ধানবাদ শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ইন্দ্ৰালয়।
পাহাড়ের মত একটা উঁচু জায়গায় ইন্দ্ৰালয়! বাড়িটা যেন দূর থেকে অবিকল একটা দুর্গের মত মনে হয়। বড় রাস্তা থেকে পাথরের তৈরী একটা চওড়া রাস্তা ঘুরে ঘুরে সোজা রাস্তা যেন ইন্দ্ৰালয়ের গেটের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়িটা। তিনতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বাগান, তার মধ্যেই রেস্ট-হাউস, আস্তাবল, গ্যারাজ ও চাকর-দারোয়ানদের থাকবার আস্তানা।
বাড়ির চতুষ্পার্শ্বস্থ সীমানা প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
একতলা, দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর। নিচের তলায় অফিস ও বসবার একটা বড় হলঘর। ওপরে দোতলায় চার ভাই থাকে চারটি ঘরে, এবং একটা ঘরে থাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
তিনতলার একটা ঘরে থাকে স্বাতী একা। স্বাতী বরাবর তার বড়মার লাগোয়া পাশের ঘরটাতেই ছিল, বছরখানেক আগে সে তিনতলায় চলে গিয়েছে।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর আদৌ ইচ্ছা ছিল না, স্বাতী তিনতলায় গিয়ে থাকে। বাধাও দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু স্বাতী শোনে নি। বলেছিল, না, তোমার পাশের ঘরে আর আমি থাকব না।
কেন থাকবি না শুনি?
সত্যি কথাটা শুনতে চাও?
হ্যাঁ, বল, কেন থাকবি না?
সৰ্বক্ষণ আমার ওপরে তোমার ওই শকুনের মত চোখ মেলে থাকাটা আমার সহ্য হয় না।
কি বললি!
হ্যাঁ, তাই। আমি চলাব ফিরব কথা বলব—জেগে থাকি বা ঘুমোই তুমি যে তোমার ঐ শকুনের দৃষ্টি দিয়ে আমাকে আমার সামনে পিছনে আড়ালেও খবরদারি করবে—সেটা আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে।
তা হবেই। আমার চোখের সামনে থাকলে বজ্জাতি করার সুবিধে হয় না কিনা।
কি বললে, বজ্জাতি?
হ্যাঁ—নষ্ট মেয়েমানুষ, তোর চরিত্রের কথা তো জানতে কারো বাকি নেই!
তুমি অতি নোংরা, অত্যন্ত ছোট মন কিনা তোমার।
কি বললি? আমি নোংরা, আমার ছোট মন?
একশবার বলব, হাজারবার বলব।-অত্যন্ত ছোট মন।
মুখ তোর থেতো করে দেব হারামজাদি!
চেষ্টা করেই দেখ না একবার-কে কার মুখ থেতো করে দেয় দেখবে।
পিছমোড়া করে ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখা উচিত—তোর মত হারামজাদি নষ্ট মেয়েমানুষকে। আমাকে নয়-বাঁধা উচিত তোমাকে। জবাব দিয়েছিল স্বাতী।
কি, যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা!
দেখ, বেশি বাড়াবাড়ি করো না—আমাকে তুমি আমার ওই ম্যান্তামুখে ভীতু দাদারা পাওনি।
চুপ কর হারামজাদি-ছেনাল
কোন চুপ করব, শুনি? তোমার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি, আর করব না। আজই আমি তেতলায় চলে যাব, দেখি তুমি কি করতে পার।
ঠ্যাং ভেঙে দেব—একবার গিয়ে দেখা না!
আমিও তোমার ঠ্যাং ভাঙব তাহলে।
উঃ দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। সব—
সে তো পুষেছই। সেটা আরো ভাল করে টের পাবে, যখন সেই কালসাপের ছোবল খাবে।
কথাগুলো বলে স্বাতী গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল। এবং সত্যি সত্যি সেইদিনই সে তেতলায় চলে যায়। চাকরদের ডেকে জিনিস-পত্ৰ সব তার তেতলার ঘরে নিয়ে যায়।
জগদীন্দ্র বলেছিল বোনকে, বড়মা খুব চটেছেন স্বাতী।
বয়েই গেল তাতে আমার। আমি ওই ডাইনী শকুনি বুড়ীকে একটুও পরোয়া করি না।
ছিঃ, ওকথা বলে না।
ডাইনীকে ডাইনী বলব, শকুনিকে শকুনি বলবী—তাঁর আবার ছিঃ! কি! দেখ দাদা, তোমরা কেন পুরুষ হয়ে জন্মেছ বলতে পার?
কিন্তু–
তোমাদের গলায় দড়ি দেওয়া উচিত।
তা কি করব বল?
করবে। আর কি! আর করবার কিছু সাধ্যই কি আছে নাকি তোমাদের কারো অবশিষ্ট? যাও যাও, বড়মার পা চাটো গিয়ে। তোমাদের মত যদি পুরুষ হয়ে জন্মাতাম, তাহলে দেখতে ঠিক ওই ডাইনী বুড়ীকে এতদিনে আমি খুন করতাম।
স্বাতী! চিৎকার করে উঠেছিল। জগদীন্দ্র সভয়ে বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে।
চার-চারটে পুরুষ তোমরা রয়েছ, পার না একদিন ওই শকুনি ডাইনী বুড়ীটাকে গলা টিপে শেষ করে দিতে?
মেজ ভাই মণীন্দ্ৰ যে ওই সময় দ্বারের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, ওরা টের পায়নি।
হঠাৎ মণীন্দ্ৰ বলে ওঠে, পারব না কেন, খুব পারি।
পার, পার মেজদা?
খুব পারি।
মণীন্দ্র বলতে বলতে ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে।
জগদীন্দ্র তখন যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে এসেছে,
মণীন্দ্র আরো বলে, তুই দেখে নিস স্বাতী, একটু সুযোগ পেলেই—
হঠাৎ শুকনো গলায় ওই সময় কোনমতে জগদীন্দ্ৰ ধমকে ওঠে ছোট ভাইকে, মণি, কি হচ্ছে কি!
আমাকে চোখ রাঙােচ্ছ কি দাদা, আমি জানি তুমিও—
মণি!
হ্যাঁ—তুমিও সুযোগ পেলে ওঁকে হত্যা করবে।
কি বললি, আমি
হ্যাঁ, তুমি।
ভুলে যাস না মণি, বড়মা না থাকলে আজ আমরা কোথায় ভেসে যেতম!
সেও বোধ হয় এর চাইতে ভাল হত দাদা। এর নাম বাঁচা বল তুমি? স্বাতী তো মিথ্যা বলেনি, ঠিকই বলছে—এর চাইতে জেলের কয়েদীদের জীবনেও স্বাধীনতা আছে। একবার ভেবে দেখ তো? আমাদের আশ্রয় দেবার ছল করে কিভাবে আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে বড়মা বন্দী, পঙ্গু করে রেখেছে! শোন দাদা, তোমাকে আমি শেষবারের মত বলে রাখছি—
কি?
ভয়ে ভয়ে তাকায় জগদীন্দ্র ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে।
তোমরা এখানে পড়ে থাকতে পার কিন্তু আমি এখান থেকে চলে যাব।
চলে যাবি?
হ্যাঁ।
কোথায়?
যেখানে হোক, পথে-ঘাটে।
কিন্তু খাবি কি?
কলের জল খাব।
বোকার মত কথা বলিস না মণি, কলের জল খেয়ে মানুষ বাঁচে না।
বাঁচে-বাঁচবে না কেন, এ রাজভোগের চাইতে সে অনেক ভাল—অনেক সম্মানের। বলে ওঠে স্বাতী।
পাগলামি করিস না মণি-ওসব গল্প-কবিতাতেই লেখা থাকে। জগদীন্দ্ৰ বলে।
স্বাতী বড় ভাইয়ের সে কথায় কান না দিয়ে মেজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, যাবেযাবে মেজদা, সত্যি চল এখান থেকে আমরা চলে যাই।
যাব।—সুযোগ এলেই যাব। মণীন্দ্র বলে।
ছেলেমানুষি করিস না মণি-জগদীন্দ্র বলে ওঠে আবার ভীতিকষ্ঠে, পৃথিবীটা এত সোজা নয়। ভুলে গেছিস? মনে নেই, বাবার সেই রোজগারের জন্য উদয়-অস্ত পরিশ্রমতবু দুবেলা পেট ভরে আমাদের আহার জুটত না, মা’র সেই কান্না—
তবু সে কান্নার মধ্যে ইজ্জত ছিল, সম্মান ছিল দাদা। এরকম গ্লানি আর অপমানের জ্বালা ছিল না। স্বাতী বলে।
চতুর্থ ভাই শচীন্দ্র ওই সময় এসে ঘরে ঢেকে ঃ ব্যাপার কিরে স্বাতী, হঠাৎ ওপরে চলে এলি কেন? বড়মা ভীষণ রেগে গেছে মনে হল—
তাই বড়মার জন্য বুঝি ওকালতি করতে এসেছী। ছোটদা!
তার মানে?
মানে আর কি, তুমি বড়মাির ভয়ে যেমন সর্বদা জুজুবুড়ী হয়ে আছ, তেমনিই থাক না। গিয়ে-এখানে কেন?
স্বাতীর কথাবার্তাগুলো আজকাল কেমন শুনিছ বড়দা? শচীন্দ্র বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
সত্যি কথা বলছি কিনা তাই শুনতে খারাপ লাগছে ছোটদা!
ওঃ, দুটো পাস করে যে একেবারে ধরাকে সারা জ্ঞান করছিস রে! শচীন্দ্র টিল্পনী কাটে।
তা তো করবই-এ তো আর গদ্য-কবিতা লেখার মত সহজ নয়!
আগে লিখে নে একটা—তারপর আমন বড় বড় কথা বলিস, শচীন্দ্ৰ বলে ওঠে।
ও যত খুশি তুমিই বসে বসে লেখা গে। আর দু বেলা বড়মার দেওয়া রাজভোগ খাও গে।
তুই নিমকহারাম ছোটলোক কিনা—তাই বড়মার সব উপকার ভুলে গেছিস আজ! তারপর একটু থেমে বলে, গলাধাক্কা দিয়ে যখন বড়মা এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে, তখন বুঝবি।
বুঝতেই তো আমি সেটা চাই। বল গে না তোমার বড়মাকে কথাটা।
দেখ স্বাতী, এত তেজ মেয়েমানুষের ভাল না।
যাও যাও, আর উপদেশ দিতে হবে না। কবিতা লেখ গিয়ে, আর তোমার বড়মায়ের পায়ে তেল দাও গে—অপদাৰ্থ কাপুরুষ!
ঘৃণাভরে কথাগুলো বলে স্বাতী মুখ ফিরিয়ে নেয় তার ভাইয়ের দিক থেকে।
কিন্তু আশ্চর্য, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল চিত্রাঙ্গদা দেবী যেন স্বাতীর তিনতলায় যাবার ব্যাপারটা মেনেই নিলেন।
প্রথমটায় যতই হ্যাঁকডাক করুন না কেন, স্বাতী ওপরে চলে যাবার পর যেন হঠাৎ চুপ করে গেলেন।
বরং বাড়ির বুড়ি ঝি লখিয়ার মাকে বলে দিলেন, রাত্রে স্বাতীর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে শুয়ে থাকতে।
স্বাতী যেন তিনতলায় গিয়ে কতকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, প্রতি মুহূর্তে এখন আর চিত্রাঙ্গদা দেবীর মুখোমুখি হতে হবে না।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর দুই চোখের সন্দিগ্ধ কুটিল দৃষ্টি তাকে কীটার মত বিধবে না। বাতের জন্য বেশি হাঁটা-চলা আর এখন করতে পারেন না চিত্রাঙ্গদা দেবী—সিঁড়ি বেয়ে যখন-তখন তিনতলায় উঠে আসাটা তো এক-প্রকার দুঃসাধ্যই তাঁর পক্ষে।