দার্শনিক মতে সৃষ্টিতত্ত্ব
সভ্যতার উষাকাল হইতেই মানুষ ভাবিত, এই অসংখ্য বৃক্ষ-লতা ও জীবসমাকুল পৃথিবী সৃষ্টি করিল কে? চন্দ্র-সূর্য, আকাশ ও নক্ষত্র সৃষ্টি করিল কে? নিত্য নূতন সৃষ্টি ও পুরাতনকে রক্ষা করে কে?
প্রশ্ন যেমন হইল, তেমন সমাধানও হইল। মানুষের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী এক জীব সৃষ্টি করিয়াছেন –মানুষ, পশু, পাখি, মাটি-পাথর, আকাশ, বাতাস সবই। উহা রক্ষা ও প্রতিপালন তিনিই করিয়া থাকেন। কেহ বলিল, সৃষ্টিকর্তা এক; আবার কেহ বলিল, অনেক। যাক সেই কথা। তাহার বা তাহাদের নাম রাখা হইল ‘ঈশ্বর’ বা ‘দেবতা।
গেল বেশ কিছুদিন। মানুষের সন্ধানী মন আবার জানিতে চাহিল, ওইসব সৃষ্ট হইল কি দিয়া? আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি, রকমারি জীবসমাকুল পৃথিবীর উপাদান কি?
জগত সৃষ্টি কে করিয়াছেন, এই প্রশ্নের সমাধান যত সহজে হইয়া গেল, কি দিয়া সৃষ্ট হইয়াছে, এই প্রশ্নের সমাধান. তত সহজে হইল না। ‘কে’ ও ‘কি দিয়া’, এই উভয় প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করিয়াছে ‘দর্শন’। কিন্তু সকল দার্শনিক একমত হইতে পারেন নাই। ইহাতে বহু দার্শনিক বহু মতবাদ প্রচার করিয়াছেন এবং বহু দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে। কেননা কোনো দার্শনিকই ধর্মজগতের আবহাওয়ার আওতার বাহিরের মানুষ ছিলেন না। তথাপি দার্শনিকগণ সাধারণত দুই শ্রেণীর –ধর্মীয় আওতাভুক্ত ও মুক্ত। এইখানে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে পাশ্চাত্য দেশের কয়েকজন দার্শনিকের মতবাদের আলোচনা করিতেছি।
থেলিস (জন্ম খ্রী. পূ. ৬৪০) –ইনি গ্রীস দেশের আদি দার্শনিক। ইনি বলিতেন, “জলই সংসারের সার-সর্বস্ব। জল হইতেই এই বিশ্বসংসারের সৃষ্টি হইয়াছে; জলেই সংসার লয়প্রাপ্ত হইবে।”
আনাক্সিমান্দর (খ্রী. পূ. ৬১০–৫৪৬) –ইনি দার্শনিক থেলিসের শিষ্য। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে ইহার মত –“বিশ্ব অনন্তকাল বিদ্যমান। তাহার অংশবিশেষের পরিবর্তন সাধিত হইতেছে মাত্র। অনন্তকাল হইতে সকল বস্তুর উদ্ভব। অনন্তেই সকল বস্তু বিলীন হইবে।” তাঁহার মতে, জগতের মূল পদার্থ নিত্য, অসীম এবং তাহা নির্দেশ করা যায় না।
পিথাগোরাস (জন্ম খ্রী. পূ. ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ)– ইতালির স্যামজ দ্বীপের অধিবাসী এই দার্শনিক সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে বলিতেন, “বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে এক অগ্নিপিণ্ড বিদ্যমান আছে। দশটি স্বর্গীয় গ্রহ বা উপগ্রহ তাহার চতুর্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তদ্বারা শীত, উত্তাপ প্রভৃতির সঞ্চারে সৃষ্টিকার্য সমাহিত হইতেছে। সামঞ্জস্যই জগতের অস্তিত্ব। সেই কেন্দ্রীভূত অগ্নিপিণ্ডই তাপ, আলোক বা প্রাণ স্থানীয়। জীবাত্মা মাত্রই সেই অগ্নিপিণ্ডের বা তেজের অংশবিশেষ। সর্বপ্রাণাধার সেই তেজ বা অগ্নিপিণ্ডই ঈশ্বর। ঈশ্বর প্রথমে অব্যবস্থাপিত জড় পদার্থ সহ বিদ্যমান ছিলেন। তাঁহার শক্তিপ্রভাবে তৎসমুদয় বিচ্ছিন্ন হয়। বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি পৃথকভাবে অবস্থিত আছেন।”
আত্মার দেহান্তর গ্রহণ পিথাগোরাস স্বীকার করিতেন। ঈশ্বরকে মনঃস্বরূপ বলিয়া তিনি প্রচার করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিতেন, “সংসারে সকলের মধ্যেই তিনি (ঈশ্বর) বিদ্যমান। প্রত্যেক মানুষের আত্মাই তাহার অংশ।” পরবর্তী অনেক দার্শনিক পিথাগোরাসের মত মান্য করিয়াছিলেন এবং কোনো কোনো ধর্মবেত্তাও।
পিথাগোরাসের বিশ্বরূপ ও সৃষ্টিতত্ত্ব আধুনিক সৌরজগত ও সৌরবিজ্ঞানের সহিত বহুলাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ।
জেনোফেনস (খ্রী. পূ. ৫৬০–৫৪০) –এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত কলফো নগরে দার্শনিক জেনোফেস্ জন্মগ্রহণ করেন। তাহার মতে, “এই বিশ্ব যেভাবে অবস্থিত দেখিতে পাইতেছি, সেইভাবেই চিরদিন বিদ্যমান আছে এবং থাকিবে।” জেনো চারি ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করিতেন। তাহার মতে, “উত্তাপ ও আর্দ্রতা, শৈত্য ও শুষ্কতা –এই চারি ভূতে সংসার উৎপন্ন। মনুষ্য মৃত্তিকা হইতে নির্মিত। চারি ভূতের সংমিশ্রণে তাহার প্রাণশক্তি সঞ্চারিত।” জগতের সৃষ্টি ও স্থিতি বিষয়ে বৌদ্ধরা জেনোর মতানুসারী।
হিরাক্লিটাস (জন্ম খ্রী. পূ. ৫০৩) –ইনি এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত ইফেসাস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। হিরাক্লিটাসের দার্শনিক গ্রন্থে প্রকাশ, “তেজ (আগুন) হইতেই পৃথিবীর সৃষ্টি; আবার তেজেই বিশ্বের লয়। তেজ বা অগ্নি সূক্ষ, অনন্ত, অপরিবর্তনীয় এবং চির গতিবিশিষ্ট। অগ্নিরই স্থূলতর অংশ বায়ু; বায়ু হইতে জল এবং জল হইতে পৃথিবীর উৎপত্তি। আত্মা বা প্রাণ জ্বলনশীল অথবা বায়বীয় পদার্থ।”
এম্পিডোকলস (খ্রী. পূ. ৪৫০) –ইনি সিসিলি দ্বীপের এগ্রিজেন্টাস নগরের অধিবাসী। ঘঁহার মতে, “বায়ু, জল, অগ্নি, পৃথিবী (মাটি) — এই চারি পদার্থের সংযোগ-বিয়োগেই এই পৃথিবীর সৃষ্টি হইয়াছে। প্রথমে ঐ চারি মূল পদার্থ একরূপ মিশ্রভাবে অবস্থিত থাকে। উহারা পরস্পর ভালোবাসা (আকর্ষণ) সূত্রে আবদ্ধ ছিল। যখন পরস্পরের মধ্যে ঘৃণার (বিকর্ষণের) সঞ্চার হইল, তখনই উহারা বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল। সেই বিচ্ছেদের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে পৃথিব্যাদি বিভিন্ন সামগ্রীর সৃষ্টিক্রিয়া সাধিত হইয়াছে।” বিশ্বসৃষ্টির মৌলিক উপাদান চারিটি, ইহা মুসলিম জগতেও স্বীকৃত। যথা –আব, আতস, খাক, বাত।
আনাক্সীগোরাস (জন্ম খ্রী. পূ. ৫০০) –আইওনিয়ার অন্তর্গত ক্রেজোমিনি নগরে হঁহার জন্ম হয়। সৃষ্টি সম্বন্ধে তাঁহার মত –“আদিতে অনন্তকাল হইতে সকল পদার্থই পরমাণুরূপে বিদ্যমান ছিল। সেই অসংখ্য পরমাণুপুঞ্জ এক অনন্ত শক্তি দ্বারা পরিচালিত হইয়া নানা আকার ধারণ করিতেছে। সেই অনন্ত শক্তির নাম ‘নৌস’। নৌস অবিমিশ্র ও সূক্ষ্ম, অনন্ত শক্তিসম্পন্ন এবং সর্বজ্ঞানাধার। আপনা-আপনি অন্ধ শক্তির দ্বারা পৃথিবীর কোনো বস্তু সৃষ্ট হয় নাই; নৌসই সকল সামগ্রীর সর্ববিধ আকৃতির সংগঠক। আকাশ স্থূল-পদার্থ-নির্মিত –খিলানের ন্যায় অবস্থিত। নক্ষত্রসমূহ এক একটি প্রস্তরপিণ্ড; কোনোরূপ পার্থিব আক্ষেপবশত ঊর্ধে উৎক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছে। আকাশে গিয়া ইথারের অগ্নিসংযোগে তাহারা প্রতিনিয়ত জ্বলিতেছে।” সূর্যকে তিনি প্রকাণ্ড জ্বলন্ত প্রস্তরখণ্ড বলিয়া বিশ্বাস করিতেন। তিনি বলিতেন, “সে প্রস্তরখণ্ড গ্রীসের পেলোপোনিসাস নগর অপেক্ষাও বৃহত্তর।” তাহার মতে, “মনই সকল বস্তুর জনয়িতা; প্রথমে সকলই বিশৃঙ্খল ছিল, মন সকলকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। মন অনন্ত শক্তিসম্পন্ন। মনই নৌস।”
ডেমক্রিটাস (খ্রী. পূ. ৪৬০)– গ্রেস প্রদেশের অব্দেরা নগরে ডেমক্রিটাস জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা ও নানাদেশ পর্যটনান্তে দেশে ফিরিয়া একমনে দার্শনিক চিন্তায় কালাতিপাত করিতে পারিবেন বলিয়া তিনি আপনার চক্ষুদ্বয় উৎপাটন করিয়াছিলেন এবং অন্ধ হইয়া একমনে দার্শনিক চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন, “পরমাণু এবং গতি, এতদুভয়ের উপর সৃষ্টি নির্ভর করিতেছে। কোনো উচ্চ শক্তি ইচ্ছা করিয়া যে পরমাণুসমূহকে একত্র করিতেছে, তাহা নহে; আপনা-আপনিই নৈসর্গিক নিয়মে গতি দ্বারা চালিত হইয়া পরমাণুসমূহ সম্মিলিত ও বিচ্ছিন্ন হইতেছে; আর তাহাতেই সৃষ্টিকার্য সাধিত হইতেছে।” অনেকের বিশ্বাস –ডেমক্রিটাস পাশ্চাত্য দেশে নিরীশ্বরবাদের প্রবর্তন করিয়া যান। ইনি পরমাণুবাদ তত্ত্বের আবিষ্কর্তা বলিয়া প্রসিদ্ধ। আবার কেহ কেহ বলেন যে, পরমাণুবাদ তত্ত্বের আবিষ্কর্তা লিউঁকিগ্লাস।
লিউকিপ্পাস (খ্রী. পূ. ৪৩০) –সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে লিউঁকিপ্পাসের মত এইরূপ — “বিশ্ব অনন্ত, ইহার কোনোও অংশ শূন্যতাময়, কোনোও অংশ পরমাণুপূর্ণ। পরমাণুসমূহ শূন্যস্থানে বিক্ষিপ্ত হইলে পরস্পর প্রতিহত হয় এবং তাহাদের মধ্যে ভীষণ সংঘর্ষ চলিতে থাকে। তাহাতে শূন্যসাগরে বিষম আক্ষেপ উপস্থিত হয়। ফলে, এক এক জাতীয় পরমাণু পরস্পর মিলিত হয় এবং তাহাতে তাহাদের এক এক প্রকার আকৃতি গঠিত হইয়া যায়। আপনা-আপনি নিয়তিবশে এই বিক্ষেপ ও মিলন-ব্যাপার সংঘটিত হইতেছে। ইহার সহিত কোনোও দৈবশক্তির সম্বন্ধ নাই।”
সক্রেটিস ও প্লেটো (খ্রী. পূ. ৪৬৯ ও ৪২৯) –সক্রেটিস ও প্লেটো, উভয়েই এথেন্স নগরের অধিবাসী ছিলেন। গ্রীসদেশীয় দার্শনিকগণের মধ্যে সক্রেটিস প্রখ্যাতনামা। তিনি ‘জ্ঞান’কেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। তাহার মতে, “ন্যায়পরতাই মানুষের ধর্ম।” সুতরাং ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তৃত্বে বা অস্তিত্বে তিনি সন্দিহান ছিলেন। তিনি দেশমান্য দেবতাগণের পূজা করিতেন না। তাহার মতের অনুসরণ করিয়া যুবকগণ বিপথগামী হইতেছে, এই অজুহাতে সক্রেটিস রাজদ্বারে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। ত্রিশ দিবস কারাগারে আবদ্ধ থাকিয়া তিনি বিষপানে প্রাণত্যাগ করেন। দেববিরোধিতার অপরাধে এরূপ অমানুষিক হত্যাকাণ্ড পাশ্চাত্য দেশে ইহা নূতন নহে। দার্শনিক আনাক্সাগোরাস দেব-দেবীর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেন বলিয়া তাহার প্রাণদণ্ডের আদেশ হয় এবং তাহার শিষ্য পেরিক্লেসের বাগ্মিতায় বিচারপতি মুগ্ধ হইয়া আনাক্সাগোরাসের প্রাণদণ্ড রহিত করিয়া হেলেস্পন্ট দ্বীপে নির্বাসিত করেন। সেখানে নির্বাসিত থাকিয়া তিনি ৭৩ বৎসর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। দেব-দেবীর অনস্তিত্ব বিষয়ে শিক্ষা প্রচার করিতেন বলিয়া দার্শনিক প্রোটাগোরাসের প্রাণদণ্ড হইয়াছিল।
সক্রেটিসের শিষ্যগণের মধ্যে প্লেটোর নাম সর্বপ্রসিদ্ধ। মুসলমানগণ ইহাকে ‘আফলাতুন’ বলিয়া থাকেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে ইহার মতের সারমর্ম এই — পৃথিবী চিরদিন বিদ্যমান আছে; ইহা সেই মঙ্গলময়ের প্রতিরূপ মাত্র। ইহার অন্তর্গত ভূতসমূহ অনন্তকাল হইতেই পরিবর্তনশীল; পরিবর্তন প্রবাহে সৃষ্টিক্রিয়া সংসাধিত হইতেছে।
আরিস্টটল (খ্রী. পূ. ৩৮৪) –গ্রীসের উপনিবেশ স্টেজেরা নামক স্থানে আরিস্টটলের জন্ম হয়। সৃষ্টি প্রকরণ সম্বন্ধে তাঁহার মত এই –“কেবল স্বর্গ ও পৃথিবী বলিয়া নহে; চেতন, অচেতন সমস্ত বস্তুই অনন্তকাল হইতে পৃথিবীতে বিদ্যমান আছে। এই বিশ্ব এক স্বর্গীয় আত্মার প্রতিরূপ। সেই আত্মা কখনও নিশ্চেষ্ট নহেন। তিনি শক্তি ও কার্য স্বরূপ; বিশ্বের গতি, সৃষ্টি এবং আকৃতির মূলে সেই স্বর্গীয় আত্মার প্রভাব চিরবিদ্যমান।” এই প্রসিদ্ধ দার্শনিকের মতে, “এই বিশ্ব আত্মার সৃষ্ট নহে; পরন্তু তাহা (আত্মা) হইতে উৎপন্ন। জাগতিক পদার্থ দশ প্রকার; যথা –দ্রব্য, পরিমাণ, গুণ, সম্বন্ধ, স্থান, সময়, অবস্থা, সামান্য, কার্য ও ভাব।” বলা বাহুল্য, এই কয়েকটি পদার্থের উপরই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় নির্ভর করিতেছে।
লেবনিজ (খ্রী. অ. ১৬৪৬) –ইনি জর্মন দর্শনের সৃষ্টিকর্তা বলিয়া কথিত হন। তিনি বলেন, “মন ও শরীরের কার্য, দুইটি স্বাধীনভাবে পরিচালিত কলের কার্য বলিয়া মনে করিতে হইবে। সেসকল পূর্বব্যবস্থাপিত একটি নিয়মানুসারে পরিচালিত হইতেছে। ব্যবস্থাপক ঈশ্বরও হইতে পারেন। কিন্তু তিনি নিয়ম করিয়া দিয়া গিয়াছেন মাত্র। এখন যে তিনি কোনো কাজ করাইতেছেন, তাহা বলা যায় না। পক্ষান্তরে হল্যাণ্ডের দার্শনিক স্পিনোজা ঈশ্বরকে ‘সর্বকারণকারণ বলিয়া স্বীকার করিতেন। দার্শনিকদের মধ্যে এরূপ বিপরীত মতবাদ আরও আছে। আরিস্টটল প্রবর্তিত সম্প্রদায়ের মতে, “পৃথিবীর গতি নাই, পৃথিবী নিশ্চল ও সীমাবদ্ধ।” কিন্তু ব্রুনো ঘোষণা করেন, “পৃথিবী ঘূর্ণিত হইতেছে; বিশ্ব অসীম এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনন্তকাল ধরিয়া পরিবর্তন চলিয়াছে।”[৩]
সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে পাশ্চাত্যের মাত্র কয়েকজন দার্শনিকের মতবাদসমূহের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হইল। ইহা ভিন্ন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শত শত দার্শনিকের শত শত মতবাদ দৃষ্ট হয়। উহাতে কোথায়ও আছে একাধিক দার্শনিকের মতের মিল, আবার কোথায়ও গরমিল, হয়তোবা বৈপরীত্যও। তথাপি অধিকাংশ দার্শনিকের একটি শেষ সিদ্ধান্ত আছে। তাহা এই — “এক অনাদি, অনন্ত, গরীয়ান ‘সৎ’ নিজেকে নানাভাবে ব্যক্ত করিতেছে– মানুষের দেহে, মনে, সমাজে, তাহার দীর্ঘ ইতিহাসে, জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, বৃক্ষে, লতায়, পুষ্পে; সুন্দর-অসুন্দর এবং সৎ অসৎ ব্যাপিয়া সে আত্মপ্রকাশ করিতেছে; আর মানুষের মনেও সেই প্রকাশের মহিমা ধ্যান করিবার মতো শক্তিরূপে বিরাজ করিতেছে। এই সৎ এক এবং অদ্বিতীয়; বহুধা ব্যক্ত, কতক ব্যক্ত এবং কতক অব্যক্ত।”
————
[৩. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ৫৬–৬৬।]