পরের তিন সপ্তাহ আনিসুর রহমানের অতি ব্যস্ততায় কাটল। তিনি ব্যাঙ্গালোরে একটি সেমিনারে টেন্ড করতে গেলেন। ফিরে এসে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস ফাইন্যাল পরীক্ষার একটারনাল একজামিনার হিসেবে রাজশাহী গেলেন। রুমানার এক খালাতো বোনের হুট করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চিটাগাং গেলেন। তবে এর ফাঁকে ফঁাকে পাই বিষয়ক কিছু তথ্য সংগ্রহ করলেন। যেমন
১. এই সংখ্যাটির মান এখনো নির্ণয় করা যায়নি। অতি শক্তিমান কম্পিউটারের সাহায্যে চেষ্টা করা হয়েছে। সংখ্যা দশমিকের পর চলতেই থাকে। কখনো পৌনঃপুনিক আসে না।
২. মহান গ্রিক অংকবিদ পিথাগোরাসের ধারণা পাই প্রকৃতির একটি রহস্যময় বিষয়। যিনি এই রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন তিনি প্রকৃতির একটা বড় রহস্য উদ্ধার করতে পারবেন।
৩. আমেরিকান এষ্ট্ৰনমার কার্ল সেগান পাই-এর রহস্য নিয়ে একটি বই লিখেছেন। যে বইয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে পাই-এর মানে ঈশ্বর কিছু বলতে চাচ্ছেন। এটা তাঁর ভাষা।
তিনি এর মধ্যে হারুন অর রশিদ নামের ছেলেটির খোঁজ বের করারও চেষ্টা করলেন। সমস্যা হল ছেলেটির নাম ছাড়া তাঁর আর কিছুই মনে নেই। ছেলেটার বাবা একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিল সেই কার্ড তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কোথায় যেন তার একটা দোকান বা শো-রুম আছে বলেছিল। জায়গাটার নাম মনে করতে পারলেন না। শুধু মনে আছে সেই দোকানে ভদ্রলোকের এক আত্মীয় বসে যার চেহারা ফিল্মের কোন নায়ক বা নায়িকার চেহারার মত। এই তথ্য দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা নিতান্তই অসম্ভব ব্যাপার। তারপরেও তিনি তার এ্যাসিসটেন্টকে দায়িত্ব দিয়েছেন—ঢাকার সব কটা স্কুলে সে যাবে সেখানে হারুন অর রশিদ নামে এগারো বার বছরের কোন ছেলে আছে কী না খোঁজ করবে। সেই অনুসন্ধানেও কোন ফল হচ্ছে না।
আনিসুর রহমানের জীবন যাপন পদ্ধতিতে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এখন আর রাত সাড়ে দশটায় বাসায় ফেরেন না। তিনি ফেরেন রাত এগারোটায়। এই আধঘণ্টা সময় গভীর নিষ্ঠায় পাই-এর মান বের করার চেষ্টা করেন।
হলুদ মলাটের একশ পৃষ্ঠার একটা বাঁধানো খাতা তিনি কিনেছেন। খাতার পাতার অর্ধেকের বেশি লিখে ফেলেছেন। অংক এখনো চলছে। কাজটা করে তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। দশটা বাজার পরপরই তিনি অস্থির বোধ করেন কখন অংক শুরু করবেন। খাতাটা তিনি বাড়িতে নেন না। অতি মূল্যবান বস্তুর মত চেম্বারে ড্রয়ারে তালাবন্ধ করে রাখেন। খাতা বিষয়ে বা অংক বিষয়ে তিনি কারো সঙ্গেই কোন কথা বলেন না। মাঝে মাঝে তার স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করেন, তোমার কি কোন সমস্যা যাচ্ছে! তোমাকে সব সময় অস্থির লাগে কেন?
তিনি হড়বড় করে বলেন, কই অস্থির নাতো।
রাতে মনে হয় তোমার ভাল ঘুম হয় না। প্রায়ই শুনি তুমি বিড়বিড় করছ।
আমার ঘুমের কোন সমস্যা নেই।
একজন ডাক্তার কি দেখাবে?
খামাখা কেন ডাক্তার দেখাব।
তাহলে চল কিছুদিন বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
চল যাই। কোথায় যেতে চাও?
মালয়েশিয়া যাবে? শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা।
যেতে পারি।
আনিসুর রহমান পনেরো দিনের জন্যে সবাইকে নিয়ে মালয়েশিয়া গেলেন। খাতাটা সঙ্গে নিলেন না। পনেরো দিন আনন্দ করেই কাটালেন। দেশে ফিরে আবার সেই আগের রুটিন। তবে অংক করার সময় আরেকটু বাড়ালেন। এখন তিনি অংক করেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বাসায় আগের মতই এগারোটায় ফেরেন। রোগী দেখেন পনেরো মিনিট কম।
ছয় মাসের ভেতর আনিসুর রহমানের খাতার সংখ্যা হল দশটা। অংক করার সময়ও বাড়ল। তিনি এখন ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা সময় দেন অংকের পেছনে। তাঁর বড় ভাল লাগে।
এক ডিসেম্বর মাসের কথা। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। কোল্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে। নেমেছে কুয়াশা। আনিসুর রহমান চেম্বারে বসে আছেন। রাত আটটা। দুজন রোগী ছিল তাদের দেখা শেষ হয়েছে। চেম্বারে আর কেউ নেই। আনিসুর রহমান তাঁর এ্যাসিসটেন্টকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নিজের মনে খুব আনন্দ। তিন ঘণ্টা টানা সময় পাওয়া গেছে। মন লাগিয়ে অংক করা যাবে। তিনি নতুন একটা খাতা বের করলেন। আর তখন তার মাথার ভেতর কেউ একজন কথা বলে উঠল। মেয়ের গলা। অতি মিষ্টি গলা তবে ভাঙা ভাঙা।
আনিসুর রহমান ভাল আছেন?
কে কে কে? আমরা আপনার নিবেদন দেখে খুশি হয়েছি।
কে? আপনারা কে?
এখন থেকে আমরা আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। আপনাকে অংক করতে সাহায্য করব।
আপনারা কে?
আমরা কে সেটা জরুরি না। যে অংকটা আপনি করছেন সেটা জরুরি।
আনিসুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
আজেবাজে কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না। অংকটা করুন।
এই অংক কী কখনো শেষ হবে?
না।
যে অংক শেষ হবে না সেই অংক করে লাভ কী?
শেষ না হলেও একটা সিরিজ বের হয়ে আসবে। আমাদের প্রয়োজন সিরিজ। সিরিজও শেষ না।
সিরিজ কী?
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ একটা সিরিজ যেটা চলতে থাকে, আবার ২৪ ৬ ৮ ১০ আরেকটা সিরিজ। কোন সিরিজই শেষ হয় না।
একই অংক কি আপনারা অনেককে দিয়ে করাচ্ছেন? আমি যতদূর জানি হারুন অর রশিদও এই অংক করছে।
যেই মুহূর্তে আপনি শুরু করেছেন আমরা হারুনকে সরিয়ে দিয়েছি। তাকে অন্য কাজ দিয়েছি। তাকে সিরিজ করতে দিয়েছি।
হারুনের সঙ্গে কি যোগাযোগ করা যায়?
অবশ্যই যায় সে আমাদের সঙ্গেই আছে। একদিন আমরা আপনাকেও আমাদের মধ্যে নিয়ে নেব।
কবে?
সেটাতো এখননা বলতে পারছি না। হারুনের সঙ্গে কথা বলবেন।
হ্যাঁ। আরেকদিন কথা বলিয়ে দেব। কেমন?
আচ্ছা!
অংক করুন।
আচ্ছা।