০৩. দরজা খুলে গেল

দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। আমাকে কোন বোতাম টিপতে হল। না, কোন হাতল ঘোরাতে হল না। আমি দরজা থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আবার দরজায় হাত রাখলাম—আবার দরজা খুলল। একধরনের খেলা। দরজা বন্ধ করা এবং দরজা খোলার খেলা। এই খেলাটায় কি বিখ্যাত জ্ঞান-গাধা সিডিসি বিরক্ত হচ্ছে? আমি যে কাণ্ডটা করছি তা সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে। তাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি যে কোন উদ্ভট কাজ করতে পারি। একলক্ষবার দরজা খুলতে পারি, দরজা লাগাতে পারি। আমি আবার দরজা খুললাম, আবার বন্ধ করলাম এবং আবারো, আবারো।

সিডিসি।

বলুন শুনতে পাচ্ছি।

আমার এই খেলাটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?

আপনার মধ্যে শিশুসুলভ কিছু ব্যাপার আছে।

দরজা খোলা এবং বন্ধ করার ব্যাপারটা তোমার কাছে শিশুসুলভ লাগছে?

হ্যাঁ লাগছে।

আমি যদি দরজা খুলে গম্ভীর-ভঙ্গিতে বের হয়ে যেতাম তাহলে ব্যাপারটা কি সুলভ হত, বৃদ্ধসুলভ?

সেটা হত স্বাভাবিক আচরণ।

তোমার ধারণা আমি অস্বাভাবিক?

না আমার ধারণা তা না।

তোমাকে খুবই জরুরি একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। প্রশ্নটা করা যাক, তুমি কি ভাগ্য বিশ্বাস কর?

না সুবিধাজনক প্রবাবিলিটিকে ভাগ্য বলা হয়। এবং অসুবিধাজনক প্রবাবিলিটির আরেক নাম দুৰ্ভাগ্য। উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করব?

তুমি মহাজ্ঞানী, তুমি জ্ঞান দান করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এখন আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি বরং এই প্রশ্নটা অন্যদের জিজ্ঞেস করব, এই মহাকাশযানে তোমার মত আরো কিছু মহাজ্ঞানী যাচ্ছেন-পদার্থবিদ অপদার্থবিদ কী জানি তাদের নাম বললে?

মহান পদার্থবিদ সুরা এবং মাহান পদার্থবিদ লিলিয়ান।

তাদের নামের আগে মহান বলাটা কি নিয়ম?

অবশ্যই নিয়ম। না বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

শুধু মহান বললেই হবে? নাকি মহান বলে পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে যেতে হবে।

মহান বললেই হবে।

আমি যদি মহান না বলি তাহলে আমাকে কী ধরনের শাস্তি দেয়া হবে?

একহাজার ইউনিট পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে।

বল কি?

তাদের সাথে কথা বলতে হবে অত্যন্ত সাবধানে।

তাতো বটেই। একহাজার ইউনিট তো সহজ কথা না।

সবচে ভাল হয় তাঁদের সঙ্গে কথা না বলা। তাঁরা ডুবে থাকেন তাঁদের নিজের ভুবনে। অসাধারণ সব বিষয় নিয়ে তাদের মস্তিষ্ক সব সময় চিন্তা-ভাবনা করে, সেখানে যদি তাদের অতি সাধারণ কিছু জিজ্ঞেস করা হয় তখন সমস্যা হয়।

কী সমস্যা?

তাঁরা অতি সাধারণ প্রশ্নটাকেও মনে করেন জটিল প্ৰশ্ন। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নানান জটিল চিন্তা করেন। তাঁদের বিরাট চিন্তাশক্তি সামান্য বিষয়ে প্রয়োগ করেন। এতে তাদের মেধার অপচয় হয়। এটা ঠিক না।

কাজেই তুমি বলছ ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করতে।

অবশ্যই। শুধু ভাগ্য কেন, কোন বিষয়েই তাদের কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক না।

রাতে ঘুম কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করতে পারি? না তাও জিজ্ঞেস করা যাবে না?

এ জাতীয় প্রশ্ন হয়ত-বা করা যেতে পারে। আপনি বরং একটা কাজ করুন, অবজারভেশন ডেকে চলে যান। সেখান থেকে নক্ষত্রপুঞ্জ দেখুন। মহান পদার্থবিদদের সঙ্গে আলাপের চেয়ে এটা আনন্দময় হবে।

আমি নিজের খুপরি থেকে বের হলাম। করিডোরের মতো লম্বাটে জায়গা। সবু করিডোর দুজন রোগা মানুষ একসঙ্গে হাঁটতে পারে এমন। করিডোরে নরম সিনথেটিক কার্পেট বিছানো। কার্পেটের রঙ সবুজ। হাঁটতে খুব আরাম। পা ডেবে যায়, আবার যেন ডাবে না। দুপাশে লোহার দেয়ালের মতো দেয়াল। দেয়ালের রঙও হালকা সবুজ। কিছুদূর হাঁটার পর আমার মনে হল সবুজ রঙের প্রতি এদের বিশেষ কোন দুর্বলতা আছে। চারপাশে যা দেখছি সবই সবুজ। কোনটা গাঢ়, কোনটা হালকা। আমি কোন্ দিকে যাচ্ছি তা বুঝতে পারছি না। অবজারভেশন ডেকে যাবার উপায় কী তা সিডিসিকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সিডিসি তুমি কি আছ?

অবশ্যই আছি।

অবজারভেশন ডেকে যাবার পথটা জিজ্ঞেস করা হয় নি।

জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যে দিকেই যাবেন অবজারভেশন ডেকে উপস্থিত হবেন।

এখন যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে গেলে অবজারভেশন ডেক পাব?

অবশ্যই পাবেন? উল্টোদিকে যদি হাঁটা দেই তাহলে?

তাহলে পাবেন। মহাকাশযানের ডিজাউনটাই এরকম। সমস্ত নদী যেমন সমুদ্রে মেশে, সমস্ত পথ তেমন অবজারভেশন ডেকে শেষ হয়।

সবুজ রঙের এমন ছড়াছড়ি কেন? তোমাদের কাছে অন্য কোন রঙ ছিল না? যা দেখছি সবই সবুজ।

মহাকাশযানের ভেতরের স্ট্রাকচার ফাইবারগ্লাসের। এর কোন রঙ নেই। আলো এমনভাবে ফেলা হয়েছে যে বুজ দেখাচ্ছে। সবকিছু সবুজ দেখাচ্ছে তার মানে আমরা নিরাপদে ভ্রমণ করছি। একসময় দেখবেন সবকিছু লাল দেখাচ্ছে তখন বুঝতে হবে আমাদের ভ্রমণ তেমন নিরাপদ নয়।

বিপজ্জনক ভ্ৰমণ কখন শুরু হবে?

আমরা একটা নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে যাব। সে সময়ের ভ্ৰমণ খুব নিরাপদ নয়।

বল কি?

নিউট্রন স্টার ব্যাপারটা কি আপনি জানেন?

জানি না এবং জানার কোন আগ্রহও বোধ করছি না। বিপজ্জনক ভ্ৰমণ এইটুকু জানাই আমার জন্যে যথেষ্ট।

আপনার ভীত হবার কোন কারণ নেই। নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে আমরা অনেকবার গিয়েছি। আমাদের সবকিছুই হিসেব করা আছে।

মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন সাহেবকে তারপরও বলবে সাবধানে চালাতে। হিসেবে ভুল হতে পারে।

কোন ভুল হবে না।

ক্যাপ্টেন সাহেবের নাম কী?

আমরা সে জাতীয় মহাকাশযানে করে যাচ্ছি যাতে কোন ক্যাপ্টেন থাকে না।

আপনা-আপনি চলে?

তাও না। মহাকাশযানটি আমি নিয়ন্ত্ৰণ করি।

বল কি?

মনে হচ্ছে আপনি খুবই বিস্মিত হয়েছেন।

হ্যাঁ বিস্মিত হয়েছি। তুমি তো কথাবার্তা বলেই সময় কাটাচ্ছ। জাহাজ চালাবে কখন?

আমার অনেকগুলি ইন্টারফেস। মাত্র একটা ইন্টারফেস আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্যে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ আমি উল্টোপাল্টা কথা বলে রাগিয়ে দিলেও তোমার জাহাজ চালাতে কোন অসুবিধা হবে না?

না তা হবে না। নিউট্রন স্টার ব্যাপারটা কি আপনাকে বলব?

তুমি নিউট্রন স্টার ব্যাপারটা কী তা বলার জন্যে এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? আমাকে জ্ঞানী বানানোর কোন দরকার নেই। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কথা তোমাকে বলি-এই জগতে যত কম জানা যায় ততই ভাল।

আপনাকে এই তথ্য কে বলেছে?

কেউ বলে নি। আমি নিজেই ভেবেচিন্তে এই তথ্য বের করেছি। ভাল। কথা, আমরা কি অবজারভেশন ডেকে চলে এসেছি?

আপনি চলে এসেছেন। আমি আগে থেকেই ছিলাম। আমি মহাকাশযানের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছি। যদিও আমাকে দেখা যায় না।

তুমি তাহলে ঈশ্বরের মতো সব জায়গাতেই আছ—আবার কোথাও নেই।

সিডিসি কিছু বলার আগেই আমি অবজারভেশন ডেকে ঢুকে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম মজাদার কোন দৃশ্য দেখব। ঝিকমিক নক্ষত্রদের পাশ দিয়ে আমরা ছুটে যাচ্ছি। গ্রহট্ৰহ দেখা যাচ্ছে। গ্ৰহদের ঘিরে চাঁদ ঘুরপাক খাচ্ছে। শাই করে একটা ধুমকেতু আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। যাবার পথে মহাকাশযানে লেজের একটা বাড়ি দিয়ে গেল। আলোর ছড়াছড়ি। লাল আলো, হলুদ আলো, সবুজ আলো। তেমন কিছু না। বাইরের আকাশ ঘন কালো। এমন কালো রঙ আমি জন্মে দেখি নি। মনে হচ্ছে কালো ভেলভেটের পর্দায় তারা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তারাগুলি স্থীর হয়ে আছে। আমাদের মহাকাশযান নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। এমন কোন আকর্ষণীয় দৃশ্য না। থ্রিডি মুভি হাউজে গেলে এরচে অনেক মজাদার দৃশ্য দেখা যায়। তবে তারার সংখ্যা দেখে কেউ যদি ভিরমি খেতে চায় খেতে পারে। আমার ভিরমি খেতে ইচ্ছা করছে না। আকাশের তারার চেয়ে আমার বরং অবজারভেশন ডেকের সাজসজ্জা ভাল লাগছে।

ঘরটা বেশ বড় এবং লম্বাটে ধরনের। নিচু গদি আটা সোফা। সোফাগুলি দূর থেকে দেখেই মনে হচ্ছে বসতে খুব আরাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলে ঘুম এসে যাবার কথা। সোেফা ছাড়া এখানে আসবাবপত্র কিছু নেই। সাধারণত খুব আরামের সোফার সামনে ছোট ছোট টেবিল থাকে, সোফায় বসে টেবিলে পা উঠিয়ে দেয়া যায়। এখানে তাও নেই। অবজারভেশন ডেকে কোন সবুজ রঙ দেখলাম না। পুরো ঘরটা খুব হালকা বেগুনি রঙ করা। বেগুনি রঙ আমার কখননা ভাল লাগে না, তবে এখানে খারাপ লাগছে না। বেগুনি রঙের মানে কি এই যে অবজারভেশন ডেকে বসে ভ্রমণ খুব নিরাপদ নয়। সামনের কাচের দেয়াল ভেঙে উল্কা ফুল্কা ঢুকে যেতে পারে।

অবজারভেশন ডেকের এক কোনায় বুডোমতো এক ভদ্রলোক সোফায় পা উঠিয়ে বেশ আরাম করে বসে আছেন। তাঁর চোখে সোনালি চশমা। আজকাল চশমা ব্যবহার হয় না। কেউ-কেউ শখ করে পরেন। মনে হচ্ছে ভদ্রলোক বেশ সৌখিন। তাঁর হাতে বই। তিনি মন দিয়ে বই পড়ছেন। মনে হয় এই ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্ভবত আমার মনের মিল আছে। তিনি নক্ষত্রপুঞ্জ-ফুঞ্জ কিছু দেখছেন না। ভদ্রলোকের চেহারা শুকননা এবং রাগী-রাগী ধরনের। আমি অতীতে দেখেছি খুব রাগী রাগী চেহারার শুকনো-টাইপ লোকগুলি আসলে ভালমানুষ ধরনের হয়। আমি ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি তীক্ষ্ণচোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি বিনীতভাবে বললাম, স্যার আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?

অবশ্যই পারেন।

আমি বসতে বসতে বললাম, কী পড়ছেন?

একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস।

গল্পটা কি স্যার ইন্টারেস্টিং?

ভদ্রলোক নড়েচড়ে বসলেন এবং আগ্রহের স্বরে বললেন, শুরুতে ইন্টারেস্টিং ছিল না। প্রথম দশ পৃষ্ঠা খুবই বোরিং, এখন অবশ্যি কাহিনী জমে গেছে। ভালই জমেছে। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা যেতে পারে শ্বাসরুদ্ধকর।

কাহিনীটা কী?

প্রশ্নটা করেই আমার মনে হল এবার ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বলবেন, অকারণে বিরক্ত করছেন কেন? তিনি তা করলেন না বরং আগ্রহের সঙ্গে বললেন, একজন পদার্থবিদের ত্রিমাত্রিক সময় সমীকরণে সমাধান চুরি গেছে। এই অসাধারণ সমাধানের ফলে প্যারালাল ইউনিভার্সের রহস্যভেদ হবে। ল্যাবোরেটরিতে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। ল্যাবোরেটরি ভেতর থেকে তালা দেয়া—নেকলোম লক। বাইরে থেকে এই তালা খোলার কোন উপায় নেই। সাইন্টিস্ট ভদ্রলোক সমীকরণের সমাধান টেবিলে রেখে পাশের টেবিলে গেলেন। কলম আনতে। কলম এনে ফিরে এসে দেখেন সমাধানটা নেই। ম্যাজিকের মতো ভ্যানিস হয়ে গেছে।

ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না?

না কেউ নেই। তাছাড়া সাইন্টিস্ট ভদ্ৰলোক শুধু এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে গেছেন এবং ফিরে এসেছেন, সময় লেগেছে এক মিনিটের কম। এর মধ্যেই ঘটনা ঘটে গেছে।

আমি বললাম, সাইন্টিস্টরা আত্মভোলা-টাইপের হয়। উনি নিজেই নিজের পকেটে রেখেছেন না তো? পকেটে রেখে ভুলে গেছেন একরম।

না তা না। উনি নিজের পকেট খুব ভাল করে দেখেছেন। টেবিলের ড্রয়ার দেখেছেন। হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে খুঁজেছেন।

দ্রলোকের কথা বলার ধরন দেখে আমার মনে হল সমীকরণের সমাধান না পাওয়ায় গল্পের পদার্থবিদের চেয়েও তিনি বেশি চিন্তিত। আমি বললাম, স্যার আপনি মনে হয় খুব টেনশনে পড়েছেন?

টেনশনে পড়ব না? জরুরি একটা সমাধান যাবে কোথায়? এ তো তীরে এসে জাহাজ ডোবার মতো। নৌকা ডুবলেও কথা ছিল ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজ।

খুব বেশি টেনশন বোধ করলে শেষ পাতাগুলি আগে পড়ে ফেলুন।

আমিও তাই ভাবছি। আবার নিজে নিজে বের করার চেষ্টা করছি। কোন লাভ হচ্ছে না। আমার বুদ্ধি সাধারণমানের। আপনার কি মনে হয় সমাধানটা কোথায় গেছে?

আমার মনে হয় সাইন্টিস্ট ভদ্রলোকের সাহায্যকারী রোবট এটা গাপ করে ফেলেছে। রোবট ব্যাটা বোধহয় সমাধানটা অন্য কোথাও পাচার করবে। ভদ্রলোকের কি কোন সাহায্যকারী রোবট আছে?

হ্যাঁ আছে। N5 টাইপ রোবট। এরা গণিতে পারদর্শী। ভদ্রলোক রোবটটি ইউনিভার্সিটি থেকে ভাড়া নিয়েছেন। তিনি অংকে সামান্য কাঁচা বলে এর সাহায্য নেন। রোবটটিকে তিনি খুব পছন্দ করেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন ল্যাঝিম। তাঁর মৃতা স্ত্রীর নামে নাম দিয়েছেন। ভয়েস-সিনথেসাইজারে তাঁর স্ত্রীর গলার স্বর ব্যবহার করা হয়েছে।

স্যার আমার ধারণা ল্যাঝিম ম্যাডামই কাজটা করেছেন।

N5 ধরনের রোবটে যে কম্পিউটার মস্তিষ্ক ব্যবহার করা হয় তা তো কোন অন্যায় করতে পারে না।

গল্পের খাতিরে অন্যায় করেছে। অন্যায় না করলে তো গল্প দাড়াচ্ছে না। স্যার আপনি ভেবে দেখুন, ঘরে ল্যাঝিম ম্যাডাম ছাড়া আর কেউ নেই। সমাধানটা তো হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে না।

বুড়ো ভদ্ৰলোক চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, আপনার কথা খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। আপনার বুদ্ধি তো অসাধারণ পর্যায়ের। কিছু মনে করবেন না আপনার নাম জানতে পারি?

স্যার আমার কোন নাম নেই।

নাম নেই মানে? আপনি কি বায়ো-রোবট?

জ্বি না স্যার, আমি মানুষ।

মানুষের নাম থাকবে না?

সবার থাকে না। টানেল-কর্মীদের থাকে না। তাদের থাকে নাম্বার। পশুদের যেমন লেজে পরিচয়, টানেল-কর্মীদের তেমনি নাম্বারে পরিচয়। স্যার আমার নাম্বার হল T5LAS0.

তার মানে?

এটা আমার ডাক নাম বলতে পারেন। ভাল নাম TS023G00/LOR420/S000127:

বুড়ো ভদ্ৰলোক অসম্ভব বিস্মিত হয়ে বললেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। রোবটদের নাম্বার থাকবে। মানুষের থাকবে কেন? তাদের কম্পিউটার নাম্বার অবশ্যই থাকবে। ডিএনএ কোড-নাম্বার থাকবে তাই বলে নাম থাকবে না?

কিছু মনে করবেন না স্যার–আপনার নাম কী?

আমার নাম স্রুরা।

আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলালাম। কী ভয়ংকর কথা, এতক্ষণ সুরার সাথে ফাজলামি ধরনের কথা বলছিলাম। কত হাজার ইউনিট ফাইন হয়েছে কে জানে। হারামজাদা সিডিসি নিশ্চয়ই সব শুনেছে এবং যথারীতি রেকর্ড করে ফেলেছে।

স্যার কিছু মনে করবেন না। আমি আপনার সঙ্গে বিরাট বেয়াদবি করেছি।

কী বেয়াদবি করেছেন।

আপনাকে সাধারণ একজন মানুষ বলে মনে করেছি।

আমি তো সাধারণ মানুষই। আমার মধ্যে অসাধারণ কী দেখলেন?

আপনি মহান একজন পদার্থবিদ।

পদার্থবিদরা অসাধারণ মানুষ হবে কেন? পদার্থবিদ্যা সামান্য জানি কিন্তু এর বাইরে আর কিছুই তো জানি না। মানুষেরও যে নাম থাকে না সেটাই জানতাম না। তাছাড়া আমার বুদ্ধিও সাধারণমানের। ডিটেকটিভ গল্প আমার খুব প্রিয়, সময় পেলেই পড়ি অথচ আজ পর্যন্ত আমি আগেভাগে বলতে পারি নি কে অপরাধী।

স্যার আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?

রাগ করব কেন?

এই যে আমি আগেভাগে বলে দিলাম কে অপরাধী।

আপনার বুদ্ধির কারণে আপনার উপর সামান্য ঈর্ষা হয়েছে। কিন্তু রাগ তো করি নি। তাছাড়া আপনার অনুমান ঠিক নাও হতে পারে। বই পুরোটা শেষ না করলে বোঝা যাবে না।

ঠিক বলেছেন স্যার।

এত ঘনঘন স্যার বলছেন কেন?

স্যার না বলে কি বলব?

নাম ধরে ডাকবেন। মানুষের নাম রাখা হয় কি জন্যে, ডাকার জন্যে।

আমি খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম, আমাকে কী বলে ডাকবেন? আমার তো কোন নাম নেই।

নাম যেহেতু নেই নাম দিতে হবে। আপনার জন্যে সুন্দর একটা নাম খুঁজে বের করতে হবে।

স্যার আপনি আমার একটা নাম রেখে দিলে সেটা হবে আমার পরম সৌভাগ্য। সবাইকে বলতে পারব আমার এই নাম মহান সুরা রেখে দিয়েছেন। দয়া করে আনকমন একটা নাম রেখে দিন।

সুরা চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছেন। রেগেটেগে যাচ্ছেন না তো? কিংবা কে জানে হয়ত কী নাম রাখবেন তাই ভাবছেন। অতি বিখ্যাত মানুষদের ব্যাপার কিছুই বোঝা যায় না। এমন মানুষটাকে আমার খানিকটা বোকা-বোকাও মনে হচ্ছে। অতি ভাল মানুষদের ভেতর একধরনের সহজ বোকামি থাকে। তবে মানুষটার কৌতূহল কম। আমার প্রতি তিনি যে সামান্য কৌতূহল দেখাচ্ছেন, তা আমার নাম নেই বলেই দেখাচ্ছেন। এর বেশি কিছু না। আমি কে? আমার পরিচয় কি এইসব নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই। সম্ভব এই জাতীয় মানুষদের সমস্ত কৌতূহল একদিকে ধাবিত হয়। তাদের চোখ একটা। সেই দৃষ্টিও কেন্দ্রীভূত অর্থাৎ শুধু কেন্দ্রটাই দেখে। কেন্দ্রের চারপাশের পরিধি দেখে না।

ল্যাঝিম নামটা তোমার কাছে কেমন লাগছে?

স্যার অত্যন্ত ভাল নাম। শুধু একটাই সমস্যা, নামটা মেয়েদের। কে বলল মেয়েদের?

আপনি যে ডিটেকটিভ উপন্যাস এই মুহূর্তে পড়ছেন সেখানকার পদার্থবিদের স্ত্রীর নাম ছিল ল্যাঝিম। পদার্থবিদ সেই নামে তার সাহায্যকারী রোবটের নাম রাখেন।

সুরা লজ্জিত গলায় বললেন, আপনি তো ঠিকই বলেছেন। আমার মনেই ছিল না। আপনার স্মৃতিশক্তিও উত্তম। আমার মাথায় তো আর কোন নাম আসছে না।

তাহলে স্যার ল্যাঝিমই থাকুক। তবে আমার একটা নাম মাথায় এসেছে, নামটা মনে হচ্ছে আনকমন। আমার ধারণা কেউ এই নাম আগে রাখে নি।

সুরা কৌতূহলী চোখে তাকালেন। আমি বললাম মানুষ নাম রাখলে কেমন হয় স্যার।

মানুষ?

জ্বি মানুষ। কেউ নিশ্চয়ই তার ছেলেপুলের নাম মানুষ রাখবে না।

রাখবে না কেন?

যে মানুষ, সে শুধু মানুষ নাম রাখবে কেন। তাছাড়া মানুষ নামটা উভলিঙ্গ। মানুষ বললে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না। নামটা এমন রাখা হয়। যেন নাম শুনে মানুষ বলতে পারে ছেলে না মেয়ে।

আপনার কথায় যুক্তি আছে। আচ্ছা বেশ আপনার নাম রাখা হল মানুষ।

স্যার আমার যে কী ভাল লাগছে! আমি সবাইকে বলতে পারব আমার নাম রেখেছেন মহামতি সুরা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই ঋণ মনে হয় আমি শোধ করতে পারব না। শোধ করার ইচ্ছাও বোধ করছি না। কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকাও ভাগ্যের ব্যাপার। স্যার আমি এখন যাই। আপনার পাঠের সময় আপনাকে বিরক্ত করেছি। দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।

আপনি চলে যাচ্ছেন? জ্বি স্যার।

আমি চলেই যাচ্ছিলাম, কী মনে করে জানি পেছন ফিরলাম, দেখি সুরা আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বললেন, এই যে মানুষ! আমার মনে হয় আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনিই কি সেই সাহসী ভলেন্টিয়ার?

স্যার আমি বুঝতে পারছি না। আমি মোটেই সাহসী না এবং আমি কোন ভলেন্টিয়ার না।

ও আচ্ছা, আমার ভুল হয়েছে আমি ভেবেছিলাম আপনি সেই ভলেন্টিয়ার।

ভলেন্টিয়ারের ব্যাপারটা কি স্যার বুঝিয়ে বলবেন? আমি ভলেন্টিয়ারও হতে পারি।

ভলেন্টিয়ার হতেও পারি মানে? আপনি ভলেন্টিয়ার হলে আপনি জানবেন না?

আমি খুব বিচিত্র পরিস্থিতিতে আছি। আমাকে নিয়ে কী ঘটছে আমি জানি না। আমি টানেলে থাকতাম, আমাকে এরা ধরে বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে।

তার মানে?

এই যে স্যার আমি আপনাদের সঙ্গে যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি তা জানি না। আপনারা কেন যাচ্ছেন তা কি জানেন? নিশ্চয়ই ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন না।

আমরা যাচ্ছি প্রক্সিমা সেনচুরির দিকে। প্রক্সিমা সেনচুরির নবম গ্রহ বারা। আমরা যাচ্ছি রারার দিকে। এই প্রথম অতি উন্নত একদল প্রাণীর সঙ্গে মানুষের দেখা হবে। রারার অধিবাসীরা এত উন্নত যে এরা হাইপার ডাইভ প্রযুক্তির অধিকারী। অতি জ্ঞানীরা সবসময় তাদের জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়। আমার ধারণা তারা আমাদেরকে কিছু প্রযুক্তি উপহার হিসেবে দেবে। আমরা পৃথিবীর প্রতিনিধি।

ভলেন্টিয়ারের ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার হয় নি স্যার। এখনো গিট্টু খুলেনি।

অতি উন্নত প্রাণীরা পৃথিবীর কাছে মানুষদের একটা স্যাম্পল চেয়েছিল। তাকে তারা রেখে দেবে। হয়তো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে। পৃথিবীর আইনে তা নিষিদ্ধ, তবে পৃথিবীর মানুষদের বৃহত্তর কল্যাণের কথা বিবেচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞান কাউন্সিল একজনকে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে। অতি সাহস এবং মানবদরদী একজন স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন। আপনি বলছেন আপনি সেই একজন নন।

জি না স্যার। আমার এত সাহস নেই। এবং আমি মানবদরদীও নই।

তা হলে আপনি কে?

স্যার আমার নাম মানুষ।

ও হ্যাঁ আপনি মানুষ। আপনি কি কিছুক্ষণ বসবেন আমার পাশে, আমি আপনার ব্যাপারটা সিডিসিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেই। কারণ আমার সামান্য কৌতূহল হচ্ছে।

আপনার মতো মহান পদার্থবিদের কৌতূহলের কারণ হতে পেরেছি, আমার যে স্যার কী ভাল লাগছে! এ আমার এক পরম সৌভাগ্য।

আমি সুরার পাশের সোফায় বসলাম। এই প্রথম সুরাকে সামান্য চিন্তিত মনে হল। তার ভুরু কুঁচকে গেছে, গলার স্বরও আগের চেয়ে গম্ভীর। এতক্ষণ সোফায় পা তুলে বসেছিলেন এখন পা নামিয়ে নিলেন। সুরা ডাকলেন–

সিডিসি।

অবজারভেশন ডেকের পেছনের দেয়ালের নীল বাতি জ্বলে উঠল। সিডিসির বিষাদমাখা গলা শোনা গেল।

মহামান্য সুরা। আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন।

আমার পাশে যে বসে আছে আমি তাকে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।

আপনাকে অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই মহাকাশযানের সবার সঙ্গেই আমার পরিচয় আছে।

ও হ্যাঁ, তা তো থাকবেই। এই ছেলেটির কোন নাম ছিল না। আমি তার নাম দিয়েছি—মানুষ। নামটা ভাল হয়েছে না?

আবারো আপনাকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনি নাম দেন নি। সে নিজেই তার এই নাম দিয়েছে, এবং আপনার ভেতর এমন ধারণা তৈরি করেছে যে নামটা আপনার দেয়া।

ও আচ্ছা তুমি ঠিকই বলেছ। মানুষ নামটার কথা সেই আমাকে প্রথম বলেছে। আমি তার নাম রাখতে চেয়েছিলাম ল্যাঝিম। ভাল কথা ল্যাঝিম নামটা কি খুব প্রচলিত?

ল্যাঝিম মোটামুটি প্রচলিত একটা নাম। বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদে খনিজ আহরণকারী যেসব মানুষ বসতি স্থাপন করেছে তাদের মধ্যে এই নামটি প্রিয়। ল্যাঝিম শব্দের অর্থ শেষ সূর্যের আলো। মানুষদের মধ্যে কত জনের নাম ল্যাঝিম এবং তাদের পরিচয় কী, তা জানতে চান?

না-তা জানতে চাচ্ছি না। আমি এই ছেলেটি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। সে আমাদের সঙ্গে কেন যাচ্ছে?

সে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে কারণ সে হল এমন একজন ভলেন্টিয়ার যে পৃথিবীর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছে। মানবজাতির জন্যে তার ত্যাগের প্রতিদানও মানবজাতি দিয়েছে। আপনি শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হবেন যে তার নামে পৃথিবীতে একটা ব্যস্ততম সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

সিডিসি আমি কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। এই ছেলের তো নামই নেই। আমি তার নাম দিয়েছি মানুষ।

মহান সুরা অবশ্যই তার নাম আছে। তার নাম ইয়ায়ু। মহাকাশযান ছাড়ার পর থেকে তার কিছু সমস্যা হচ্ছে। মানসিক কিছু সমস্যা। সে হয় তার পূর্ব ইতিহাস ভুলে গেছে কিংবা সে ভান করছে যে ভুলে গেছে। আমরা তাকে আলাদা করে রেখেছি সেই কারণেই।

ও আচ্ছা।

দীর্ঘ সময় ছোট্ট ঘরে আটকে রাখলে তার কেবিন-ফিবার হতে পারে বিবেচনাতেই আজ তাকে ছাড়া হয়েছে। তবে তার উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে, আপনি হয়ত লক্ষ করছেন অবজারভেশন ডেকের বাইরে একজন শান্তিরোবট আছে। যাতে সে কারোর কোন ক্ষতি করতে না পারে।

এই ছেলেটিকে আমার মোটেই বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে না।

আমারো মনে হচ্ছে না, তারপরও বাড়তি সাবধানতা।

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে শান্তি-রোবটকে দেখলাম। কিছুক্ষণ আগেও এ ছিল না, এখন কোত্থেকে উদয় হয়েছে? শান্তি-রোবট নাম শুনে বিভ্রান্ত হবার কারণ নেই। শান্তির সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই। এরা দেখতে ভালমানুষের মতো কিন্তু আসলে ভয়াবহ। টানেলে কাজ করার সময় এদের দেখেছি। এদের কর্মকাণ্ডও দেখেছি। না দেখাই ভাল ছিল।

সিডিসির কথাবার্তা শুনে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। সিডিসি মিথ্যা কথা বলছে এটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন বলছে? আমি সুরার দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার কিছু মনে করবেন না, সিডিসি কম্পিউটার হয় মিথ্যা কথা বলছে নয় রসিকতা করছে।

স্রুরা বললেন, কম্পিউটারের মিথ্যা বলার ক্ষমতা নেই। মিথ্যা বলা মানে কম্পিউটার লজিকে উল্টোদিকে চলা। সেই ক্ষমতা কম্পিউটারের নেই। একটা কম্পিউটার কখনো কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলতে পারে না। কম্পিউটার প্রসেসরের বিদ্যুপ্রবাহের একটা বিশেষ দিক আছে, মিথ্যা বললে সেই দিক উল্টে যায়। দুটি বিপরতিমুখী মাইক্রো কারেন্ট তখন একে অন্যকে নষ্ট করে ফেলে বলে কম্পিউটারের মূল প্রবাহ অকেজো হয়ে যায়। ইন্টারফেসে জেটা পটেনশিয়ালের সৃষ্টি হয়। কপোট্রন অকেজো হয়ে যায়। বুঝতে পারছ?

আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। সুরার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বুঝতে পারছি তা হল আমি গভীর জলে পড়েছি এবং কম্পিউটার সিডিসি মিথ্যা কথা বলছে। এতে তার কোন ক্ষতি হচ্ছে না।

ইয়ায়ু আপনি আপনার কেবিনে যান এবং বিশ্রাম করুন।

সিডিসি যে কথাগুলো আমাকেই বলছে তা বুঝতে পারলাম না। আমি তাকিয়ে রইলাম সুরার দিকে। সিডিসি আবারো বলল, ইয়ায়ু আপনি ঘরে যান এবং বিশ্রাম করুন। তখন বুঝলাম আমারই নাম ইয়ায়ু এবং আমাকেই ঘরে যেতে বলা হচ্ছে। আমি বললাম, মিথ্যাবাদী সিডিসি আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমার সাধ্য নেই আমাকে এখান থেকে সরাবে।

ইয়ায়ু আপনি উত্তেজিত হবেন না।

আমি মোটেই উত্তেজিত হচ্ছি না। অধিক শোকে পাথর হয় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। আমি অধিক শোকে লোহা হয়ে গেছি।

স্রুরা কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যেন ভয় পাচ্ছেন। অপ্রকৃতস্থ একজন মানুষ পাশে থাকলে ভয় পাবারই কথা। আমি তার দিকে তাকিয়ে অভয়দানের মতো করে হাসলাম। এতে মনে হয় তিনি আরো ভয় পেয়ে গেলেন। আমি মনে মনে আবারো দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম। এখন আমি যে আচরণই করব তাঁর কাছে সেই আচরণ অপ্রকৃতস্থ বলে মনে হবে। আমি চুপ করে থাকলে তিনি ভাববেন আমি অতিরিক্ত চুপচাপ। আমি আসলে ভাববেন–পাগলের হাসি হাসছি। এই ধারণা যখন বদলানো যাবে না তখন পুরোপুরো পাগলের অভিনয় করাই ভাল। সবচে ভাল হয় যদি বদ্ধ উন্মাদের অভিনয় করে সিডিসিকে বিভ্রান্ত করতে পারি। উন্মাদের অভিনয় খুব কঠিন হবার কথা না।

আমি স্রুরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললাম, আপনি দয়া করে আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনি মহাজ্ঞানী আর আমি জ্ঞানহীন মূর্খ। কে জানে হয়তবা পাগল।

স্রুরা বললেন, আপনি কেবিনে চলে যান।

তুমি করে বলুন স্যার।

তুমি তোমার কেবিনে যাও বিশ্রাম কর।

আমি বরং এখানেই বিশ্রাম করি। আপনার পাশের সোফাটায় শুয়ে থাকি। জ্ঞানী মানুষদের পাশে শুয়ে থাকলেও জ্ঞান হয়। স্যার আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে।

না আমার কোন আপত্তি নেই। এখানে শুয়ে থাকলে তোমার যদি ভাল লাগে তুমি এখানেই শুয়ে থাক।

এবং স্যার ডিটেকটিভ বই যেটা আপনি পড়ছেন সেই বইটা যদি শব্দ করে পড়েন তাহলে ভাল হয়। শুয়ে-শুয়ে শুনতে পারি। কাহিনীটা আমাকে খুবই আকর্ষণ করেছে। ল্যাঝিমের সঙ্গে পদার্থবিদের সম্পর্কটা আসলে কেমন? অর্থাৎ স্যার আমি বলতে চাচ্ছি ল্যাঝিম কি পদার্থবিদকে পছন্দ করে? পদার্থবিদের নামও তো স্যার জানা হল না। সেও কি আপনার মতো মহান টাইটেল পেয়েছেন নাকি সে সিডিসির মতো গাধা-টাইপ?

বলতে বলতে পারে সোফায় আমি শুয়ে পড়লাম এবং লক্ষ করলাম শান্তি-রোবটটা এগিয়ে আসছে। সে আমার দিকে আসছে বলাই বাহুল্য। আমি অসহায় বোধ করছি। আমার আসলে এখন কিছুই করার নেই। শান্তি-রোবট অতি নিম্নশ্রেণীর রোবট, তবে বোবটের নিয়ম মেনে চলে। মানুষকে কখনোই আহত করে না। সে আমাকে আহত করবে না, তবে অতি নিশ্চিত যে ধরে নিয়ে কেবিনে শুইয়ে দেবে। তার আগে সে তার একটি হাতে খুব আলতো করে আমার হাত চেপে ধরবে। সেই ধাতব-হাতের ভেতর থেকে হাইপোরমিক সিরিজের সুচের মতো একটা সুচ বের হয়ে আমার চামড়া ভেদ করে রক্তে চলে যাবে। সেই সুচ দিয়ে কড়া ঘুমের ওষুধ আমার রক্তে মিশতে থাকবে। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ব। যখন ঘুম ভাঙবে আমি দেখব আমি আমার কেবিনে শুয়ে আছি। আমার ক্ষুধাবোধ হচ্ছে এবং আমার শরীর অসম্ভব ক্লান্ত। শান্তি-রোবটদের এই আচরণের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

রোবটটা এগিয়ে আসছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কেমন আছ, ভাল? সে সামান্য থমকে দাঁড়াল।

আমি বললাম, মহান পদার্থবিদ সুরার সঙ্গে কি তোমার পরিচয় আছে। ইনি মহান পদার্থবিদ সুরা। অতি নিরহংকারী মানুষ।

রোবট আমার কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছে না। তার চোখ জ্বলছে। নীল আলো বের হচ্ছে।

সিডিসি বলল, ইয়ায়ু আপনি ঝামেলা করবেন না। আপনার হাত বাড়িয়ে দিন। শান্তি রোবট আপনাকে স্পর্শ করতে চায়।

আমি বললাম, কেন?

আপনার মঙ্গলের জন্যে। ইয়ায়ু আমি আপনার মঙ্গল চাই।

আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম। এমনকি হতে পারে যে সিডিসি আসলে সত্যি কথা বলছে। না তা হতে পারে না।

রোবটটা তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমার মনে হল ঝামেলা করে কী হবে, দিক ঘুম পাড়িয়ে। আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। বুঝতে পারছি সুচটা চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে। তীব্র ঘুমের ওষুধ সে রক্তে মিশিয়ে দিচ্ছে। গভীর ক্লান্তি, গভীর অবসাদে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে যে আমাকে রক্ষা করবে, যে আমাকে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দেবে। আমার আশেপাশে এমন কেউ নেই।

নেই বলছি কেন? একজন তো অবশ্যই আছে। তার নাম ইমা। বাস্তবে তার কোন অস্তিত্ব নেই সে আছে কল্পনায়। কল্পনায় থাকলেও তার অনেক ক্ষমতা। সে আমার সমস্ত দুঃখ সমস্ত কষ্ট নিমেষে ভুলিয়ে দিতে পারে। আমি বিড়বিড় করে বললাম, ইমা ইমা। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি তারপরেও আমি তার মমতাময়ী মুখ দেখতে পারছি। সেই মুখ ঝুঁকে এসেছে আমার দিকে। আহ কী সুন্দর সেই মুখ! ইমার পরনে সবুজ একটা পোশক। সবুজ মানে হচ্ছে নিরাপদ ভ্ৰমণ। এই মহাকাশযান যখন বিপজ্জনক পথে যাবে তখন ইমার পোশাকের রঙ লাল হয়ে যাবে। এই তো লাল হতে শুরু করেছে। আমি তাকিয়ে আছি, ইমা যেন কিছু বলতে চেষ্টা করছে। তার ঠোট নড়ছে।

আমি বিড়বিড় করে বললাম, ইমা তুমি কি বলতে পার আমি কে?