বেলা প্রায় নটা নাগাদ থানা থেকে আমাদের ডাকতে লোক এল। মহান্তি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছে।
আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম। থানায় পৌঁছে দেখি মহান্তি সাহেব বসে আছে মৃতদেহের অপেক্ষায়। মৃতদেহ তখনও এসে পৌঁছয়নি।
কালী সরকারের মৃতদেহটা থানায় এসে পৌঁছল যখন তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা।
একটা স্ট্রেচারে করে—একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে মৃতদেহ থানায় বহন করে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাহকরা এলে স্ট্রেচারটা সামনের বারান্দায় নামিয়ে রাখল মহাতি সাহেবের নির্দেশে।
ইতিমধ্যে মহান্তি সাহেব সমুদ্রতীরে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে এসেছিল। এবং সেই। প্রসঙ্গেই ঐ সময় কিরীটীর সঙ্গে মহান্তি সাহেবের আলোচনা চলছিল।
মহান্তি সাহেবের ইঙ্গিতে বাহকদের মধ্যে একজন মৃতদেহের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিল। কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং স্ট্রেচারে শায়িত মৃতদেহের কাছে এগিয়ে যায়—বোধ করি মৃতদেহটা আর একবার ভাল করে দেখবার জন্য। বলাই বাহুল্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে কিরীটীকে অনুসরণ করি।
আবার মৃতদেহের দিকে তাকালাম।
কিরীটীর সন্দেহ মিথ্যা নয়। গলার দাগটা সত্যিই সন্দেহজনক। এবং মনে হয় না। অনেকক্ষণ মৃতদেহটা সমুদ্রের জলে ছিল। খুব জোর ঘণ্টা দেড়েক বা দুই। তার বেশী নয়। এবং মৃতদেহে রাইগার মর্টিস তখনও সেট-ইন করেনি পরীক্ষা করে বোঝা গেল। তাতেই অনুমান হয় রাত বারোটার পরে কোন এক সময় নিহত হয়েছে লোকটা সম্ভবত।
পরীক্ষা করা হয়ে গেলে কিরীটী কম্বলটা আবার টেনে দেয় মৃতদেহের উপরে। ফিরে এসে চেয়ারে বসল।
তাহলে মিঃ রায়, আপনি নিঃসন্দেহ-লোকটাকে হত্যাই করা হয়েছে! মহান্তি কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আবার প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, মহান্তি সাহেব। অবিশ্যি লোকটার মৃত্যুর কজ অর্থাৎ স্ট্যাজুলেশান-শাসরোধ হয়ে
জলে ড়ুবে সেটা সঠিকভাবে ময়না তদন্তের দ্বারাই একমাত্র প্রমাণিত হবে। তবে–
তবে?
মৃতদেহ পরীক্ষা করে ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে যা মনে হচ্ছে-ব্যাপারটা দুর্ঘটনা নয়–নিষ্ঠুর হত্যা। সে বিষয়ে এখন কিন্তু আমি নিঃসন্দেহ।
নিঃসন্দেহ সত্যিই আপনি মিঃ রায়?
হ্যাঁ। সামান্যতম সন্দেহও আমার মনের কোথাও নেই ঐ সম্পর্কে।
কিন্তু আপনি এত ডেফিনিট হচ্ছেন কি করে?
কারণ প্রথমতঃ ধরুন—যদি অ্যাক্সিডেন্টই হত অর্থাৎ ড্রাউনিং-ই লোকটার মৃত্যুর কারণ হত, সে নিশ্চয় স্নান করতে গিয়েই হত—কেমন কি না?
হ্যাঁ—সেটাই স্বাভাবিক।
তাই যদি হয় তো লোকটা নিশ্চয়ই পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে ও হাতে ঘড়ি, বিশেষ করে অমন দামী একটা ঘড়ি বেঁধে নিশ্চয়ই সমুদ্রস্নান করতে যেত না! আই থিঙ্ক ইউ উড এগ্রি উইথ মি অন দ্যাট পয়েন্ট মিঃ মহান্তি!
হ্যাঁ।
আসুন এবার দ্বিতীয় পয়েন্টে আমার। মৃতদেহ দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না—অন্ততঃ দেড় ঘণ্টা থেকে দুঘণ্টা মৃতদেহটা জলে ছিলই এবং আমরা যতদূর জেনেছি নুলিয়ারা ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মৃতদেহটা জলে ভাসতে দেখে তুলে আনে ডাঙায়। তাই যদি হয় এবং লোকটা যদি স্নান করতে গিয়েই ড়ুবে গিয়ে মরে থাকে, নিশ্চয়ই সে রাত তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ সমুদ্রস্নান করতে যায়নি-অবিশ্যি যদি না লোকটার মাথায় কোন গোলমাল থেকে থাকে। কিন্তু আগেই আপনাকে আমি বলেছি কালী সরকার আমার পরিচিত এবং মাত্র গতকালই ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সন্ধ্যায় সমুদ্র-সৈকতে দুবার এবং কথাবার্তাও হয়েছে আমার লোকটার সঙ্গে। এবং সেরকম কিছুই তো মনে হয়নি। অতএব–
আর–এনি আদার পয়েন্ট মিঃ রায়? এবারে মহান্তি প্রশ্নটা করে।
আছে। আমার তৃতীয় পয়েন্ট, যদি অ্যাক্সিডেন্টের কথা বাদ দিয়ে ভাবি লোকটার আত্মহত্যার কথা—সেটা অবিশ্যি আমার পক্ষে এত তাড়াতাড়ি বলা সম্ভব নয়—আরো প্রমাণ ও অনুসন্ধানের-ইনভেস্টিগেশন-এর প্রয়োজন, তবে এ কথাও তো আপনাকে আমি বলেছি, কালী সরকার খুব ভাল সাতুরু ছিল। কাজেই সেটা তো আমরা উড়িয়ে দিতে পারছি না!
তা ঠিক।
নাউ দি ফোর্থ-চতুর্থ পয়েন্ট, মৃতের গলার দাগটা লক্ষ্য করুন মিঃ মহান্তি, ঠিক মনে হবে কোন কিছু ফিতে বা দড়ির মত গলায় বেঁধে শ্বাসরোধ করা হয়েছে লোকটাকে
কিন্তু–
অবিশ্যি সেটাও ময়না তদন্তের ফলাফলের উপরই অনেকটা নির্ভর করছে নিঃসন্দেহে। তবু আপাতত এই পয়েন্টগুলোর উপরে নির্ভর করেই তো আপনি তদন্ত শুরু করতে পারেন মিঃ মহাত্তি!
তা পারি—এবং তদন্ত তো করবই। তবে একটা কথা মিঃ রায়—
বলুন?
ঘটনাচক্রই বলুন আর যাই বলুন, আপনি যখন এখানে উপস্থিত আছেনই, আপনার সাহায্য এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই পাব আশা করতে পারি।
মোস্ট গ্লাডলি। আপনাকে আমার যথাসাধ্য-আমি শুধু নয়, আমরা দুজনেই আমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করব মিঃ মহান্তি-কথা দিচ্ছি।
সত্যি বলছেন তো?
সত্যিই।
তাহলে এবারে কাজের কথায় আসা যাক মিঃ রায়—
নিশ্চয়ই, আপনি তাহলে তদন্ত–
শুরু করব এবং এখুনি। তাই ভাবছি কোথা থেকে শুরু করব—
একেবার মূল স্থান থেকেই শুরু করুন মিঃ মহান্তি। কিরীটী বলে।
মূল স্থান!
হ্যাঁ, সী-সাইড হোটেল থেকে—যেখানে আমরা জেনেছি কালী সরকার উঠেছিল। সী-সাইড হোটেল মানে হারাধন অর্থাৎ হরডন বিশ্বাসের হোটেল! বিজয় মহান্তিই তখন সংক্ষেপে পরিচয় দেয় ঐ হরডন বিশ্বাস লোকটার ও স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাসের।
লোকটা ক্রিশ্চান—জাতে জেলে-গঞ্জাম জিলাতেই বাড়ি।
এক পাদ্রীর কৃপায় ক্রিশ্চান হয়ে তাঁরই দয়ায় লেখাপড়া শিখে চাকরি করছিল রেলেতে, তারপর ওর পালনকর্তা পাদ্রী ফারলোর মৃত্যুর পর কলকাতা হগ মার্কেটে তার ফুলের স্টল ও নার্সারি উইলে পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়। ফুলের কারবার করেছে বছর-পাঁচেক, তারপর বছরখানেক হল ঐ হোটেল খুলেছে এখানে এসে-কলকাতার ব্যবসা বেচে দিয়ে।
হোটেলটা তো বেশ চমৎকার। অনেক টাকা ঢালতে হয়েছে মনে হয়! কিরীটী বলে।
তা হয়েছে বৈকি। পাদ্রীর নার্সারী ও ফুলের স্টলটা বিক্রি করেও শুনেছি নেহাৎ কম টাকা পেয়েছিল না—সেই বিক্রির টাকা দিয়েই নাকি এখানে এসে হোটেলটা খুলেছে।
হুঁ, ভাগ্যবান বলতে হবে।
তা ভাগ্যবান বৈকি! তাছাড়া মিসেস বিশ্বাস—
মিসেস বিশ্বাস কি—
শি ইজ অ্যান অ্যাসেট!
কি রকম?
দেখলেই বুঝবেন। চলুন না—উঠুন –হোটেলেই তো এখন যাব।
চলুন।
.
সী-সাইড হোটেল।
সী-সাইড হোটেলটি অনেকখানি জায়গা নিয়ে এবং অনেক টাকা খরচ করে তৈরী হয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। একেবারে বলতে গেলে বীচের উপরে যে রাস্তা সেই রাস্তার উপরেই। বিরাট গেট। তারপরই খানিকটা খোলা জায়গা।
হোটেলের বাসিন্দাদের ছেলেমেয়েদের খেলবার ব্যবস্থা আছে সেখানে নানা ধরনের। তারপরই দোতলা বিল্ডিংটি।
ভিতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় ইংরাজী অক্ষর ই-র প্যাটার্নে তৈরী বাড়িটা। উপরে ও নীচে ছোট-বড়য় মিলে প্রায় ত্রিশটা ঘর। ফোর সিটেড-সিঙ্গল সিটেড ও পুরো ফ্যামিলি থাকবার মত সর্বপ্রকার ব্যবস্থাই হোটেলটিতে আছে।
চার্জও একটা খুব বেশী নয়-মডারেট।
ম্যানেজার-প্রোপ্রাইটার মিঃ হরডন বিশ্বাস নীচের তলায় এক কোণে একেবারে খানতিনেক ঘর নিয়ে থাকে। লোকজনের মধ্যে সে নিজে, তার স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাস ও একটি বেকার শ্যালক-রেণুকার ভাই রামানুজ।
তার পদবী যাই থাক, সবাই রামানুজ বলেই জানে এবং ডাকে। রামানুজই হোটেলের সুপারভাইজার ও কেয়ারটেকার।
রামানুজই আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে ম্যানেজারের ঘরে বসাল, কাম-কাম, ওয়ান্ট রুম-সিঙ্গল-ডবল-ভেরি চিপ স্যার-ভেরি চিপ।
রামানুজের বয়স আটাশ-ত্রিশের বেশী হবে না।
অনর্গল ভুল ইংরাজী বলা তার মুদ্রাদোষ একটা। তবে সত্যিই সুশ্রী। লম্বা ঢ্যাঙা চেহারা। টকটকে রঙ-কটা চুল, কটা চোখ।
পরিধানে একটা স্ন্যাক-হাওয়াই শার্ট চিত্র-বিচিত্র অ্যামেরিকান টাইপের এবং পায়ে হাওয়াই চপ্পল। মুখে ধূমায়মান সিগারেট।
মিঃ মহান্তি শুধায়, মিঃ বিশ্বাস কোথায়?
হোয়াই স্ট্যাডিং? বসুন না বসুন, মিঃ বিশ্বাস মনে হয় থানাতেই গন। এখুনি আসবেন-কামিং সুন।
কথাটা শুনে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি।
মহান্তি বলে, মিসেস বিশ্বাস নেই?
হ্যাঁ–কিচেনে আছে-কল হার?
হ্যাঁ, তাকে খবর দিন।
রামানুজ চলে গেল এবং মিনিট দশেক পরেই রেণুকা বিশ্বাস এসে ঘরে ঢুকল। নমস্কার মিঃ মহান্তি—কি খবর? মিঃ বিশ্বাস তো থানাতেই গিয়েছেন আপনার কাছে। দেখা হয়নি?
না। তার আগেই আমরা বের হয়ে পড়েছি।
ও, তাই বুঝি—
হ্যাঁ।
তবে বসুন না, এখুনি হয়ত এসে পড়বেন।
আমরা বসলাম।
একটু চায়ের কথা বলে আসি!
না, না-আপনাকে এই দুপুরে ব্যস্ত হতে হবে না। আপনি বসুন মিসেস বিশ্বাস—
মৃদু হেসে মিসেস বিশ্বাস একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
পরে পরিচয় জেনেছিলাম মহান্তিরই মুখে ঐদিনই-মিসেস বিশ্বাসের মিশ্র রক্তে জন্ম।
ওর মা ছিল আদিবাসী সাঁওতাল, আর বাপ একজন স্কচ মিশনারী ডাক্তার। জম্মস্বত্বে কিন্তু স্কচ বাপের সব বৈশিষ্ট্যই পেয়েছিল মহিলা।