তোমার নাম কী?
টুরান।
টুরান, তুমি মাত্র বাইশ বছরের একজন যুবক। তুমি কেন পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের অনিশ্চিত জীবনে ঝাঁপ দিতে চাও? তুমি কোথায় বসতি স্থাপন করবে কিংবা আদৌ কোথাও বসতি স্থাপন করতে পারবে কী না সেটি কেউ জানে না।
তুমি কেন এই প্রশ্ন করছ?
টুরান, এখানে প্রশ্ন করব আমি, তুমি উত্তর দেবে। তুমি প্রশ্ন করতে পারবে। বল, তুমি কেন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?
তুমি যে উত্তর শুনলে খুশি হবে সেটি দেব নাকি সত্যি উত্তর দেব? (হাসি) প্রথমে আমাকে খুশি করার জন্যে উত্তরটি দাও।
খুব শৈশব থেকে আমার মহাকাশ নিয়ে কৌতূহল। জন্মের পর থেকে আমার স্বপ্ন ছিল মহাকাশচারী হওয়ার। আমি সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আমি নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ঘুরে বেড়াতে চাই। আমি অজানাকে জানতে চাই।
চমৎকার টুরান। এবারে সত্যি কারণটি বল।
এই পৃথিবী নিয়ে আমার ঘেন্না ধরে গেছে। আমি এই দূষিত গ্রহ থেকে পালাতে চাই।
কেন?
আমার সম্পর্কে সব তথ্য তোমার কাছে আছে। তুমি জান।
টুরান। তোমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। বল, কেন?
তোমরা নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে সব তথ্য জান। কেন আমার কাছে আবার জানতে চাইছ?
আমি তোমাকে বলেছি তুমি প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। বল। কেন?
আমার ভালোবাসার মেয়েটি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
একটা মেয়ের জন্যে তুমি আস্ত পৃথিবীটাকে পরিত্যাগ করতে চাইছ।
হ্যাঁ।
তোমার নাম কী মেয়ে?
ইহিতা।
সুন্দর, একটি নাম। ইহিতা।
তুমিও খুব ভালো করে জান আমিও খুব ভালো করে জানি এটি মোটেও সুন্দর একটি নাম নয়। কাজেই কাজের কথায় চলে আসি।
ঠিক আছে ইহিতা। তুমি কেন পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের একটা অনিশ্চিত যাত্রায় যেতে চাইছ?
এটি মোটেও অনিশ্চিত যাত্রা নয়। পৃথিবী থেকে যখন একটা মহাকাশযান মহাকাশে পাড়ি দেয় সেটি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট যাত্রা। এর প্রতিটি মুহূর্ত অসংখ্যবার সঠিকভাবে যাচাই করে দেখা হয়।
সেটি সত্যি ইহিতা। কিন্তু তুমি জান এর গন্তব্য অনিশ্চিত। এটি যেখানে যাবে সেখানে পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো যায় নি।
বলতে পার সেটি আমার মূল আকর্ষণ।
কেন?
গত কিছুদিনে আমার জীবনের খুব কষ্টের সময় গিয়েছে। আমি সেগুলো ভুলে থাকতে চাই কিন্তু ভুলে থাকতে পারি না। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে গেলে হয়তো ভুলে থাকতে পারব।
স্মৃতি ভুলে থাকা কোনো কঠিন কিছু নয়। নিউরন থেকে স্মৃতি মুছে দিলেই হয়।
আমি মানুষ। আমি রবোমানব নই যে নিউরনের স্মৃতি পুনর্বিন্যাস করব। তুমি কষ্ট করবে?
মানুষ হলেই কষ্ট পেতে হয়। কষ্ট করতে হয়। চেষ্টা করতে হয় কষ্টকে ভুলে থাকতে।
তোমার কষ্টের কথাটা কী বলবে?
আমার ভালোবাসার মানুষটি একটি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমরা বিয়ে করার দিন ঠিক করেছিলাম।
আমি দুঃখিত ইহিতা। শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম।
শুনে তুমি আসলে খুব দুঃখ পাও নি। এটি ভদ্রতার কথা।
তুমি কেন বলছ শুনে আমি দুঃখ পাই নি?
কারণ নেটওয়ার্কে আমার সব তথ্য আছে। তুমি আমার সম্পর্কে সবকিছু জান। তুমি কেন আমার সাথে কথা বলছ আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।
এটি নিয়ম। আমাদের প্রত্যেকের সাথে কথা বলতে হয়।
তোমার নাম কী? টর।
টর, তুমি কেন পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে চাইছ?
আমার বয়স চল্লিশ। আমি পৃথিবীর জীবন মোটামুটি দেখেছি। জীবনটা আমার কাছে একঘেয়ে মনে হচ্ছে। আমি নতুন কিছু চাই, নতুন উত্তেজনা চাই।
তোমার পরিরার?
আমার পরিরার নেই। আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেকদিন আগে।
টর, মহাকাশযান যদি তোমার একঘেয়ে মনে হয়?
সে আশংকাটুকু আছে। কিন্তু আমি সেখানেও উত্তেজনা খুঁজে নিতে পারব।
তাহলে পৃথিবীতে উত্তেজনা কেন খুঁজে নিচ্ছ না টর?
চেষ্টা করেছি। আমাকে দেবার মতো উত্তেজনা পৃথিবীতে নেই।
তুমি কি মনে কর পৃথিবী থেকে মহাকাশে অভিযান করার জন্যে যে বিশাল মহাকাশযানটি প্রস্তুত করা হয়েছে সেটি শুধুমাত্র তোমাকে উত্তেজনা দেবার জন্যে?
না। কিন্তু আমি যদি উত্তেজনা পাই ক্ষতি কী?
উত্তেজনার খোঁজে তুমি যদি দায়িত্বহীন হয়ে যাও?
উল্টোটাও তো হতে পারে।
উল্টো কি হতে পারে টর?
মহাকাশযানের ভয়ংকর কোনো বিপর্যয়ে অন্য সবাই যখন পিছিয়ে যাবে তখন ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে আমি এগিয়ে যাব। সবাইকে রক্ষা করব।
তুমি এটা বিশ্বাস কর, টর?
হ্যাঁ, বিশ্বাস করি। আমার ধারণা তুমিও বিশ্বাস কর।
তুমি কেন এ কথা বলছ?
কারণ নেটওয়ার্কে আমার সব তথ্য আছে। তুমি নিশ্চয়ই আমার সবকিছু জান। আমি যেগুলো জানি না তুমি সেগুলোও জান। আমি কী ঠিক বলেছি?
হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছ।
তোমার নাম কী?
নুট।
তোমার বয়স কত?
আঠারো।
তোমার বয়স মাত্র আঠারো। তুমি কেন পৃথিবীর নিরাপদ জীবন ছেড়ে মহাকাশের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে চাইছ?
মহাকাশ নিয়ে আমার একটি আকর্ষণ আছে।
সেটাই কী একমাত্র কারণ?
হ্যাঁ। সেটাই একমাত্র কারণ।
নুট।
বল।
আমি যদি বলি সেটা একমাত্র কারণ না।
(নিরুত্তর)
নুট।
বল।
আমার কথার উত্তর দাও। তুমি নিশ্চয়ই জান আমাদের নেটওয়ার্কে তোমার সব তথ্য আছে? তুমি মাত্র আঠারো বছরের একজন তরুণ। কিন্তু এর মাঝে তুমি তোমার ঘরে ভয়ংকর ভিরবিয়াস ড্রাগ তৈরি করে বিক্রি করার চেষ্টা করেছ। পৃথিবীতে থাকলে তোমাকে দীর্ঘ সময় শুদ্ধকরণ প্রতিষ্ঠানে কাটাতে হবে। সেজন্যে তুমি মহাকাশে পালিয়ে যেতে চাইছ।
(নিরুত্তর)
আমার কথার উত্তর দাও নুট।
(নিরুত্তর)
নুট।
বল। আমার কথার উত্তর দাও।
(নিরুত্তর)
তোমার নাম কী?
আমার নাম নীহা।
নীহা, তোমার বয়স কত?
ষোল।
নীহা।
বল।
নীহা, তুমি মাত্র ষোল বছরের একটি মেয়ে। তুমি কেন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?
আমি তোমার প্রশ্নটি ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি পৃথিবীতে থাকি আর মহাকাশযানে থাকি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোনো গ্রহতেই থাকি, এর মাঝে পার্থক্য কী?
কোনো পার্থক্য নেই?
না।
কেন নেই, নীহা?
আমি গণিত ছাড়া আর কোনো কিছু বুঝি না। আমি প্রতিমুহূর্তে আমার মস্তিষ্কে গণিতের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি। আমি যখন তোমার সাথে কথা বলছি তখন গণিত নিয়ে চিন্তা করতে করতে কথা বলছি। সত্যি কথা বলতে কী আমি রূপাকভ সমীকরণ নিয়ে চিন্তা করছিলাম। এই মাত্র তার একটি সমাধান পেয়ে গেছি।
তোমাকে অভিনন্দন নীহা।
এটি মোটেও অভিনন্দন পাওয়ার মতো কাজ নয়। খুবই সহজ কাজ।
নীহা। তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। কেন পৃথিবী আর মহাকাশযানে কিংবা অন্য কোনো গ্রহে থাকা একই ব্যাপার?
তার কারণ আমার চারপাশে কী আছে তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার প্রয়োজন ছোট একটা ডেস্ক, ভাবনা করার জন্য নিরিবিলি একটু জায়গা।
পৃথিবীর কী নিরবিলি জায়গা নেই নীহা?
আছে।
তাহলে কেন মহাকাশযানের অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতে চাইছ?
তার কারণ পৃথিবীতে থাকলে আমার চারপাশের সমাজ আমাকে সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব পালন করতে বলবে। আমাকে নিরিবিলি বসে থাকতে দিবে না।
মহাকাশযানে তোমাকে নিরিবিলি বসে থাকতে দেবে?
দেবে। সেখানে মানুষের কোনো দায়িত্ব নেই। মহাকাশযান চালানোর জন্যে শক্তিশালী কম্পিউটার থাকে। তাছাড়া–
তাছাড়া কী, নীহা?
মহাকাশযানে ওঠার পর আমাদের শীতল ঘরে দীর্ঘদিনের জন্যে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। আমার এই ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহ আছে।
কী ধরনের আগ্রহ?
তাপমাত্রা কমিয়ে শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল করে রাখলেও মস্তিষ্কের কোনো একটি ধাপ সচল থাকে বলে আমার ধারণা। আমি দীর্ঘ যাত্রায় মস্তিষ্কের সেই সচল অংশটুকু ব্যবহার করে দেখতে চাই।
নীহা।
বল।
তুমি কী জান তুমি খুব অদ্ভুত একটি মেয়ে।
(নিরুত্তর)
নীহা।
বল।
তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
এটি আরেকটি কারণ।
কোনটি আরেকটি কারণ নীহা?
জন্মের পর থেকে আমি শুনে আসছি যে আমি অদ্ভুত একটি মেয়ে। তাই আমি এমন একটা জায়গায় যেতে চাই সেখানে পৃথিবীর কেউ নেই। কেউ যেন আমাকে না বলে আমি অদ্ভুত একটি মেয়ে।
নীহা।
বল।
আমার ধারণা বহুদূর কোনো গ্রহেও তোমাকে বলা হবে তুমি অদ্ভুত একটি মেয়ে।
(নিরুত্তর)
তুমি কী তবুও মহাকাশযান করে যেতে চাও?
হ্যাঁ।
যেতে চাই।
তোমার নাম কী?
আমার নাম সুহা।
তোমার সাথে যে শিশুটি আছে তার নাম কী?
ক্লদ।
সে তোমার কী হয়?
ক্লদ আমার ছেলে।
আমি তার মা।
সুহা, তোমার বয়স কতো?
আমার বয়স ছাব্বিশ।
ক্লদের বয়স কত? চার।
তুমি তোমার চার বছরের সন্তানকে নিয়ে মহাকাশযানে করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতে রওনা দিতে চাও?
আমি ব্যাপারটি সেভাবে দেখছি না।
তুমি ব্যাপারটি কীভাবে দেখছ?
আমি মনে করি আমার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে এই মহাকাশযানে করে দূর মহাকাশে রওনা দিতে পারলে আমি আমার সন্তানের জীবন নিশ্চিত করতে পারব।।
তুমি কেন এই কথা বলছ?
কারণ আমি জানি রবোমানবেরা পৃথিবী দখল করে নেবে। তখন তারা কোনো মানুষকে রাখবে না। যদিবা রাখে তাদেরকে রবোমানবের আজ্ঞাবহ নিচু শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। আমি আমার সন্তানের জন্যে সেই ধরনের জীবন চাই না। আমি তাকে মানুষের সম্মানিত জীবন দিতে চাই।
তুমি কেন বলছ এই পৃথিবী রবোমানবেরা দখল করে নেবে।
তার কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি তারা প্রায় দখল করে ফেলছে।
তুমি কীভাবে সেটা জান সুহা?
সংবাদ মাধ্যমে আগে রবোমানব খুঁজে পাওয়ার খবর দেয়া হতো। এখন দেয়া হয় না। যার অর্থ রবোমানবদের আর খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। কিংবা–
কিংবা কী?
কিংবা শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীতে রবোমানবেরা ঢুকে গেছে যেটি আরো বিপজ্জনক।
তুমি কী মানুষের কর্মদক্ষতাকে বিশ্বাস কর না?
করি। কিন্তু—
কিন্তু কী সুহা?
রবোমানবেরাও এক ধরনের মানুষ। আমাদের যা আছে তাদেরও তার সবকিছু আছে। তাদের একটা বাড়তি জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে থ্যালামাসে ইমপ্ল্যান্ট করে দেয়া নিউরন স্টিমুলেটর। সেটা তাদের মস্তিষ্ককে অনেক বেশি দক্ষ করে তুলেছে। আমি নিশ্চিতভাবে জানি এই রবোমানবেরা খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবী দখল করে নেবে। আমি তার আগে পৃথিবী ত্যাগ করতে চাই।
তোমার চার বছরের ছেলে ক্লদ? সেও কী যেতে চায়?
ক্লদকে এখনো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া হয় না।
ক্লদের বাবা?
আমি তার সম্পর্কে কথা বলতে চাই না।
কেন?
কারণ আমি তার সম্পর্কে একটি ভালো কথাও বলতে পারব না। আমি ক্লদের সামনে কিছু বলতে চাই না।
ঠিক আছে। আমি কী ক্লদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?
পার।
ক্লদ।
উঁ। তুমি কী জান তুমি কোথায় যাচ্ছ।
জানি।
কোথায়?
আকাশে।
আকাশে কোথায়?
রাত্রিবেলা যে তারাগুলো মিটমিট করে সেখানে।
সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে?
আমি তারাগুলো ধরে একটা কাচের বোতলে রাখব। রাত্রিবেলা সেগুলো বোতলের ভেতর মিটমিট করবে।
চমৎকার ক্লদ। তোমাকে আরেকটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি?
পার। তুমি তোমার মাকে কতটুকু ভালোবাস?
অনেকটুকু। এই ঘরের সমান। আরো বেশি।
চমৎকার ক্লদ। চমৎকার।