাহলে দাঁত দেখাতে গিয়েছিলেন?

নিশ্চয়ই।

–মাপ করবেন, কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হল না।

ঠিক আছে, তাহলে আপনিই বলুন কেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন?

–আপনার কথাতে সায় দিয়ে বলি আমিও দাঁত দেখাতে গিয়েছিলাম।

–আপনি দাঁতের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন? অথচ আপনাকে মি. মর্লের ঘরে যেতে দেখলাম না। দাঁত না দেখিয়েই ফিরে এসেছিলেন মি. রেইকস।

মি. রেইকস এবার উত্তেজিত হলেন তিনি কর্কশ স্বরে জবাব দিলেন। যদি চলে আসি তত আপনার কি? আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই চলে এসেছিলাম। আসলে আপনি গিয়েছিলেন প্রখ্যাত সুপ্রতিষ্ঠিত ধনী মানুষটিকে পাহারা দেবার জন্যে। আপনাদের প্রিয় অ্যালস্টেয়ার ব্লাস্ট আশা করি সুস্থ আছেন। আমাকে জালবন্দী করার মতো কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ আপনাদের হাতে নেই।

পোয়ারো কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন–সেদিন আপনি চলে আসার পরই ওই বাড়ির কর্তা মারা যান, হয়তো সেটা মনে আছে। রেইকস অবজ্ঞা ভরে বললেন–ওঃ সেই দন্ত চিকিৎসক হেনরী মলে না কি যেন নাম তার!

গম্ভীর স্বরে পোয়ারো বললেন–বাঃ মনে আছে তো। হেনরী মর্লে।

অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন মি. রেইকস। তারপর মাথা চুলকে বললেন–এর জন্যে আপনি আমাকে দায়ী করছেন। এবার আপনার আসল মুখোশটা খুলে গেল। আপনার জারিজুরি এখানে চলবে না। আমি ইনকোয়েস্টের রিপোর্ট দেখেছি। বেচারা নিজেকে নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, ভদ্রলোক ভুলবশত একজনকে অবশ করার ওষুধ অতিমাত্রায় দিয়েছিলেন। ফলে রোগীটি মারা যায়।

পোয়ারো অসহিষ্ণু হয়ে বললেন–আপনি প্রমাণ দিতে পারেন বাড়ি ছেড়ে আপনি যখন বেরিয়ে আসেন তখন আপনাকে কেউ দেখেছে? এমন কেউ কি আছে যে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে পারে বারোটা থেকে একটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?

রেইকস ঘাবড়ে গিয়ে বললেন–একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আপনার মতে আমি খুন করেছি। আচ্ছা এতে ব্লাস্টের কাছ থেকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছেন আপনি, তাই না?

পোয়ারো ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললেন–আপনাকে আমি প্রথমেই বলেছি মি. ব্লাস্ট আমাকে নিযুক্ত করেননি। আমি তার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি।

এদিক ওদিক মাথা নেড়ে রেইকস বললেন–আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না। আপনি ব্লাস্টের নিয়োগ করা গোয়েন্দা। তাকে আপনি বাঁচাতে সাহায্য করবেন। কিন্তু অকৃতকার্য হবেন। তাকে আমরা বাঁচতে দেবো না কিছুতেই। ওকে মরতেই হবে। এই পচা ঘূণ ধরা অর্থনীতির অবসান হবে, নতুন সূর্য উঠবে। মাকড়সার জালের মতো চারদিক ঘিরে রয়েছে ধনী ব্যাঙ্কাররা। এদেরই মতো একজন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট। সেই আমাদের সামনে বাঁধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো সব নিয়ম নীতি বিসর্জন দিতে হবে। কেউ আটকাতে পারবে না। কি কিছু বুঝেছেন?

পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–বুঝতে পারছি আপনি একজন আদর্শবাদী, যাকে কোনো মৃত্যু বিচলিত করতে পারে না।

–রেইকস বললেন–কে এক দাঁতের ডাক্তার তার মৃত্যুতে আমার কি আসে যায়? পোয়ারো করুণ সুরে বললেন–এতে আপনার কিছু আসে যায় না, তবে আমার অবশ্যই যায়। আর এখানেই আমাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য।

পোয়ারো বাড়ি ফিরে এলেন। সেখানে তার জন্য একটা চমক অপেক্ষা করছিল।

পোয়ারোকে দেখে তার পরিচারক জর্জ বলল–স্যার, এক ভদ্ৰমিহলা এসেছেন। তাকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখেছি। দেখে মনে হল উনি কোনো কারণে ভীত সন্ত্রস্ত। পোয়ারো আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন কে হতে পারে? মিস সীল কি? না, তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। তিনি বসার ঘরে ঢুকে চমকে উঠলেন। মিস গ্ল্যাডিস নেভিল। যে একদা মৃত মি. মর্লের সেক্রেটারী ছিল।

মিস নেভিলের চোখ গেল পোয়ারের দিকে। সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল–ওহ, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আপনার মহামূল্যবান সময়ের কিছুটা আমাকে দিতে হবে। জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ, তবুও অনুরোধ করছি, একটু সময় যদি দিতে পারেন।

ইংরেজদের সম্পর্কে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই পোয়ারো জানতে চাইলেন আপনাকে কি এক কাপ চা দিতে বলবো, মিস নেভিল?

উচ্ছ্বসিত হয়ে গ্ল্যাডিস বলল–হ্যাঁ, দিলে ভালোই হয়। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো।

এরকুল পোয়ারো জর্জকে চা আনতে হুকুম করলেন। জর্জ চা দিয়ে গেল। মিস নেভিল চায়ে চুমুক দিলেন, সে যেন আগের সত্ত্বায় ফিরে এল। এবার বলল গতকালের ইনকোয়েস্ট আমাকে ভীষণ দুর্ভাবনায় ফেলেছে স্যার।

পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বললেন সেটাই স্বাভাবিক।

আমাকে সাক্ষ্য দেবার জন্য ডাকা হয়নি তবুও আমি বাধ্য হয়েই মিস মর্লের সঙ্গে গিয়েছিলাম। কেননা মিস মর্লে, মি রেইলির সঙ্গে যেতে রাজী ছিলেন না, তাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পোয়ারো বললেন–আপনার কর্তব্য আপনি করেছিলেন।

হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার কর্তব্য। বেশ কয়েক বছর মি. মর্লের কাছে চাকুরিরতা ছিলাম আমি। এই দুর্ঘটনা আমাকে আঘাত দিয়েছে। আমার মন এমনিতেই ভেঙে পড়েছে, তার ওপর এই ইনকোয়েস্ট আরও খারাপ করে দিয়েছে।

–তা বটে।

মিস নেভিল পোয়ারোর আরও কাছে এগিয়ে এল। তারপর নিচু গলায় বলল–ওই ইনকোয়েস্টে যেসব যুক্তি দেখানো হয়েছে সেটা পুরোটাই মিথ্যে মঁসিয়ে পোয়ারো। এর মধ্যে গভীর একটা ষড়যন্ত্র আছে।

–আপনার কি মনে হয়, মাদামোয়াজেল?

–আমার মনে হয় ওরা যা বলছে তা ঠিক নয়। চিকিৎসায় গাফিলতি কখনও মি. মর্লে করেননি। ভুলবশতঃ কোনো ওষুধ প্রয়োগ করে রোগীর ক্ষতি করা তার পক্ষে অসম্ভব। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, হয়তো কোনো কোনো রোগী কড়া ইনজেকশন সহ্য করতে পারে না। তবে তা ঘটে যাদের হার্ট দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে। তবে আমি নিশ্চিত মাত্রা বেশি হওয়া অবাস্তব কথা। ডাক্তারেরা কখনও এ ধরনের ভুল করতে পারেন না।

পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন–আমিও বিশ্বাস করি না। আপনি কী এসব কথা ইনকোয়েস্টে বলেছেন?

মাথা নেড়ে মিস নেভিল বললেন–না, আমি বলিনি, কারণ আমি ইচ্ছে করেই কেসটাকে জটিল করতে চাই নি। তবে আমার স্থির বিশ্বাস মি. মর্লে কখনও ভুল করে বা ইচ্ছে করে এমন জঘন্যতম কাজ করতে পারেন না। সে একটু থামলো। পোয়ারোর মুখভঙ্গী জরিপ করে আবার বলতে শুরু করলো, তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি, মঁসিয়ে পোয়ারো। কেননা আপনি সরকারি পক্ষের কেউ না। বেসরকারি রহস্য সন্ধানী আমার মনে হল কাউকে কিছু বলতে হলে আপনাকেই কেন বলবো না। আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন। ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেবেন না। পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন, আপনাকে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ডাকা হয় সে ব্যাপারে কিছু কথা কিছু বলুন।

সচকিত হয়ে মিস নেভিল বললেন–আসলে আমি ওই টেলিগ্রাম নিয়ে ভাবছি না। কারণ যে এটা পাঠিয়েছে তিনি আমার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এমনকি আমার দিদিমা কোথায় থাকেন তাও তিনি জানেন।

হ্যাঁ, আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ। হয়তো বন্ধু বা ওই বাড়িতে বসবাসকারী এমন কেউ।

আমার কোন বন্ধু নেই যিনি এতবড় রসিকতা করতে পারেন। তবে আমি এটাও ভাবছি মি. মর্লে কি ওই টেলিগ্রম পাঠিয়েছিলেন? কেন এই কথা ভাবছেন? ফ্রাঙ্ক কার্টারকে বিয়ে করতে তিনি আমাকে নিষেধ করেছিলেন। তার পরামর্শ আমি গ্রাহ্য করিনি। আমি ফ্র্যাঙ্কের বাগদত্তা। তাই তিনি চেয়েছিলেন আমাকে ফ্রাঙ্কের থেকে দূরে রাখতে। তাঁর আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাকে টেলিগ্রাম করবেন তা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমি সমারসেট গিয়েছিলাম। সেকথা শুনে ফ্রাঙ্ক রেগে গিয়েছিল। তার ধারণা আমি অন্য কারোর সঙ্গে বেড়াতে যাব বলে আমি নিজেই একাজ করেছি।

–সত্যিই কি কেউ আছে?

 লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেল গ্লাডিসের সমস্ত মুখ। সে মুখ নিচু করে বলল না, না, আসলে বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে তার চাকরি নেই সে বেকার তাই সে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। যত উদ্ভট চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খেত।

পোয়ারো হেসে বললেন–তাই সেদিন আপনাকে না পেয়ে সে অস্থির, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

হ্যাঁ, সে একটা নতুন চাকরি পেয়েছিল। সপ্তাহে দশ পাউণ্ড করে বেতন পাবে। সেই আনন্দের খবর আমাকে জানানোর জন্য ছুটে এসেছিল। ও জানতো আমি সে সময় মি. মর্লের দন্ত চিকিৎসালয়ে থাকি তাই সেখানে গিয়েছিল। তাছাড়া খবরটা মি. মর্লেকে শোনানোর আগ্রহ ছিল তার কিছুদিন আগে তিনি ফ্র্যাঙ্ককে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছিলেন। সেই আঘাত ও ভুলতে পারেনি। এমনটা ওর সম্পর্কে আমাকে নানা কথা বলে আমার মন বিষিয়ে দিয়েছিলেন।

পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–আপনার বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিন; তাকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে মিস নেভিল।

-ঠিক আছে আঁসিয়ে পোয়ারো। তবে রবিবার ছাড়া তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। তার রবিবার ছুটি থাকে। সে দিনই সে এখানে আসে। আর সপ্তাহের দু’দিন বাইরে বাইরে ঘুরে কাজ করে। তবে ফ্র্যাঙ্ক লন্ডনের একটা ঠিকানা দিয়েছে আমাকে। আমার প্রয়োজন হলে সেই ঠিকানায় আমি চিঠি পাঠাই। ওরা সেটা ফ্র্যাঙ্কের হাতে পৌঁছে দেয়।

–ওহ, সেই নতুন চাকরি? আচ্ছা কাজটা কি?

মিস নেভিল আমতা আমতা করে বলল–মানে, আমি ঠিক জানি না। হবে হয়তো কোনো কেরানি বা সেক্রেটারির চাকরি।

পোয়ারো আর কথা না বাড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মিনিট কয়েক কেটে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বললেন–তাই না। আসুন না আপনারা দু’জনে, মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ রইল। খাওয়ার ফাঁকে আপনাদের দু’জনের সঙ্গে হেনরি মর্লের মৃত্যু রহস্য নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাবে।

গ্ল্যাডিস সম্মত্তি জানিয়ে বলল–ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি, আমার মনে হয় ফ্রাঙ্কেরও আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগবে।

পরদিন রবিবার। দুপুর বারোটা। লোগানস কর্নার হাউস। এরকুল পোয়ারো আগেই সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপর এল মিস গ্ল্যাডিস নেভিল। সঙ্গে ফ্রাঙ্ক কার্টার। পোয়ারো তাকে দেখেই চিনতে পারলেন।

মাঝারি চেহারার এক তরুণ। হাবভাবে প্রগলভতা ফুটে উঠেছে। কোনো কারণে বিব্রত বোধ করলে চোখ দুটো তার অস্বস্তিকরভাবে চঞ্চল হয়ে ওঠে। তারা পোয়ারোর পাশাপাশি দুটি চেয়ারে এসে বসল। গ্ল্যাডিস দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিল। গোড়াতেই তার মন সন্দিহান হয়ে উঠেছিল। তাই অসহিষ্ণু স্বরে বলল–আপনার আমন্ত্রণ আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। তবে আশ্চর্যও কম হইনি। গ্ল্যাডিস আমাকে কোনো কথাই বলেনি।

পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন–গতকাল ঠিক করা হয়। মিস নেভিল, মি. মর্লের মৃত্যুতে অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। তাই ভাবলাম এ বিষয়ে আমরা একসঙ্গে যদি কিছু কথা বলি।

ফ্র্যাঙ্ক কার্টার তীক্ষ্ণ স্বরে বাধা দিয়ে বলল–কি! মি. মর্লের মৃত্যু? শুনে শুনে কান পচে গিয়েছে। আমি তোমাকে কত বার বলেছি ওকে ভুলে যেতে গ্ল্যাডিস।

বিরক্ত হয়ে গ্ল্যাডিস বলল–আঃ ফ্র্যাঙ্ক, এভাবে বলছ কেন? জানো তো উনি আমাকে একশো পাউণ্ড দিয়ে গেছেন। কাল রাতে মিসেস মর্লের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।

ফ্র্যাঙ্ক দমে গিয়ে বলল–তা অস্বীকার করছি না। এর বিনিময়ে তোমাকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হত। আর উনি হয়েছেন লাভবান।

–তা করেছেন, তবে আমার উপযুক্ত বেতন দিতে উনি কার্পণ্য করেননি কখনও।

–আমি বিশ্বাস করি না। তুমি সরল বলে ওকে চিনতে পারোনি। তা নাহলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তোমাকে চাপ দিতেন না উনি।

–তিনি ভুল করেছিলেন।

-না, না তিনি জেনে বুঝেই করেছিলেন। উনি মারা গেলেন, না-লে আমি সেদিন যা খুশি দু-চার কথা শুনিয়ে আসতাম।

এতক্ষণ এরকুল পোয়ারো ওদের দুজনের কথা চুপচাপ শুনছিলেন। এবার তিনি জেরা শুরু করলেন মি. মর্লের মৃত্যুর দিন সকালে আপনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন?

ফ্র্যাঙ্ক কার্টার কর্কশ স্বরে বলল–হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। এর থেকে আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন? তাছাড়া আমি গিয়েছিলাম গ্ল্যাডিসের সঙ্গে দেখা করতে।

–আপনার সঙ্গে কি মিস নেভিলের দেখা হয়েছিল?

না, ওই ছোকরা চাকরটা জানায়, সে আসেনি।

–তারপর আপনি কি করলেন? চলে এসেছিলেন?

–না, বসেছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল মি. মর্লের সঙ্গে দেখা করার। তাকে বলতাম, আপনি জঘন্য খারাপ লোক। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা বলে গ্ল্যাডিসকে প্ররোচিত করেছেন। আমি ভাল একটা চাকরি পেয়েছি। সুতরাং ও আপনার এখানে আর কাজ করবে না। আজই চাকরি ছাড়ার নোটিশ দেবে।

–সত্যিই আপনি তার সাথে দেখা করে এসব কথা বলেছিলেন?

–না, ওই ঘরটায় বসে থেকে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তাই তাঁর সঙ্গে দেখা না করে চলে এসেছিলাম।

কখন গিয়েছিলেন এবং কখন চলে এসেছিলেন, ঠিক সময়টা বলুন তো মি. কার্টার।

–ঠিক সময়টা আমার এখন আর মনে নেই। তবে মনে হয় যখন গিয়েছিলাম তখন বারোটা বেজে গিয়েছিল। কখন বেরিয়ে এসেছিলাম সেটা মনে নেই।

–আপনি যখন ওয়েটিং রুমে বসেছিলেন তখন সেখানে আর কে কে ছিলেন?

–একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি চলে যেতে আমি একাই ছিলাম।

সাড়ে বারোটায় একজন ভদ্রমহিলা সেখানে গিয়েছিলেন। তাকে কি আপনি দেখেছিলেন?

-না। সংক্ষেপে জবাব দিল ফ্র্যাঙ্ক কার্টার।

–তাহলে আপনি সাড়ে বারোটার আগেই চলে এসেছিলেন, তাই না?

হবে হয়তো। ঘড়ি দেখা আমার অভ্যেস নেই। তাই সময়টা বলতে পারব না।

পোয়ারো ফ্র্যাঙ্ককে অপলক দৃষ্টিতে পরখ করছিলেন। ওর অস্থিরতা তাঁর দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি বুঝতে পারলেন ও একটা কথাও সত্যি বলছে না। তাই ও মনে মনে ভয় পেয়েছে।

পোয়ারো নরম সুরে বললেন মিস নেভিলের কাছে জানতে পারলাম আপনি একটা ভাল চাকরি পেয়েছেন। মাইনেও বেশ ভাল।

-হ্যাঁ, সপ্তাহে দশ পাউণ্ড, খারাপ নয় নিশ্চয়ই? আমারও যে ভাল কাজ জোগাড় করার যোগ্যতা আছে, সেটা জানাতে পারলাম না মি. মর্লেকে, এই দুঃখটা আমার রয়ে গেল।

–তা ঠিক। আশা করি পরিশ্রম করতে হয় না খুব বেশি?

–তেমন নয়।

কাজটা ভাল?

–খুব ভাল নিঃসন্দেহে। ব্যঙ্গের সুরে বলল, আমার অদম্য কৌতূহল ছিল বেসরকারি গোয়েন্দারা কিভাবে তদন্তের কাজ করে তা প্রত্যক্ষ করার। শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দা এখন আর দেখা যায় না। সব গোয়েন্দাই এখন বিবাহবিচ্ছেদের কাজ করেই খুশি।

এরকুল পোয়ারো বিরক্তির সুরে বললেন আমি বিবাহ বিচ্ছেদের তদন্ত করি না।

–অবিশ্বাস্য! আপনার সংসার খরচ জোগানের উৎস কি?

–আছে কোনো রহস্য।

 গ্ল্যাডিস নেভিল বলল–কেন? মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি তো রাজা মহারাজা, স্বরাষ্ট্র দপ্তর আর ডাচেসদের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। একথা মি. মর্লের মুখেই শুনেছি আমি।

হাসি মুখে পোয়ারো বললেন অসংখ্য ধন্যবাদ, মাদামোয়াজেল।

একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন এরকুল পোয়ারো। চিফ ইন্সপেক্টরকে ফোন করলেন। বললেন–বন্ধু, প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বিরক্ত করা জন্য গ্ল্যাডিস নেভিলের পাওয়া টেলিগ্রামটার খোঁজ নিয়েছিলেন? কে করেছে? কোথা থেকে এসেছে?

জ্যাপ বললেন–খুনের চিন্তা এখনও মাথা থেকে বের হয়নি দেখছি। হ্যাঁ, খোঁজ পেয়েছি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে এই টেলিগ্রামটা করা হয়েছিল। মিস নেভিলের দিদিমা থাকেন সমারসেটের রিচবোর্নে। টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছিল লণ্ডনের শহরতলি রিচবোর্ন থেকে। এরকুল পোয়ারো উৎসাহিত হয়ে বললেন–হুঁ, খুবই পাকা বুদ্ধির কাজ। তাড়াহুড়োয় দেখলে রচবার্নকে রিচবোর্ন ভাবা খুবই স্বাভাবিক। আচ্ছা এই টেলিগ্রাম সম্পর্কে আপনার যুক্তি কি?

–কিছুই না। নিছক তামাশা। একাজ কে করতে পারে বলে আপনি ভাবেন?

 –কে আবার? মানসিক বিকারগ্রস্ত কেউ। লোক ঠকাতেই যে আনন্দ পায়।

 –আর কাজটা সেদিনেই করতে হল যেদিন মি. মর্লে ইঞ্জেকশান দিতে ভুল করলেন।

আপনি যেহেতু ঘটনাটাকে খুন বলে ভেবেছেন তাই রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। তা না হলে এত সাধারণ ব্যাপার, সেদিন মিস নেভিল অনুপস্থিত। তাই মর্লেকে একা হাতেই সব রোগীকে দেখতে হয়েছে। ব্যস্ত হাতে কাজ সারতে হয়েছে। তাই তার ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

-আপনার ব্যাখ্যা আমার মনঃপুত হল না।

–আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনার এই সন্দেহ ঘটনার মোড়কে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। মি. মর্লেই মিস নেভিলকে ছলনা করে বাইরে পাঠিয়েছিলেন। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যামবেরিওটিসকে অতিমাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করেছিলেন। এতে তার মৃত্যু হয়। সুতরাং এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। যুক্তিটা এবার বোধগম্য হল আপনার?

না, মানতে পারলাম না। অ্যামবেরিওটিসের মৃত্যুর কারণ অন্য হতে পারে।

-না, আপনার ধারণা ভুল। আমি যেটুকু জেনেছি, তা হল তিনি স্যাভয় হোটেল থেকে বের হননি। তার কাছে কেউ আসেননি। নিজের ঘরে বসে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন। আর পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও এটাই উল্লেখ আছে, তার পেটে কোনো ওষুধ ছিল না। তাকে ইঞ্জেকশান করেই হত্যা করা হয়েছে। অতএব এটাই প্রকৃত ঘটনা। এই যুক্তি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারও মেনে নিয়েছেন।

–আর যে মহিলা বেপাত্তা তার সম্পর্কে তিনি কি মত প্রকাশ করেছেন?

–মিস সীল? না, এখনও তার খোঁজ-খবর চলছে। পোয়ারো বিদ্রুপের সুরে বললেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কি স্থির বিশ্বাস ওই ভদ্রমহিলা নিরুদ্দেশ হয়েছেন?

-হ্যাঁ, তারও ওই একমত। তবে জীবিত অথবা মৃত যে অবস্থাতেই হোক তাকে আমরা খুঁজে বের করব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মৃতের তালিকায় তাকে রাখেনি।

-কেন?

কারণ তার দেহ কোথাও না কোথাও পাওয়া যেত।

জ্যাপ, তাহলে কি বুঝব, আপনারা সব সমস্যার সমাধান সহজেই করতে পারেন?

বুঝতে পারছি, আপনার অনুমান যে খুন হয়েছে।

–আপনি কি জোর দিয়ে বলতে পারেন বেশির ভাগ নিরুদ্দিষ্ট মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন আপনারা?

–চেষ্টা করি, মেয়েদের ক্ষেত্রে বলতে পারি, অন্তত দশজনের মধ্যে আটজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। দেখা গেছে তিনি হয়তো কোনো পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গেছেন।

তাহলে সত্যিই মিস সীলকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?

–আমরা তার ছবি পাঠিয়ে দিয়েছি বিভিন্ন সংবাদ পত্রে, তার বর্ণনা দিয়ে ছবি ছাপা হবে। বি.বি.সি.র-ও সাহায্য চেয়েছি আমরা। ঠিক খুঁজে বের করব।

 –এতে কাজ হলেও হতে পারে। ঠিক আছে বন্ধু। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ফোন রেখে দিলেন পোয়ারো। গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলেন।

নিঃশব্দে ঘরে এসে ঢুকল জর্জ। তার হাতের ট্রে-তে এক কাপ গরম চকোলেট ও কিছু বিস্কুট রয়েছে।

চকোলেটের কাপ ও প্লেট টেবিলে রেখে বলল–স্যার, আর কিছু লাগবে আপনার?

পোয়ারো কাপের চকোলেট নাড়তে নাড়তে বললেন–মনটা বড়ই বিচলিত লাগছে, জর্জ।

 তার এই ভাবভঙ্গী জর্জের পরিচিত। তাই সে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। মন যখন অস্থির হয়ে ওঠে, মাথা কাজ করে না তখন তদন্ত সম্পর্কে জর্জের সঙ্গে তিনি আলোচনা করে থাকেন। তিনি বলেন জর্জের বিচার বুদ্ধি অনেক জটিল কেসের সমাধান সূত্র বের করে দিয়েছে।

হঠাৎ পোয়ারো জানতে চাইলেন–আমার দন্তচিকিৎসক হেনরি মর্লের মৃত্যুর খবর তুমি কি শুনেছ, জর্জ?

-হ্যাঁ, স্যার শুনেছি। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। তিনি নাকি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছেন? হ্যাঁ, আমিও সেরকমই শুনেছি। আসলে তিনি খুন হয়েছেন।

হুঁ, স্যার। –

-এখন কথা হচ্ছে তিনি যদি খুন হয়ে থাকেন, কে খুন করল কে?

–ঠিক কথা, স্যার।

–যাদের ওপর আমার সন্দেহ হচ্ছে তারা হল, রাঁধুনি, পরিচারিকা, মৃতের বোন জর্জিনা মর্লে, মৃতের অংশীদার মি. রেইলি, মৃতের ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড আর হলেন এক গ্রীক ভদ্রলোক। প্রথম ও দ্বিতীয় জনকে আমি ধরছি না। তারা খুব ভাল ও নিরীহ মানুষ। তাদের দ্বারা একাজ সম্ভব নয়। তৃতীয় জন অর্থাৎ মিস মর্লে, যদিও ভাইয়ের সব সম্পত্তির অধিকারী। তবুও অর্থের লোভ বিপদ ডেকে আনে। মি. রেইলির উদ্দেশ্য এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ছোকরা চাকরটিকেও সন্দেহ মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। তবে বেশি বিপজ্জনক ওই গ্রীক ভদ্রলোকটি।

জর্জ একটু কেশে বলল–এইসব বিদেশীরা, স্যার

এরকুল পোয়ারো তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ জর্জ, তবে কি জানো, সেই ভদ্রলোক আর বেঁচে নেই। আপাতদৃষ্টিতে মি. মর্লেই তার এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে এটা ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত ভুল তা এখনও জানা যায়নি।

আচ্ছা স্যার, এটা হয় না, তারা দুজন দুজনকে খুন করেছেন।

হ্যাঁ, সেটা অসম্ভব নয়। দাঁতের ডাক্তার চেয়ারে বসা রোগীকে মারার পরিকল্পনা করছেন আর এদিকে ওই রোগী ভদ্রলোক তাকে মারার জন্য বন্দুক বের করেছেন। অথচ কেউ তা জানেন না কি ঘটতে চলেছে। এটা একটা বুদ্ধির খেলা। তবে আমার নামের তালিকায় আরও দু’জনের নাম আছে। তাদের মধ্যে একজন এক আমেরিকান ভদ্রলোক অন্যজন ফ্র্যাঙ্ক কার্টার, যদিও সে রোগী হিসেবে আসেনি। সে বারোটার পর ওই বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তাকে কেউ বেরিয়ে যেতে দেখেনি। আমার বক্তব্য তুমি শুনলে, এবার বলো এর থেকে তুমি কি বুঝতে পারলে?

–স্যার, খুনের সময় আপনি জানতে পেরেছেন?

অ্যামবেরিওটিস যদি খুন করে থাকেন তাহলে তা হবে বারোটা থেকে বারোটা কুড়ির মধ্যে। আর যদি অন্য কেউ করে থাকে তাহলে তারপরেই হবে। তা না হলে মর্লের মৃত্যুদেহ অ্যামবেরিওটিসের চোখে পড়ত। এছাড়া বারোটা পঁচিশের পর মি. মর্লে আর কোনো রোগীকে ডাকেননি। তা আমি ওই ছোকরা চাকরের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।

জর্জ মাথা চুলকে বলল–স্যার আমি একটা কথা বলব?

 হ্যাঁ বলো।

স্যার, কথাটা হল, এবার আপনাকে আর একজন ডাক্তারের সন্ধান করতে হবে।

এরকুল পোয়ারো বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে বললেন–তোমার তারিফ করতেই হবে জর্জ। এই ভাবনাটা আমার মাথায় ছিল না।

জর্জ হাসি মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পোয়ারো গম্ভীর মুখে একাকী বসে আছেন। মর্লের মৃত্যু রহস্যের জট কিছুতেই খুলতে পারছেন না তিনি। কাকে তিনি চিহ্নিত করবেন খুনি বলে। হঠাৎ মনে পড়ল একটা নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে। সেটি হল মি. বার্নেস।

ঠিক সেই মুহূর্তে টেলিফোনটা ঝন ঝন করে বেজে উঠল। জর্জ ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরল। তারপর বলল–স্যার আপনাকে একজন মহিলা চাইছেন।

পোয়ারো রিসিভার কানে ধরতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।

ও প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠ–মি. এরকুল পোয়ারো, আমি জেন অলিভেরা, মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের ভাইঝি বলছি। চিনতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে না?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনতে পারছি বলুন, মিস অলিভেরা।

দয়া করে একবার গথিক হাউসে আসুন। আপনার সঙ্গে ভীষণ জরুরি কথা বলার আছে।

–অবশ্যই যাব। কিন্তু কখন যাব?

সাড়ে ছটায় আসুন।

 –বেশ তাই হবে।

 জেন অলিভেরা নিচু স্বরে বলল–আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো, মঁসিয়ে পোয়ারো?

–একদম না, এটাই আমি মনে মনে চাইছিলাম।

 পোয়ারো ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। এবার গথিক হাউসে যেতে হবে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। গথিক হাউসে এসে পৌঁছলেন গোয়েন্দা প্রবর এরকুল পোয়ারো। তাকে একটা বিরাট হলঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটা লেখার টেবিলের সামনে বসেছিলেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট তাঁর হাতে একটি ছুরি। তিনি আনমনে ছুরিটা নিয়ে খেলা করছিলেন। তাকে খুব অস্থির চঞ্চল মনে হচ্ছিল।

সে ঘরে আরও দুজন মহিলা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে পোয়ারো চিনতে পারলেন, সে জেন অলিভেরা। জেন একটি ম্যান্টলপীসের সামনে দাঁড়িয়েছিল। অন্য মহিলাকে তিনি চিনতে পারলেন না। তবে যে কথা চিৎকার করে বলছিলেন তা পোয়ারোর কর্ণগোচর হল। তিনি বলছিলেন–এই ব্যাপারে আমার মতামতও জানতে চাওয়া উচিত ছিল, অ্যালিস্টেয়ার।

–অবশ্যই, জুলিয়া অবশ্যই, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন অ্যালিস্টেয়ার। তিনি পোয়ারোকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসতে বললেন।

–তোমরা যদি ওই নোংরা ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলো তাহলে আমি এঘরে আর থাকব না।

–আমারও একমত মা, জেন অলিভেরা বলল।

মিসেস অলিভেরা এরকুল পোয়ারোকে না দেখার ভান করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

মি. ব্লাস্ট হাসতে হাসতে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি আসায় আমি আনন্দিত হয়েছি। আপনাকে আমার ভাইঝি জেন আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ওর সঙ্গে আপনার আগেই পরিচয় হয়েছে।

সেই মুহূর্তে জেন বলল–কাগজে নিরুদ্দেশ কলামে যে মহিলার নাম বেরিয়েছে তার সম্বন্ধে কিছু বলার ছিল। মিস সীল নাকি কি যেন নাম ওই মহিলার?

পোয়ারো বললেন–সেইনসবারি সীল।

 মিস অলিভেরা নাক কুঁচকে বলল–কি বিচ্ছিরি নামরে বাবা, তাই মনে রাখতে পারছি না। কাকা তুমি বলবে না আমি বলব?

–ওই গল্পটা তুমি ভাল রপ্ত করেছে, মামনি। তাই তুমিই বলো।

জেন একবার পোয়ারোর দিকে তাকাল। তারপর বলতে শুরু করল–ব্যাপারটার মধ্যে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই হয়তো। তবুও আপনাকে ডেকে এনেছি। কারণ আপনার এ কাহিনি জেনে রাখা উচিত।

–হুঁ বলুন, আমি শুনতে আগ্রহী।

–আমি তিন মাস আগে ঘটা একটা ঘটনার কথা বলছি। আমি কাকার সঙ্গে সেদিন বেরিয়েছিলাম রোলসে চড়ে। কথা ছিল তিনি ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটে নামবেন আর আমি যাব রিজেন্ট পার্কে। সেখানে আমার এক বন্ধু থাকে। গাড়ি গিয়ে থামল ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটে। কাকা গাড়ি থেকে নামলেন। আর সেই মুহূর্তে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা, মধ্যবয়স্কা ওই মহিলার পরনে ছিল ডবল ছাঁটের পোশাক। তিনি কাকার দিকে ছুটে এসে বললেন, ওহ, মি. ব্লাস্ট, আমাকে চিনতে পারছেন? কাকার ভাবভঙ্গী দেখে আমি বুঝতে পারলাম তিনি ওই মহিলাকে চিনতে পারছিলেন না।

মি. ব্লাস্ট বললেন, সত্যিই আমি সব কথা ভুলে যাই। জেন আবার বলতে শুরু করল, কাকা যেন চিনতে পেরেছেন এমন ভাব করে। বলল, ওহ ঘঁ, অবশ্যই। মহিলা আবার বললেন, আপনার স্ত্রীকে আমি বহুদিন থেকে চিনি। সে আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল।

মি. ব্লাস্ট বিষণ্ণ সুরে বললেন–চাঁদা নেওয়ার জন্য সবাই ওরকম কথা বলে থাকে। সেদিনও পাঁচ পাউণ্ড চাঁদা দিয়ে রেহাই পেয়েছিলাম।

পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন–ওই ভদ্রমহিলার কথা সত্যি? উনি কি আপনার স্ত্রীকে চিনতেন?

চিনতেও পারেন। তবে বন্ধু বলতে পারব না। মিশনের কাজে তাকে দেশের বাইরেও যেতে হয়। সেখানে কোনো অনষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল হয়তো।

জেন অলিভার দ্রুত বলে উঠল–রেবেকা কাকিমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ছিল তা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা তোমার সাথে কথা বলার একটা অজুহাত মাত্র। মি. ব্লাস্ট সায় দিয়ে বললেন–তা হবে হয়তো। পোয়ারো জানতে চাইলেন–ওই মহিলার সঙ্গে আর কোনোদিন আপনার দেখা হয়েছিল?

মাথা ঝাঁকিয়ে ব্লাস্ট বললেন–ওকথা কবেই আমি ভুলে গিয়েছি। ইদানীং পেপারে তার খবর ছাপা হয়েছে তা শুনেছি।

জেন ধীরে ধীরে বলল–মঁসিয়ে পোয়ারোর ব্যাপারটা জানা দরকার ভেবেই আমি ফোন করেছিলাম।

পোয়ারো হাসি মুখে বললেন–ধন্যবাদ মাদামোয়াজেল, এরপর ব্লাস্টকে উদ্দেশ্য করে বললেন মি. ব্লাস্ট আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ, আপনার অনেকটা সময় অপচয় করেছি, আর নয়। এবার আমি উঠব।

জেন বলল–চলুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।

পোয়ারোর মুখে মুচকি হাসি। তারা দুজনে নিচে নেমে এলেন। জেন একটা ঘর দেখিয়ে বলল–এই ঘরে একবার আসুন।

পোয়ারো জেনের পেছন পেছন ঘরটিতে গিয়ে প্রবেশ করলেন। ঘরটি খুবই ছোট্ট।

জেন এবার পোয়ারোকে সরাসরি প্রশ্ন করল–তখন ফোনে বললেন আপনি আমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন? কিন্তু কেন?

পোয়ারো দ্রুত বললেন–ওটা কথার কথা ছিল, মাদামোয়াজেল।

–মানে হল এই, ওই মহিলার বিষয়ে আমি কিছু জানাতে চাইব তা আপনি আগেই ভেবে রেখেছিলেন।

তাহলে বলুন সেইনসবারি সীল সম্বন্ধে ওই তুচ্ছ খবর আমাকে দিলেন কেন? কেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকে জানালেন না? আছে আপনার কোনো ব্যাখ্যা এই বিষয়ে?

–ঠিক আছে, মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি আর কি জানতে পেরেছেন?

আমি জানি আপনি আমার ব্যাপারে কৌতূহলী। আর যখন জানতে পারেন আমি হর্বোন প্যালেস হোটেলে গিয়েছিলাম তখন থেকেই ছুতো খুঁজছিলাম কিভাবে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায়। একথা শুনে জেনের চোখ মুখ রক্তহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। পোয়ারো তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন মি. হাওয়ার্ড রেইকস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে আপনি আগ্রহী ছিলেন।

জেন অবাক হবার ভাব করে বলল–লোকটা কে জানতে পারি কি?

পোয়ারো জেনের ছলনা ধরতে পারলেন। তিনি বললেন আমাকে উত্তেজিত করে লাভ নেই। আমি যা জানি সব বলব। তবে তা অনুমানসাপেক্ষ। সেদিনের কথা আপনার মনে আছে নিশ্চয়। যেদিন আমি ও আমার বন্ধু চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ প্রথম এখানে। এসেছিলাম। আপনি আমাদের দেখে চমকে উঠেছিলেন। আপনার অনুমান আপনার কাকার কিছু হয়েছিল। কেন, এরকম ধারণা হয়েছিল আপনার সেদিন?

কারণ তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ। তাই ঈর্ষা করেই হোক বা রাগেই হোক তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায় অনেকে। হার্জো স্লোভাকিয়ার ঋণের পর কাকাকে কত রকম ভয় দেখানো চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি তাকে মেরে ফেলার জন্য ডাকে বোমা পাঠানো হয়েছিল।

এরকুল পোয়ারো বললেন–দন্ত চিকিৎসক মি. মর্লেকে, কে বা কারা গুলি করে, সেকথা চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ আপনাকে বলেছিলেন। আপনি গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, এ অসম্ভব। মনে কি পড়ে আপনার মাদামোয়াজেল?

জেন ঠোঁট কামড়ে বলল–আশ্চর্যজনক ঘটনা কিনা তাই হয়তো…..।

–এতে বোঝা যায় আপনি মি. মর্লের কথা আগেই জানতেন, আপনি আশা করেছিলেন ওর বাড়িতে কিছু একটা অঘটন ঘটবে। তবে মি. মর্লের নয়, আপনার কাকার কোনো ক্ষতি হতে পারে। এমন একটা আশঙ্কা আপনার ছিল। তাই এমন কিছু আপনি জানেন যা আমরা এখনও জানি না। সেদিন মি. মর্লের চেম্বারে যারা ছিলেন তাদের সবার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। কথাও বলেছি। সেদিন যারা ওখানে ছিলেন তাদের কোনো একজনের সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। আমার ধারণা তিনি হলেন আমেরিকান ভদ্রলোক হাওয়ার্ড রেইকস। পোয়ারো একটু থেমে আবার বললেন আমি তার সঙ্গে দেখা করেছি। সাংঘাতিক মানুষ তিনি এবং সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

জেন বিষণ্ণ সুরে বলল–ঠিক আছে, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কাছে আমি হার মানলাম। আপনি সঠিক পথে এগোচ্ছেন।

জেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসল। তারপর নিচু স্বরে বলতে থাকল–আমি সব বলছি। আমি হাওয়ার্ড রেইকসকে পাগলের মতো ভালবাসি। আমার মা সব জানতেন। তাই তিনি পছন্দ করতেন না যে আমি ওর সঙ্গে মেলামেশা করি। আমাকে এখানে আনার পিছনে মায়ের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হল রেইকসের কাছ থেকে আমাকে দূরে রাখা। অন্যটি হল অ্যালিস্টেয়ার কাকা মারা যাবার পর তার সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা, আমার কাকিমা রেবেকা আর্নহোস্টের বোন হলেন আমার মায়ের মা। অ্যালিস্টেয়ার কাকা নিঃসন্তান। এছাড়া তাদের আমরা ছাড়া কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তাই মায়ের দাবি একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে আমাকে তার সম্পত্তি দিতে হবে। তবে পদমর্যাদায় কোনো দিনই আমরা কাকার সমকক্ষ হতে পারব না।

জেন কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে চলল–আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। এতদিনের সব পরিকল্পনা হাওয়ার্ড ভেস্তে দিতে চায়। সব ও ঘৃণা করে। আমি অ্যালিস্টেয়ার কাকাকে ভালোবাসি, তবে মাঝে মধ্যে তার আচরণ আমাকে দ্বিধা বিভক্ত করে তোলে। তখন ভাবি হাওয়ার্ডের কথাই ঠিক। তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াই উচিত। তা–হলে আমরা উন্নতির মুখ দেখতে পাব না। উন্নতির পথের কাঁটা হয়ে রয়েছেন তিনি।

–মি. রেইকসের মৃত্যুদশী হয়েই কি আপনার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে?

–হয়তো তাই, আবার হয়তো না। হাওয়ার্ড উগ্র প্রকৃতির মানুষ। অ্যালিস্টেয়ার কাকার কথা শুনলে হয়তো ওকে পাল্টানো যেত। ওরা বিশ্বাস করে পুরোনো ধ্যান ধারণায় চললে আমাদের দেশ আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই পিছনে না তাকিয়ে এগিয়ে চলতে হবে আমাদের। সেই কারণে প্রথমেই সরতে হবে অ্যালিস্টেয়ার কাকাকে।

–খুবই চিত্তাকর্ষক মতবাদ। –আপনিও আমাকে ভুল বুঝছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।

হয়তো আমার বয়স হয়েছে, তাই ওদের কাছে আমার মতো বুড়োদের স্বপ্ন অতীত ইতিহাস হয়ে যায়।

পোয়ারো মাথা চুলকে বললেন–সেদিন মি. রেইকস কেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন? দাঁতের কোনো সমস্যা?

না, সেটা নয়। আমার ইচ্ছে ছিল তার সঙ্গে কাকার আলাপ করিয়ে দেওয়া। আলাপ হলে ও বুঝতে তিনি কত ভালো মানুষ, তিনি ঘৃণার পাত্র নন। এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না আমার কাছে। কেন না মা জানতে পারলে সব পণ্ড করে দিতেন।

তারপর আপনার ভয় পাবার কারণ কি ছিল?

জেন চোখ দুটো বন্ধ করল। কোনোরকমে বলল–কারণ হল, মাঝেমধ্যে হাওয়ার্ড বড় নিষ্ঠুর হয়ে যায়। সে তখন বদ্ধপরিকর

–একেবারে শেষ করে দেবার।

 জেন আর্তনাদ করে উঠল

না, না।