আপনাদের অনেকেরই স্মরণ আছে যে আপনারা শিশুকালে উদীয়মান জ্যোতির্ময় সূর্যকে কত আনন্দের সহিতই না অবলোকন করিতেন; আর আপনারা সকলেই জীবনের কোন না কোন সময়ে ভাস্বর অস্তাচলগামী সূর্যকে স্থির দৃষ্টিতে অবলোকন করিয়া অন্ততঃ কল্পনাসহায়ে অদৃশ্য লোকে অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টাও করেন। বস্তুতঃ এই ব্যাপারটি সমগ্র বিশ্বের ভিত্তিমূলে রহিয়াছে—অদৃশ্যলোক হইতে উদয় এবং উহাতেই পুনরায় অস্তগমন, অজানা হইতে এই সমগ্র বিশ্বের উদ্ভব, পুনরায় অজানার ক্রোড়ে অনুপ্রবেশ; শিশুর মত অন্ধকার হইতে হামাগুড়ি দিয়া আবির্ভূত হওয়া এবং পুনরায় বৃদ্ধ বয়সে হামাগুড়ি দিয়া কোনপ্রকারে অন্ধকারের মধ্যে ফিরিয়া যাওয়া।
আমাদের এই বিশ্ব, এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ, এই যুক্তি ও বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্রহ্মাণ্ডটি উভয় প্রান্তেই অসীম, অজ্ঞেয় ও চির অজ্ঞাতের দ্বারা আবৃত। অনুসন্ধান—এই অজ্ঞাত সম্বন্ধেই অনুসন্ধান চলে, প্রশ্ন এখানেই চলে, তথ্যও এইখানেই রহিয়াছে, ইহারই মধ্য হইতে সেই আলোক বিচ্ছুরিত হয়, যাহা জগতে ‘ধর্ম’ নামে প্রসিদ্ধ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহলোকের বস্তু নয়; ইহা অতীন্দ্রিয় স্তরের বস্তু। ইহা যুক্তি-বিচারের অতীত, ইহা বুদ্ধিগ্রাহ্য স্তরের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইহা এমন একটি প্রত্যক্ষ দর্শন, এমন একটি দৈব-প্রেরণা, অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়ের মধ্যে এমন এক আত্ম-নিমজ্জন যাহার ফলে অজ্ঞেয়কে জ্ঞাত অপেক্ষাও নিবিড়ভাবে জানা যায়; কারণ লৌকিক অর্থে ইহার জ্ঞান সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস মানব-মনের এই অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টির আদি হইতেই চলিয়া আসিতেছে। জগতের ইতিহাসে এমন কোন সময়েই ছিল না, যখন মানুষের বিচারশক্তি ও বুদ্ধিমত্তা ছিল অথচ এই প্রচেষ্টা—এই অতীন্দ্রিয় বস্তুর অনুসন্ধিৎসা ছিল না। আমরা হয়তো দেখিতে পাইলাম, আমাদের এই ক্ষুদ্র বিশ্বে, এই মানব-মনে একটি ভাবনার উদয় হইল, কিন্তু কোথা হইতে ইহার উদ্ভব হইল, তাহা আমরা জানি না, এবং যখন ইহা বিলুপ্ত হয়, তখনই বা ইহা কোথায় যায়, তাহাও আমরা জানি না। এই ক্ষুদ্র জগৎ ও বিরাট ব্রহ্মাণ্ড, একই উৎস হইতে উদ্ভূত হয়, একই ধারায় চলে, একই প্রকার স্তরসমষ্টি অতিক্রম করে এবং একই পর্দায় ঝঙ্কৃত হয়।
আমি আপনাদের সম্মুখে হিন্দুদের এই মতবাদ উপস্থিত করিতে চেষ্টা করিব যে, ধর্ম বাহির হইতে আসে না, অন্তর হইতে উৎসারিত হয়। আমার বিশ্বাস—ধর্ম মানুষের এমনই মজ্জাগত যে, যতক্ষণ মানুষ দেহ ও মন ত্যাগ না করে, চিন্তা ও প্রাণের গতি নিরুদ্ধ না করে, ততক্ষণ ধর্ম ত্যাগ করিতে পারিবে না। যতক্ষণ মানুষ চিন্তা করিতে সমর্থ থাকিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত—এই প্রয়াস থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত মানুষের কোন-না-কোন রকম ধর্ম থাকিবেই, এইরূপে আমরা দেখিতে পাই—জগতে নানা ধর্মের উৎপত্তি হইয়াছে। এইগুলির অনুশীলনে মানুষ দিশেহারা হইয়া যায়, কিন্তু অনেকে যদিও মনে করেন যে এ জাতীয় গবেষণা বৃথা, তথাপি বস্তুতঃ উহা বৃথা নয়। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি সামঞ্জস্য আছে, এই-সকল বেতাল বেসুরের মধ্যেও একটি সঙ্গীতের ছন্দ পাওয়া যায়; যিনি শুনিতে চেষ্টা করিবেন, তিনিই সে ছন্দ শুনিতে পাইবেন।
বর্তমান সময়ে সকল প্রশ্নের বড় প্রশ্ন হইল, যদি ইহাই সত্য হয় যে, জ্ঞেয় এবং জ্ঞাত বস্তুর উভয় প্রান্তে অজ্ঞেয় এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অনন্তের বেষ্টন রহিয়াছে, তবে সেই অজানাকে জানিবার জন্য এত প্রয়াস কেন? কেন আমরা জ্ঞাত বস্তু লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিব না, কেন আমরা পানাহার এবং সমাজের মঙ্গলসাধনকল্পে সামান্য কিছু করিয়াই পরিতৃপ্ত থাকিব না? এই ধারণাই সর্বত্র আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া আছে। পণ্ডিত অধ্যাপক হইতে আরম্ভ করিয়া অস্ফুট-ভাষাভাষী শিশু পর্যন্ত সকলেই বলেঃ জগতের উপকার কর; ধর্ম বলিতে এইটুকুই বুঝায়; ইন্দ্রিয়াতীত বস্তু সম্পর্কে মাথা ঘামাইও না। এই কথা এত বেশী ক্ষেত্রে বলা হইয়া থাকে যে, এখন ইহা একটি অবধারিত সত্যে পরিণত হইয়া গিয়াছে।
কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, আমরা স্বভাবতই ইহারও ঊর্ধ্বে অনুসন্ধান করিতে বাধ্য। এই যে বর্তমান, এই যে ব্যক্ত, তাহা অব্যক্তের এক অংশ মাত্র। এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্ব যেন সেই অনন্ত অধ্যাত্মলোকের এমন একটি অংশ, এমন একটি খণ্ড, যাহা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চেতনস্তরের মধ্যে প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছে। সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্বকে বাদ দিয়া কেবল এই প্রসারিত ক্ষুদ্র অংশটিকে কিরূপে বুঝা যায় বা ব্যাখ্যা করা সম্ভব? সক্রেটিস সম্বন্ধে কথিত আছে যে, এথেন্স নগরীতে একদা বক্তৃতা করিবার কালে তিনি এমন একজন ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পান, যিনি ভ্রমণ ব্যপদেশে গ্রীসে উপস্থিত হইয়াছিলেন। সক্রেটিস তাঁহাকে বলিলেন, মানুষের প্রধান জ্ঞাতব্য বিষয় হইল ‘মানুষ’। ব্রাহ্মণ তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, ‘ঈশ্বরকে না জানিয়া আপনি মানুষকে জানিবেন কিরূপে?’ এই যে ঈশ্বর, এই যে সদা অজ্ঞেয় সত্তা, অথবা পরমতত্ত্ব, অথবা অনন্ত বস্তু, অথবা নামহীন সত্তা—আপনি তাঁহাকে যে নামে ইচ্ছা অভিহিত করিতে পারেন—একমাত্র তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই জ্ঞাত ও জ্ঞেয় অর্থাৎ এই বর্তমান জীবনের যৌক্তিকতা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা বা অবস্থিতির মূল কারণ প্রদর্শন করা সম্ভব। আপনার সম্মুখস্থ যে-কোন অতি-জড়বস্তুই ধরুন—যে-সব বিদ্যা অতীব জড়-বিষয়সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান বলিয়া পরিচিত, তাহার যে-কোনটি—যথা রসায়ন-বিদ্যা, পদার্থ-বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা প্রাণী-বিজ্ঞান অধ্যয়ন করুন; ক্রমাগত তাহার অনুশীলন করিয়া চলুন—দেখিবেন স্থূল রূপগুলি ক্রমেই বিলীন হইয়া সূক্ষ্মে পরিণত হইতেছে, অবশেষে এমন একটি বিন্দুসদৃশ কেন্দ্রে আসিয়া পৌঁছিতেছে, যেখানে আপনি জড় হইতে অ-জড়ে উপনীত হইবার জন্য একটি বৃহৎ লম্ফ প্রদান করিতে বাধ্য। স্থূল বিগলিত হইয়া সূক্ষ্মাকার গ্রহণ করে, পদার্থ-বিজ্ঞান দর্শন-শাস্ত্রে পরিণত হয়; জ্ঞানরাজ্যের সকল ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
আমাদের যাহা কিছু আছে—আমাদের সমাজ, আমাদের পরস্পরের সহিত সম্পর্ক, আমাদের ধর্ম এবং আপনারা যাহাকে নীতিশাস্ত্র নামে অভিহিত করেন—সর্ব ক্ষেত্রেই এই একই কথা প্রযোজ্য। কেবলমাত্র উপযোগিতার (utility) ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র গড়িয়া তুলিবার বহু প্রচেষ্টা দেখা যায়। আমি প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে যে কোন ব্যক্তিকে এইরূপ কোন ন্যায়সম্মত নীতিশাস্ত্র গড়িয়া তুলিতে আহ্বান করিতেছি। তিনি হয়তো অপরের উপকার সাধন করিতে উপদেশ দিবেন। ‘কেন ঐরূপ করিব? যেহেতু ঐরূপ করাই মানবের পক্ষে সর্বাপেক্ষা অধিক উপযোগী।’ এখন ধরা যাক, কোন ব্যক্তি যদি বলে, ‘আমি উপযোগিতা গ্রাহ্য করি না, আমি অপরের কণ্ঠচ্ছেদ করিয়া নিজে ধনী হইব।’ আপনি তাহাকে কি উত্তর দিবেন? সে তো আপনার প্রয়োজনবাদেরই আশ্রয় লইয়া ঐ প্রয়োজনবাদকেই নস্যাৎ করিয়া দিল। আমি যদি জগতের উপকার সাধন করি, তাহাতে আমার কোন্ প্রয়োজন সিদ্ধ হইবে? আমি কি এতই নির্বোধ যে, অপরে যাহাতে সুখে থাকিতে পারে, তাহার জন্য পরিশ্রম করিয়া জীবনপাত করিব? যদি সমাজ ব্যতীত অপর কোন চেতন বস্তু না থাকে, পঞ্চেন্দ্রিয় ব্যতীত জগতে অপর কোন শক্তি না থাকে, তাহা হইলে আমি নিজেই বা সুখী হইব না কেন? যদি আইন-রক্ষীদের করতল হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিতে পারি, তবে আমি কেন আমার ভ্রাতৃবর্গের কণ্ঠচ্ছেদ করিয়া নিজে সুখী না হইব? আপনি ইহার কি উত্তর দিবেন? আপনাকে ইহার সমর্থনে কোন উপযোগিতা দেখাইতে হইবে। এইরূপে যখনই আপনার যুক্তির ভিত্তি শিথিল করিয়া দেওয়া হয়, তখনই আপনি বলেন, ‘ওহে বন্ধুবর, জগতে ভাল করাই ভাল।’ মানব-মনের অন্তর্নিহিত যে শক্তি বলে, ‘ভাল হওয়াই ভাল’, যে শক্তি আমাদের নিকট অতি সমুজ্জ্বল আত্মার মহিমা প্রকাশ করে, সাধুত্বের সৌন্দর্য—পুণ্যের সর্বমনোহর আকর্ষণ প্রকটিত করে, মঙ্গলের অনন্ত শক্তির পরিচয় দেয়, সেই শক্তিটির স্বরূপ কি? তাহাকেই তো আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি। তাই নয় কি?
দ্বিতীয়তঃ এবার আমি এমন এক ক্ষেত্রে আসিয়া পড়িতেছি, যেখানে সাবধানে কথা বলিতে হয়। আমি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করিতেছি এবং অনুরোধ করিতেছি, যাহাতে আপনারা আমার বক্তব্য শুনিয়াই দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত না করিয়া ফেলেন। আমরা এই জগতে উপকার সাধন বিশেষ কিছুই করিতে পারি না। জগতের কল্যাণ করা ভাল কথা। কিন্তু এই জগতের কোন বিশেষ উপকার আমরা করিতে পারি কি? এই যে শত শত বৎসর ধরিয়া আমরা চেষ্টা করিতেছি, তাহাতে কি খুব বেশী কিছু উপকার করিতে পারিয়াছি, জগতের মোট সুখের পরিমাণ কি বৃদ্ধি করিতে পারিয়াছি? জগতে সুখ-সৃষ্টির জন্য নিত্যই অসংখ্য উপায় উদ্ভাবিত হয়, এবং এই প্রক্রিয়া শত-সহস্র বৎসর ধরিয়া চলিতেছে। আমি আপনাদিগকে প্রশ্ন করি, এক শতাব্দীকাল পূর্বের তুলনায় বর্তমানে মোট সুখের পরিমাণ কি বৃদ্ধি পাইয়াছে? তাহা সম্ভব নয়। মহাসাগরের বুকে কোথাও না কোথাও গভীর গহ্বর সৃষ্টি করিয়াই উত্তাল তরঙ্গ উঠিতে পারে। যদি কোন জাতি ধনী ও শক্তিশালী হইয়া উঠে, তাহা অন্য কোন জাতির ধনসম্পদ্ ও ক্ষমতার হ্রাস করিয়াই হইয়া থাকে। প্রতিটি নবাবিষ্কৃত যন্ত্র বিশ জনকে ধনী করিতেছে আর বিশ সহস্রকে দরিদ্র করিতেছে। সর্বত্রই দেখা যায়—প্রতিযোগিতার এই সাধারণ নিয়মের অভিব্যক্তি। মোট স্ফূর্ত শক্তির পরিমাণ সর্বদা একই থাকে। আরও দেখুন এই কার্যটাই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক; দুঃখকে বাদ দিয়া আমরা সুখের ব্যবস্থা করিতে পারি—ইহা অযৌক্তিক কথা। ভোগের এই-সকল উপকরণ সৃষ্টি করিয়া আপনারা জগতের অভাব বৃদ্ধি করিতেছেন এই মাত্র। আর অভাবের বৃদ্ধির অর্থ হইল অতৃপ্ত বাসনা, যাহা কখনও প্রশমিত হইবে না। কোন্ বস্তু এই অভাব—এই তৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করিতে পারে? যতক্ষণ এই তৃষ্ণা থাকিবে, ততক্ষণ দুঃখ অনিবার্য। জীবনের স্বাভাবিক ধারাই এই যে, পর পর দুঃখ এবং সুখ ভোগ করিতে হয়। তারপর আপনি কি মনে করেন যে, পৃথিবীর মঙ্গল-সাধনের কর্ম আপনার উপরই অর্পণ করা হইয়াছে? আর কি কোন শক্তি এই বিশ্বে কার্য করিতেছে না? যিনি সনাতন, সর্বশক্তিমান্, করুণাময়, চিরজাগ্রত—যিনি সমগ্র বিশ্ব নিদ্রামগ্ন হইলেও নিজে কখনও নিদ্রিত হন না, যাঁহার চক্ষু সতত নির্নিমেষ, সেই ঈশ্বর কি আমার ও আপনার হস্তে তাঁহার বিশ্বকে সমর্পণ করিয়া মৃত্যু বরণ করিয়াছেন বা বিশ্ব হইতে বিদায় লইয়াছেন? এই অনন্ত আকাশ যাঁহার সদা উন্মীলিত চক্ষু-সদৃশ, তিনি কি মৃত্যু-কবলিত হইয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছেন? তিনি কি আর এই বিশ্বের পালনাদি করেন না? বিশ্ব তো বেশ ভালভাবেই চলিতেছে, আপনার ব্যস্ত হইবার তো কোন প্রয়োজন নাই; এ-সকল ভাবিয়া আপনার দুঃখ ভোগ করিবার প্রয়োজন নাই।
[স্বামীজী এখানে সেই লোকটির গল্প বলিলেন, যে ভূতের দ্বারা আপনার কর্ম করাইতে চাহিয়াছিল, এবং ভূতকে ক্রমাগত কর্মের নির্দেশ দিয়াছিল; কিন্তু পরিশেষে আর তাহাকে নিযুক্ত রাখিবার মত কোন কর্ম না পাওয়ায় একটি কুকুরের বাঁকা লেজকে সোজা করিতে দিয়াছিল।]
এই বিশ্বের উপকার-সাধন করিতে গিয়া আমাদেরও সেই একই অবস্থায় পড়িতে হইয়াছে। হে ভ্রাতৃবৃন্দ, আমরাও ঠিক তেমনি এই শতসহস্র বৎসর ধরিয়া কুকুরের লেজ সোজা করিবার কাজে লাগিয়া আছি। ইহা বাতব্যাধির মত। পাদদেশ হইতে বিতাড়িত করিলে উহা মস্তকে আশ্রয় লয়, মস্তক হইতে বিতাড়িত করিলে অপর কোন অঙ্গে আশ্রয় লয়।
আপনাদের অনেকেরই নিকট জগৎ সম্বন্ধে আমার এই মতটি ভয়াবহভাবে নৈরাশ্যজনক বলিয়া মনে হইবে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নয়। নৈরাশ্যবাদ ও আশাবাদ, দুই-ই ভ্রান্ত মত—দুই-ই অতিমাত্রায় চরম। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তির অপর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয় থাকে, পরিধানে উত্তম বস্ত্র থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে অত্যন্ত আশাবাদী, কিন্তু সেই মানুষই যখন সবকিছু হারায়, তখন চরম নৈরাশ্যবাদী হইয়া উঠে। যখন কোন ব্যক্তি সর্বপ্রকার ধনসম্পদ্ হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় এবং একেবারে দীন-দরিদ্র হইয়া যায়, কেবল তখনই মানবজাতির ভ্রাতৃত্ব সংক্রান্ত ধারণারাশি তাহার নিকট সবেগে আবির্ভূত হয়। সংসারের স্বরূপই এই। যতই দেশদেশান্তর ভ্রমণ করিয়া জগতের সহিত অধিক পরিচিত হইতেছি, যতই আমার বয়স হইতেছে, ততই আমি নিরাশাবাদ ও আশাবাদের মত চরম মত পরিহার করিবার চেষ্টা করিতেছি। এই জগৎ ভালও নয়, মন্দও নয়; ইহা প্রভুর জগৎ। ইহা ভাল-মন্দ উভয়ের অতীত, নিজের দিক্ হইতে ইহা সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ। ভগবানেরই ইচ্ছায় কাজ চলিতেছে, এবং এই সকল বিভিন্ন চিত্র আমাদের সম্মুখে আসিতেছে; অনাদি অনন্ত কাল ধরিয়া ইহা চলিতে থাকিবে। ইহা একটি সুবৃহৎ ব্যায়ামাগার তুল্য; এখানে আমাকে আপনাকে ও লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে আসিয়া ব্যায়াম অভ্যাস করিতে হইবে এবং নিজদিগকে সরল ও দোষশূন্য করিয়া লইতে হইবে। জগৎ এই উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট হইয়াছে। ভগবান্ যে ত্রুটিহীন জগৎ সৃষ্টি করিতে পারিতেন না বা জগতে দুঃখের ব্যবস্থা করা ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না, তাহা নয়।
আপনারা সেই ধর্মযাজক ও তরুণীর কাহিনী স্মরণ করুন; একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে উভয়েই চন্দ্র অবলোকন করিয়া কলঙ্করেখাগুলি দেখিতে পাইলেন। ধর্মযাজক বলিলেন, ‘ওইগুলি নিশ্চয়ই গীর্জার চূড়া।’ তরুণী বলিলেন, ‘বাজে কথা, ওরা নিশ্চয়ই চুম্বনরত তরুণ প্রণয়িযুগল।’ এই পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের দর্শনও অনুরূপ। আমরা যখন জগতের ভিতরে থাকি, তখন মনে করি, উহার অন্তর্ভাগ দেখিতেছি। আমরা জীবনের যে স্তরে থাকি, তদনুযায়ী বিশ্বকে দেখি। রান্নাঘরের অগ্নি ভালও নয়, মন্দও নয়। যখন এই অগ্নি আপনার আহার্য প্রস্তুত করিয়া দেয়, তখন আপনি তাহার প্রশংসা করিয়া বলেন, ‘অগ্নি কত ভাল!’ অগ্নি যখন আপনার আঙুল দগ্ধ করে, তখন আপনি বলেন, ‘ইহা কি জঘন্য!’ ঠিক একইভাবে এবং সমযুক্তিসহায়ে এ-কথা বলা যায়, ‘এই বিশ্ব ভালও নয়, মন্দও নয়।’ এই সংসারটি সংসার ছাড়া আর কিছু নয়; এবং চিরকাল তাহাই থাকিবে। যখনই আমরা নিজদিগকে ইহার নিকট এমনভাবে খুলিয়া ধরিতে পারি যে, জাগতিক কার্যাবলী আমাদের অনুকূল হয়, তখন আমরা ইহাকে ভাল বলি। আবার যদি আমরা নিজেদের এমন অবস্থায় উপস্থাপিত করি যে, ইহা আমাদের দুঃখসাগরে ভাসাইয়া দেয়, তাহা হইলে ইহাকে আমরা মন্দ বলি। ঠিক এইভাবে আপনারা সর্বদাই দেখিতে পাইবেন, নির্দোষ ও আনন্দময় যে শিশুর মনে কাহারও প্রতি কোন অনিষ্টচিন্তা জাগ্রত হয় নাই, তাহারা আশাবাদী হয়, তাহারা সোনার স্বপ্ন দেখে। এদিকে যেসব বয়স্ক ব্যক্তির অন্তর বাসনায় পূর্ণ, অথচ উহা পূর্ণ করিবার কোন উপায় নাই, বিশেষতঃ যাহারা সংসারে প্রচুর ঘাত-প্রতিঘাতে আবর্তিত হইয়াছে, তাহারা নৈরাশ্যবাদী হয়। ধর্ম সত্যকে জানিতে চায়; এবং প্রথম যে তত্ত্ব সে আবিষ্কার করিয়াছে, তাহা হইল এই—সত্যের অনুভূতি ব্যতীত বাঁচিয়া থাকার কোন অর্থ নাই।
আমরা যদি লোকাতীতকে জানিতে না পারি, তাহা হইলে আমাদের জীবন মরুভূমিতে পরিণত হইবে, মানব-জন্ম বৃথা যাইবে। ‘বর্তমানের বস্তু লইয়া সন্তুষ্ট থাক’—ইহা বলিতে বেশ। গাভী, কুকুর এবং অন্যান্য পশুদের ক্ষেত্রে এইরূপ হওয়া সম্ভব, এবং এই সন্তোষই তাহাদের পশু করিয়া রাখিয়াছে। সুতরাং মানুষ যদি বর্তমানেই সন্তুষ্ট থাকে এবং লোকাতীতের উদ্দেশ্যে সমস্ত অনুসন্ধান পরিত্যাগ করে, তাহা হইলে মানুষকে পুনরায় পশুত্বের স্তরে ফিরিয়া যাইতে হইবে। এই ধর্ম, এই লোকাতীতের জন্য অনুসন্ধিৎসাই মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করিয়াছে। এ-কথাটা বেশ বলা হইয়াছে যে, মানুষই একমাত্র জীব যে স্বভাবতঃ ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করে, অন্যান্য প্রাণী স্বভাব-বশেই নিম্নদৃষ্টি। এই যে ঊর্ধ্বদৃষ্টি এবং ঊর্ধ্বাভিমুখে গতি ও পূর্ণতালাভের আকূতি—ইহাকেই মুক্তি বলা হয়, এবং যত শীঘ্র মানুষ ঊর্ধ্বস্তরাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করে, তত শীঘ্রই সে এইরূপ ধারণায় উপনীত হয় যে, মুক্তি বলিতে সত্যকেই বুঝায়। তোমার পকেটে কত টাকা আছে, কিংবা তুমি কিরূপ পোষাক-পরিচ্ছদ পরিতেছ—কিংবা কি প্রকার গৃহে বাস করিতেছ, তাহার উপর মুক্তি নির্ভর করে না, নির্ভর করে তোমার মস্তিষ্কে কতটুকু অধ্যাত্ম-চিন্তা আছে, তাহার উপর। ইহারই ফলে মানুষের উন্নতি হয়, ইহাই জড়জগতে ও বুদ্ধিজগতে সর্বপ্রকার উন্নতির উৎস; ইহাই সেই মৌলিক আকূতি, সেই উৎসাহ যাহা মানুষকে প্রগতির পথে পরিচালিত করে।
তাহা হইলে মানব-জীবনের লক্ষ্য কি? সুখ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভোগই কি লক্ষ্য? পুরাকালে বলা হইত, মানুষ স্বর্গে গিয়া তুরী নিনাদ করিবে এবং রাজ-সিংহাসনের নিকটে বাস করিবে। বর্তমান যুগে দেখিতেছি, এই ধারণাকে অতি হীন বলিয়া মনে করা হয়। বর্তমান যুগে এই ধারণাটির উৎকর্ষ সাধন করা হইয়াছে এবং বলা হয় যে, স্বর্গে সকলেই বিবাহ করিতে পাইবে এবং ঐ জাতীয় সবকিছুই সেখানে পাইবে। এই দুইটি ধারণার মধ্যে যদি কোনটির অগ্রগতি হইয়া থাকে, তাহা হইলে দ্বিতীয়টির অগ্রগতি হইয়াছে মন্দেরই দিকে। স্বর্গ সম্পর্কে এই যে-সকল ধারণা উপস্থাপিত করা হইল, তাহা মনের দুর্বলতারই পরিচায়ক। এবং এই দুর্বলতার কারণঃ প্রথমতঃ মানুষ মনে করে, ইন্দ্রিয়সুখই জীবনের লক্ষ্য; দ্বিতীয়তঃ পঞ্চেন্দ্রিয়ের অতীত কোন বস্তুর ধারণা সে করিতে পারে না। এই মতবাদীরা প্রয়োজনবাদীদের মতই যুক্তিহীন। তথাপি ইহারা অন্ততঃপক্ষে আধুনিক নাস্তিক প্রয়োজনবাদীদের তুলনায় অনেক ভাল। পরিশেষে বলিতে হয়, প্রয়োজনবাদীদের এই মতবাদটি বালকোচিত। আপনার এ-কথা বলিবার কি অধিকার আছে যে, ‘এই আমার বিচারের মাপকাঠি এবং সমগ্র বিশ্বকে এই বিচারের মাপকাঠি অনুযায়ী চলিতে হইবে?’ যে মাপকাঠির শিক্ষা হইল—শুধু অন্ন, অর্থ ও পোষাকই ঈশ্বর, সেই মাপকাঠি দ্বারা সকল সত্যকেই বিচার করিতে হইবে, এইরূপ বলিবার আপনার কি অধিকার আছে?
ধর্ম কোন খাদ্যের মধ্যে বা বাসস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। আপনারা প্রায়ই এবংবিধ সমালোচনা শুনিতে পান যে, ‘ধর্ম আবার মানুষের কি হিতসাধন করিতে পারে? ইহা কি দরিদ্রের দারিদ্র্য দূর করিতে পারে, তাহাদিগকে পরিধানের বস্ত্র দিতে পারে?’ ধরুন ধর্ম তাহা পারে না, ইহা দ্বারাই কি ধর্মের অসত্যতা প্রমাণিত হইবে? ধরুন জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত কোন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হইতেছে, এমন সময় আপনাদের মধ্যে একটি শিশু উঠিয়া প্রশ্ন করিল, ‘এই তত্ত্ব কি কোন ভাল খাবার উৎপন্ন করিতে পারিবে?’ আপনি হয়তো বলিলেন, ‘না, পারে না।’ শিশুটি তখন বলিল, ‘তাহা হইলে ইহা নিরর্থক।’ শিশুরা সমগ্র বিশ্বকে নিজেদের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখে—অর্থাৎ খাবার প্রস্তুতের দৃষ্টি দিয়া; আর এই সংসারে যাহারা শিশুসম, তাহারাও এইরূপ করে।
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে এ-কথা বলিতে দুঃখ হয় যে, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যাঁহাদিগকে পণ্ডিত, সর্বাধিক যুক্তিবাদী, সর্বাপেক্ষা ন্যায়কুশল এবং সর্বোত্তম মনীষাসম্পন্ন বলিয়া আমরা জানি, এই-সব ব্যক্তি ঐ শিশুদেরই মধ্যে পরিগণিত। উচ্চ তত্ত্বগুলিকে আমাদের এই হীন দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করা সঙ্গত নয়। প্রত্যেক বস্তুকে তাহার নিজস্ব মাপকাঠি দিয়া বিচার করিতে হইবে এবং অসীমকে অসীমেরই মান অনুসারে পরীক্ষা করিতে হইবে—অনন্তের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিতে হইবে। ধর্ম মানুষের সমগ্র জীবন, শুধু বর্তমান নয়, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সমগ্র জীবনধারাকে ব্যাপ্ত করিয়া রাখিয়াছে। অতএব ধর্ম হইল সনাতন আত্মার সহিত সনাতন ঈশ্বরের শাশ্বত সম্পর্ক। পাঁচ মিনিটের মানব-জীবনের উপর ইহা কি প্রকার প্রভাব বিস্তার করে, তাহা দেখিয়া ইহার মূল্যনির্ধারণ করা কি ন্যায়সঙ্গত হইবে? কখনই নয়। এগুলি সমস্তই নেতিবাচক যুক্তি।
এখন প্রশ্ন উঠিতেছে—ধর্ম কি মানুষের জন্য সত্যই কিছু করিতে পারে? পারে। ধর্ম কি সত্যই মানুষের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করিতে পারে? অবশ্যই পারে। ধর্ম সর্বদাই তাহা করে, এবং তদপেক্ষা অনেক বেশী কিছু করেঃ ইহা মানুষকে অনন্ত মহাজীবন আনিয়া দেয়। ইহা মানুষকে মানুষ করিয়াছে, এবং এই পশুমানবকে দেবত্বে উন্নীত করিবে। ইহাই হইল ধর্মের ফল। মানব-সমাজ হইতে ধর্মকে বাদ দিন, কি থাকিবে? বর্বরে পরিপূর্ণ একটি অরণ্যানী ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। যেহেতু এইমাত্র আমি তোমাদের নিকট প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি যে, ইন্দ্রিয়-সুখকে মানবজীবনের লক্ষ্য মনে করা অসম্ভব, সেহেতু আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিতেছি যে, জ্ঞানই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। আমি আপনাদের ইহাও দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছি যে, এই সহস্র বৎসর ধরিয়া সত্যানুসন্ধানের জন্য এবং মানব-কল্যাণের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা উল্লেখযোগ্য উন্নতি করিতে পারিয়াছি—খুবই অল্প। কিন্তু মানুষ জ্ঞানের অভিমুখে বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে। জৈব-ভোগের ব্যবস্থা করাকেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ উপযোগিতা বলা চলে না; পরন্তু পশু-মানব হইতে দেবতার সৃষ্টি করাই হইবে ইহার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। অতঃপর জ্ঞানলাভ হইলে উহা হইতে স্বভাবতই পরমানন্দ আবির্ভূত হয়। শিশুগণ মনে করে, ইন্দ্রিয়সুখই হইল তাহাদের লভ্য সুখগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আপনারা প্রায় সকলেই জানেন যে, মানবজীবনে ইন্দ্রিয়সম্ভোগ অপেক্ষা বুদ্ধিজ সম্ভোগ অধিকতর তৃপ্তিপ্রদ। কুকুর আহার করিয়া যে আনন্দ পায়, আপনারা কেহ তাহা পাইবেন না। আপনারা সকলেই ইহা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতে পারেন। মানুষের মধ্যে কোথা হইতে তৃপ্তিবোধ জাগ্রত হয়? আহার হইতে শূকর বা কুকুর যে আনন্দ পায়, আমি তাহার কথা বলিতেছি না। লক্ষ্য করুন—শূকর কিভাবে আহার করে। সে যখন খায়, তখন সমগ্র বিশ্ব ভুল হইয়া যায়; তাহার গোটা মন ঐ আহারের মধ্যে ডুবিয়া যায়। আহার-গ্রহণকালে তাহাকে হত্যা করিলেও সে গ্রাহ্য করিবে না। ভাবিয়া দেখুন, ঐ কালে শূকরটির আনন্দসম্ভোগ কত তীব্র। কোন মানুষেরই এই তীব্র সম্ভোগানুভূতি নাই। মানুষের সে অনুভূতি কোথায় গেল? মানুষ ইহাকে বুদ্ধিজ ভোগে পরিণত করিয়াছে। শূকর ধর্মসম্বন্ধীয় বক্তৃতা উপভোগ করিতে পারে না। বুদ্ধিসাহায্যে উপভোগ অপেক্ষাও উহা উচ্চতর ও তীব্রতর স্তরে ঘটিয়া থাকে; ইহাই হইল আধ্যাত্মিক স্তর, ইহাই ঐশী বস্তুর আত্মিক সম্ভোগ, ইহা বুদ্ধি ও যুক্তির ঊর্ধ্বে অবস্থিত। ইহা লাভ করিতে হইলে আমাদের এই-সকল ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ করিতে হইবে। জীবনে ইহারই সর্বশ্রেষ্ঠ উপযোগিতা আছে। উপযোগিতা বলিতে তাহাই বুঝায়, যাহা আমি উপভোগ করিতে পারি, অপর সকলেও ভোগ করিতে পারে; এবং ইহারই দিকে আমরা সকলে ধাবমান। আমরা দেখিতে পাই, পশুগণের ইন্দ্রিয়সুখ অপেক্ষা মানুষ নিজ বুদ্ধিমত্তা হইতে অধিকতর আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকে এবং ইহাও দেখি যে, মানুষ তাহার বুদ্ধিমত্তা অপেক্ষাও আধ্যাত্মিক স্বরূপ হইতে অধিকতর আনন্দ লাভ করিয়া থাকে। অতএব এই আধ্যাত্মিক অনুভূতিই হইল সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। এই অনুভূতির সহিত আনন্দলাভও হইবে। এই জগৎ—এই যে-সকল দৃশ্যমান বস্তু—এ-সকল তো সেই প্রকৃত সত্য এবং আনন্দের ছায়ামাত্র, উহার তৃতীয় অথবা চতুর্থ স্তরের নিম্নতর বিকাশমাত্র।
মানবপ্রেমের মধ্য দিয়া এই পরমানন্দই তোমাদের নিকট আসে; মানবীয় ভালবাসা এই আধ্যাত্মিক আনন্দেরই ছায়ামাত্র, কিন্তু মানবীয় আনন্দের সহিত ইহাকে এক করিয়া ফেলিও না। এই একটি বড় রকমের ভুল সর্বদাই হইতেছে। আমরা প্রতিমুহূর্তে আমাদের এই দৈহিক ভালবাসা, এই মানবীয় প্রেম, এই তুচ্ছ সসীমের প্রতি আকর্ষণ, সমাজের অন্তর্গত অপরাপর মানুষের প্রতি এই বিদ্যুৎসদৃশ আকর্ষণকে আমরা সর্বদাই পরমানন্দ বলিয়া ভুল করিতেছি। আমরা ইহাকেই সেই শাশ্বত বস্তু বলিয়া অভিহিত করিতেছি, প্রকৃতপক্ষে ইহা সেই বস্তু নয়। ইহার ঠিক কোন সমার্থক শব্দ ইংরেজী ভাষায় না থাকায়, আমি ইহাকে bliss বা পরমানন্দ বলিব। এই পরমানন্দ শাশ্বত জ্ঞানের সহিত অভিন্ন এবং ইহাই আমাদের লক্ষ্য। বিশ্বের যেখানে যত ধর্ম আছে বা ভবিষ্যতে থাকিতে পারে, সকলেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত—এই একই উৎস হইতে উদ্ভূত হইয়াছে এবং হইবে। এই পাশ্চাত্য দেশে তোমরা যাহাকে দিব্য প্রেরণা বল, তাহাও এই উৎস ভিন্ন আর কিছু নয়। এই প্রেরণার স্বরূপ কি? প্রেরণাই ধর্মানুভূতির একমাত্র উৎস। আমরা দেখিয়াছি, ধর্ম অতীন্দ্রিয় স্তরের বস্তু। ধর্ম সেই বস্তু ‘যেখানে চক্ষু বা কর্ণ গমন করিতে পারে না, মন যেখানে পৌঁছাইতে পারে না, বাক্য যাহাকে প্রকাশ করিতে পারে না।’ ইহাই ধর্মের ক্ষেত্র এবং লক্ষ্য; যাহাকে আমরা প্রেরণা নামে অভিহিত করিতেছি, তাহাও এখান হইতে উদ্গত হয়। অতএব স্বভাবতই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এই ইন্দ্রিয়াতীত লোকে পৌঁছিবার কোন না কোন পথ অবশ্যই আছে। ইহা সম্পূর্ণ সত্যকথা যে, যুক্তি ইন্দ্রিয়সমূহকে অতিক্রম করিতে পারে না, সমস্ত যুক্তি ইন্দ্রিয়ের পরিধির মধ্যে, ইন্দ্রিয়বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ; ইন্দ্রিয়গুলি যে-সকল তথ্যে উপস্থিত হইতে পারে, যুক্তি তাহারই ভিত্তিতে গড়িয়া উঠে। কোন মানুষ কি ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করিতে পারে? কোন মানুষ কি এই অজ্ঞেয়কে জানিতে পারে? এই একটি প্রশ্নের ভিত্তিতেই ধর্মসম্বন্ধীয় সকল প্রশ্নের সমাধান করিতে হইবে, ইতঃপূর্বে তাহাই করা হইয়াছে। স্মরণাতীতকাল হইতেই সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর—ইন্দ্রিয়ের বাধা বিদ্যমান রহিয়াছে; স্মরণাতীত কাল হইতে শত-সহস্র নরনারী এই প্রাচীর ভেদ করিবার জন্য সংগ্রাম করিয়াছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ অকৃতকার্য হইয়াছে; অপরদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কৃতকার্যও হইয়াছে। ইহাই হইল এই জগতের ইতিহাস। আবার আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে, যাহারা এ-কথা বিশ্বাস করে না যে, সত্যই কেহ কখনও কৃতকার্য হইয়াছে। ইহারাই পৃথিবীর আধুনিক সন্দেহবাদী (sceptics)। মানুষ চেষ্টা করিলেই এই প্রাচীর ভেদ করিতে পারে। মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র যে যুক্তি আছে তাহা নয়, কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়সমূহ আছে তাহা নয়—তাহার মধ্যে আরও অনেক কিছু আছে, যাহা ইন্দ্রিয়ের অতীত। আমরা এ-কথা একটু ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিব। আশা করি, তোমরাও অনুভব করিতে পারিবে যে, ইহা তোমাদের মধ্যেও আছে।
আমি যখন আমার হস্ত সঞ্চালন করি—তখন অনুভব করি এবং জানি যে, আমি হস্ত সঞ্চালন করিতেছি। ইহাকে আমরা চেতনা বলি। আমি এ বিষয়ে সচেতন যে, আমি হস্ত সঞ্চালন করিতেছি। আমার হৃৎপিণ্ডও স্পন্দিত হইতেছে। সে বিষয়ে আমি সচেতন নই; তথাপি আমার হৃৎপিণ্ড কে সঞ্চালন করিতেছে? ইহাও অবশ্য সেই একই সত্তা হইবে। সুতরাং আমরা দেখিতেছি যে, যে-সত্তা হস্ত-সঞ্চালন ঘটাইতেছে, বাক্যস্ফুরণ করাইতেছে, অর্থাৎ সচেতন কর্ম সম্পন্ন করিতেছে, তাহাই অচেতন কার্যও সম্পন্ন করিতেছে। অতএব আমরা দেখিতেছি যে, এই সত্তা উভয় স্তরেই কার্য করিতে পারে—একটি চেতনার স্তর, অপরটি তাহার নিম্নবর্তী স্তর। অবচেতন-স্তর হইতে যে-সকল সঞ্চালন ঘটে, সেগুলিকে আমরা সহজাতবৃত্তি নামে অভিহিত করি; এবং যখনই সেই সঞ্চালন চেতনার স্তর হইতে ঘটে, আমরা তাহাকে যুক্তি বলি। কিন্তু আর একটি উচ্চতর স্তর আছে, তাহা মানুষের অতি-চেতন স্তর। ইহা আপাততঃ অচেতন অবস্থার তুল্য, কারণ ইহা চেতন স্তরের অতীত; বস্তুতঃ ইহা চেতনার ঊর্ধ্বে অবস্থিত, নিম্নে নয়। ইহা সহজাত-বৃত্তি নয়, ইহা ‘দিব্য প্রেরণা।’ ইহার সপক্ষে প্রমাণ আছে। সমগ্র জগতে যে সকল অবতার পুরুষ ও সাধক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কথা স্মরণ করুন; ইহা সর্বজনবিদিত যে, তাঁহাদের জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসিয়াছে, যখন আপাতদৃষ্টিতে তাঁহাদিগকে বাহ্যজগৎ সম্পর্কে অচেতন বলিয়া মনে হয়; অতঃপর তাঁহাদের ভিতর হইতে যে জ্ঞানরাশি উৎসারিত হয়, সে সম্বন্ধে তাঁহারা বলেন, উহা তাঁহারা অতিচেতন স্তর হইতে পাইয়াছেন। সক্রেটিস সম্বন্ধে কথিত আছে যে, তিনি যখন একদা সৈনিকদলের সহিত চলিতেছিলেন, তখন অতি সুন্দর সূর্যোদয় হইয়াছিল, ঐ দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার মনে কি এক চিন্তাপ্রবাহ শুরু হইল, যাহাতে তিনি উক্ত স্থানে রৌদ্রের মধ্যে বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া একাদিক্রমে দুইদিন দাঁড়াইয়া রহিলেন। এই সকল মুহূর্তই জগৎকে সক্রেটিসীয় জ্ঞান প্রদান করিয়াছে। এইরূপে জগতের যাবতীয় অবতার ও সাধক পুরুষদের জীবনে এমন মুহূর্ত আসে, যখন তাঁহারা চেতন-স্তর হইতে উঠিয়া ঊর্ধ্বতন স্তরে আরোহণ করেন এবং যখন তাঁহারা পুনরায় চেতনার স্তরে আগমন করেন, তখন তাঁহারা জ্ঞানজ্যোতিতে উজ্জ্বল হইয়া আসেন এবং সেই সর্বাতীত লোকের সংবাদ প্রদান করেন। ইঁহারাই জগতের দিব্যভাবে আরূঢ় ঋষি।
কিন্তু এখানে একটি বড় বিপদ রহিয়াছে। অনেকেই দাবী করিতে পারেন যে, তাঁহারা দিব্যভাবে অনুপ্রাণিত; প্রায়ই এইরূপ দাবী শোনা যায়। এ বিষয়ে পরীক্ষার উপায় কি? নিদ্রার সময় আমরা অচেতন থাকি; ধরুন—একটি মূর্খ নিদ্রামগ্ন হইল, তিন ঘণ্টা তাহার সুনিদ্রা হইল; যখন সে উক্ত অবস্থা হইতে ফিরিল, সে যে বোকা সে বোকাই রহিয়া গেল, যদি না তাহার আরও অবনতি হইয়া থাকে। এদিকে নাজারেথের যীশু দিব্যভাবে আরূঢ় হইলেন; তিনি যখন ফিরিলেন, তখন তিনি যীশুখ্রীষ্টে পরিণত হইয়া গেলেন। এখানেই যা কিছু প্রভেদ। একটি হইল দিব্য প্রেরণা, অপরটি হইল সহজাত প্রবৃত্তি। একজন শিশু, অপরজন প্রবীণ অভিজ্ঞ ব্যক্তি। এই দিব্য প্রেরণা আমরা যে কেহ লাভ করিতে পারি; ইহা যাবতীয় ধর্মের উৎপত্তিস্থল এবং চিরকাল ধরিয়া ইহা উচ্চতর জ্ঞানের উৎস হইয়া থাকিবে। তথাপি এ পথে বহু বিপদের সম্ভাবনা। অনেক সময়েই ভণ্ডব্যক্তি জনসমাজকে প্রতারিত করিতে চায়। বর্তমান যুগে ইহাদের বিশেষ প্রাদুর্ভাব দেখা যাইতেছে। আমার জনৈক বন্ধুর একখানি চমৎকার চিত্রপট ছিল, অপর একজন অনেকাংশে ধর্মভাবাপন্ন অথচ ধনী ভদ্রলোকের উহার উপর লোভ ছিল; কিন্তু আমার বন্ধু উহা বিক্রয় করিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। অপর ভদ্রলোকটি একদিন আমার বন্ধুর নিকটে আসিয়া বলিলেন, ‘আমি দৈব প্রেরণা লাভ করিয়াছি, এবং ঈশ্বর কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট হইয়া আসিয়াছি।’ আমার বন্ধু প্রশ্ন করিলেন, ‘ভগবানের নিকট হইতে আপনি কি আদেশ পাইয়াছেন?’ ‘আদেশটি এই যে, আপনাকে এই চিত্রটি আমায় অর্পণ করিতে হইবে।’ আমার বন্ধুও ধূর্ততায় তাঁহার সমান; তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘ঠিক কথা; কি চমৎকার! আমিও ঠিক অনুরূপ প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছি যে, ছবিখানি আপনাকে দিতে হইবে। আপনি কি টাকাটা আনিয়াছেন?’ ‘টাকা? কিসের টাকা?’ আমার বন্ধু বলিলেন, ‘তাহা হইলে আপনার প্রত্যাদেশ ঠিক বলিয়া আমি মনে করি না। আমি যে প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছি, তাহাতে বলা হইয়াছে যে, যে-ব্যক্তি একলক্ষ ডলার মূল্যের চেক দিবে, তাহাকেই যেন চিত্রখানি আমি দিই। আপনাকে নিশ্চয়ই চেকখানি আগে আনিতে হইবে।’ অপর ব্যক্তি দেখিলেন, তিনি ধরা পড়িয়া গিয়াছেন। তখন তিনি প্রত্যাদেশের কথা পরিহার করিলেন। এই হইল বিপদ। বোষ্টন শহরে একদা এক ব্যক্তি আসিয়া আমাকে বলিল, তাহার এমন এক দৈবদর্শন হইয়াছে, যাহাতে তাহার সহিত হিন্দু-ভাষায় কথা বলা হইয়াছে। তখন আমি বলিলাম, ‘যে যে কথা শুনিয়াছেন, সেগুলি শুনিলে আমি বিশ্বাস করিব।’ কিন্তু ঐ ব্যক্তি কতগুলি অর্থহীন কথা লিখিল। আমি তাহা অনুধাবন করিবার অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু সফল হইলাম না। তখন আমি তাহাকে বলিলাম, আমার জ্ঞানমতে এইরূপ ভাষা ভারতবর্ষে কখনও ছিল না, কখনও হইবে না। তাহারা এখনও এরূপ ভাষা লাভ করিবার মত যথেষ্ট সুসভ্য হইয়া উঠিতে পারে নাই। ইহাতে অবশ্য সে মনে করিল যে, আমি ভাল লোক নই এবং সংশয়বাদী; সুতরাং সে প্রস্থান করিল। ইহার পর যদি আমি শুনিতে পাই যে, ঐ ব্যক্তি উন্মাদাগারে আশ্রয়লাভ করিয়াছে, তাহা হইলে বিস্মিত হইব না। সংসারে এই দুই প্রকার বিপদের সম্ভাবনা সর্বদাই রহিয়াছে—এই বিপদ আসে হয় ভণ্ডদের নিকট হইতে, অথবা মূর্খদের নিকট হইতে। কিন্তু এজন্য আমাদের দমিয়া যাওয়া উচিত নয়, কারণ জগতে যে-কোন মহৎ বস্তুলাভের পথই বিপদাকীর্ণ। কিন্তু আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করিতে হইবে। অনেক সময় দেখিতে পাই, অনেক ব্যক্তি যুক্তি-অবলম্বনে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে অক্ষম। কেহ হয়তো আসিয়া বলিল, ‘আমি এই দেবতার নিকট হইতে এই বাণী লাভ করিয়াছি’ এবং জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি কি ইহা অস্বীকার করিতে পারেন? ইহা কি সম্ভব নয় যে, এরূপ দেবতা আছেন এবং তিনি এরূপ আদেশ দিয়া থাকেন?’ শতকরা নব্বইজন মূর্খ এ কথা গলাধঃকরণ করিয়া লইবে। তাহারা মনে করে যে, ঐরূপ যুক্তিই যথেষ্ট। কিন্তু একটি কথা আপনাদের জানা উচিত, যে-কোন ঘটনাই সম্ভবপর হইতে পারে; এবং ইহাও সম্ভব হইতে পারে যে, লুব্ধক নক্ষত্রের সংস্পর্শে আসিয়া পৃথিবী আগামী বৎসরে বিদীর্ণ হইয়া যাইবে। আমি যদি এইরূপ সম্ভাবনা উপস্থাপিত করি, তবে আপনাদেরও অধিকার আছে যে, আপনারা আমাকে ইহা প্রমাণ করিতে বলিবেন। আইনজ্ঞেরা যাহাকে বলেন, ‘প্রমাণ করার দায়িত্ব’, সে দায়িত্ব তাহার উপরই বর্তাইবে, যে ঐ জাতীয় মতবাদ উপস্থিত করিবে। যদি আমি কোন দেবতার নিকট হইতে প্রত্যাদেশ লাভ করিয়া থাকি, তাহা হইলে তাহা প্রমাণ করিবার দায়িত্ব আমার, আপনার নহে, কারণ আমিই আপনাদের সম্মুখে প্রকল্পটি উপস্থিত করিয়াছি। যদি আমি ইহা প্রমাণ করিতে না পারি, তাহা হইলে আমার জিহ্বাকে শাসন করা উচিত ছিল। এই উভয় বিপদকে পরিহার করুন, তারপর আপনি যদৃচ্ছা বিচরণ করিতে পারেন। আমরা জীবনে অনেক দৈববাণী শুনিয়া থাকি, অথবা মনে করি যে, শুনিতে পাইলাম; যতক্ষণ পর্যন্ত এইগুলি আপনাদের নিজেদের বিষয় হইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যাহা ইচ্ছা করিতে পারেন; কিন্তু সেইগুলি যদি অপরের সহিত আপনার সম্বন্ধ বা অপরের প্রতি আচরণ বিষয়ে হয়, তবে সে সম্পর্কে কিছু করিবার পূর্বে একশ-বার বিবেচনা করিয়া দেখুন; তাহা হইলে আর বিপদের সম্ভাবনা থাকিবে না।
আমরা দেখিলাম যে, দিব্য প্রেরণা ধর্মের উৎস; অথচ উহা নানা বিপদাকীর্ণ। সর্বশেষ ও সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বিপদ হইল অতিরিক্ত দাবী। এমন লোকও আছেন, অকস্মাৎ যাঁহাদের অভ্যুদয় হয়, আর তাঁহারা বলেনঃ ভগবানের নিকট হইতে তাঁহারা বার্তা লাভ করিয়াছেন, এবং তাঁহারা সর্বশক্তিমান্ ভগবানের বাণীই উচ্চারণ করিতেছেন এবং অপর কাহারও ঐরূপ বার্তালাভের অধিকার নাই। শুনিলেই মনে হয়, উহা অত্যন্ত অযৌক্তিক। এই বিশ্বে যাহা কিছু থাকুক না কেন, উহা সকলের পক্ষে সমভাবে থাকা উচিত। এই বিশ্বে এমন কোন স্পন্দনই নাই, যাহা বিশ্বজনীন নয়, কারণ সমগ্র বিশ্বই নিয়মের অধীন। ইহা আগাগোড়া বিধিবদ্ধ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাজেই কোথাও যদি কোন কিছু থাকে তো তাহার সর্বত্র থাকার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। সর্বাপেক্ষা বৃহদাকার সূর্য ও নক্ষত্রাদি যেভাবে গঠিত, একটি অণুও সেইভাবে গঠিত। যদি কখনও কেহ দিব্যভাবে অনুপ্রেরিত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাদের প্রত্যেকের পক্ষেই দিব্য-প্রেরণার সম্ভাবনা আছে। আর ইহাই হইল ধর্ম। এই-সকল বিপদ্-বিভ্রম, প্রহেলিকা ও ভণ্ডামি এবং অতিরিক্ত দাবী পরিহার করুন; ধর্মতথ্যগুলিকে প্রত্যক্ষ করুন, এবং ধর্মবিজ্ঞানের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে আসুন। ধর্ম মানে কতকগুলি মতবাদ ও বিধিনিষেধ স্বীকার করা, বিশ্বাস করা, গীর্জা বা মন্দিরে যাওয়া অথবা কোন বিশেষ গ্রন্থ অধ্যয়ন করা নয়। আপনি কি ঈশ্বরকে দেখিয়াছেন? আপনার কি আত্মদর্শন হইয়াছে? যদি না হইয়া থাকে, আপনি কি সেজন্য প্রয়াস করিতেছেন? ইহা এখনই—এই বর্তমানেই লভ্য, ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে অপেক্ষা করিতে হইবে না। ভবিষ্যৎ তো সীমাহীন বর্তমান ব্যতীত আর কিছু নয়। যাবতীয় সময় একটি মুহূর্তের পুনরাবর্তন ব্যতীত আর কি? ধর্ম এখানে এখনই আছে, এই বর্তমান জীবনেই রহিয়াছে।
আর একটি প্রশ্ন এইঃ মানব জীবনের লক্ষ্য কি? বর্তমানে প্রচার করা হইতেছে যে, মানুষ ক্রমেই উন্নত হইতেছে; অনন্ত প্রগতি-পথের সে যাত্রী; এই উন্নতিলাভের কোন নির্দিষ্ট সীমা বা লক্ষ্য নাই। সর্বদা সে কোন কিছুর দিকে ক্রমেই অগ্রসর হইতেছে, অথচ লক্ষ্যে সে কোন কালেই পৌঁছিবে না—এ-কথার অর্থ যাহাই হউক, ইহা যত বিস্ময়করই হউক না কেন, শুনিলেই মনে হয় ইহা অত্যন্ত অসম্ভব ব্যাপার। সরলরেখা অবলম্বনে কোন প্রকার গতি কি সম্ভব হয়? কোন সরলরেখাকে অনন্তরূপে প্রসারিত করিলে ঐ রেখাটি এক বৃত্তে পরিণত হয়, যেখান হইতে রেখাটি প্রসারিত হইয়াছিল, আবার সেই বিন্দুতে ফিরিয়া আসে। যেখান হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, সেখানেই ফিরিয়া যাইতে হইবে। এবং যেহেতু ঈশ্বর হইতেই আপনার যাত্রারম্ভ হইয়াছে, সেহেতু তাঁহাতেই ফিরিয়া যাইতে হইবে। তাহা হইলে আর কি রহিল? রহিল আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি। অনন্তকাল ধরিয়া আপনাকে এই-সকল আনুষঙ্গিক কর্ম করিয়া যাইতে হইবে।
আরও একটি প্রশ্ন আছে। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদিগকে কি নূতন নূতন ধর্মতত্ত্ব আবিষ্কার করিতে হইবে? হাঁ-ও বটে, না-ও বটে। প্রথমতঃ ধর্ম সম্বন্ধে আর নূতন কিছু জানা সম্ভব নয়; তাহার সবটুকুই জানা হইয়া গিয়াছে। পৃথিবীর সকল ধর্মেই দেখা যায়, এই দাবী করা হইয়াছে যে, আমাদেরই মধ্যে কোথাও একটি মিলন-ভূমি আছে। যেহেতু ঈশ্বরের সহিত আমরা অভিন্ন, অতএব ঐ অর্থে আর কোন অগ্রগতি সম্ভব নয়। জ্ঞানের অর্থই হইল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য দর্শন করা। আমি আপনাদিগকে বিভিন্ন নর-নারীরূপে দেখিতেছি—ইহাই বৈচিত্র্য। যখন আপনাদের সকলকে গোষ্ঠীভুক্ত করিয়া একত্র মানব বলিয়া ভাবিব, তখনই তাহা বিজ্ঞান-জাতীয় জ্ঞানে পরিণত হইবে। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ রসায়ন-বিজ্ঞানের কথা ধরুন; রাসায়নিকেরা সমগ্র জ্ঞাত বস্তুকে মূল ভৌতিক উপাদানে পরিণত করিতে সচেষ্ট আছেন এবং সম্ভব হইলে তাঁহারা এমন একটিমাত্র পদার্থ আবিষ্কার করিতে চান, যাহা হইতে এই বিবিধ পদার্থের উৎপত্তি দেখান যাইতে পারে। হয়তো এমন সময় আসিবে, যখন তাঁহারা উহা আবিষ্কার করিতে পারিবেন। উহাই হইবে সমস্ত পদার্থের মূল উপাদান। সেখানে উপনীত হইলে তাঁহারা আর অগ্রসর হইতে পারিবেন না; তখন রসায়ন-বিজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করিবে। ধর্মবিজ্ঞান সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা চলে। আমরা যদি এই পূর্ণ ঐক্য আবিষ্কার করিতে পারি, তাহা হইলে আর অধিকতর উন্নতি সম্ভব হইবে না। যখন আবিষ্কৃত হইল, ‘আমি ও আমার পিতা অভিন্ন’ তখনই ধর্ম সম্বন্ধে শেষকথা বলা হইয়া গিয়াছে—তারপর বাকী রহিল শুধু খুঁটিনাটি। প্রকৃত ধর্মে—অন্ধবিশ্বাসবশতঃ কোন কিছু বিশ্বাস করা বা মানিয়া লওয়ার স্থান নাই। কোন ধর্মপ্রচারক মহাত্মা এরূপ প্রচার করেন নাই। অধঃপতনের সময়ে ইহা আসিয়া জোটে। বুদ্ধিহীন ব্যক্তিরা কোন কোন ধর্মনেতাদের অনুসরণকারী বলিয়া ভান করে, এবং তাঁহাদের কোন ক্ষমতা না থাকিলেও তাঁহারা মানবসমাজকে অন্ধবিশ্বাস শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন। কি বিশ্বাস করিবে তাহারা? অন্ধবিশ্বাস করার অর্থ হইল মানবাত্মার অধঃপতন। নাস্তিক হইতে চাও তো তাহাই হও; কিন্তু বিনা প্রশ্নে কোন কিছু গ্রহণ করিবে না। মানবের আত্মাকে পশুত্বের স্তরে নামাইবে কেন? তোমরা যে ইহাতে শুধু নিজেদেরই অনিষ্ট করিতেছ তাহা নয়, তোমরা সমাজেরও ক্ষতি করিতেছ, এবং যাহারা তোমাদের পরে আসিবে, তাহাদের পথ বিপদসঙ্কুল করিতেছ। উঠিয়া দাঁড়াও, বিচার কর, অন্ধবিশ্বাসের অনুবর্তী হইও না। ধর্মের অর্থ হইল—তদাকারকারিত হওয়া বা হইতে চেষ্টা করা, শুধু বিশ্বাস করা নয়। ইহাই ধর্ম; আর তুমি যখন সেই অবস্থা প্রাপ্ত হইবে, তখনই ধর্মলাভ করিবে। তাহার পূর্বে তুমি পশু অপেক্ষা উচ্চতর নও। মহাত্মা বুদ্ধ বলিয়াছেন, ‘শুনিবামাত্র কিছু বিশ্বাস করিও না; বংশানুক্রমে কোন মতবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ বলিয়াই তাহাতে বিশ্বাস করিও না; অপরে যেহেতু নির্বিচারে বিশ্বাস করিতেছে, সেহেতু কোন কিছুতে আস্থা স্থাপন করিও না; কোন এক প্রাচীন ঋষি বলিয়াছেন বলিয়া কোন কিছু মানিয়া লইও না; যে-সকল তত্ত্বের সহিত নিজেকে অভ্যাসবশে জড়াইয়া ফেলিয়াছ, তাহাতে বিশ্বাস করিও না; শুধু আচার্য ও গুরুবাক্যের প্রমাণবলে কোন কিছু মানিয়া লইও না। বিচার ও বিশ্লেষণ কর, এবং যখন ফলগুলি যুক্তির সহিত মিলিয়া যাইবে, এবং সকলের পক্ষে হিতকারী হইবে, তখন তাহা গ্রহণ কর এবং তদনুযায়ী জীবন যাপন কর।’