ধ্বনি ও স্বরগ্রাম
ঋগ্বেদের সূক্তগুলি হােতা ও তার সহকারীরা তিন প্রকার শ্বাসাঘাত-সহ উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতেন, সামবেদের সূক্তগুলি উদ্গাতা ও তার সহায়করা বহুবিধ ভিন্ন ভিন্ন সুরে সংযোজিত হয়ে উচ্চস্বরে গীত হ’ত—তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে উপগাতাগণ কিছু একক একাক্ষর স্তোভের সঙ্গে যুক্ত ক’রে সেই গানে অংশ নিতেন। অন্যদিকে সংক্ষিপ্ত যজুঃসূক্তগুলি অধ্বর্যু ও তার সহায়করা আনুষ্ঠানিক যজ্ঞকর্মের অঙ্গ হিসাবে উপাংশু রীতিতে অর্থাৎ মৃদুস্বরে, প্রায় গুণগুণ করে করতেন। স্পষ্টতই তৎকালীন সমাজের কাছে কণ্ঠস্বর ও স্বরগ্রামের বৈচিত্র্য কিছু প্ৰতীকী তাৎপর্যে গৃহীত হত। ঋগ্বেদের আবৃত্তিতে শ্বাসাঘাত ও স্বরগ্রাম সুক্তের বিষয়বস্তুতে কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নতুন শুরুত্ব যোগ করত এবং এভাবেই দৈনন্দিন জীবনের একমাত্রিক কথ্য ভাষার তুলনায় তার মধ্যে নতুনতর কিছু বৈশিষ্ট্য আরোপিত হয়েছিল। নিম্নগ্রামে উচ্চারিত ধ্বনির সূত্রগুলিতে স্পষ্টতই এক ধরনের ঐন্দ্ৰজালিক তাৎপর্য ছিল। তাছাড়া স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, যজ্ঞে বিঘ্ন-উৎপাদনকারী হিংস্র দানব ও পিশাচরা অর্থাৎ আর্যদের শত্ৰু প্ৰাগাৰ্যগোষ্ঠীর মানুষরা যজ্ঞভূমির নিকট বিচরণ করত বলেই মন্ত্রের কিছু কিছু অংশ দুর্বোধ্য করে রাখারও প্রয়োজন ছিল। এ প্রয়োজন প্রাচীন যুগের সমস্ত ধর্মাচরণের মন্ত্রেরই ছিল যাতে পুরোহিতের গৃঢ় জ্ঞানের সম্বন্ধে জনতা শ্ৰদ্ধাশীল থাকে। এভাবে আগত বৃহত্তর আর্যজনগোষ্ঠীর দর্শকদের কাছেও এইসব মন্ত্র গুপ্তই থেকে যেত যেহেতু এভাবেই তাদের বিশ্বাস উৎপাদন করা হত যে, অনুষ্ঠান পরিচালক পুরোহিতদের কাছেই শুধু তাদের তাৎপর্যবোধগম্য। একদিকে প্রার্থী ও তার উদ্দিষ্ট দেবতা, এবং অন্যদিকে জাদুকর ও শক্তিশালী অতিজাগতিক শক্তিসমূহের মধ্যে বহু বিচিত্র পার্থিব আকাঙ্ক্ষাপূরণের প্রয়োজনে মন্ত্রের মাধ্যমে যেন গোপন যোগাযোগ গড়ে তুলত
পুরোহিতরা। অধ্বর্যু প্রকৃতপক্ষে আদিম সমাজের জাদু-পুরোহিত বা শামানদের প্রধান কার্যকলাপের উত্তরাধিকারী হিসাবে এইসব ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠানে প্ৰবৃত্ত ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; প্রাথমিক ধর্মীয় কার্যাবলীর কিছু অংশ অধ্বর্যু পরিশীলিত করে বৈদিক অনুষ্ঠানের মধ্যে গ্রহণ করেছিলেন। বাকি অংশ রয়ে গেল জনজীবনের জাদুকর, প্ৰাচীন অগ্নি-পূজক পুরোহিত অর্থাৎ অথর্বাদের কাছে এবং বহু পরবর্তীকাল পর্যন্ত বৈদিক বাগ্ময়ে তার কোনো স্থান হয় নি। সংগীত বস্তুত বহুবিধ স্তরে যজ্ঞানুষ্ঠানে নুতন শক্তি যুক্ত করেছিল। নান্দনিক স্তর সম্পর্কে অবশ্য যথেষ্ট সংশয় রয়েছে; কেননা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, সেই সুদূর অতীতে শব্দসমূহের জন্য অতিরিক্ত শক্তি জোগান দেওয়া ছাড়া সুরমূৰ্ছনার অন্য কোনো ভূমিকা ছিল কি না। বিখ্যাত সমালোচক সি. এম. বাওরা বলেছেন, ‘অলৌকিক শক্তিগুলিকে প্রভাবিত করাই ধর্মীয় সংগীতের লক্ষ্য।’ ইন্দ্ৰজালের মাধ্যমে তা পরোক্ষভাবে আপন উদেশ্য সিদ্ধ করতে পারে কিংবা প্ৰত্যক্ষভাবে সূক্ত ও প্রার্থনার মাধ্যমেও সেটা করা যেতে পারে; তবে উভয়ক্ষেত্রেই বাস্তব ফল লাভই তার অভীষ্ট। সঙ্গীত ইতিবাচক ও কার্যকরী ফললাভের জন্য উদিষ্ট ব’লেই শিল্পকলাকে পরিশীলিত করে উচ্চস্তরে উন্নীত করে, কেননা তা না হলে প্রার্থীর প্রকৃত আকাঙক্ষা পূর্ণ না হলেও সংগীতের সন্মোহন তাকে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে। বহির্জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙক্ষা থেকে ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়ে দেখা দেয়-শব্দসমবায়ের মাধ্যমে ঐ পার্থিব বা অতিলৌকিক জগৎকে আয়ত্তাধীন করতে হয় বলে অত্যন্ত অনন্যসাধারণ কোনো শক্তি দিয়ে শব্দকে অন্তর্দীপ্ত করে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে। এই ‘অনন্যসাধারণ শক্তিই হল পবিত্র গীতির ঐন্দ্ৰজালিক উপাদান। আনুষ্ঠানিকভাবে সমগ্র সমাজকে স্বতঃসন্মোহিত করে বলেই এ ধরনের ধর্মীয় গীতির প্ৰকাশশৈলী ও গায়ানরীতি লোকায়ত সংগীতের তুলনায় স্বরূপত ভিন্ন। ফিনল্যাণ্ডের জাতীয় মহাকাব্য কালেহ্বলার মধ্যেও অনুরূপভাবে সৃষ্টিশীল ইন্দ্ৰজাল পরিস্ফুট হয়েছে। সংগীতের সম্মোহনী শক্তির তাৎপৰ্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা সামবেদের সঙ্গে সোমযাগের নিবিড় সম্পর্কের কথা স্মরণ করি; এই সোমযাগে শামান বা জাদু-পুরোহিতসুলভ সম্মোহনী সংগীতের প্রয়োগ ছাড়াও সন্মোহন বা উন্মাদনার দ্বিতীয় সহায়করূপে সোমরস ব্যবহার করা হত। পরিশীলিত, লোকায়ত সুরকে ঋগ্বেদীয় শব্দ-বিন্যাসে সন্নিবেশিত করে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল, তাই সামগানরূপে পরিচিতি লাভ করে-উদ্গাতা ও তার সহায়ক পুরোহিতগণ আনুষ্ঠানিক প্রয়োজনে সেই সব সংগীত যজ্ঞকালে পরিবেশন করতেন। এদের মধ্যে শামান বা জাদু-পুরোহিত-সুলভ যে অর্থহীন চীৎকার রযেছে, সেগুলি সম্ভবত অনুষ্ঠানে নিহিত ঐন্দ্রজালিক শক্তি উদবোধনের জন্য অনুষ্ঠানে একাত্ম হওয়ার মুহুর্তে সমগ্ৰ সমবেত জনতা একসঙ্গে উচ্চারণ করত। এই সব চীৎকারকেই ‘স্তোভ’ বলা হত; এরা মুখ্যত দুই জাতীয়–পদ ও বাক্য। মূল পাঠে যা সন্নিবিষ্ট হত, তা কখনও ছিল বিচ্ছিন্ন পদ, কখনও বা সংক্ষিপ্ত বাক্য-সাধারণত দ্বিপদী শব্দ প্ৰযুক্ত হত। যেমন : হুব, হৌ, হোই, হােবি, হাবু প্রভৃতি। স্পষ্টতই শ্রোতৃবর্গের সমবেত যোগদান বিশেষ প্রশিক্ষণলব্ধ পরিশীলিত সংগীতের অংশে সম্ভব হত না; আনুষ্ঠানিক সংগীত যেহেতু ঐন্দ্ৰজালিক ভীতি ও আশঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই সাধারণ মানুষ জাদুপুরোহিতদের কার্যকলাপের প্রত্ন-স্মৃতি দ্বারা তাড়িত হয়েই একই সুরে উচ্চ-গ্রামে চীৎকার করত। স্তোভের রহস্যময় উপাদান সম্পর্কে বিদেশী সমালোচকগণ কৌতুহলাজনক মন্তব্য করেছেন। বস্তুত সামবেদের অধিকাংশ সংগীতের মূলে রয়েছে অতিলৌকিক উদ্দেশ্য-সিদ্ধির জন্য সুরমূর্ছনায় নিহিত ইন্দ্রজাল সম্পর্কে মানুষের স্বাভাবিক বিশ্বাস ও তার শক্তির উপর অন্ধ নির্ভরতা। প্রত্নকথাগুলি আবৃত্তি করে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি যা অর্জন করতে চাইত বা মহাকালের প্রেক্ষিতে পরিস্ফুট ঘটনাপ্রবাহের পার্থিব নবরাপায়ণের মাধ্যমে যজুর্বেদ যেখানে উপনীত হতে চাইত–সামবেদ সুরের ঐন্দ্ৰজালিক শক্তি দিয়ে তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে প্ৰয়াসী ছিল।
সংগীত বিক্ষুব্ধ মনকে শান্ত করে–দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে এটা লক্ষ্য করে প্রাচীন মানুষ তার মধ্যে রোগপ্রশমনের ক্ষমতা কল্পনা করে নিয়েছিল। সামবেদে সংগীতের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানের সাফল্য সুনিশ্চিত করা অর্থাৎ যজ্ঞের ভিত্তিস্থানীয় প্রার্থনাসমূহের পুরণ–এদের লক্ষ্য হিসাবে অতিজাগতিক শক্তিসমূহের নির্বিয় সক্রিয়তা বা সমাজগোষ্ঠীর জয়লাভ, স্বাস্থ্য বা সমৃদ্ধি—যাই থাক না কেন। যজমানের উদ্দেশ্যকে বিঘ্নিত করার জন্য সক্রিয় বহুবিধ অপশক্তির মধ্যে রয়েছে শক্ৰ, দানব, ভূতপ্রেত ও পিশাচ। কতকটা তাদের এই অপশক্তিকে প্রতিরোধ করার জন্যই যেন সামবেদের স্তোত্রগীতি উদ্ভাবিত হয়েছিল। শুধু দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্যই নয়, অশুভশক্তিকে পরাহত করার জন্য এবং আরও কিছু ঐন্দ্ৰজালিক উদ্দেশ্য উদ্গাতা অত্যন্ত রহস্যনিবিড় আঙ্গিকে আপনি সঙ্গীতাংশ যজ্ঞকালে পরিবেশন করতেন। নির্দিষ্ট কিছু অক্ষরের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে যে প্রত্নতান্ত্রিক গূঢ় বিদ্যার উপাদান রয়েছে, তার উৎস শামান বা জাদু-পুরোহিতের সৃষ্ট আনুষ্ঠানিক গীতির মধ্যেই নিহিত। এর সঙ্গে তুলনীয় অধ্বর্যু কর্তৃক ওম্, বট্, বেট্ বা বষট্-এর মতো অর্থহীন অক্ষর-প্রয়োগ, যাতে যজ্ঞানুষ্ঠান গোষ্ঠবহির্ভূত ব্যক্তিদের নিকট রহস্যময় হয়ে ওঠে; এতে সুচারুভাবে এই বিশ্বাসটিও প্রকাশিত হত যে, যজ্ঞনিম্পাদক পুরোহিত এবং অতিলৌকিক ক্ষমতার মধ্যে এমন এক নিগূঢ় দুর্জ্ঞেয় সম্বন্ধ রয়েছে যা অদীক্ষিতদের নিকট একান্তই অনধিগম্য।
লক্ষ্যণীয় যে, ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি ‘যোনি’ বলে অভিহিত হ’ত অর্থাৎ এই উৎস থেকেই সুরের জন্ম হয়েছিল। সম্ভবত এখানে এই ঐতিহাসিক তথ্য আভাসিত যে সুরে সংযোজিত হওয়ার বহু পূর্বে ঋগ্বেদের সূক্তগুলি আবৃত্তির প্রয়োজনে রচিত হয়েছিল। সমগ্ৰ বৈদিক সাহিত্যে উচ্চারিত শব্দের অতিলৌকিক শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রাধান্য পেয়েছে কেননা তা সৃজনশীল, অন্তর্গূঢ় শক্তিসম্পন্ন এবং ‘নাস্তি’র গর্ভ থেকে তা অস্তিত্বের উৎপত্তি সূচিত করছে। সুর এই শব্দকেই সমুন্নীত করে এমন এক রহস্য-নিবিড় উচ্চতায় স্থাপিত করত যে তা শ্রোতার কাছে বহুগুণে শক্তিসম্পন্ন বলে প্ৰতিপন্ন হ’ত।