০৩. তেরো বছর পর

তেরো বছর পর

পুকুরের বাঁধানো ঘাটে শুয়ে শামীম আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। গভীর নীল আকাশ। সেই আকশে এক চিলতে মেঘ। সেই মেঘের কাছাকাছি একটা চিল উড়ছে। সত্যিই কী উড়ছে, নাকী ভেসে আছে? দুটি পাখা মেলে ধরে আকাশে কী সহজে একটা চিল ভেসে থাকে। কেমন করে ভেসে থাকে?

শামীম উঠে বসে পুকুরের দিকে তাকাল, পুকুরের স্থির পানিতে একটু ঢেউ নেই, একটু আলোড়ন নেই, মনে হয় পুকুরের পানি নয়, সময় বুঝি স্থির হয়ে আছে। পুকুরের কাচের মতো স্থির পানিতে বড় বড় গাছের ছায়া পড়েছে, সেই ছায়াগুলোও স্থির। শামীম নিজের ভেতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করে, কেন তার ভেতরে এই অকারণ বিষণ্ণতা সে জানে না। শামীম একবার আকাশের চিলটিকে দেখে আবার পুকুরের স্থির পানির দিকে তাকাল, এই মুহূর্তে সেরিনা পানির নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কতোক্ষণ থেকে সে পানির নিচে আছে কে জানে! পয়তাল্লিশ মিনিট? এক ঘন্টা? নাকী আরো বেশি?

তেরো বছর আগে অজানা অচেনা একটা গ্রামের ডোবায় সেরিনাকে কোচ দিয়ে একজন প্রায় গেঁথে ফেলছিল, শামীম শেষ মুহূর্তে তাকে বাঁচিয়েছিল। টাওয়েলে পেঁচিয়ে নিয়ে এসে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। গরিলার মতো একজন ডাক্তার ঠিক করে সেরিনার চিকিৎসা করতে রাজী হয় নি বলে শামীম সেরিনাকে তার বাসায় নিয়ে এসেছিল। তাকে বাসায় নিয়ে এসেছিল বলে সে বুঝতে পেরেছিল সেরিনা অন্য সবার থেকে ভিন্ন। সালামান্ডারের মতো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মার্ক্সপিয়াল জুলিয়া ক্রিক ডুনার্টের মতো সেরিনা ত্বক দিয়ে নিশ্বাস নিতে পারে। শামীমের মনে হয়, মাত্র সেদিনের ঘটনা যখন সেরিনার কথা শুনে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে পরের দিন আলেক্স এই দেশে চলে এসেছিল। পুরো এক মাস আলেক্স সেরিনার পাশে পাশে ছিল। এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে যেন সুস্থ মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারে সে জন্যে আলেক্স একটু একটু করে সেরিনাকে প্রস্তুত করেছে। সেরিনার রক্তটাকে পরিশুদ্ধ করেছে, ত্বকটাকে কোমল করেছে, লোমকূপকে বিস্তৃত করেছে, রক্তনালীকে স্পষ্ট করেছে। ফুসফুঁসে নিমোনিয়াকে দূর করেছে। সেরিনা নামটিও আলেক্সের দেওয়া, গ্রীক উপাখ্যানে মৎস্যকন্যার নাম ছিল সাইরেন-সাইরেন থেকে সেরিনা।

এক মাস পর আলেক্স ওয়াশিংটন ডিসি ফিরে গিয়েছিল। সেরিনার পরিচয় গোপন রেখে আলেক্সের নেচারে একটা প্রবন্ধ লেখার কথা ছিল। সেই প্রবন্ধ আর লেখা হয় নি। আলেক্স ছুটি কাটাতে মাউন্ট রেইনিয়ারের চূড়ায় উঠতে গিয়ে বরফ ধ্বসে হারিয়ে গেল। শামীমের কী অবাক লাগে, একজন মানুষ কী সহজে হারিয়ে যায়।

শামীম কখনো ভাবে নি অজানা অচেনা একটা গ্রামের ডোবায় পরিত্যক্ত একটি নবজাতককে নিয়ে সে আবার নিজের জীবন শুরু করবে। শাহানা আর রিতু মারা যাবার পর তার জীবনটা ছিল খাপছাড়া, সে ঠিক করে নিয়েছিল বাকী জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দেবে। কিন্তু সেরিনার কারণে আবার তার সব হিসেব ওলট পালট হয়ে গেল। এই মেয়েটি যেন সুন্দর সুস্থ একটা জীবন পেতে পারে শামীম তার সব ব্যবস্থা করতে শুরু করেছিল, তখন একদিন রাতে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার জন্য কোলে নিয়েছে তখন হঠাৎ করে অবোধ শিশুটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল। এক মাসের শিশু সত্যি সত্যি কারো চোখের দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে হাসতে পারে কী না সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু শামীম কোনো আলোচনার মাঝে গেল না। সেই অর্থহীন হাসিটি তার বুকের ভিতর সবকিছু ওলট পালট করে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে শামীম ঠিক করল সেরিনাকে সে নিজের সন্তান হিসেবে বড় করবে। তার খাপছাড়া অগোছালো জীবনটাকে আবার নূতন করে সাজাতে হল। মফস্বলের একটা শহরে সে এসে স্থায়ী হল। শহরতলীতে বড় জায়গা নিয়ে তার বাসা। বাসার পাশে বড় পুকুর। সেই পুকুরের ঘাটে সে এখন বসে আছে, গভীর পুকুরের কালো পানির নিচে সেরিনা সাঁতার কাটছে।

হঠাৎ পুকুরের ঠিক মাঝখানে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সেরিনা লাফিয়ে উঠে, তার সমস্ত শরীর পানি থেকে বের হয়ে আসে, দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে সে চরকীর মতো ঘুরপাক খেতে খেতে আবার পানিতে আছড়ে পড়ে, তারপর সে পানি ছিটিয়ে সাঁতরে সাঁতরে পুকুর ঘাটের দিকে আসতে থাকে। পুকুরের সিঁড়ি ধরে সে শামীমের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল, “আব্বু! তুমি ভয় পেয়েছ?”

শামীম বলল, “তোর ধারণা, আমি তোকে ভয় পাই?”

“চমকে উঠেছ কী না বল?”

“হ্যাঁ একটু চমকে উঠেছি। হঠাৎ করে পানি থেকে লাফ দিলি তো, সেজন্যে।”

সেরিনা পুকুর ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে, শামীমের বড় একটা টি শার্ট পরেছে, সেটা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাথার ভিজে চুলগুলো তার মুখে লেপটে আছে। ভিজে শরীর থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সেরিনা ওপরে উঠে ভিজে শরীরে শামীমকে জাপটে ধরে আহ্লাদী গলায় বলল, “আবু আব্বু আবু আব্বু! আমার সুইট আব্বু।”

শামীম বলল, “দিলি আমাকে ভিজিয়ে!”

“ভিজলে কিছু হয় না আব্বু, আবার শুকিয়ে যায়।” শামীম হাত দিয়ে সেরিনাকে ধরে বলল, “তোর কিছু হয় না। তুই হচ্ছিস মৎস্যকন্যা। আমরা তো তোর মতো মৎস্যকন্যা না। মৎস্যমানবও না। আমরা হচ্ছি বোরিং মানুষ”

“মৎস্যমানব হওয়া খুব সোজা। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।”

শামীম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “থাক। আমাকে আর কিছু শিখাতে হবে না।”

সেরিনা বলল, “আব্বু! যা খিদে পেয়েছে তোমাকে কী বলব। মনে হচ্ছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”

“থাক। আস্ত ঘোড়া খেতে হবে না। ভাত খাবি আয়।”

সেরিনা তার ভিজে শরীরে শামীমকে ধরে রাখে। সেই অবস্থায় দুইজনে পুকুর ঘাট থেকে গাছ গাছালীর ছায়া দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ঢুকল। বাসায় কেউ নেই, সাধারণত কেউ থাকে না। সকালে একজন মহিলা এসে ঘর দোর পরিষ্কার করে দেয়। বিকেলে এসে একটু রান্না করে দেয়।

সেরিনা তার ভেজা শরীর মোছায় কোনো চেষ্টা করল না। যতক্ষণ পানিতে ছিল একবারও সে নিশ্বাস নেয় নি। পানি থেকে উপরে উঠে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে শুরু করেছে। শরীর পুরোপুরি শুকিয়ে যাবার পর সে আবার সত্যিকার অর্থে নিশ্বাস নেবে ফুসফুস ব্যবহার করে বাতাস থেকে অক্সিজেন নেবে। যখন ছোট ছিল তখন সেরিনাকে এটা শেখাতে হয়েছে। আস্তে আস্তে এটা সেরিনার জন্যে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে তাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়, যখন অন্যদের সামনে থাকে তখন তাকে ভেজা থাকলেও নিশ্বাস নেবার একটা সুক্ষ্ম অভিনয় করতে হয়।

শামীম খাবার গরম করে টেবিলে রাখতে থাকে। সেরিনা ভেজা শরীরে ঘুর ঘুর করে শামীমকে সাহায্য করে, তারপর দুজন খেতে বসে। সেরিনার প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার সাথে সাথে সে খাবারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শামীম কিছুক্ষণ তাকে খেতে দেখল তারপর বলল, “তোর এত হুড়মুড় করে খেতে হবে না। আস্তে আস্তে খা। তোর খাবার কেউ চুরি করে নেবে না!”

সেরিনা আবার হি হি করে হাসল, বলল, “তোমাকে বলেছি না খিদে লেগেছে!”

“এক ঘণ্টা পানির নিচে সাতরাবি, খিদে লাগবে না!”

“আমি পানির নিচে সাঁতরাই না আব্বু।”

“কী করিস?”

“ঘুরে বেড়াই। শুয়ে থাকি। মাছদের সাথে কথা বলি।”

শামীম হেসে ফেলল, “কী কথা বলিস? কেমন আছেন, ভালো আছেন? ডিম পাড়বেন?”

সেরিনা আবার হি হি করে হাসল, বলল, “আগে মাছগুলো আমাকে দেখলে পালিয়ে যেত। এখন পালায় না। কাছে আসে। আমার সাথে সতরায়। আমি মাঝে মাঝে সাঁতারের কম্পিটিশন করি।”

“কে জেতে?”

“মাছ!” সেরিনা এক টুকরো সবজি চিবুতে চিবুতে বলল, “একটা জিনিস জান আব্বু?”

“কী জিনিস?”

“মাছগুলো কিন্তু বোকা! কুকুর বেড়াল যেরকম পোষ মানে সাথে সাথে ঘুরে বেড়ায মাছগুলো মোটেও সেরকম না। এরা পোষ মানে না।”

শামীম বলল, “তাই তো হবার কথা! কুকুর বেড়াল হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণী। ম্যামেল। তাদের বুদ্ধি তো বেশি হবেই।”

“মাছদের মাঝে স্তন্যপায়ী প্রাণী নেই?”

“থাকবে না কেন? তিমি মাছ? তিমি মাছ তো আসলে মাছ না। তিমি মাছ হচ্ছে ম্যামেল। স্তন্যপায়ী প্রাণী।

সেরিনা হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে বলল “আমরা তো পুকুরে তিমি মাছ পালতে পারব না! এক তিমি মাছেই পুরো পুকুর ভরে যাবে!”

শামীম বলল, “ডলফিনও ম্যামেল। ডলফিন সাইজে ছোট আছে।”

সেরিনা আদুরে গলায় বলল, “আব্বু আমাকে একটা ডলফিন এনে দেবে? প্লীজ প্লীজ!”

“কি করবি?”

“পালব। সাথে নিয়ে সাঁতরাব।”

“এনে দিতাম কিন্তু সমস্যা আছে”

“কী সমস্যা?”

“এগুলো তো লোনা পানিতে থাকে, তোর পুকুরে মনে হয় না বেঁচে থাকতে পারবে।”

সেরিনা আশা ভঙ্গের মতো একটা শব্দ করল। শামীম বলল, “তোর সমস্যাটা কী? পানির নিচেই সবকিছু করতে হবে? পানির উপর কুকুর বিড়াল গরু ছাগল কতো কী আছে? তাদের পোষ মানিয়ে তাদের সাথে সময় কাটা।”

“সেটা তো সবসময়েই কাটাই।”

“শুধু কুকুর বিড়াল কেন? তোর স্কুল আছে না? স্কুলের বন্ধু বান্ধব আছে না? টিচার আছে না?”

সেরিনা বলল, “বন্ধু বান্ধব ঠিক আছে, কিন্তু টিচাররাই তো সমস্যা।”

শামীম জিজ্ঞেস করল, “কেন? টিচাররা কী সমস্যা করল?”

“খুবই কড়া। খালি বলে পড় পড়।“

“বলবেই তো। টিচাররা যদি পড়ার কথা না বলে তাহলে কী বলবে? বলবে খাও খাও? ঘুমাও ঘুমাও?”

সেরিনা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার পড়তে ভালো লাগে না।” কারো পড়তে ভালো লাগে না। তবু পড়তে হয়।”

“পড়ে কী হবে?”

শামীম চোখ কপালে তুলে বলল, “বলিস কী তুই? পড়ে কী হবে মানে? না পড়ে তুই কী করবি?”

“তুমি আর আমি ঘুরে বেড়াব। পৃথিবীর যত নদী আছে দেখব। যত লোক আছে দেখব। যত সমুদ্র আছে দেখব।”

শামীম হেসে সেরিনার মাথার ভেজা চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তুই আর আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব। কিন্তু সে জন্যে পড়া বন্ধ করতে হবে কে বলেছে?”

সেরিনা কিছু বলল না কিন্তু শামীমের যুক্তিটা মেনে নিল সেরকম মনে হল না। বিকেলে সেরিনা বলল, “আব্বু, আমি আবার পানিতে নামি?”

শামীম জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না। তোর আলেক্স চাচা আমাকে অনেকবার বলেছে আমি যেন তোকে সবসময় পানিতে ফেলে না রাখি।”

“কেন?”

“তাহলে ধীরে ধীরে তুই তোর ফুসফুস ব্যবহার করতে ভুলে যাবি। চামড়ার নিচে তোর রক্তনালীগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।”

“আলেক্স চাচা আর কী বলেছে?”

“বলেছে তুই যখন বড় হবি তখন খুব হ্যাঁন্ডসাম একটা ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দিতে।”

“যাও।” বলে সেরিনা শামীমকে একটা ধাক্কা দিল। “আলেক্স চাচা এটা বলতেই পারে না। আমি কোনোদিন বিয়ে করব না।”

“ঠিক আছে করিস না।”

“আমি তোমার সাথে থাকব।“

“ঠিক আছে থাকিস।”

সেরিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার খুব আলেক্স চাচাকে দেখার ইচ্ছা করে।”

সেরিনা শামীমের কাছ থেকে অনেকবার আলেক্সের গল্প শুনেছে। সেরিনার কথা শুনে মানুষটি সেই আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি থেকে রাতারাতি এই দেশে হাজির হয়েছিল। বাক্স বোঝাই করে ওষুধপত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিল। আলেক্স যদি তখন তাকে চিকিৎসা না করতে তাহলে সে নাকী অন্যরকম হয়ে বড় হতো। অক্সিজেনের অভাবে তার মস্তিষ্ক ঠিকভাবে তৈরি হতো না, সে নাকী অনেকটা মানসিক প্রতিবন্ধীর মতো হয়ে যেতো। যে মানুষটা তাকে ঠিক ঠিক মানুষ কিংবা মৎস্যকন্যা করে দিয়েছে তার জন্যে সেরিনা সবসময়েই এক ধরণের ভালোবাসা অনুভব করে। মাউন্ট রেইনিয়ারে বরফের ধ্বসে আলেক্স সারা জীবনের জন্যে হারিয়ে গেছে সেরিনা সেটা মানতেই পারে না!

সেরিনা শামীমের হাত ধরে বলল, “আচ্ছা আব্বু, এ-রকম কী হতে পারে যে আলেক্স চাচা আসলে তুষার ধ্বসে মারা যায় নাই?”

সেরিনা কী বলতে চাইছে শামীম সেটা অনুমান করার চেষ্টা করে বলল, “হতে তো পারেই। কিন্তু তাই যদি হতো তাহলে এতোদিনে কী একবার তোকে দেখতে আসতো না?”

“এরকম কী হতে পারে না যে আলেক্স চাচা বরফ ধ্বসে মারা যায় নাই কিন্তু বরফের নিচে চাপা পড়েছে বলে তার কিছু মনে নাই!”

শামীম অনিশ্চিতের মতো বলল, “হতে পারে।”

“তাহলে এমন কী হতে পারে না যে একদিন হঠাৎ করে আলেক্স চাচার সবকিছু মনে পড়ে যাবে তখন আলেক্স চাচা আমাকে দেখার জন্যে ছুটে আসবে?”

শামীম এই ছেলেমানুষ মেয়েটির দিকে এক ধরনের মমতা নিয়ে তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, “হ্যাঁ। হতেই তো পারে।”

সেরিনার সারা মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, বলল, “তখন কী মজা হবে, তাই না আব্বু?”

“হ্যাঁ। তখন অনেক মজা হবে।”

“আমি তখন আলেক্স চাচাকে নিয়ে স্কুলে যাব।”

“ঠিক আছে।” শামীম সেরিনার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল, “চল এখন আমরা হেঁটে আসি। মাঠে সব বাচ্চারা আছে তাদের সাথে খেলবি চল।”

“চল আব্বু।”

.

একটু পরে দেখা গেল ধান কাটার পর খালি হয়ে যাওয়া মাঠটাতে গ্রামের ছোট বড় অনেক ছেলে মেয়ের সাথে সেরিনা খেলছে। শামীম খেতের আলে বসে থেকে সেরিনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। হরিণীর মতো ক্ষীপ্র একটি মেয়ে। পানির নিচে সে কী করে শামীম কখনো দেখে নি কিন্তু মাটির ওপরে সেরিনার মতো ক্ষীপ্র একটি মেয়ে সে কখনো দেখে নি। পৃথিবীর কেউ জানে না এই মেয়েটি কী বিস্ময়কর। যদি কখনো তারা জানতে পারে তখন কী হবে চিন্তা করেই শামীমের বুক কেঁপে ওঠে।

.

রাতে খাওয়ার পর টেবিলের দুই পাশে শামীম আর সেরিনা বসে পড়াশোনা করছে। শামীম একটা মেডিক্যাল জার্নাল পড়ছে সেরিনা একটা জটিল এলজেবরা সমাধান করার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত এলজেবরাটাকে ঘায়েল করে সেরিনা একটা আনন্দের ধ্বনি করল। শামীম চশমার ওপর দিয়ে সেরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে? এতো আনন্দ কিসের?”

“একটা এলজেবরা করেছি।”

“গুড।”

“অনেক কঠিন ছিল।”

“ভেরি গুড।”

“এলজেবরা করে আমার মগজ জ্যাম হয়ে গেছে।”

“এখন এই জ্যাম ছোটানোর জন্যে কী করতে হবে?”

“আমার সাথে গল্প করতে হবে।”

“কীসের গল্প?”

সেরিনা লাজুক মুখে বলল, “আমার আম্মু আর আব্বুর গল্প। তুমি কেমন করে আমাকে পেয়েছ সেই গল্প।”

শামীম মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলল। সেরিনাকে সে কীভাবে পেয়েছে সেই সত্যি ঘটনাটি সে কখনো তাকে বলে নি। তাকে খুঁজে পাওয়ার একটা কাল্পনিক গল্প বলেছে, সেই গল্পটি সেরিনার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই সেই গল্পটি তাকে বলতে হয়। গল্পটি এতোবার বলেছে যে এখন তার নিজের কাছেই এটাকে সত্যি বলে মনে হয়।

শামীম হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোকে কতোবার এই গল্প বলেছি–আর কতোবার শুনবি?”

সেরিনা বলল, “আরো অনেকবার শুনব আব্বু। গল্পটা শুনতে আমার একটু কষ্ট হয় আবার একটু ভালো লাগে।”

শামীম বলল, “ঠিক আছে, তাহলে কাছে আয়। আমার কাছে বস।”

সেরিনা শামীমের কাছে এসে তার গলা ধরে বসল। শামীম তখন সেরিনাকে খুঁজে পাওয়ার সেই কাল্পনিক কাহিনীটা শুরু করে। কীভাবে একটা নদী দিয়ে সে স্পিড বোটে করে যাচ্ছে, বিশাল নদী সেখানে উথাল পাতাল ঢেউ। সেই নদীতে নৌকা করে একজন মাঝি তার স্ত্রীকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। মাঝ নদীতে হঠাৎ ঝড় উঠেছে। সেই ভয়ংকর ঝড়ের মাঝে কীভাবে মাঝি তার নৌকাটাকে উথাল পাথাল ঢেউয়ের মাঝে হাল ধরে রেখেছে। ঠিক তখন স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছে। ডাক্তার নেই, দাই নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই তার মাঝে সন্তানের জন্ম হল, ফুটফুটে একটা মেয়ে। ঠিক তখন নৌকা পড়েছে এক ঘূর্ণির মাঝে, সাথে দমকা হাওয়া, হঠাৎ করে নৌকা কাত হয়ে গেল। সন্তান ছিটকে পড়ল নদীতে তাকে বাঁচানো জন্যে মা ঝাঁপ দিল নদীতে আর মাঝিও তখন স্ত্রী আর সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঘূর্ণিতে টেনে নিচ্ছে স্ত্রী আর সন্তানকে, মাঝি প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের বাঁচানোর জন্যে।

শামীম তখন সেই ভয়ংকর ঘটনার একটা শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা দিল। সে কীভাবে তার স্পিড বোট নিয়ে সেখানে হাজির হল, তারপর কীভাবে দেখল প্রাণহীন বাবা কীভাবে তার প্রাণহীন স্ত্রীকে ধরে রেখেছে, আর তাদের দুজনের মাঝখানে ছোট একটা শিশু কীভাবে পানিতে ভেসে আছে। তখন শিশুটি ঠিক মাছের মতো সাঁতরে তার কাছে এসেছে, তার দৃষ্টি কী বিস্ময়কর অবাক হয়ে এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই ছোট শিশুটি হচ্ছে সেরিনা।

কাল্পনিক গল্প। বলতে গিয়ে শামীমের গলা ধরে আসে। শুনতে শুনতে সেরিনার চোখ ভিজে আসে।