দুই দিন পর মিঠুন আমাদের স্কুলের পেয়ারাগাছের ডালে বসে দাঁড়ি কমা সহ তার লম্বা স্টোরিটা বলল। (এই পেয়ারাগাছটার মত কপাল খারাপ কোনো পেয়ারাগাছ পৃথিবীতে নাই। এই গাছে কোনো পেয়ারা কখনো বড় হতে পারে নাই–পেয়ারার মত দেখতে হওয়ার আগেই কেউ না কেউ খেয়ে ফেলেছে।) মিঠুন আগে কখনো গাছে ওঠেনি, একটা গল্প বলার জন্যে কেন পেয়ারাগাছে উঠতে হবে সেটাও সে প্রথমে বুঝতে পারেনি। নিচের থেকে ঠেলে এবং উপর থেকে টেনে তাকে পেয়ারাগাছে তুলতে হয়েছে। একবার আরাম করে বসার পর সে অবশ্যি স্বীকার করেছে গল্প বলার জন্যে এই জায়গাটার তুলনা নাই।
মিঠুনের গল্পে অনেক বৈজ্ঞানিক বকর বকর আছে যার কোনোটা আমরা কিছুই বুঝি নাই। বৈজ্ঞানিক বকর বকর বাদ দিলে গল্পটা এরকম :
আমার নাম মিঠুন, ভালো নাম কাজী রকিবুল আলম। আমার বাবার নাম কাজী জাহিদুল আলম। মা নুসরাত জাহান আমার দাদা কাজী জাহাঙ্গীর, দাদী জোবেদা খানম। আমার নানা–
(এ রকম জায়গায় আমরা মিঠুনকে থামালাম। তার দাদা দাদী নানা নানীর নাম জানলেও আমাদের ক্ষতি নাই। মিঠুন একটু অসন্তুষ্ট হল মনে হল। বলল, “তোমরা না একটু আগে বলেছ দাড়ি কমা সহ বলতে হবে। এখন যখন বলছি তখন বলতে দিচ্ছ না।” আমি বললাম, “দাদা দাদী নানা নানীর নাম, চাচা-চাচী, ফুপা-ফুপু-মামা-মামী কিংবা খালা-খালুর নাম দাড়ি কমার মাঝে পড়ে না। দাড়ি কমা সহ বলার অর্থ হচ্ছে গল্পটি বলার সময়
এরকম জায়গায় ঝুম্পা আমাকে ধমক দিয়ে বলল, “ইবু, তুই বকর বকর করবি না। চুপ করে দেখি।” কাজেই আমি চুপ করে গেলাম আর মিঠুন আবার শুরু করল।)
আমার বাসায় আমি ছাড়া আছে আমার আপু। আমার আপু হচ্ছে পারফেক্ট একজন মানুষ। লেখাপড়ায় ভাল, সব সাবজেক্টে জি.পি.এ ফাইভ, গান গাইতে পারে, নাচতে পারে, গলা কাপিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। ছবি আঁকতে পারে, ডিবেট করতে পারে। এমন কী ভালো ব্যাডমিন্টনও খেলতে পারে। বাসায় যখন কোনো গেস্ট আসে সে তাদের সাথে যতক্ষন দরকার মিষ্টি মিষ্টি করে কথাও বলতে পারে। আমার আব্দু আম্মু আমার বোনকে নিয়ে খুবই খুশী, আমাকে প্রত্যেকদিন কম করে হলেও দশবার করে বলে, “তোর বোন এতো ভালো আর তুই এরকম অপদার্থ বের হলি কেমন করে?”
(এরকম জায়গায় সবাই নিজেদের কথা বলতে শুরু করল, দেখা গেল সবার জীবনে মিঠুনের বড় বোনের মত কেউ একজন আছে যার কারণে তাদের জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুধু আমায় কিছু বলতে হল না কারণ আমার সেরকম কেউ নাই, আমি একা। আমার সাথে আছে আমার বাবা যার আমাকে নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নাই।
সবাই নিজের দুঃখের কথা বলে পরিচিত অন্যান্যদের দুঃখের কথা বলতে শুরু করল তখন আমি ধমক দিয়ে বললাম, “তোরা ঘ্যানঘ্যান করা থামাবি? মিঠুনের কথাটা একটু শুনি?” তখন মিনি আবার শুরু করল।)
কথাটা ভুল না যে আমি মোটামুটি অপদার্থ। অংক আর বিজ্ঞান ছাড়া অন্য সব সাবজেক্টে গোল্লা পেতাম। আস্তে আস্তে আমি অংক আর বিজ্ঞানেও গোল্লা পেতে আরম্ভ করলাম তার কারণ পরীক্ষার খাতায় আমি যেটা লেখি সেটা স্যার আর ম্যাডামেরা বুঝতে পারে না। যেমন মনে কর পরীক্ষায় এসেছে অনু পরমানু কীভাবে তৈরী হয়। সবাই লিখেছে পরমানুর ভিতরে থাকে নিউক্লিয়াস বাইরে থাকে ইলেকট্রন এই সব হাবিজাবি। আমি লিখেছি কোয়ার্কের কথা। আপ ডাউন কোয়ার্ক আর তাদের এন্টি পার্টিকেল দিয়ে সবকিছু তৈরী হয়েছে। চার্জ হচ্ছে ফ্রাকশনাল–
(আমরা খুব অস্বস্তির সাথে আবিষ্কার করলাম এরকম জায়গায় মিঠুন তার গল্প বলার বদলে বিজ্ঞান নিয়ে বকর বকর করা শুরু করেছে। আমরা কিছুক্ষণ সহ্য করলাম, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম তারপর বাধ্য হয়ে ঝুম্পা মিঠুনকে থামাল। বলল, “মিঠুন, তোর বিজ্ঞানের ভ্যাদর ভ্যাদর শোনার জন্যে আমরা বসি নাই।”
“ভ্যাদর ভ্যাদর?” মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “ভ্যাদর ভ্যাদর বলে যে একটা শব্দ আছে সেইটাও আমি জানতাম না।”
ঝুম্পা বলল, “আছে। তুই এখন যেটা করছিস সেটা হচ্ছে ভ্যাদর ভ্যাদর। ভ্যদির ভ্যাদর ছাড়াও আরো ইন্টারেস্টিং শব্দ। আছে, তুই চাইলে তোকে শিখিয়ে দেব। এখন ভ্যাদর ভ্যাদর। করা বন্ধ করে তোর গল্পটা বল।”
বিজ্ঞানের কথা বলতে না দেওয়ার জন্যে মিঠুনের মুখটা একটু ভোঁতা হল কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার শুরু করল।)
আমার মনে যে সব প্রশ্ন তৈরি হয় আমি সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারি না। প্রথম প্রথম কেউ কেউ উত্তর দিতে পারত, আস্তে আস্তে আর কেউ পারে না। তখন আমি বই পড়া শুরু করলাম, বেশীর ভাগ ইংরেজী বই সেগুলো পড়ে পড়ে আমার ইংরেজীটা ভালো হয়ে গেল। পরীক্ষায় ইংরেজীতে ভালো মার্কস পেতে শুরু করলাম। ইন্টারনেটে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতো, বেশীর ভাগ ভুলভাল। তবে দেশে বিদেশে অনেক ইউনিভার্সিটির টিচার আছে ই-মেইলে তাদের কাছে প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দিতো। সেইভাবে আমি অনেক কিছু শিখে গেলাম।
একসময় আবিষ্কার করলাম আমাদের ইউনিভার্সের মাত্র চার ভাগ সম্পর্কে আমরা জানি, বাকী ছিয়ানব্বই ভাগ সম্পর্ক আমরা কিছুই জানি না।
(এই কথাটা বলে সে চোখ বড় বড় করে থেমে গেল, সে আশা করছিল এখন তার কথা শুনে আমরাও চোখ কপালে তুলে বলব, “বলিস কী?” “অসম্ভব?” “হতেই পারে না।” কী আশ্চর্য!” কিন্তু আমরা তার কিছুই করলাম না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শতকরা চার ভাগ সম্পর্কে জানলেই কী আর চল্লিশ ভাগ সম্পর্কে জানলেই বা কী? আমাদের কী আসে যায়?
আমাদের দিক থেকে কোনো উৎসাহ না পেয়ে মিঠুন একটু মনমরা হয়ে গেল। মনমরা হয়েই সে আবার বলতে শুরু করে!)
এই ইউনিভার্সের মাত্র চারভাগ পদার্থের কথা আমরা জানি, বাকী ছিয়ানব্বই ভাগ পদার্থ আছে কিন্তু আমরা সেটা কখনো চোখে দেখি নাই। বৈজ্ঞানিকদের ধারণা সেটা আমাদের চারপাশেই আছে, কিংবা কে জানে আমরা হয়তো সেই পদার্থের ভিতরেই ডুবে আছি কিন্তু সেটা দেখতে পাচ্ছি না।
(মিঠুন আবার একটু থামল, আমরা অবাক হয়ে কিছু একটা বলি কী না–দেখার জন্যে। আমরা কিছু বললাম না, অবাক হওয়ায় জন্যে বিষয়টা বুঝতে হয়। আমরা বুঝি নাই তাই অবাক হই নাই।)
তখন আমার মাথার মাঝে একটা আইডিয়া এল। আমাদের চারপাশে যে অদৃশ্য পদার্থ আছে সেটা কী অন্য কোনোভাবে দেখা সম্ভব? তোরা সবাই জানিস সাধারণ যে পদার্থ আছে সেগুলো যদি অনেক বেশী হয়ে যায় তাহলে তার নিজের আকর্ষণে সবকিছু ভেঙে চুরে কোনো একসময়ে সেটা ব্ল্যাক হোল হয়ে যায়।
(আমরা কখনো ব্ল্যাক হোল কিংবা হোয়াইট হোল কিংবা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট হোলের কথা শুনি নাই। কিন্তু এখন সেটা প্রকাশ করলাম না। মিঠুনকে খুশী করার জন্যে মাথা নাড়লাম। মাথা নাড়াটা মনে হয় একটু বেশী হয়ে গেল তাই মিঠুন কেমন সন্দেহ করল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ ইবু কেমন করে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয় বল দেখি?”
আমি পড়লাম বিপদে। মাথা চুলকে বললাম, “অ্যাঁ অ্যাঁ ইয়ে, মানে–
ঝুম্পা আমাকে রক্ষা করল। মিঠুনকে ধমক দিয়ে বলল, “তোর বৈজ্ঞানিক ভ্যাদর ভ্যাদর শুনেই কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে আর এখন তুই পরীক্ষা নেওয়া শুরু করবি? তুই প্রশ্ন করবি আর আমাদের উত্তর দিতে হবে? পাশ ফেল হবে? পেয়েছিসটা কী তুই?”
মিঠুন তখন আরও মনমরা হয়ে গেল। মনমরা হয়ে বলতে শুরু করল।)
আমাদের পরিচিত পদার্থ দিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরী করা এতো সোজা না। চাপ দিয়ে যদি পৃথিবীটাকে ব্ল্যাক হোল বানাতে চাই তাহলে পৃথিবীটার সাইজ হবে পিপড়ার মতো। কী দিয়ে চাপ দিব? কেমন করে চাপ দিব? কিন্তু বাকী যে ছিয়ানব্বই ভাগ পদার্থ সেটা সম্পর্কে আমরা জানি না। তার সস্তুর ভাগ হয়তো ডার্ক এনার্জী কিন্তু চল্লিশ ভাগ তো অন্যরকম পদার্থ। সেই অন্যরকম পদার্থ দিয়ে একটা নতুন রকম ব্ল্যাক হোল বানানো সম্ভব? হয়তো তার শোয়ার্ডস চাইল্ড ব্যাসার্ধ হবে অন্য রকম।
(মিঠুন আবার চোখ বড় বড় করে আমাদের দিকে তাকাল, আশা করল আমরা অবাক হয়ে যাব। হতবাক হয়ে যাব। আমরা কিছু বুঝি নাই তাই হতবাক হই নাই। শুধু তাই না বগা তার মাড়ি এবং দাঁত বের করে বিকট ভাবে হাই তুলল। মিঠুন মনমরা ভাবে আবার শুরু করল।)
যেহেতু পৃথিবীর কেউই জানে না এটা কীভাবে করা যায় কেমন করে করা যায় তাই আমি ভাবলাম এইটা পরীক্ষা করে দেখা যাক। প্রথমে হাতুরী দিয়ে এই অদৃশ্য পদার্থকে বাড়ি দিয়ে দেখলাম কিছু করা যায় কী না। কোনো লাভ হল না তখন আমি ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি শুরু করলাম। ইন্টারনেটে অনেক গোপন সাইট আছে, বড় বড় সন্ত্রাসী আর জঙ্গীদের সাইট, আমি হ্যাক করে সেগুলোতে ঢুকে কেমন করে বোমা বানানো যায় সেটা শিখে ফেললাম।
(গল্পের এই জায়গায় আমরা সবাই নড়ে চড়ে বসলাম, বগা পর্যন্ত তার বিশাল একটা হাই গিলে ফেলে চোখ বড় বড় করে তাকাল। আমরা এক সাথে বললাম, “বোমা?” মিঠুন মাথা নেড়ে কথা বলতে শুরু করে।)
বোমা বানানো পানির মত সোজা কিন্তু বোমা বানানোর জন্যে যে মাল মশলা লাগে সেগুলো জোগাড় করা এতো সোজা না। আল্লুর ব্যাংক থেকে সিগনেচার জাল করে টাকা চুরি করা যায় কিন্তু আগে হোক পরে হোক ধরা।
পড়ে যাব। তখন আমার অক্সব্রীজ স্কুলের কথা মনে পড়ল।
অক্সব্রীজ স্কুল হচ্ছে পুরোপুরি ভূয়া স্কুল। শুধু বড়লোকের ছেলে মেয়েরা এই স্কুলে পড়ে আর তাদের কাছে এতো টাকা বেতন নেয় সেটা শুনলে তোর অবাক হয়ে যাবি?
(অন্য কেউ লক্ষ করল কী না জানি না আমি লক্ষ করলাম, মিঠুনকে আমরা তুই তুই করে বলছি কিন্তু সে আমাদের তুমি তুমি করে বলছিল। এই প্রথম সেও আমাদের তুই করে বলল।)
অক্সব্রীজ স্কুলের একটা ছেলের এক মাসের বেতন দিয়ে এই দেশের একটা ফেমিলির এক মাসের খরচ চলে যায়। আমি তাই হিসাব করে বের করলাম অক্সব্রীজ স্কুল এখন পর্যন্ত কতো টাকা বানিয়েছে। আমি ঠিক করলাম সেই টাকা থেকে কিছু টাকা আমার এই বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে খরচ করব।
(আমরা মিঠুনের কথা শুনে খুবই অবাক হলাম। একটা স্কুল কেন তার একজন ছাত্রকে বোমা বানানোর জন্যে টাকা দিবে? মিঠুনকে জিজ্ঞেস করতে হল না, সে নিজেই বলতে শুরু করল।)
অক্সব্রীজ স্কুল তো আমার গবেষণার জন্যে যে বোমা দরকার সেই বোমা বানানোর টাকা দিবে না। টাকাটা আনতে হবে খুবই কায়দা করে। সেটা করার জন্যে আমি প্রথমে সায়েন্স টিচারের সাথে খাতির করলাম। মানুষটা সাদাসিধে হাবাগোবা। বিজ্ঞানের ব’ও জানে না। ক্লাশে ভুলভাল যাই পড়ায় আমি জোরে জোরে মাথা নাড়ি। মাঝে মাঝে সোজা সোজা বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলি। আস্তে আস্তে তাকে একটু একটু বিজ্ঞান শিখাই, কঠিন অঙ্কগুলো করে দেই। কোন একটা কনফারেন্সে সে একটা পেপার জমা দিল, সেই পেপারে অনেক ভুলভাল ছিল আমি ঠিক করে দিলাম। কনফারেন্সে সেই পেপার পড়ে তার অনেক নাম হল। তখন তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি স্কুলের ল্যাবরেটরির একটা চাবি নিয়ে নিলাম। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম স্কুলে কম্পিউটারের ল্যাব তৈরির করার জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কম্পিউটার, সার্ভার, রাউটার, সুইচ, নেটওয়ার্কিং এসবের যন্ত্রপাতি কিনবে। আমি কম্পিউটার হ্যাক করে পুরা অর্ডারটা পাল্টে দিলাম। অক্সব্রীজ স্কুল জানতেও পারল না কম্পিউটার আর যন্ত্রপাতির অর্ডারের বদলে আমার বোমা বানানোর ক্যামিকেল অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে।
(এরকম জায়গায় আমরা সবাই প্রথমবার চোখ বড় বড় করে মিঠুনের দিকে তাকালাম। চশমা পরা শান্তশিষ্ট চেহারার একটা ছেলের মাথায় এরকম ফিচলে বুদ্ধি?)
আমি বুঝতে পারলাম আমার হাতে সময় খুব কম। বিকেলে বোমা বানানোর জন্যে ফার্টিলাইজার আর ক্যামিকেল ডেলিভারী দিয়েছে। আমি জানি সেই রাতেই যদি এক্সপেরিমেন্ট না করি তাহলে দেরী হয়ে যাবেআমি ধরা পড়ে যেতে পারি। কাজেই রাতের মাঝে সব ঠিক করে ফেললাম। দুই পাশে বিশাল বিস্ফোরকের স্তুপ। একসাথে ডোটানেট করলে তখন মাঝখানে প্রচণ্ড চাপ তৈরী হবে। চাপটাকে এক বিন্দুতে আনার জন্যে আমি দুইটা ডায়মন্ড ব্যবহার করলাম ডায়মন্ড সবচেয়ে শক্ত তাই ডায়মন্ড চাপ দেয়ার জন্যে সবচেয়ে ভালো।
(এরকম সময় ফারা মিঠুনকে থামাল, জিজ্ঞেস করল, “ডায়মন্ড মানে কী হীরা?” মিঠুন মাথা নাড়ল, তখন ফারা জানতে চাইল, “হীরা কোথায় পেলি?” মিঠুন মুখ সুঁচালো করে বলল যদি তার মাকে কোনোদিন বলে না দেয় তাহলে সে বলতে পারে। আমরা সবাই মাথা নেড়ে বললাম তার মাকে কখনো বলে দিব না।’ তখন মিঠুন আমাদেরকে তার ডায়মন্ডের গল্প শোনালো।)
আমার আম্মুর এক জোড়া ডায়মন্ডের কানের দুল আছে। আন্তু সেটা আম্মুকে কিনে দিয়েছে। ডায়মন্ড আর কাচ দেখতে একই রকম। তাই আমি নকল জুয়েলারীর দোকান থেকে এক জোড়া কানের দুল কিনে আনলাম। সেখানে আম্মুর ডায়মন্ডের মতো দেখতে কাচের টুকরো লাগানো। একদিন যখন বাসায় কেউ নাই আমি ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুচিয়ে ডায়মন্ড দুইটা খুলে সেখানে কাচের টুকরো দুইটা লাগিয়ে দিলাম। আম্মু কোনোদিন বুঝতে পারেনি–আম্মু ও খুশী আমিও খুশী।
সেই দুইটা ডায়মন্ড দিয়ে আমি একটা পাঞ্জার বানালাম। ডায়মন্ড গুলো লাগানো হলো একটা স্টেনলেস পিস্টনের মাথায় পিস্টনটা লাগালাম দুইটা বড় মেটাল প্লেটে। প্লেটের পিছনে এক্সপ্লোসিভ। দুইটা এক্সপ্লোসিভ একসাথে ডোটানেক্ট করতে হবে সে জন্যে ছোট একটা সার্কিট আগে থেকে তৈরী …
(মিঠুন তার পুরো যন্ত্রটা বর্ণনা করে গেল। আমরা কিছুই বুঝলাম কিন্তু সে এতো উৎসাহ নিয়ে হাত পা নেড়ে নেড়ে বলল যে আমরা ধৈর্য্য ধরে শুনে গেলাম। যন্ত্রটার বর্ণনা শেষ করে সে আবার বলতে শুরু করল।)
কতো বড় বিস্ফোরণ হবে আমি জানি না, বিস্ফোরণের পর সবকিছু ওলট পালট হয়ে যাবে, তাই আমি একটা ছোট শিশি রাখলাম ঠিক ডায়মন্ড দুটোর নিচে। যখন ডায়মন্ড দুটো মাখখানের জায়গাটাকে প্রচণ্ড চাপ দিবে তখন যদি একটা ব্ল্যাকহোল বা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা তৈরী হয় সেটা এই শিশির মাঝে টুপ করে পড়বে। বিস্ফোরণের পর শিশিটা যেন খুঁজে পাওয়া যায় সেইজন্যে এটার সাথে একটা ছোট ব্যাটারী দিয়ে একটা এল.ই.ডি লাগিয়ে রাখলাম।
তারপর আমি লম্বা তার দিয়ে চলে গেলাম পাশের বিল্ডিংয়ে। ঘড়িতে ঠিক যখন রাত আটটা বাজে তখন সুইচ টিপে দিলাম। সাথে সাথে—
(মিঠুন তখন থেমে গেল, তার মুখে একটা আজব ধরণের হাসি ফুটে উঠল, তারপর দুই হাতে উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, বু-ম।)
সেই শব্দটার মত সুন্দর কোনো শব্দ আমি জীবনেও শুনি নাই। একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা যখন ঠিক করে কাজ করে তখন তার থেকে আনন্দ আর কিছুতে হয় না।
বিস্ফোরণের পর মিনিটখানেক ধরে ইট পাথর ধূলা বালি পড়তে লাগল। তারপর সবকিছু থেমে গেল। আমি তখন ল্যাবরেটরি ঘরে গেলাম। দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে ছাদ উড়ে গেছে। ভিতরে ধোয়া ধূলা বালি। কারেন্ট চলে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি তার মাঝে দেখলাম একটা এল.ই.ডি, জ্বলছে। আমার শিশিটা তখনো খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হামাগুড়ি দিয়ে কাছে গেলাম, সাবধানে শিশিটা তুলে তার মুখে ছিপিটা লাগালাম তারপর হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে দে দৌড়।
(এরকম সময়ে ফারা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর ডায়মন্ড দুইটা?” মিঠুন বলল, “ঠিক ওপরে ডায়মন্ড দুটি একটা আরেকটার সাথে লেগেছিল সেই দুটিও নিয়ে এসেছি।” ডায়মন্ড দুটি নিয়ে এসেছে শুনে ফারার বুকের মাঝে মনে হয় এক ধরণের শান্তি হল। মিঠুনকে বলল, “আবার যেদিন তোর বাসায় কেউ থাকবে না সেই দিন তোর আম্মুর কানের দুলে ডায়মন্ড দুটি লাগিয়ে দিস।” মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “কেন?” ফারা আরো অবাক হয়ে বলল, “কেন না?” মিঠুন আরেকটা কিছু বলতে চাচ্ছিল, ঝুম্পা ধমক দিয়ে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হল? মিঠুন তখন আবার বলতে শুরু করল।)
তারপর আমি বাসায় ফিরে এলাম, বাসায় ততক্ষণে জানাজানি হয়ে গেছে সে আমাদের স্কুল উড়ে গেছে। আমার আম্মু আব্দু আমকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলেন, আমি বললাম স্কুল উড়ে গেছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম সেজন্যে দেরী হয়েছে। আল্লু আম্মু আমার কথা বিশ্বাস করলেন তখন আর কোনো ঝামেলা হল না।।
আস্তে আস্তে খবর বের হয়ে গেল, সায়েন্স স্যার স্কুলের মালিকদের আমার কথা বলল, আমি যে কম্পিউটার হ্যাক করেছি সেটাও জানাজানি হল। আবু আম্মুকে স্কুলে ডেকে নিয়ে গেল, আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে ঠিক করল। কিন্তু আমার বয়স কম, আমার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না উল্টো স্কুলই ঝামেলায় পড়ে যাবে। তখন স্কুল আমাকে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দিল। টিসির মাঝে এতে খারাপ খারাপ কথা লিখল যে শহরের আর কোনো স্কুল আমাকে ভর্তি করতে রাজী হল না, তাই শেষ পর্যন্ত মহব্বতজান স্কুলে ভর্তি হয়েছি।
(ঝুম্পা তখন জানতে চাইল টিসিতে কী কী লিখেছিল। মিঠুন হাত নেড়ে প্রথমে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল, চাপাচাপি করার পর বলল “সেখানে লিখেছে, আমি মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ, অপরাধ প্রবণ এবং বিপজ্জনক। আমি সমাজের জন্যে ঝুঁকি এবং আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেওয়া ঠিক না।” বগা তখন জানতে চাইল কথাগুলো সঠিক কী না। মিঠুন বলল পুরোপুরি সঠিক না। মিঠুন তখন আবার তার কাহিনী শুরু করল।)
আমি কেন কীভাবে ঘটনাটা ঘটিয়েছি জানার জন্যে পুলিশ র্যাব আমার বাসায় গিয়ে আমার জিনিষপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ খুলে নিয়ে গেছে। আমার ভয় হচ্ছিল আমার শিশিটা না আবার নিয়ে যায়। সে জন্যে এটা আমি পকেটে রাখি।
(মিঠুন তখন খুব সাবধানে পকেট থেকে সেই বিখ্যাত শিশিটা বের করে আমাদের সামনে ধরে রাখল। আমরা আবার শিশির ভিতরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম। আমি ইতস্তত করে বললাম, “মিনি, মানলাম তোর এক্সপেরিমেন্ট ঠিক আছে। তুই আস্ত একটা স্কুল ধ্বসিয়ে দিয়েছিস? অক্সব্রীজ স্কুলের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারছি না সত্যি সত্যি তুই ব্ল্যাকহোল কিংবা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা এই শিশির ভিতরে আটকাতে পেরেছিস কী না। আসলে হয়তো ভেতরে কিছুই নাই।” মিঠুন বলল, “আছে!” আমি তখন জানতে চাইলাম সে কীভাবে জানে ভিতরে কিছু আছে। মিঠুন তখন আমার হাতে শিশিটা দিয়ে বলল, “এই দ্যাখ। খুব সাবধান।” আমি হাতে নিলাম আর চমকে উঠলাম। ছোট একটা শিশি কিন্তু শিশিটা বেশ ভারী। শিশিটা নাড়লে ভেতরে কিছু একটা নড়ে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু এর ভিতরে আসলেই কিছু একটা আছে। কী আশ্চর্য!)
এটা সত্যিকার ব্ল্যাকহোল না, তাহলে আশেপাশের সবকিছু শুষে নিত। এটা ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা। আসল ব্ল্যাকহোল কী করে আমি মোটামুটি জানি। কিন্তু এই ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা কী করে আমি জানি না। শুধু আমি না, পৃথিবীর কেউ জানে না। কাজেই এখন আমার এটাকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে।।
(মিঠুন তখন অনেক লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ঝুম্পা তখন জানতে চাইল কী হয়েছে। মিঠুন বলল, তার বাসা থেকে তার গবেষণার সবকিছু পুলিশ নিয়ে গেছে। যেটুকু বাকী ছিল সেটুকু ফেলে দেয়া হয়েছে। কাজেই তার এখন গবেষণা করার কোনো জায়গা নাই। শুনে আমরা খুব দুশ্চিন্তিত ভঙ্গী করে মাথা নাড়লাম। মিঠুন খুবই মন খারাপ করে আবার শুরু করল।)
আমার কাহিনী এই খানেই শেষ। অনেক লম্বা স্টোরি ছোট করে বললাম। তোরা বিজ্ঞানের কিছু শুনতে চাস না তাই আসল জিনিষগুলি বলতেই পারলাম না। অক্সব্রীজ স্কুল থেকে আমাকে বের করে দিয়েছে সে জন্যে আল্লু আম্মুর খুব মন খারাপ। আপু সকাল বিকাল আমাকে টিটকারী মারে। দেখা হলেই হাত পা নেড়ে বলে :
সোনার চান
মহব্বত জান
নাকে ধরে দাও টান
আমি কোনোমতে সহ্য করি। যদি কোনোভাবে আমার ল্যাবরেটরিটা পেতাম, ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা নিয়ে গবেষণা করতে পারতাম তাহলেই আমার কোনো চিন্তা ছিল না।
(মিঠুন বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার কাহিনী শেষ করল।)