০৩. নিহন ভাসমান দ্বীপের কিনারায়

নিহন ভাসমান দ্বীপের কিনারায় দাঁড়িয়ে বলল, ক্ৰিহা কোথায়?

একজন বলল, আসছে। আমি খবর দিয়েছি।

তা হলে দেরি করে লাভ নেই। কায়ীরা বলেছে এক্ষুনি যেতে।

আঠার-উনিশ বছরের একটি মেয়ে উজ্জ্বল চোখে বলল, কায়ীরা আমাদের নূতন দলপতি, কী মজা তাই না!

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। দলপতি হওয়ার পর এটা হচ্ছে কায়ীরার প্রথম নির্দেশ। তাই সবাইকে খুব ভালো করে এটা করতে হবে।

ভাসমান দ্বীপের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলো বলল, করব। অবশ্যই খুব ভালো করে করব।।

টাইফুন আসছে। কায়ীরা বলছে, আমরা বোঝার আগেই নাকি চলে আসবে। যারা গভীর সমুদ্রে গেছে তাদের কাছে গিয়ে আমাদের খবর দিতে হবে।

ছেলেমেয়েগুলো মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক আছে, চল তা হলে রওনা দিয়ে দিই।

নিহন বলল, তোমরা তো নিয়ম জান। দুজন করে একটা দল। নিজেরা দল ভাগ করে রওনা হয়ে যাও। চারদিকে চারটি দল যাও। কে কোথায় গেছে তালিকাটা নিয়ে এসেছি, যাওয়ার আগে তোমরা দেখে নাও।

ছেলেমেয়েগুলো তালিকাটা দেখে কোন দলের কতগুলো নৌকাকে খবর পৌঁছাতে হবে মনে মনে ঠিক করে নেয়। লাল চুলের একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, আর তুমি, নিহন তুমি কোন দিকে যাবে?

মাহার পরিবার পাওয়ার বোট নিয়ে বের হয়েছে। অনেক দূর চলে গেছে নিশ্চয়ই। আমি তার কাছে যাই।

ঠিক আছে।

ক্রিহা আসছে না, সেটাই হচ্ছে সমস্যা। দেরি করলে বিপদ হয়ে যাবে।

দেরি করবে না। ক্ৰিহা খুব দায়িত্ববান ছেলে। নিহন বলল, তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না। রওনা হয়ে যাও।

ছেলেমেয়েগুলো বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি।

তারা কোমরে ঝোলানো ছোট ব্যাগ থেকে সামুদ্রিক মাছ থেকে তৈরি করা এক ধরনের ক্রিম শরীরে মাখতে থাকে। সমুদ্রের লোনা পানিতে দীর্ঘ সময় থাকতে হলে তারা এই ক্রিমটা শরীরে মেখে নেয়, শরীরের চামড়া তা হলে শুষ্ক বিবর্ণ হয়ে ওঠে না। ক্রিম মাখা শেষ করে তারা তাদের গলায় ঝোলানো আলট্রাসাউন্ড হুইসেলগুলো নিয়ে সমুদ্রের পানিতে মুখ ডুবিয়ে বাজাতে শুরু করে। পোষা ডলফিনগুলো মরণত খুব দূরে যায় না, হুইসেলের শব্দ শুনে তারা ছুটে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষপের অধ্যেই সেগুলো ভূশ করে পানি থেকে বের হয়ে আসে। ছেলেমেয়েগুলো ডলফিনগুলোর শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে, তাদের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে। তারপর তাদের পিঠে উঠে দেখতে দেখতে সমুদ্রের পানি কেটে দূরে অদৃশ্য হয়ে যায়। সে

নিহন একা দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রিহা এখনো আসে নি। দায়িত্ববান ছেলে, তার না আসার কথা নয়। সম্ভবত কোনো ঝামেলায় পড়েছে। টাইফুনের আগে দ্বীপটাকে রক্ষা করার জন্য এক শ ধরনের কাজ করতে হয়। জিহাকে হয়তো হঠাৎ করে সেরকম কোনো দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রিহার বদলে আর কাউকে নিতে হবে। এখন সে কাকে খুঁজে পাবে? সবাই নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। এক হয় একা চলে যাওয়া, কিন্তু সমুদ্রে একা যাওয়া নিষিদ্ধ-সব সময় সঙ্গে অন্য কাউকে থাকতে হয়। কত রকম বিপদ হতে পারে, সঙ্গে অন্য একজন থাকলে বিপদের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে এসে খবর দেওয়া যায়।

নিহন আকাশের দিকে তাকাল। ধূসর এক ধরনের মেঘ আকাশে এসে জমতে শুরু করেছে, চারপাশে কেমন থমথমে একটা ভাব চলে এসেছে, তার আর দেরি করা ঠিক হবে না। নিহন ঠিক করল, সে একাই চলে যাবে। সমুদ্রকে তার এতটুকু ভয় করে না। একা একা সে সমুদ্রে বহুবার গেছে, সব নিয়ম যে সব সময় মানা যায় না, সেটা সবাই জানে।

নিহন তার গলায় ঝোলানো হুইসেলটা পানিতে ডুবিয়ে পরপর তিনবার একটা টানা শব্দ। করল। এটা তার পোষা ডলফিনটা, গুণ্ডর সঙ্কেত। সঙ্কেত পেলেই শুও ছুটে আসবে।

নিহন সমুদ্রের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে, বহু দূরে একটা ডলফিনকে পানির ওপর ঝাঁপিয়ে উঠতে দেখে, নিশ্চয়ই শুশু! নিহনকে গুণ্ড অসম্ভব ভালবাসে। নিহন সমুদ্রের পানিতে তাকিয়ে থাকে, দেখতে পায় পানি কেটে শুশু ছুটে আসছে। কাছাকাছি এসে শুশু শূন্যে ঝাঁপিয়ে উঠে তার আনন্দটুকু প্রকাশ করল। তারপর নিহনের কাছে এসে মাথা বের করে দাঁড়াল।

এসেছ শুশু?

শুশুও মাথা নাড়ল। নিহন জিজ্ঞেস করল, সমুদ্রের কী খবর?

শুশু তার গলার ভেতর থেকে এক ধরনের শব্দ করে। শব্দগুলোর অর্থ, ভালো। খুব ভালো।

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, ভালো না। টাইফুন আসছে।

শুশু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার ভাষায় জিজ্ঞেস করল, টাইফুন?

হ্যাঁ, টাইফুন। খুব খারাপ একটা টাইফুন আসছে শুশু।

শুশুর মুখে দুশ্চিন্তার একটা ছাপ পড়ে। নিহন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ডলফিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর মানুষ যখন শুকনো মাটিতে থাকত তখন কখনো কল্পনা করে নি সমুদ্রের এই প্রাণীটি তাদের এতবড় সহায় হয়ে দাঁড়াবে। পৃথিবীর মানুষকে পানিতে ঠেলে দেওয়ার পরও তারা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি তার একটা বড় কারণ হচ্ছে এই ডলফিন। বিবর্তনের ধারায় মানুষের পরে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে গেছে ডলফিন। পৃথিবীর মানুষ কখনো কি কল্পনা করেছিল একদিন মানুষ আর ডলফিন পরস্পর কথা বলতে পারবে? অর্থহীন আদেশ-নির্দেশ নয়, কাজ চালানোর মতো কথা। এই দুটি প্রাণী যে এত কাছাকাছি হবে সেটা কি কেউ জানত? কায়ীরা সব সময় বলে যে, জলমানবেরা নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানেও অসাধ্য সাধন করেছে এটাই কি সেই অসাধ্য সাধন?

টাইফুন খারাপ। শুশু বোঝাল এবং দুশ্চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, বেশি খারাপ।

হ্যাঁ। নিহন মাথা নাড়ে। এখন আমাদের গভীর সমুদ্রে যেতে হবে।

শুশু আনন্দে পানি থেকে অনেকটুকু বের হয়ে এসে নিহনের মুখ স্পর্শ করে নিজের ভাষায় অনেক কথা বলে ফেলল, নিহত সব কথা ধরতে পারল না। সমুদ্র আনন্দ খেলা এ রকম বিচ্ছিন্ন কয়েকটা শব্দ শুধু ধরতে পারল। নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, শুশু না। আমি তোমার সঙ্গে খেলা করতে যাচ্ছি না। আনন্দ করতে যাচ্ছি না। কাজ করতে যাচ্ছি। কাজ।

শুশুকে আবার একটু উদ্বিগ্ন দেখায়, কাজ?

হ্যাঁ, কাজ।

কী কাজ?

গভীর সমুদ্রে যারা গেছে তাদের খবর দিতে হবে।

খবর?

হ্যাঁ।

কী খবর?

টাইফুনের খবর। তাদের চলে আসতে বলব।

শুশুকে আবার উদ্বিগ্ন দেখায়। সে তার নিজের ভাষায় বলে, টাইফুন খারাপ। বেশি খারাপ।

হ্যাঁ। টাইফুন খারাপ, বেশি খারাপ। এখন চল যাই।

শুশু আনন্দে আবার পানি থেকে বের হয়ে এসে একটা পানির ঝাপটায় নিহনকে ভিজিয়ে দিল। বলল, চল, বন্ধু চল।

নিহন আলগোছে শুশুকে জড়িয়ে ধরে, শুও সঙ্গে সঙ্গে তার শক্তিশালী শরীরটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পানি কেটে শুশু সোজা সামনের দিকে ছুটে যেতে থাকে। পানির ঝাপটায় নিহন কিছু দেখতে পায় না। নিহন কপাল থেকে টেনে গগলসটা চোখের ওপর নিয়ে আসে। শুশু নিহনকে নিয়ে হঠাৎ পানির নিচে ঢুকে যেতে থাকে, এটা। এক ধরনের দুষ্টুমি। পানির নিচে খানিকটা ঢুকে হঠাৎ করে শুশু সোজা ওপরের দিকে ছুটে আসে, নিহন শুশুকে ধরে রাখতে পারে না-ছিটকে পানিতে গিয়ে পড়ে। পুরো ব্যাপারটায় শুশু খুব আনন্দ পায়, ডলফিনের যে কৌতুক বোধ আছে সেটা নিহন কখনো জানত না। শুশুকে দেখে সে সেটা জেনেছে।

নিহন পানিতে গা ভাসিয়ে শুয়ে থাকে, নিচে থেকে শুও এসে তাকে নিজের ওপর তুলে নিয়ে আবার ছুটে যেতে থাকে। নিহন শুর শরীরে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, গুণ্ড। দুই মেয়ে।

উত্তরে শুশু কিছু একটা বলে, পানির ঝাপটার জন্য নিহন কথাটি শুনতে পায় না। নিহন শুশুর পিঠে চেপে বসে দুটি পা দুদিকে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেছে। শুশুর শরীরের সঙ্গে নিহন তার দেহটা শক্ত করে চেপে রাখে। শুশু পানি কেটে ছুটে যাচ্ছে-কোথায় যেতে হবে সে জানে, পানির মধ্যে ইঞ্জিনের পোড়া তেলের গন্ধটুকু সে বহু দূর থেকে ধরতে পারে।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর নিহন বহু দূরে মাহার নৌকাটা দেখতে পেল। ইঞ্জিনটা বন্ধ করে মাহা বিশাল একটা জাল টেনে তুলছে। জালের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ আটকে আছে, সেগুলো ছটফট করে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। নিহনকে দেখতে পেয়ে মাহা তার জাল টেনে তোলানো থামিয়ে একটু অবাক হয়ে গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল, কী ব্যাপার, নিহন? তুমি এখানে?

বলছি দাঁড়াও। নিহন শুশুকে নিয়ে মাহার নৌকার কাছে গিয়ে থামল। মাহা আর তার স্ত্রী নীহা নিহনকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করে। নিহন নৌকায় বসে গগলসটা চোখ থেকে খুলে কপালে লাগিয়ে বলল, তোমাদের জন্য দুটি খবর নিয়ে এসেছি। একটা ভালো, একটা খারাপ। কোনটা আগে শুনতে চাও বল।

মাহার কমবয়সী স্ত্রী নীহা বলল, আমি কোনো খারাপ খবর শুনতে চাই না। শুধু ভালো খবরটা শুনব।

শুধু ভালো খবর শুনলে কেমন করে হবে? খারাপ খবরটাও গুনতে হবে। নিন গম্ভীর মুখে বলল, একটা বাজে ধরনের টাইফুন আসছে। তোমাদের এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।

সত্যি? মাহা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ, দেখেছ আকাশটা কেমন হয়ে যাচ্ছে। মাহার স্ত্রী নীহা বলল, খারাপটা তো শুনলাম। এখন ভালো খবরটা বল শুনি।

আমাদের নূতন দলপতি হচ্ছে, কায়ীরা।

মাহা এবং নীহার চোখ একসঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সত্যি?

হ্যাঁ। রিসি বুড়ো একটু আগে কায়ীরাকে দায়িত্ব দিয়েছে।

সত্যি? কায়ীরা আমাদের নূতন দলপতি? নীহা ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে ওঠে।

হ্যাঁ সত্যি।

কী মজা তাই না?

হ্যাঁ। খুব মজা। কায়ীরা আমাকে পাঠিয়েছে তোমাদের সবাইকে ফিরিয়ে নিতে।

চল ফিরে যাই মাহা উঠে দাঁড়িয়ে তার জাল গুটিয়ে নিতে শুরু করে। নীহা জাল থেকে মাছগুলো খুলে নৌকার মাঝখানে রাখতে শুরু করে। নিহন দুজনের সঙ্গে হাত। লাগায়। শুৎ নৌকাটা ঘিরে ঘুরছিল, এবার পানি থেকে লাফিয়ে বের হয়ে নিহনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। নিহন গলা উঁচিয়ে বলল, আসছি, শুও। আসছি। মাহা আর নীহা তাদের কাজ গুছিয়ে নেবার পর নিহন আবার শুশুর পিঠে চেপে বসল। তার শরীরে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, তোমার খুব পরিশ্রম হচ্ছে, তাই না শুশু?

শুশু মাথা নাড়ে, বলে, না, পরিশ্রম না।

তা হলে?

শুশু আনন্দের ভঙ্গি করে বলল, আনন্দ।

নিহন শুশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি খুব লক্ষ্মীমেয়ে। তোমাকে আমি খুব ভালবাসি।

শুশু মাথা নাড়ল, বলল, ভালবাসি। আমি ভালবাসি।

চল এখন। আর কেউ বাকি কি না খুঁজে দেখি।

চল চল। নিহনকে পিঠে নিয়ে শুশু প্রথমে শূন্যে ঝাঁপিয়ে ওঠে, তারপর সমুদ্রের গভীরে ডুবে যায়। নিহন নিঃশ্বাস আটকে রাখে, সে জানে এগুলো হচ্ছে শু দুষ্টুমি। কয়েক মুহূর্ত পর শুশু নিহনকে নিয়ে আবার ওপরে ভেসে ওঠে। তারপর পানি কেটে ছুটে যেতে শুরু করে। এই দুষ্ট ডলফিনটা না থাকলে নিহন কেমন করে তার কাজ করত?

.

বিকেলবেলা যখন নিহন ফিরে এসেছে, তখন সে তাদের ভাসমান দ্বীপটাকে চিনতে পারে না। মাঝামাঝি অংশটা এর মাঝেই ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য অংশগুলো আলাদা করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেগুলোও ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বড় বড় পাম্পগুলো গর্জন করে কাজ করছে। মোটা শেকল দিয়ে ভাসমান দ্বীপগুলোকে নোঙর করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্বীপের দুই হাজার মানুষের সবাই কোনো না কোনো কাজ করছে। ছোট ছোট বাচ্চাদেরও কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা বড় বড় বাক্সে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে। একেবারে যারা শিশু শুধু তাদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। কয়েকজন মা তাদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। ক্রিটিনা ছোট অক্সিজেন মাস্ক তাদের মুখে পরানোর চেষ্টা করছে এবং বাচ্চাগুলো সেটা নিয়ে প্রবল আপত্তি করে হাত-পা ছুঁড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।

নিহন কায়ীরাকে খুঁজে বের করে, সে ডুবিয়ে রাখা অংশটুকুতে বাতাসের চাপ পরীক্ষা করছিল। নিহন কাছে দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, যখন সে একটু সময় পেল নিহন জিজ্ঞেস করল, কায়ীরা, তুমি কি আমাকে নূতন কিছু করতে দেবে, নাকি আমি নিজে কিছু একটা বের করে নেব?

আমি দিচ্ছি নিহন। তুমি একটু অপেক্ষা কর।

ঠিক আছে।

যারা সমুদ্রে গিয়েছিল, সবাইকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, খবর দেওয়া হয়েছে। তারা ফিরে আসতে শুরু করেছে।

কায়ীরা আকাশের দিকে তাকাল, বলল, মাঝরাত থেকেই টাইফুনের ঝাপটা টের পেতে থাকব। শেষ রাতে সেটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। আমাদের হাতে সময় খুব কম।

নিহন কোনো কথা বলল না। কায়ীরা অনেকটা আপনমনে বলল, তার আগেই আমাদের সব কাজ শেষ করতে হবে।

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ একটা মোটা দড়ি টেনে আনতে আনতে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না, কায়ীরা। তার আগেই আমাদের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।

কায়ীরা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, আমি সেটা জানি। তোমরা সব কাজ শেষ করে ফেলবে সেটা আমি জানি।

কায়ীরা ঘুঁটিনাটি কয়েকটা জিনিস দেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিহনকে বলল, তোমার দশজন ঠিক আছে?

নয়জন। ক্রিকে পানির পাম্পের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কায়ীরা এক মুহূর্তের জন্য ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে তুমি একা গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কায়ীরা কয়েক মুহূর্ত নিহনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেঁচে থাকতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু কতটুকু ঝুঁকি নেওয়া যায় সেটা কিন্তু তোমাকে চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করতে হবে।

আমি করি, কায়ীরা।

মনে রেখ সাহস আর বোকামির মাঝে পার্থক্যটা খুব অস্পষ্ট।

মনে রাখব, তুমি চিন্তা কোরো না।

ঠিক আছে। আমরা আমাদের পুরো দ্বীপটাকে ভাগ ভাগ করে ডুবিয়ে দিচ্ছি। এর নিচে বাতাস আটকে রাখার চেম্বারগুলো আছে। আমরা সবাই সেখানে থাকব।

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। জানি।

এত মানুষের অক্সিজেন সাপ্লাই সোজা কথা নয়। ওপর থেকে পাম্প করে আনতে হবে। চেম্বারগুলো পুরোপুরি বায়ুনিরোধক কি না দেখতে হবে। তুমি তোমার নয়জন নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা কর। চেম্বারগুলো পুরোনো, অনেক জায়গায় জং ধরে গেছে। ছোটখাটো ফুটো অনেক আছে, বিপজ্জনক বড় ফুটো থাকলে সেগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা কর।

নিহন বলল, ঠিক আছে, কায়ীরা।

মনে রেখ, যখন সবাই চেম্বারে বসে থাকবে তখন কিছু একটা ঘটে গেলে কিন্তু কিছু করতে পারবে না। যা করার আগে থেকে করতে হবে।

বুঝতে পেরেছি, কায়ীরা।

যাও, নিচে চলে যাও।

.

নিহন তার দলের নয়জনকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল। পানির নিচে কাজ করার জন্য তারা নিজেদের অক্সিজেন মাস্কগুলো লাগিয়ে নেয়। বাতাসে দ্রবীভূত অক্সিজেনকে বের করে নেওয়ার এই যন্ত্রটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। জলমানবেরা দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে এটাকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছে। নিচে অন্ধকার, দেখার জন্য তারা সবাই আলোর টিউব নিয়ে নেয়। কিছু ব্যাক্টেরিয়া থেকে আলো বের হয়, সেগুলো সগ্রহ করে এই টিউব তৈরি করা হয়েছে। ব্যাক্টেরিয়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই দীর্ঘদিন আলো পাওয়া যায়-তীব্র আলো নয়, কিন্তু কাজ চলে যায়।

পানির নিচে ঢুকে ওরা আলাদা হয়ে যায়, বাতাস আটকে রাখা চেম্বারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। জায়গায় জায়গায় পানির বুদ্বুদ বের হচ্ছে। একজন বাইরে থেকে ফুটোগুলো বের করে, আরেকজন ভেতরে ঢুকে ছোট ছোট ফুটো বুজিয়ে দিতে রু করে। আঠালো এক ধরনের পেস্ট নিয়ে এসেছে, গর্তের ওপর লাগানো হলে বাতাসের চাপে গর্তের ভেতরটুকু সঙ্গে সঙ্গে বুজিয়ে দেয়।

চেম্বারগুলো বায়ু নিরোধক করে ওরা যখন ওপরে উঠে এসেছে তখন অনেক রাত। ওপরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, তার সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। ভাসমান দ্বীপের বেশিরভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সব মানুষ ছোট একটা জায়গায় ভিড় করে রয়েছে। অনেকেই নৌকার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, বাতাসে নৌকাগুলো দুলছে, সবাই সমুদ্রের নিচে চলে যাওয়ার পর। নৌকাগুলোও ডুবিয়ে দেওয়া হবে। আজ রাতের জন্য সবার খাবারের আয়োজন করা হয়েছে এক জায়গায়, আগে কমবয়সীদের খাইয়ে দিয়ে বড়রা দ্রুত খেয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষগুলো পানির নিচে চলে যেতে রু করবে।

নিহন তার খাবারটুকু নিয়ে একটা নৌকার পাটাতনে বসে দ্রুত খেয়ে নেয়। প্লেটটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিয়ে কায়ীরাকে খুঁজে বের করল। কায়ীরা ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিয়ে সবাইকে পানির নিচে পাঠাতে শুরু করেছে। টাইফুনটি তাদের ওপর দিয়ে চলে যেতে কত সময় নেবে কে জানে, এই পুরো সময়টুকু পানির নিচে থাকতে হবে। টাইফুন চলে যাওয়ার পর আবার সবকিছু পানির ওপর ভাসিয়ে এনে তাদের জীবন শুরু করতে হবে।

নিহনকে দেখে কায়ীরা বলল, চেম্বারগুলো ঠিক আছে?

হ্যাঁ, কায়ীরা। ফুটোগুলো বন্ধ করেছি। অক্সিজেনের সাপ্লাই ঠিক রাখলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

চমৎকার। তুমি তা হলে আমাদের সঙ্গে হাত লাগাও, সবাইকে পানির নিচে পাঠাতে শুরু কর।

ঠিক আছে, কায়ীরা।

.

প্রায় হাজার দুয়েক মানুষকে পানির নিচে চেম্বারগুলোতে নামিয়ে দিতে দিতে রাত আরো গম্ভীর হয়ে যায়। খানিকক্ষণ আগে যেটা ছিল দমকা বাতাস এখন সেটা রীতিমতো ঝড়ো হাওয়া। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও এখন প্রবল বৃষ্টিতে পাল্টে গেছে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানিতে সবাই শীতে অল্প অল্প কাঁপছে। নৌকাগুলো পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু বহুষ্কোণ একটা ভাসমান পাটাতন সমুদ্রের পানিতে দুলছে। সেখানে কায়ীরা কয়েকজনকে নিয়ে অপেক্ষা করছে।

নিহন নিচের চেম্বারগুলো পরীক্ষা করে ওপরে উঠে এলে কায়ীরা জানতে চাইল, নিচে কীরকম অবস্থা, নিহন?

আট-দশ ঘণ্টা থাকার জন্য ঠিক আছে, কিন্তু তার বেশি হলে সমস্যা!

তার বেশি হওয়ার কথা নয়!

তা হলে ঠিক আছে।

কী করছে সবাই?

ছোটরা হাঙর হাঙর খেলছে। তাদের মনে হয় খুব আনন্দ হচ্ছে।

আর বড়রা?

তারা বসে বসে গল্প-গুজব করছে। কেউ কেউ তাস খেলছে।

চমৎকার।

যারা ছোটও না বড়ও না তারা দেখে এসেছি গান গাইছে।

কায়ীরা মুখের ওপর থেকে মুখের পানি মুছে ফেলে হেসে ফেলল, চমৎকার। চল, আমরাও গিয়ে গানের আসরে যোগ দিই।

হ্যাঁ, চল। নিচে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

দাঁড়াও তার আগে রিসি বুড়োকে নিচে পাঠিয়ে দিই! সে কিছুতেই আগে যেতে রাজি হল না!

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, সবাই জানে টাইফুন এলেই রিসি বুড়োর অন্য রকম আনন্দ হয়।

নিহন কায়ীরার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। পাটাতনের মাঝামাঝি জায়গায় অতিকায় সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলর মাঝখানে রিসি বুড়ো দুই হাত বুকের কাছে রেখে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে সে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে এতটুকু বিকার নেই। সে পানিকে খুব ভালবাসে। কায়ীরা উবু হয়ে কাছে বসে ডাকল, রিসি বুড়ো।

রিসি বুড়ো চোখ খুলে তাকাল, বলল, কী হয়েছে, কায়ীরা?

টাইফুনটা প্রায় চলে এসেছে। এখন চল নিচে যাই।

তোমরা যাও, কায়ীরা।

কায়ীরা অবাক হয়ে বলল, আমরা যাব? আর তুমি?

আজকে তোমার হাতে সকল দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পর নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই।

হ্যাঁ, কিন্তু

আমি সারা জীবন যেটা করতে চেয়েছিলাম আজকে সেটা করব, কায়ীরা।

কী করবে, রিসি বুড়ো?

আমার এই সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলে শুয়ে শুয়ে টাইফুনকে খুব কাছ থেকে দেখব।

কায়ীরা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ, কায়ীরা, আমি ঠিকই বলছি। আমাকে তোমরা সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দাও। আমি সমুদ্রের পানিতে ভেসে ভেসে টাইফুনকে দেখতে চাই

তুমি কী বলছ? একটু পরে যখন বড় বড় ঢেউ আসবে তুমি কোথায় তলিয়ে যাবে

আমি জানি। রিসি বুড়ো তার শীর্ণ মুখে হাসে, হাসতে হাসতে বলে, আমি সারা জীবন এ রকম একটি কথা চিন্তা করেছি। টাইফুনের বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউ, আমি তার মাঝে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি! কী চমৎকার একটি জীবন!

কায়ীরা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ রিসি বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই এটা চাও, রিসি বুড়ো?

হ্যাঁ, কায়ীরা। আমি সত্যিই এটা চাই। আমি সারা জীবন এ রকম একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

কায়ীরা কোনো কথা না বলে রিসি বুড়োর শীর্ণ হাতটি নিজের হাতে টেনে নেয়। রিসি বুড়ো ফিসফিস করে বলল, আমার কী ভালো লাগছে তুমি চিন্তা করতে পারবে না। তোমার মতো একজনের হাতে সবার দায়িত্ব দিয়ে কী নিশ্চিন্ত হয়ে বিদায় নিতে পারছি। একজন মানুষ তার জীবনে আর কী চাইতে পারে? রিসি বুড়ো শীর্ণ হাতে কায়ীরার মুখ স্পর্শ করে বলল, আমাকে বিদায় দাও, কায়ীরা।

অতিকায় সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলটি পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হল। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সেটি ধীরে ধীরে ভেসে যেতে থাকে।

কায়ীরার পাশে নিহন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় তাদেরকে মনে হয় উড়িয়ে নেবে, তবুও তারা সামুদ্রিক কচ্ছপের বিশাল খোলটি বহু দূরে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।