০৩. ঝড়ের রাত

৩. ঝড়ের রাত

ট্রনেদের আক্রমণের পর তিন মাস কেটে গেছে, সেই ভয়ংকর বিভীষিকার স্মৃতির উপর সময়ের প্রলেপ পড়তে শুরু করেছে। তবে সবার জন্যে নয়। কয়েকটি মা সেই ঘটনার পরপরই সমুদ্রের পানিতে আত্মাহুতি দিয়েছে, তাদের শিশুপুত্র-কন্যাদের পরিণতিটুকু কিছুতেই তারা ভুলতে পারে নি। কয়েকজন মা এবং বাবার খানিকটা করে মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। যাদের ধরে নিয়ে গেছে, তাদের প্রিয়জনের মানসিক অবস্থা সম্ভবত আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না। তাদের বেশির ভাগই প্রায় সর্বক্ষণ একটি গভীর যন্ত্রণার মাঝে সময় কাটায়।

অন্যের মোটামুটি সামলে নিয়েছে। মানুষের সহ্য করার ক্ষমতার নিশ্চয়ই কোনো সীমা নেই, বিশেষ করে দুঃখী মানুষের। আর আমাদের মতো দুঃখী মানুষ আর কে হতে পারে?

আমার মা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজটি ছেড়ে দিয়েছেন। ট্রনেদের আক্রমণে। সেটিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। সারতে সময় নেবে। ট্রনদের আক্রমণে অনেক শিশু অনাথ হয়েছে, মা তাদের জন্যে একটা অনাথাশ্রম খুলেছেন। আমি খামারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাকে সেখানে সাহায্য করি।

সেদিন ভোরবেলা থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেঘ কেটে পরিষ্কার না হয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল, তার সাথে ঝড়ো হাওয়া। মা বাইরে তাকিয়ে বললেন, কুনিল, বৃষ্টির ধরনটা ভালো লাগছে না। আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তিটা কি?

আমাদের সত্যিকার কোনো রেডিও টেলিভিশন স্টেশন নেই। জরুরি প্রয়োজনে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার জন্যে শর্ট ওয়েভে কিছু ভিডিও সিগনাল পাঠানো হয়। আলাদা করে টেলিভিশন কারো নেই, কম্পিউটারের মনিটরে ভিডিও সিগনালটি দেখতে হয়। আমি দেখার চেষ্টা করলাম, আবহাওয়া খারাপ বলে ভিডিও সিগনালটিও খুব খারাপ। তবু বুঝতে পারলাম সমুদ্রে একটা নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। সেটা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আমাদের এলাকায় আসতে পারে। আমি মাকে খবরটা জানালাম। মা চিন্তিত মুখে বললেন, বাচ্চাদের তাহলে সরিয়ে ফেলা দরকার।

কোথায় সরাবে মা?

আরো ভেতরে। স্কুলঘরটা যথেষ্ট উঁচু নয়, জলোচ্ছ্বাস হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। একটা উঁচু জায়গায় রাত কাটানো দরকার।

মা একটি রেনকোট পরে বাইরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। আমি বললাম, দাঁড়াও মা, আমিও যাই তোমার সাথে।

যাবি? চল। মা সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। এই ঝড়ো হাওয়ার মাঝে উন্মুক্ত সমুদ্রের ধার ঘেঁষে একা একা যেতে নিশ্চয়ই মায়ের একটু ভয় ভয় করছিল। আমার মা খুব সাহসী মহিলা, প্রয়োজন হলে খেপা সিংহীকেও খালিহাতে জাপটে ধরবেন, কিন্তু ঝড়-বৃষ্টিকে খুব ভয় পান। আমার ঠিক উল্টো। ঝড়-বৃষ্টি আমার অসম্ভব ভালো লাগে। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে যখন সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে, আমি আমার রক্তের মাঝে একধরনের উন্মুক্ত আনন্দের ডাক শুনতে পাই।

সমুদ্রের তীর ঘেঁষে আমরা হেঁটে যাই। আকাশে কেমন একটা লালচে রং। সমুদ্র উত্তাল হয়ে আছে, বড় বড় ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। ঝড়োহাওয়া আমাদের উড়িয়ে নিতে চায়। আমরা যখন অনাথাশ্রমের স্কুলঘরটিতে পৌঁছেছি, তখুন দু’জনেই শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি।

বাচ্চাগুলো আমার মাকে দেখে খুব খুশি হল। মা একটা আগুন তৈরি করে হাতপা সেঁকে একটু গরম হয়ে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। জনা পঞ্চাশেক বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাকে এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাইল দুয়েক ভেতরে একটা নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা খুব সহজ কথা নয়। যখন কাজ শেষ হয়েছে, তখন বেলা পড়ে এসেছে। কয়েকজন স্থানীয় মানুষকে দায়িত্ব দিয়ে মা ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। এক জন বলল, এই ঝড়-বৃষ্টিতে ফিরে যাবেন কি, রাতটা কাটিয়ে যান।

মা বললেন, না গো, ফিরে যাই। নিজের বাড়ি না হলে ঘুম আসতে চায় না।

আমরা যখন পথে নেমেছি তখন ঝড়ের বেগ আরো অনেক বেড়েছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সুচের মতো বিধছে শরীরে। আকাশে কেমন জানি একটা ঘোলাটে লাল রং, সমুদ্রে কালচে অশুভ ছায়া। বড় বড় ঢেউ এসে প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ছে তীরে। আমি বুকের ভেতর একধরনের উন্মত্ততা অনুভব করি। দুই হাত উপরে তুলে ঝড়ো হাওয়ার সাথে এক পাক নেচে মাকে বললাম, কী সুন্দর ঝড়।

মা গলা উঁচিয়ে বললেন, কি বাজে কথা বলিস! ঝড় আবার সুন্দর হয় কেমন করে?

আমি মায়ের কথায় কান না দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম, আয় আয় আয়রে—আরো জোরে আয়।

মা বললেন, চুপ করু–চুপ কর অলক্ষুণে ছেলে!

আমি আবার চিৎকার করে বললাম, ভেঙে ফেল সবকিছু। ধ্বংস করে ফেল পৃথিবী—

মা আমাকে ধমক দিয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে গিয়ে অবাক হয়ে বললেন, কে? কে ওটা বসে আছে এই ঝড়-বৃষ্টিতে?

কোথায়?

মা হাত তুলে সমুদ্রতীর দেখালেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় গুটিসুটি মেরে কে যেন বসে আছে। এত দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু মনে হচ্ছে লোকটির গায়ে কোনো কাপড় নেই। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ একেক বার খুব কাছে এসে আছড়ে পড়ছে। ঝড়ের বেগ আরো বাড়লে লোকটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উত্তাল তরঙ্গ। মা বললেন, ডাক দেখি লোকটাকে।

আমি চিৎকার করে ডাকলাম, কে ওখানে? ঝড়ের প্রচণ্ড গর্জনে আমার গলার স্বর চাপা পড়ে গেল, লোকটি ফিরে তাকাল না।

মা বললেন, আহা, কোনো পাগল মানুষ?

আমি বললাম, হতে পারে আত্মহত্যা করতে এসেছে। মা আমার দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বললেন, চল্ দেখি গিয়ে।

আমার মা, যিনি ঝড়-বৃষ্টি-ঘর্ণিঝডকে এত ভয় পান তাঁর জন্যে এই ঝড়ের মাঝে সমুদ্রতীরে যাওয়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সাহসের কাজ। আমি দেরি না করে সমুদ্রতীরে ছুটতে থাকি। ‘হে পরম করুণাময় ঈশ্বর’ জপতে জপতে আমার মা পিছু পিছু আসতে থাকেন।

মানুষটির কাছে এসে প্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে মানুষটি পুরোপুরি নগ্ন। মানুষ সাধারণত নগ্নতাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু এই মানুষটির বসার ভঙ্গিটিতে না ঢেকে রাখার কোনো চেষ্টা নেই। বৃষ্টির ছাঁটে সে ভিজে চুপসে গেছে, কিন্তু সে পুরোপুরি নির্বিকারভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে? কে ওখানে?

আমার গলার স্বর শুনে লোকটি ঘুরে আমার দিকে তাকাল, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, অপূর্ব সুন্দর একটি তরুণ। আমি আমাদের সবাইকে চিনি, এই তরুণটি ভিন্ন কোনো অঞ্চলের। এত সুন্দর চেহারা, নিশ্চয়ই কোনো টন। আমি এক পা পিছিয়ে এসে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?

তরুণটি কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি পিছনে তাকালাম, মা অনেক পিছনে পড়ে গেছেন, ঝড়োহাওয়ার সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে কোনোমতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কে? কে লোকটা?

মনে হয় ট্রন।

ট্রন? মা চমকে উঠলেন, ট্রন কোথা থেকে আসবে?

দেখ না মা, চেহারা অন্যরকম।

মা এবারে কাছে এগিয়ে গেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তরুণটি কোনো উত্তর দিল না। মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিট্রন?

তরুণটি কোনো উত্তর দিল না, একটু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মা যে এক জন মহিলা এবং তার সামনে যে নগ্নতাকে একটু আড়াল করা দরকার, মনে হয় সেটাও সে জানে না।

দমকা হাওয়ার সাথে সাথে হঠাৎ বৃষ্টির বেগ অনেক বেড়ে গেল, তরুণটি শীতে একটু কেপে উঠে ধীরে ধীরে হাত দুটি বুকের উপর দিয়ে নিয়ে নিজেকে শীত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। বৃষ্টির পানি তার চুল ভিজিয়ে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

মা আমাকে বললেন, ছেলেটিকে বাসায় নিতে হবে, এখানে তো ফেলে রাখা যাবে না।

আমি বললাম, কেমন করে নেবে মা, মনে হয় পাগল।

মা নিজের রেনকোটটা খুলে, ভেতর থেকে চাদরটা বের করে তরুণটার কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, তুমি চল আমার সাথে। তরুণটি স্থির এবং কেমন জানি বিষণ্ণ ভঙ্গিতে আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মা এবারে তার হাত ধরে তোলার চেষ্টা করলেন। তরুণটি বেশ সহজেই উঠে দাঁড়াল। মা হাতের চাদরটি দিয়ে তাকে ঢেকে দিলেন, তরুণটি বাধা দিল না। মা আবার বললেন, তুমি এস আমার সাথে।

তার হাত ধরে আকর্ষণ করতেই তরুণটি ছোট পদক্ষেপে হাঁটতে থাকে। মা তার হাত ধরে বাসার দিকে যেতে থাকেন।

ব্লাস্তায় উঠে মা তরুণটির হাত ছেড়ে দেন, তরুণটি ছোট ছোট পদক্ষেপে আমাদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যায় না, কিন্তু তার হাঁটার ভঙ্গিটিতে একটি আশ্চর্য নির্লিপ্ততা। মনে হয় পৃথিবীর কোনো কিছুতে তার কোনো আকর্ষণ নেই।

প্রচণ্ড ঝড়োহাওয়া আমাদের উড়িয়ে নিতে চায়, তার মাঝে মাথা নিচু করে কোনোমতে বাসায় পৌঁছাই। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ঘরের আলো নিবুনিবু করছে, আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারটি প্রায় প্রাগৈতিহাসিক, ঝড়-বৃষ্টি হলে বড় শর্ট সার্কিট হয়ে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। মনে হয় আজকেও সেরকম কিছু-একটা হবে। মা ঝুঁকি নিলেন না, দেরাজ থেকে মোমবাতি বের করে জ্বালিয়ে নিলেন। প্রায় সাথে সাথেই বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ হয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরের ভিতর ছোট মোমবাতির আলোতে চাদর জড়িয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণটিকে অত্যন্ত রহস্যময় দেখাতে লাগল। সে স্থির দৃষ্টিতে মোমবাতির শিখাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় চোখের পলক পড়ছে না।

মা একটি শুকনা তোয়ালে নিয়ে এসে বললেন, বাবা, শরীরটা মুছে নাও।

তরুণটি মায়ের কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল না, মা তখন নিজেই তার শরীরটা মুছে দিয়ে আরেকটা শুকনা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তরুণটি দুই হাত দিয়ে চাদরটি জড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

রাতে তরুণটি কিছু খেল না। খাবারের আয়োজন আহামরি কিছু ছিল না; সুপ, আলুসেদ্ধ ও শুকনা মাংস, কিন্তু তরুণটিকে খাবারের টেবিলের কাছেই আনা গেল না। মা স্যুপের বাটিটা নিয়ে তার মুখে কয়েকবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সে প্রত্যেকবারই তার মুখ সরিয়ে নিল।

আমি বললাম, মনে হয় অনেক ভালো খাবার খেয়ে অভ্যাস, তোমার স্যুপ খেতে পারছে না।

মা উষ্ণ হয়ে বললেন, বাজে বকিস না। আমার স্যুপ যে খেয়েছে, সে কখনো তার স্বাদ ভোলে নি।

কথাটি সত্যি, শুধু স্যুপ নয়, মা সবকিছু খুব ভালো রান্না করেন।

রাত বাড়ার সাথে সাথে ঝড়ের প্রকোপ আরো বেড়ে যেতে থাকে। আমি কয়েকবার ভিডিও বুলেটিনটি শুনতে চেষ্টা করলাম, ঘরে বিদ্যুৎ নেই বলে খুব লাভ হল না। ভয়ঙ্কর জলোচ্ছাস শুরু হওয়ার আগে পাহাড়ের চুড়ায় একটি লাল বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, সেটি এখনো জ্বালানো হয় নি। মা প্রতি দুই মিনিটে একবার করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলছিলেন, হে করুণাময় সৃষ্টিকর্তা, রক্ষা কর, রক্ষা কর—

কোনো কাজ নেই বলে সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম। মা তরুণটির জন্যে একটি উঃ বিছানা তৈরি করে দিলেন কিন্তু সে জানালার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। আমি নিজের বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঝড়ের শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার ঘুম ভাঙল মায়ের আর্তচিৎকারে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি, মা হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে আমাকে ঝাকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ওঠ, ঘুম থেকে ওঠ, সর্বনাশ হয়েছে, সর্বনাশ–

কী হয়েছে মা? কি?

পানি আসছে। পানি–

আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলাম, আমাদের বাসাটি একটি পাহাড়ের পাদদেশে, বড় জলোচ্ছ্বাস এলে পুরো বাসাটি পানিতে তলিয়ে যাবার কথা। আগেও কয়েকবার আমরা খুব অল্প সময়ের মাঝে বাসা ছেড়ে পাহাড়ে উঠে গেছি। ব্যাপারটিতে সেরকম কোনো ভয় নেই, সত্যি কথা বলতে কি, আমার প্রত্যেকবারই কেমন একধরনের ফুর্তি হয়েছে। মায়ের কথা অবশ্যি ভিন্ন, তিনি আতঙ্কে অধীর হয়ে প্রত্যেকবারই মৃতপ্রায় হয়ে গেছেন।

আমি উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। গাঢ় অন্ধকার নেই, আবছা আলোতে বেশ দেখা যায়। সমুদ্র ফুসে উঠছে, বড় বড় ঢেউয়ে পানি অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। আমি পাহাড়ের উপরে তাকালাম, একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিতছে। তার মানে মায়ের আতঙ্কট অহেতুক নয়, সত্যি সত্যি বড় জলোচ্ছাস আসছে।

আমি জুতো পরছিলাম, মা তাড়া দিলেন, এখন এত সাজগোজের দরকার কি?

সাজগোজ কোথায় দেখলে? খালিপায়ে যাব নাকি?

পাগল ছেলেটাকে নিতে হবে আবার!

আমার হঠাৎ তরুণটির কথা মনে পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম, কী করছে মা?

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমায় নি?

না। ওঠ এখন, বের হতে হবে। মা ছুটে গিয়ে তরুণটির হাত ধরে টেনে আনলেন। সে একটু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল, কিন্তু বের হয়ে আসতে আপত্তি করল না। বাইরে বৃষ্টিটা কমেছে, কিন্তু প্রচণ্ড বাতাস। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি, পিছনে মা তরুণটিকে হাত ধরে আনছেন। একটু উঠে পিছনে তাকালাম, হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলাম, তরুণটি সোজা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর মা তারস্বরে চিৎকার করছেন। আমি ছুটে গিয়ে তরুণটিকে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অসম্ভব শক্তি এই বিচিত্র তরুণটির। আমাকে প্রায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সোজা সমুদ্রের দিকে হেঁটে গেল। ভয়ংকর একটা ঢেউ ছুটে আসছে। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম, মুহূর্তে ঢেউটি এই তরুণটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উন্মত্ত সমুদ্রে। কিন্তু একটা খুব বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, ভয়ঙ্কর ঢেউটি হঠাৎ করে ভেঙে গেল তার পায়ের কাছে। পানির ঢল হয়ে নিচে নেমে গেল ঢেউটি।

তরুণটি আরো এগিয়ে যায়, পানির বড় আরেকটা ঢেউ আবার আঘাত করতে এগিয়ে এসে পায়ের কাছে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। কী আশ্চর্য! তরুণটি কেমন করে জানল এটি ঘটবে? কী বিচিত্র আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত সমুদ্রের দিকে, আর কী সহজে উন্মত্ত সমুদ্র বশ মেনে যাচ্ছে এই তরুণের কাছে!

আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মা আমার পাশে এসে দাঁড়ান। ফিসফিস করে বলেন, কুনিল। দেখেছিস?

কী হচ্ছে এটা মা? সত্যি কি হচ্ছে?

হ্যাঁ বাবা। আমি দেখে বুঝেছিলাম এ সাধারণ মানুষ নয়।

তাহলে কে?

ঈশ্বরের দূত। মা ফিসফিস করে প্রার্থনা শুরু করলেন, হে পরম করুণাময় ঈশ্বর। দয়া কর। দয়া কর। দয়া কর।

আরেকটি ভয়াবহ ঢেউ ছুটে আসছে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো। তরুণটি ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে যায় আর সেই ভয়াবহ জলরাশি আবার পায়ের কাছে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তরুণটি মাথা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে, আর বিশাল জলরাশি মাথা নিচু করে পিছিয়ে যাচ্ছে। গায়ের সাদা চাদর উড়ছে বাতাসে, মনে হচ্ছে সত্যিই সে নেমে এসেছে স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের আহ্বানে। তার সামনে মাথা নত করে ফেলছে প্রকৃতি, উন্মত্ত সমুদ্র, ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস।

মা আবার ফিসফিস করে বললেন, ঈশ্বর আমাদের দিকে মুখ চেয়ে তাকিয়েছেন। তাঁর দূত পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। দেখু কুনিল, তাকিয়ে দেখ! হা ঈশ্বর! হা ঈশ্বর।

আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলাম, কিন্তু তবু মায়ের কথার সাথে একমত হতে পারলাম না। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, এই পৃথিবীতে যে ভয়ঙ্কর অত্যাচার করা হয়, এক জন ঈশ্বর থাকলে তিনি সেটা করতে দিতেন না। আর সেটা যদি করতে দিয়ে থাকেন, হঠাৎ করে একটি জলোচ্ছ্বাস থামিয়ে দেওয়ার জন্যে এক জন উলঙ্গ দূত পাঠিয়ে দেবেন না। আমাদের জন্যে ঈশ্বরের বিন্দুমাত্র ভালবাসা নেই। বিন্দুমাত্রও নয়।

এই তরুপটি মানসিক ভারসামহীন একটি তরুণ। নির্বোধের মতো সে জলোচ্ছ্বাসের মাঝে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল। ঘটনাক্রমে ঠিক সেই মুহূর্তে জলোচ্ছাস সরে গিয়েছে। মানসিক ভারসামাহীন এই তরুণ এক জন ভাগ্যবান তরুণ—অসম্ভব ভাগ্যবান এক জন তরুণ। তার বেশি কিছু নয়।

আমি অবাক বিস্ময়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এই অস্বাভাবিক ভাগ্যবান তরুণটির দিকে তাকিয়ে থাকি।