নীচের ব্যাঙ্কের কর্মচারীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। কিন্তু তারা সবাই বললে, কেউ কিছু জুনে না—জানতেও পারেনি।
জনা ছয়েক মিস্ত্রী যারা ভারায় বসে প্লাস্টারিংয়ের কাজ করছিল তাদের মধ্যে একজন মিস্ত্রী—মকবুল বললে, বেলা তখন সওয়া বারোটা কি সাড়ে বারোটা হবে, একা সে বাড়িটার অদূরে একটা ছোট মিষ্টির দোকানের সামনে গাছতলায় বসে ছিল টিফিন সেরে—একটা কালো রংয়ের অ্যামব্যাসাড়ার গাড়িকে এসে ঐ বাড়িটার সামনে দাঁড়াতে দেখে—
তারপর? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।
গাড়ি থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক নামেন—ৰ্তার হাতে একটা চামড়ার সুটকেস ছিল হুজুর।
তারপর? ভদ্রলোক কি করলেন?
ভদ্রলোককে দেখলাম ঐ বাড়ির মধ্যে ঢুকতে–
ভদ্ৰলোক দেখতে কেমন?
দূর থেকে দেখেছি হুজুর, ঠিক ঠাহর করতে পারিনি।
সুদৰ্শন প্রশ্ন করে, তারপর কি হল?
আধঘণ্টাটাক বাদে দেখলাম। একজন সুট-পরা ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন বাড়ি থেকে— গাড়িতে উঠে তিনি গাড়িটা চালিয়ে চলে গেলেন।
গাড়ির নম্বরটা দেখেছিলে?
দেখিনি ভাল করে—
তাঁর হাতে কিছু ছিল?
হ্যাঁ, একটা সুটকেস।
গাড়িটা নতুন না পুরনো?
নতুন গাড়ি বলেই মনে হল হুজুর।
আর কাউকে দেখনি?
আজ্ঞে আরো দুটো ট্যাক্সিতে লোক এসেছে—তারা ব্যাঙ্কে ঢুকেছে—তারপর ব্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
পথে লোকজন ঐসময় ছিল না?
ছিল—তবে খুব বেশী নয়।
মকবুল!
হুজুর?
তোমরা তো অনেকদিন ধরে ঐ ফ্ল্যাটে কাজ করছ?
আজ্ঞে তা মাস তিনেক হবে
ওই বাড়ির একটা চাকরকে দেখেছ?
হ্যাঁ বাবু-শম্ভুকেও জানি।
তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল?
হ্যাঁ-রোগা পাতলা ছেলেটা।
আজ তাকে দেখেছ?
দেখেছি।
কখন?
বেলা সাড়ে এগারটা নাগাদ, আমাদের টিফিনের কিছু আগে।
কোথায় দেখলে?
হাতে কিছু ছিল? একটা সাদা খাম ছিল বলে মনে হচ্ছে।
তাকে ফিরতে দেখনি?
না। নজরে পড়েনি।
মকবুলকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, মণিশঙ্করেরই ফ্ল্যাটের বাইরের ঘরে বসে একজন সেপাই বারো-তেরো বছরের একটা ক্ৰন্দনরত রোগা ছেলেকে ধরে টানতে টানতে সুদৰ্শনের সামনে নিয়ে এল।
হুজুর, ছেলেটাকে পাকাড়াও করেছি।
শম্ভু কাঁদতে কাঁদতে বললে, ওরা সব কি বলছে সেপাইরা—দোহাই হুজুর আমি কিছু জানি না।
তোর নাম শম্ভু?
আজ্ঞা শম্ভুচরণ বেরা।
বাড়ি কোথায়?
আজ্ঞা পানিপারুল—বড় পোস্টাপিস এগরা—মেদিনীপুর জিলা।
কোথায় গিয়েছিলি তুই?
আমার পিসের কাছে টালিগঞ্জে-জিজ্ঞাসা করেন না কেনে আমার বাবুকে—ঐ যে— আমি তো—পরশুই ছুটি চেয়ে রেখেছিলাম।
মণিশঙ্কর বললে, হ্যাঁ, ও আমাকে পরশু বলেছিল বটে—পিসির সঙ্গে দেখা করতে যাবে টালিগঞ্জে
তা কখন তুই গিয়েছিলি?
কেন, এগারটায়
তোর মাকে বলে গিয়েছিলি?
হ্যাঁ-মা তো বললেন যেতে–
সুদৰ্শনই আবার প্রশ্ন করে, যখন যাস দরজাটা খোলা রেখে গিয়েছিলি?
না-মা তো দরজা বন্ধ করে দিলেন, ভিতর থেকে আমার সামনেই।
তোর মা তখন কি করছিলেন?
মার তো তখনো স্নানই হয়নি।
আর খুকু?
সে তো খেলছিল। ঘরে। কি হয়েছে হুজুর—সত্যিই মা আর খুকুকে মেরে ফেলেছে!
সুদৰ্শন শম্ভুর কথার কোন জবাব দেয় না।
সে তখন মনে মনে ভাবছিল—শম্ভু এগারটায় চলে যায়। অর্থাৎ এগারটার পর থেকেফ্ল্যাটে মণিশঙ্করের স্ত্রী ও মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না-ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মণিশঙ্করের স্ত্রী। অথচ মণিশঙ্কর ফোন পেয়ে অফিস থেকে এসে দেখে তার ফ্ল্যাটের দরজা ভেজানো এবং ঠেলতেই সেটা খুলে গেল।
সুদৰ্শন আবার প্রশ্ন করে, তুই যখন যাস তোর হাতে একটা চিঠি ছিল?
হ্যাঁ হুজুর–
ডাকে ফেলতে যাচ্ছিলি?
না।
তবে?
শম্ভু কেমন যেন ইতস্তত করে।
কিরে, কথা বলছিস না কেন?
আজ্ঞে–
চিঠিটা কার, কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলি সেটা?
আজ্ঞে–
তোর মা দিয়েছিল চিঠিটা?
আজ্ঞে–
পোস্ট করতে?
হ্যাঁ।
সত্যি কথা বলছিস?
হ্যাঁ হুজুর।
চিঠিটা ডাকে দিয়েছিলি?
হ্যাঁ।
সুদৰ্শন আর কোন প্রশ্ন করে না।
রবীন দত্ত পাশের সোফায় বসে নীচু টেবিলের উপর কাগজপত্র রেখে রিপোর্ট লিখছিল। সে মুখ তুলে তাকাল, তাহলে ওর কি ব্যবস্থা করব স্যার?
কার, শম্ভুর?–
আপাততঃ ‘ওকে থানায় নিয়ে রাখুন। এদিককার কাজ শেষ হয়েছে। মিঃ দত্ত?
একরকম মোটামুটি-ডেড বডি দুটো মর্গে পাঠিয়ে দিতে পারলেই—, কিন্তু এ ফ্ল্যাটের কি ব্যবস্থা করব?
এটা আপাততঃ আনডার লক অ্যান্ড কী থাকবে, আর পাহারা রাখুন।
বেশ। তাহলে মিঃ ঘোষাল-দত্ত মণিশঙ্করের দিকে তাকাল।
সে অন্য একটা সোফায় বসে ওদের কথা শুনছিল। রবীন দত্তর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে তাকাল।
আপনি তাহলে এক কাজ করুণ—
কি বলুন?
এই ফ্ল্যাটটা আপনার আপাততঃ আন্ডার লক অ্যান্ড কী ও পুলিস প্রহরায় থাকবে— আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে—
সে আপনার বলবার কোন প্রয়োজন ছিল না—এরপর এখানে আমি রাত্রিবাস করতে পারব। আপনি ভাবতেই বা পারলেন কি করে? আমি এখুনি শম্ভুকে নিয়ে চলে যাব।
সুদৰ্শন বললে, ওর জন্য আপনার ভাবতে হবে না। মিঃ ঘোষাল—ও থানায় থাকবে। ওকে কি তাহলে আপনারা অ্যারেস্ট করছেন?
না।
তবে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন?
ওকে আমাদের প্রয়োজন আছে।
ওঃ, তাহলে তো আপনাদের আশ্রয়েই থাকল!
হ্যাঁ-কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আজ রাত্রের গাড়িতেই মালদায় চলে যাব।
মালদায়?
হ্যাঁ আমার এক বন্ধু সেখানে থাকে-ভাবছি ছুটি নিয়ে তার ওখানেই কিছুদিন থাকব। কিন্তু আপনাকে যে আমাদের প্রয়োজন হবেমালদার ঠিকানা রেখে যাচ্ছি, যখনই তার করে দেবেন। আমি চলে আসব।
না।
তবে?
আপনি বরং আপাততঃ কিছুদিন কলকাতাতেই থাকবার ব্যবস্থা করুন।
কলকাতায়?
হ্যাঁ।
বেশ-তাহলে আমি ভবানীপুরেই, আমার একটা পরিচিত মেস আছে—কালিকা বোর্ডিং–সেখানেই থাকব।
কোথায় বোর্ডিংটা? সুদৰ্শন শুধায়। ৩৩/১২ কালীঘাট রোড। আমি তাহলে উঠি-কিছু জিনিসপত্র নিতে হবে
যান।
মণিশঙ্কর উঠে পাশের ঘরে গেল। ইতিমধ্যে সুদর্শনেরই নির্দেশে দুটো বেডকভার দিয়ে ডেড বডি দুটো ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
সুদৰ্শনের চোখের ইঙ্গিত পেয়ে রবীন দত্ত মণিশঙ্করের পিছনে পিছনে যায়, নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করে।
মণিশঙ্কর পকেট থেকে একটা চাবির রিং বের করে স্টীলের আলমারিটা খুলে কিছু জামা-কাপড় বের করে আলমারির মাথায় যে অ্যাঢাচি কেন্সটা ছিল তার মধ্যে ভরে নিল। ও যখন ব্যস্ত তখন হঠাৎ পেছন থেকে সুদর্শনের গলা শোনা গেল।
ও যে ইতিমধ্যে রবীন দত্তর পাশে এসে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল— মণিশঙ্কর জানতেও পারেনি।
মণিশঙ্করবাবু?
অ্যাঁ—
ফিরে তাকাল মণিশঙ্কর ওদের দিকে। ওরা দুজনে এসে ততক্ষণ ঘরের মধ্যে ঢুকেছে।
চাবিটা বুঝি আপনার প্যান্টের পকেটেই ছিল?
হ্যাঁ-মানে ওটা—আলমারির একটা ড়ুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে থাকত।
ড়ুপ্লিকেট কেন?
বিজির বড় ভুলো মন ছিল—কোথায় কি রাখত সব সময় মনে করতে পারত না, তাই তারই ব্যবস্থামত একটা চাবি আমার কাছে বরাবর থাকত।
ওতে বাইরের দরজার চাবিও আছে বোধ হয়?
হ্যাঁ—দরজায় গডরেজের লকের চাবি, একটা আমার কাছে থাকত একটা বিজির কাছে থাকত।
দেখলেন?
কি!
আলমারির ভিতর থেকে কিছু চুরি গেছে কিনা?
না-এখনো দেখিনি, দেখছি—
মণিশঙ্কর কথাটা বলে আলমারির ভিতরে সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। সুদৰ্শন আর রবীন দত্ত দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলো।
মিনিট দশ-পনের পরে মণিশঙ্কর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পারছি না। মিঃ দত্ত—কিছু চুরি গিয়েছে কিনা। মানে আমি তো ঠিক জানতাম না কোথায় কি আছে— সব কিছুই তো আমার স্ত্রীই রাখত—
সুদৰ্শন বললে, গহনাপত্র-টাকাকড়ি—সব ঠিক আছে—
গহনাপত্র যা ওর গায়ে দেখছেন, এছাড়া তো আর বিশেষ কিছু ছিল না। আর টাকাপয়সা তো ব্যাঙ্কেই রাখা হয়।
ও। তাহলে–
তাই তো বলছিলাম, ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে কিছুই হয়তো চুরি যায়নি। দেখুন তো—বালিশের তলায় বা ড্রয়ারে অন্য চাবিটা আছে কিনা! সুদৰ্শন আবার বললে।
মণিশঙ্কর অতঃপর সুদর্শনের কথামত ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারগুলো ও শয্যার কাছে গিয়ে বালিশের তলা হাতড়ে দেখলো কিন্তু কোথাও কোন দ্বিতীয় চাবির রিং পাওয়া গেল না।
কি হল-পাওয়া গেল না? দত্ত জিজ্ঞাসা করল।
না। দেখছি না তো—
গেল কোথায় তবে চাবির রিংটা যেটা আপনার স্ত্রীর কাছে থাকত?
বুঝতে পারছি না। হয়তো—
কি? যারা এসেছিল চুরি করতে তারাই নিয়ে গিয়েছে—তাড়াতাড়িতে কিছু নিতে পারেনি—
তাই হয়তো হবে—সুদৰ্শন মৃদু গলায় বললে।
একসময় সুদৰ্শন বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হল। সুটকেসটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগুতে যাবে, তখন সুদৰ্শন বললে, চলুন মিঃ ঘোষাল, আমিই আমার জীপে আপনাকে পৌঁছে দেব।
আপনি দেবেন?
হ্যাঁ চলুন—তাহলে রবীন আমরা চলি—তুমি এদিককার ব্যবস্থা করে তারপর যেও–
তাই যাব স্যার–
সুদৰ্শন নিজের জীপে মণিশঙ্করকে কালীঘাট রোডে কালিকা বোর্ডিং হাউসে পৌঁছে দিয়ে লালবাজারে ফিরে এল।
লালবাজারে পৌঁছে দুজন প্লেন-ড্রেস সি. আই. ডির কর্মচারী সলিল ও সন্তোষকে ডেকে কিছু উপদেশ দিয়ে রবীনকে থানায় ফোন করল।
রবীন তখনো ফেরেনি জানতে পারল।
সেকেন্ড অফিসার ফোন ধরেছিল, সে শুধাল, মিঃ দত্ত এলে আপনাকে কি ফোন করতে
বলব স্যার?
হ্যাঁ, বলবেন।
ঠিক আছে স্যার—
সুদৰ্শন ফোনটা রেখে দিল।
ইতিমধ্যে বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। পথে পথে আলো জ্বলে উঠছে।
একটা সিগারেট প্যাকেট থেকে বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করে সুদর্শন।
সমীরণ দত্ত।
নামকরা রবীন্দ্ৰ-সংগীতশিল্পী। মণিশঙ্কর ও বিজিতার সঙ্গে বহুদিনকার আলাপ সমীরণ দত্তর।
থাকে বালিগঞ্জে, মণিশঙ্কর বলছিল।
একটিবার সমীরণ দত্তর সঙ্গে দেখা করে কথা বলা দরকার। কিন্তু তার ঠিকানা জানে না। সুদৰ্শন।
কোথায় পাওয়া যেতে পারে সমীরণ দত্তর ঠিকানাটা?
হঠাৎ মনে পড়লো সমীরণ দত্ত একজন রেকর্ড ও রেডিওর নামকরা আর্টিস্ট-রেডিও অফিস থেকেই তো তার ঠিকানাটা পাওয়া যেতে পারে।
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুদৰ্শন লালবাজার থেকে রেডিও অফিসে নিজের পরিচয় দিয়ে ফোন করল।
স্টেশন-ডাইরেক্টর আছেন?
না-অ্যাসিস্টেন্ট স্টেশন-ডাইরেক্টর বোধ হয় আছেন।
তাঁকেই দিন ফোনটা।
সমীরণ দত্তর ঠিকানাটা পাওয়া গেল।
মনোহরপুকুর রোডে থাকে সমীরণ—তিনতলা একটা ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে। ফোনও সেখানে আছে, কিন্তু অনেকক্ষণ ফোনে রিং হল, কেউ ধরলে না।
হতাশ হয়েই একসময় সুদৰ্শন ফোনটা রেখে দিল।