পরের খেলাগুলো তেমন কিছু জমজমাট নয়। পাঁচটা বাঘ একসঙ্গে দেখা যায়নি, দুটো বাঘকেই ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে আনা হয়েছে, অন্য নাম দিয়ে। সে বাঘ দুটোও রোগা আর বুড়ো, মনে হয় আফিং খাইয়ে রাখা হয়েছে, আস্তে-আস্তে হাঁটে। হাতির নাচটা মোটেই নাচ নয়। হাতিটাকে নিয়ে আসার পর পেছন থেকে এত জোরে জোরে ঢাক-ঢোল-জগঝম্প বাজানো হতে লাগল যে, মনে হল যেন হাতিটা ভয় পেয়ে দৌড়চ্ছে। একজন লোক তাকে গোল করে ঘোরাতে লাগল।
সন্তু মাঝে-মাঝে পেছন ফিরে দেখছে যে জোজো ফিরে আসছে কি না। কিন্তু একটার পর একটা খেলা হয়ে যাচ্ছে, জোজোর দেখা নেই।
ক্লাউন দুজনের কাণ্ডকারখানাই বেশ মজার। একবার একজন ক্লাউন একটা জ্বলন্ত সিগারেট পুরোটাই মুখের মধ্যে ভরে দিল, তারপর তার মুখ থেকে আগুন বেরোতে লাগল ভলকে ভলকে। অন্য ক্লাউনটি এক বালতি জল এনে ঢেলে দিল তার মাথায়, তখন তার চুল থেকেও বেরোতে লাগল ধোঁয়া। বালতিতে আর জল নেই। অন্য ক্লাউনটি তখন মুখ থেকে পিচকিরির মতন জল বার করতে লাগল।
এই খেলাটা দেখে কাকাবাবু পর্যন্ত হাততালি দিয়ে উঠলেন।
সব খেলা শেষ হওয়ার পর দর্শকরা উঠে চলে যেতে লাগল, কাকাবাবু আর সন্তু দাঁড়িয়ে রইল জোজোর জন্য। জোজো আসছে না। সব লোক বেরিয়ে গেল তবু পাত্তা নেই জোজোর।
কাকাবাবু হাসিমুখে সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, আমাদের জোজোবাবু কি সত্যি অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি?
সন্তু বলল, ও বোধ হয় এখনও ম্যাজিশিয়ানের কাছ থেকে কায়দাটা শিখছে।
কাকাবাবু বললেন, চল দেখে আসি, কতটা শিখল।
যেখানে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, সেখানে এসে কাকাবাবু পেছনের পরদাটা সরিয়ে ফেললেন। যারা খেলা দেখাল, তাদের মধ্যে কয়েকজন সেখানে বসে শিঙাড়া আর চা খাচ্ছে। সোনালি কোট পরা লোকটি মনে হয় এই সার্কাসের ম্যানেজার। তার হাতেই শিঙাড়ার ঝুড়ি। জাদুকর এক্স একটা টিনের চেয়ারে বসে আছেন, সামনের দিকে পা দুটো ছড়ানো। মুখোশটা এখনও খোলেননি, একটা চুরুট টানছেন আপনমনে। তাঁর পাশে একজন লোক একটা লম্বা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকটা আলো ঠিক করছে।
কাকাবাবু সেই সোনালি কোট পরা ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন, ও মশাই, আপনাদের খেলা তো শেষ হয়ে গেল, এবার আমাদের ছেলেটিকে ফেরত দেবেন না?
ম্যানেজার বললেন, আপনাদের ছেলে মানে?
কাকাবাবু বললেন, ওই যাকে অদৃশ্য করে দিলেন? আর কতক্ষণ অদৃশ্য করে রাখবেন?
ম্যানেজার একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সে তো চলে গেছে!
কাকাবাবু বললেন, চলে গেছে? কখন গেল?
ম্যানেজার বললেন, কখন? তাকে চারটে শিঙাড়া আর দুটো রসগোল্লা দেওয়া হয়েছিল, সব খেয়ে নিল, তারপর নিজেই চলে গেছে।
সন্তু বলল, তা হলে নিশ্চয়ই বাইরে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও কাকাবাবু আবার মুখ ফিরিয়ে ম্যাজিশিয়ান এক্স-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার এই অদৃশ্য করার কায়দাটা কী বলুন তো!
উত্তর না দিয়ে ম্যাজিশিয়ান কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখোশের আড়ালে তাঁর মুখোনা কেমন তা বোঝার উপায় নেই। শুধু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
কাকাবাবু আবার বললেন, আপনার খেলাটা আমাদের খুব তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আপনার শো-ম্যানশিপ চমৎকার।
ম্যাজিশিয়ান এবার শুধু বললেন, থ্যাঙ্কস!
ম্যানেজার হেঁ-হেঁ করে হেসে বললেন, আমাদের কায়দাগুলো ফাঁস করে দিলে কি চলে? তা হলে আর লোকে টিকিট কেটে দেখতে আসবে কেন?
কাকাবাবু বললেন, তা বটে, তা বটে! আমি এমনই কৌতূহলে জিজ্ঞেস করছিলাম। চল সন্তু
এই সময় টুলের ওপর দাঁড়ানো লোকটি হঠাৎ হুড়মুড় করে টুল উলটে পড়ে গেল। একেবারে সন্তুর গায়ের ওপর। দুজনেই মাটিতে গড়াগড়ি।
ম্যানেজার হা-হা করে ছুটে এসে সন্তুকে ধরে তুলতে-তুলতে বললেন, লাগেনি তো ভাই? লাগেনি তো?
সন্তুর কিছুই হয়নি, কিন্তু অন্য লোকটির মাথা ঠুকে গেছে। সন্তুই তাকে তুলতে গেল। লোকটির বেশ শক্ত-সমর্থ চেহারা, মাথায় একটাও চুল নেই, মুখে গোঁফ-দাড়ির কোনও চিহ্ন নেই, এমনকী ভুরু দুটোও প্রায় নেই-ই বলতে গেলে।
ম্যাজিশিয়ান চেয়ার থেকে ঝুঁকে সেই লোকটির গালে জোরে একটা চড় কষিয়ে বললেন, ইউ ফুল!
ম্যানেজার বললেন, আহা-হা, ওকে মারছেন কেন? বেচারা পা পিছলে পড়ে গেছে। ক্ষতি তো কিছু হয়নি।
পড়ে যাওয়ার সময়, কিংবা চড় খেয়েও সেই লোকটা মুখ দিয়ে একটা শব্দও করেনি।
কাকাবাবু আর সন্তু বেরিয়ে এল তাঁবুর পেছন দিক থেকে। একপাশে বাঘের খাঁচা। একটু দূরে সেই ছাগলটাও বাঁধা রয়েছে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, ম্যাজিশিয়ান এক্স-এর মুখে মুখোশ কেন?
কাকাবাবু বললেন, ম্যাজিশিয়ানদের নানারকম সাজপোশাক করতে হয়। ইনি মুখোশ লাগিয়েছেন। মুখোশ লাগালে অন্য গ্রহের প্রাণী মনে হয় না?
সন্তু বলল, খেলা দেখাবার পরেও মুখোশ খোলে না?
কাকাবাবু বললেন, সাড়ে ছটার সময় তো আবার শো শুরু হবে, তাই খোলেনি বোধ হয়।
বাইরে কোথাও জোজোকে দেখা গেল না। গাড়ির কাছেও সে নেই।
কাকাবাবু বললেন, জোজোটা কোথায় গেল?
সন্তু বলল, নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কোথাও লুকিয়ে আছে। আমাদের কাছে প্রমাণ করবে যে ও সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। এর পর এসে যে কত গল্প বানাবে! ও অদৃশ্য হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে, এর মধ্যে হিমালয় ঘুরে এসেছে, কিংবা সমুদ্রের তলায়…
কাকাবাবু বললেন, জোজোর গল্প শুনতে আমার ভালই লাগে। কিন্তু কতক্ষণে সে দেখা দেবে? সন্ধে হয়ে গেল যে, ফিরতে হবে না?
শীতকালের বিকেল তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গিয়ে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। গাড়ির কাছে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও জোজোর পাত্তা পাওয়া গেল না।
কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন পরে গাড়ি চালাচ্ছি, রাত্তিরবেলা অসুবিধে হতে পারে। তুই দেখে আয় তো, ওই তাঁবুর আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছে কি না। এখানে মাঠের মধ্যে কোথায় লুকোবে?
সন্তু দৌড়ে দেখে এল। সেখানে কোথাও জোজো নেই। সার্কাসের লোকেরাও কেউ কিছু বলতে পারে না।
ফিরে এসে সন্তু বলল, ও সহজে দেখা দেবে না। এক কাজ করা যাক। তুমি গাড়িতে স্টার্ট দাও। আমাদের চলে যেতে দেখলেই দৌড়ে আসবে।
সন্তু উঠে বসল, কাকাবাবু গাড়ি চালাতে শুরু করলেন, বড় রাস্তা ধরে গেলেন খানিকটা। জোজো তবু দৌড়ে এল না।
সন্তু বলল, বেশি গল্প বানাবার জন্য জোজো বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকবে। হয়তো ডায়মন্ড হারবার চলে গেছে বাসে চেপে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে। আমাদের দেখলে বলবে, অদৃশ্য হয়ে উড়ে ডায়মন্ড হারবার পৌঁছে গেছে।
তবু কাকদ্বীপের কয়েকটা দোকানে উঁকি দিয়ে জোজোকে খুঁজে দেখা হল। তার কোনও চিহ্ন নেই। অগত্যা গাড়ি ছুটল ডায়মন্ড হারবারের দিকে।
কাকাবাবু বললেন, জোজোর প্র্যাকটিক্যাল জোক একটু বেশি-বেশি হয়ে যাচ্ছে। ডায়মন্ড হারবারে অত ভিড়ের মধ্যে কোথায় তাকে খুঁজব?
সন্তু বলল, ও নিশ্চয়ই রাস্তার ধারে বসে থাকবে। আমাদের গাড়ি দেখলেই চিনবে।
ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি এসে কাকাবাবু গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন। এখন অবশ্য তেমন ভিড় নেই। যারা পিকনিক করতে এসেছিল, প্রায় সবাই ফিরে গেছে। তা ছাড়া বেশ শীত পড়েছে, গঙ্গার ধারে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না।
আস্তে-আস্তে গাড়ি চালিয়ে কাকাবাবু পুরো শহরটা অতিক্রম করে গেলেন। আবার ফিরে এলেন সাগরিকা হোটেলের কাছে। আবার উলটো দিকে গাড়ি ঘোরালেন। কোথায় জোজো?
কাকাবাবু বললেন, তা হলে কি জোজো কাকদ্বীপেই থেকে গেল?
সন্তু বলল, বরং আমার মনে হয়, জোজো কলকাতায় ফিরে গেছে। এখান থেকে ট্রেন আছে, বাস আছে।
কাকাবাবু সাধারণত রাগ করেন না। কিন্তু এখন বিরক্তিতে তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি আপনমনে বললেন, এটা জোজো ঠিক করেনি। এতক্ষণ লুকিয়ে থাকার কী মানে হয়? শুধু-শুধু আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলা।
সন্তু বলল, জোজো ঠিক কলকাতায় চলে যেতে পারবে। বাস আছে, ট্রেন আছে। ওর কাছে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট আছে, আমি দেখেছি।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কলকাতায় ফিরতেই হল। আগে সন্তুদের বাড়ি। বাড়িতে ঢুকে ফোন করল সন্তু।
জোজোর মা ধরেছেন, সন্তু বলল, মাসিমা, একটু জোজোকে দিন তো।
জোজোর মা বললেন, জোজো তো নেই। ও তো সকালবেলা তোমাদের সঙ্গেই বেরিয়েছিল। এখনও ফেরেনি। তোমাদের সঙ্গে ফেরেনি?
সন্তু আমতা-আমতা করে বলল, না, মানে, আমাদের সঙ্গেই গিয়েছিল, কিন্তু ওখানে ওর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ও তার সঙ্গে ফিরবে বলল…নিশ্চয়ই এসে যাবে খানিকক্ষণ পরে—
রাত্তির দশটা, এগারোটা, বারোটা, তিনবার ফোন করল সন্তু, তারপর সারারাত কেটে গেল। পরদিন সকাল দশটার মধ্যেও জোজো ফিরল না, নিজের বাড়িতে সে কোনও খবরও দেয়নি।
কাকাবাবু বললেন, ছি ছি ছি ছি। আমাদের সঙ্গে বেড়াতে গেল, অথচ আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। ওর মা-বাবা কী ভাবছেন আমাদের!
সন্তু বলল, জোজোর বাবা কলকাতায় নেই, কাশী গেছেন।
কাকাবাবু বললেন, ওর মা একলা রয়েছেন? ছেলের জন্য উনি ব্যাকুল হয়ে পড়বেন।
সন্তু বলল, না, একলা নন মাসিমা। জোজোদের বাড়িতে অনেক লোক।
সন্তু এখনও ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতে পারছে না। তার দৃঢ় ধারণা, জোজো নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কোথাও লুকিয়ে আছে। তার মনে পড়ল, কাকাবাবু দিল্লিতে আছেন শুনে জোজো বলেছিল, কাকাবাবুকে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দে, জোজো মিসিং! তা হলেই কাকাবাবু হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আসবেন। আমি লুকিয়ে থাকব, কাকাবাবু আমাকে খুঁজে বার করবেন। বেশ মজা হবে। জোজো নিশ্চয়ই এই খেলাটাই খেলছে।
কিন্তু নিজের মাকেও যে দারুণ চিন্তায় ফেলে দিল জোজো? তিনি বারবার ফোন করছেন উতলা হয়ে। আর একবার ফোন করতেই সন্তুকে বাধ্য হয়ে একটা ছোট্ট মিথ্যে কথা বলতে হল।
সন্তু বলল, মাসিমা, কাল তো জোজোর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। সে নিশ্চয়ই জোজোকে জোর করে ধরে রেখেছে। এখন আমাদের কলেজ ছুটি, তাই জোজো থেকে গেছে। দু-একদিনের মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরবে।
একথা বলে তো দিল, কিন্তু জোজো যদি দু-একদিনের মধ্যেও না ফেরে? যদি তার সত্যিই কোনও বিপদ হয়ে থাকে? তখন সবাই বলবে, আগেই কেন পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি।
এখন পুলিশে খবর দিলে তারা প্রথমেই ভাল করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য জোজোদের বাড়িতে যাবে। তাতে জোজোর মা আরও ব্যাকুল হয়ে পড়বেন না? নিশ্চয়ই কান্নাকাটি শুরু করে দেবেন!
কী মুশকিলেই ফেলে দিল জোজো!
অসীম দত্ত কাকাবাবুকে একটা কার্ড দিয়েছিলেন। কাকাবাবু সেই কার্ড দেখে অফিসে ফোন করলেন। সেখান থেকে জানানো হল, তিনি অফিসে আসেননি, বাড়িতেই আছেন। বাড়িতে ফোন করার পর একটি মেয়ে বলল, অসীম দত্ত বাড়িতেও নেই, মাংস কিনে আনতে গেছেন, খানিক বাদেই ফিরবেন।
কাকাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি অসীমের মেয়ে? তোমার নাম কী?
মেয়েটি বলল, আমার নাম রূপকথা, ডাকনাম অলি।
কাকাবাবু বললেন, শোনো অলি, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, তোমার বাবাকে বাড়িতে থাকতে বলো, আমি এক্ষুনি আসছি।
কাকাবাবুর নাম শুনে অলি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু ফোন রেখে দিলেন। সন্তুকে বললেন, তৈরি হয়ে নে। মাকে বলে যা, রাত্রে আমরা নাও ফিরতে পারি।
আজ আর কাকাবাবু গাড়ি নিলেন না। একটা ট্যাক্সি ধরে চলে এলেন আলিপুরে অসীম দত্তর বাড়িতে।
দরজা খুলে অসীম দত্ত সারামুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, আমি তোমার বাড়িতে যাব বলেছিলাম, তার আগে তুমিই চলে এলে? দ্যাখো, আমার মেয়ে কী কাণ্ড করেছে!
বসবার ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল, একগাদা নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে। টেবিলের ওপর দুখানা ফুলদানি ভর্তি ফুল, এক জন লোক ক্যামেরা তুলে খচাত-খচাত করে ছবি তুলতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, এ কী!
অসীম দত্ত বললেন, আমার মেয়ে তোমার কী দারুণ ভক্ত, তুমি জানো! কতবার বলেছে, তোমাকে দেখতে যাবে। আজ তুমি নিজেই আসছ শুনে পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে ডেকে এনেছে।
অলির বয়েস তো তেরো-চোদ্দো বছর, একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পরে আছে। সে একটা রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে দিল কাকাবাবুর গলায়। তারপর কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেল।
কাকাবাবু তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে বললেন, থাক, থাক!
একজন মহিলা বললেন, সন্তু কোথায় গেল? সে এসেছে?
অসীম দত্ত সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, আরে, তুমি পেছনে লুকিয়ে আছ কেন? সামনে এসো
সেই মহিলাটি বললেন, ও মা, সত্যি-সত্যি সন্তু নামে কেউ আছে? এ তো দারুণ ছেলে, কাকাবাবুর চেয়ে কম যায় না।
অলি একটা ফুলের তোড়া তুলে দিল সন্তুর হাতে। সন্তু লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে।
ওদের দুজনকে বসানো হল দুটি চেয়ারে। অনেকে বলতে লাগল, আমরা সন্তু আর কাকাবাবুর সঙ্গে ছবি তুলব!
এক-একজন পাশে এসে দাঁড়ায়, ক্যামেরাম্যানটি ছবি তোলে। এরই মধ্যে অনেকে মিলে কাকাবাবুকে নানান প্রশ্ন করতে লাগল, রাজা কনিষ্কর মুণ্ডু আবার খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তার কি ছবি তোলা আছে? মাউন্ট এভারেস্টে যাওয়ার পথে কি সত্যিই ইয়েতি দেখা গিয়েছিল? আন্দামানের জাবোয়ারা এখনও বিষাক্ত তীর ছোড়ে?
কাকাবাবু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর হাত তুলে বললেন, আজ এই পর্যন্ত থাক। অসীমের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
অসীম দত্ত সবাইকে বললেন, ছবি তোলা তো হয়েছে, এবার আপনারা একটু পাশের ঘরে যান।
ঘর খালি হয়ে যাওয়ার পর কাকাবাবু গলা থেকে মালা খুলে ফেলতে লাগলেন। অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি কিছু জরুরি কথা আছে?
কাকাবাবু বললেন, তোমার কাছে একটা পরামর্শ নিতে এসেছি। কাল আমার সঙ্গে দুজনকে দেখেছিলে তো? আমার ভাইপো সন্তুর সঙ্গে ওর বন্ধু জোজোও ছিল। সেই জোজোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে? কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?
কাকাবাবু বললেন, সে আমাদের সঙ্গে কাল ফেরেনি। আমরা কাকদ্বীপে একটা সার্কাস দেখতে গিয়েছিলাম। একটা লোক মানুষ অদৃশ্য করার খেলা দেখাচ্ছিল, জোজো নিজেই এগিয়ে গেল, ম্যাজিশিয়ানটা কীসব কায়দা-টায়দা করল, তারপর, মানে, তারপর জোজো আর নেই!
অসীম দত্ত ঠাট্টার সুরে বললেন, বলো কী! জলজ্যান্ত ছেলেটা অদৃশ্য হয়ে গেল? একেবারে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়?
কাকাবাবু বিব্রতভাবে বললেন, শুনলে সবাই মনে করবে গাঁজাখুরি ব্যাপার। কিন্তু ওই খেলার পর জোজোকে আর আমরা দেখিনি, এটাও ঠিক।
সন্তু এবার বলল, ওই খেলার পর জোজো শিঙাড়া আর রসগোল্লা খেয়েছিল, ম্যানেজার বলেছেন। অদৃশ্য হয়ে থাকলে কি কিছু খাওয়া যায়?
অসীম দত্ত আরও মজা করে বললেন, সেও তো একটা প্রশ্ন বটে। অদৃশ্য হলে কি খেতে পারে? ভূতেরা কি কিছু খায়?
কাকাবাবু এবার গলায় জোর এনে বললেন, ইয়ার্কি রাখো তো! ছেলেটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তার কোনও বিপদ হতে পারে তো! যদি তাকে কেউ জোর করে আটকে রেখে থাকে?
অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, জোজোর বয়েস কত?
কাকাবাবু বললেন, ষোলো-সতেরো হবে!
সন্তু বলল, সতেরো। আমার সমান।
অসীম দত্ত বললেন, ওই বয়েসের ছেলেদের ধরে রাখা খুব শক্ত। কী সন্তু, তোমায় কেউ কোথাও আটকে রাখতে পারবে?
সন্তু মাথা নিচু করে হাসল। অনেকবারই কাকাবাবুর শত্রুরা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারেনি।
অসীম দত্ত বললেন, ঠিক আছে। কাকদ্বীপ থানায় খবর পাঠাচ্ছি, ওরা খোঁজখবর নেবে।
কাকাবাবু বললেন, তোমার ওই কাকদ্বীপ থানার ওপর ভরসা করে কতদিন বসে থাকব? আমার নিজেরই খুব লজ্জা লাগছে। ছেলেটা আমার সঙ্গে গেল, অথচ আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না! আজই একটা কিছু করা দরকার। অসীম, তোমার কার্ডে দেখলাম, তুমি এখন আই জি ক্রাইম, তার মানে সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে তোমার কাজ। তুমি আমার সঙ্গে চলো কাকদ্বীপ। ওই সার্কাসে গিয়ে আবার খোঁজ নিতে হবে।
অসীম দত্ত প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, কালই ওদিক থেকে ফিরেছি, আবার আজ যাব? অত ঘাবড়াচ্ছ কেন, দেখবে হয়তো বিকেলের মধ্যেই ছেলেটা বাড়ি ফিরে আসবে! শোনো, রাজা, আজ পার্ক সার্কাস থেকে ভাল খাসির মাংস কিনে এনেছি। আমার রান্নার শখ আছে জানো তো? নিজে আজ বিরিয়ানি রান্না করব। দুপুরে এখানে খাওয়াদাওয়া করো, বিশ্রাম নাও, তারপর বিকেলবেলা ফোন-টোন করে—
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চল, সন্তু!
অসীম দত্ত বললেন, এ কী, তুমি রাগ করলে নাকি?
কাকাবাবু বললেন, তোমার বিরিয়ানি তুমি খাও। যত ইচ্ছে খাও! আমি আর সন্তু এক্ষুনি কাকদ্বীপের দিকে রওনা হব।
অসীম দত্ত বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? ঠিক আছে, যদি যেতেই চাও, আমি ডায়মন্ড হারবারের মহকুমা অফিসারকে ফোন করে দিচ্ছি। ওর নাম অর্ক মজুমদার, খুব ভাল ছেলে। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই স্মার্ট। সে তোমাদের সাহায্য করবে।
অসীম দত্ত টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। এই সময় একজন কাজের লোক একটা ট্রে-তে করে একগাদা কচুরি-আলুর দম আর মিষ্টি নিয়ে এল, তার পেছনে-পেছনে এল অলি। তার মুখে একটা চাপা উত্তেজনার ভাব।
অলি জিজ্ঞেস করল, জোজো হারিয়ে গেছে?
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে মাথা নাড়লেন।
অলি বলল, জোজোকে হাত-পা বেঁধে রেখেছে। মুখও বেঁধেছে।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? কে বেঁধে রেখেছে?
অলি বলল, তা জানি না। যেই শুনলাম যে জোজোকে পাওয়া যাচ্ছে না, অমনই আমি দেখতে পেলাম, একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে জোজো শুয়ে আছে। হাত-পা-মুখ সব বাঁধা!
অসীম দত্ত অলির মাথায় হাত রেখে বললেন, জানো তো রাজা, আমার মেয়ের এই একটা রোগ আছে। দিনের বেলা জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখে। কত কী-ই যে বলে, তার দু-একটা মিলেও যায়। মেয়েটা একটু-একটু পাগলি!
কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে অলির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর কথা কীরকম মিলে গেছে শুনি? একটা উদাহরণ দাও!
অসীম দত্ত বললেন, ও বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে, বেশিরভাগই মেলে না। তবে, কয়েকদিন আগে হঠাৎ বলল, আজ পিসিমণি আসবে, খুব মজা হবে! ওর পিসিমণি মানে আমার বোন মণিকা। সে দিল্লিতে থাকে, কলকাতায় আসার কোনও কথাই নেই, আমাদের কিছু জানায়নি। সেইজন্য আমরা অলির কথা বিশ্বাস করিনি। ও মা, সন্ধের সময় হঠাৎ মণিকা তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির। ওরা প্লেনে কাঠমণ্ডু যাচ্ছিল, সেখানে এমন কুয়াশা আর বৃষ্টি যে, প্লেন নামতেই পারল না, চলে এল কলকাতায়। আবার পরদিন ছাড়বে। সেইজন্য মণিকাও রাতটা কাটাতে চলে এল এখানে। আমার পাগল মেয়েটা কী করে আগে থেকে টের পেয়ে গেল বলো তো?
কাকাবাবু বললেন, এটা রোগও নয়, পাগলামিও নয়। কোনও-কোনও মানুষের এই ক্ষমতা থাকে। তারা দূরের জিনিস দেখতে পায়। দশ লক্ষ কুড়ি লক্ষ মানুষের মধ্যে একজনের থাকে এই ক্ষমতা। সাধারণ মানুষের চেয়ে এদের অনুভূতি অনেক তীব্র হয়। একে বলে ই এস পি।
তারপর তিনি অলিকে জিজ্ঞেস করলেন, সেই অন্ধকার ঘরটা কোথায় বলতে পারো?
দুদিকে মাথা নেড়ে অলি বলল, তা জানি না।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আর দেরি করতে পারছি না। এইসব কিছু আমরা খাব না!
অসীম দত্ত বললেন, একটা করে মিষ্টি অন্তত খাও। সন্তু, তুমি খাও। ততক্ষণে আমি অর্ককে টেলিফোন করে জানিয়ে দিই।
অলি কাকাবাবুকে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব।
অসীম দত্ত সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, তুই কোথায় যাবি? সামনের সপ্তাহে তোর গানের পরীক্ষা। আমরা যখন গেলাম, তখন তুই গেলি না!
অলি বলল, আমি জোজোকে খুঁজতে যাব!
অসীম দত্ত বললেন, তুই এই কাকাবাবুটাকে ঠিক চিনিস না। জোজো যদি সত্যিই হারিয়ে গিয়ে থাকে, কিংবা কেউ জোর করে ধরে রাখে, তা হলে জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যেখানেই হোক, কাকাবাবু ঠিক খুঁজে বার করবে। তাই না রাজা?
অলি ঘাড় নিচু করে বলল, আমি কাকাবাবুর সঙ্গে থাকব!
অসীম দত্ত দু হাত ছড়িয়ে বললেন, এই রে! এ মেয়ে যদি একবার জেদ ধরে, তা হলে কিছুতেই তো একে বোঝানো যাবে না! যদি জোর করে যেতে না দিই, তা হলে কাঁদবে, অনবরত কাঁদবে, ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে, কিছু খাবে না, কোনও কথা শুনবে না। কী মুশকিলে ফেললে বলো তো রাজা!
কাকাবাবু বললেন, তা হলে অলি চলুক আমাদের সঙ্গে।
সঙ্গে সঙ্গে অলির মুখোনা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অসীম দত্ত একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, তার মানে, আজ আর কপালে বিরিয়ানি নেই। মাংসটা ফ্রিজে তুলে রাখতে হবে। আমাকেও যেতে হবে, না হলে ওর মা কিছুতেই ছাড়বে না। একটু অপেক্ষা করো, আমি ভেতর থেকে তৈরি হয়ে আসছি।