[ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রদত্ত বক্তৃতা]
প্রাচীনকালে ভরত নামে এক প্রবলপ্রতাপ সম্রাট্ ভারতবর্ষে রাজত্ব করিতেন। বৈদেশিকগণ যাহাকে ‘ইণ্ডিয়া’ নামে অভিহিত করেন, তাহা ঐ দেশের অধিবাসিগণের নিকট ‘ভারতবর্ষ’ নামে পরিচিত। শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে বৃদ্ধ হইলে সকল আর্য-সন্তানকেই সে-যুগে সংসার ছাড়িয়া, নিজ পুত্রের উপর সংসারের সমস্ত ভার ঐশ্বর্য ধন সম্পত্তি সমর্পণ করিয়া বানপ্রস্থাশ্রম অবলম্বন করিতে হইত। সেখানে তাঁহাকে তাঁহার যথার্থ স্বরূপ—আত্মার চিন্তায় কালক্ষেপ করিতে হইত; এইরূপে তিনি সংসারের বন্ধন ছেদন করিতেন। রাজাই হউন, পুরোহিতই হউন, কৃষকই হউন, ভৃত্যই হউন, পুরুষই হউন বা নারীই হউন, এই কর্তব্য হইতে কেহই অব্যাহতি পাইত না। কারণ—পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নী, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি রূপে গৃহস্থের অনুষ্ঠেয় কর্তব্যগুলি সেই এক চরম অবস্থায় পৌঁছিবার সোপান মাত্র, যে অবস্থায় মানুষের জড়বন্ধন চিরদিনের জন্য ছিন্ন হইয়া যায়।
রাজা ভরত বৃদ্ধ হইলে পুত্রকে সিংহাসনে বসাইয়া বনে গমন করিলেন। এক সময় যিনি লক্ষ লক্ষ প্রজার দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা ছিলেন, যিনি সুবর্ণরজতখচিত মর্মরপ্রাসাদে বাস করিতেন, যাঁহার পানপাত্র নানাবিধ রত্নমণ্ডিত ছিল, তিনি হিমারণ্যের এক স্রোতস্বিনীতীরে কুশ ও তৃণদ্বারা সহস্তে এক ক্ষুদ্র কুটীর নির্মাণ করিয়া বন্য ফলমূল খাইয়া জীবনধারণ করিতে লাগিলেন। মানবাত্মায় যিনি অন্তর্যামিরূপে নিত্যবর্তমান, সেই পরমাত্মার অহরহঃ স্মরণ-মননই তাঁহার একমাত্র কার্য হইল।
এইরূপে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর চলিয়া গেল। একদিন রাজর্ষি নদীতীরে বসিয়া উপাসনা করিতেছেন, এমন সময় এক হরিণী জল পান করিবার জন্য সেখানে উপস্থিত হইল। ঠিক সেই সময়েই কিছুদূরে একটি সিংহ প্রবল গর্জন করিয়া উঠিল। হরিণী এত ভীত হইল যে, পিপাসা দূর না করিয়াই নদী পার হইবার জন্য এক উচ্চ লম্ফ প্রদান করিল। আসন্নপ্রসবা হরিণী এইরূপে হঠাৎ ভয় পাওয়ায় এবং লম্ফপ্রদানের অতিরিক্ত পরিশ্রমে তৎক্ষণাৎ একটি শাবক প্রসব করিয়াই প্রাণত্যাগ করিল। হরিণশাবকটি জন্মিয়াই জলে পড়িয়া গেল; নদীর খরস্রোত তাহাকে দ্রুত একদিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছিল, এমন সময় রাজার দৃষ্টি সেইদিকে নিপতিত হইল। রাজা নিজ আসন হইতে উঠিয়া হরিণশাবকটিকে জল হইতে উদ্ধার করিলেন, পরে নিজ কুটীরে লইয়া গিয়া অগ্নিসেকাদি শুশ্রূষা দ্বারা তাহাকে বাঁচাইয়া তুলিলেন। করুণাহৃদয় রাজর্ষি অতঃপর হরিণশিশুটির লালনপালনের ভার স্বয়ং গ্রহণ করিলেন, প্রত্যহ তাহার জন্য সুকোমল তৃণ ও ফলমূলাদি স্বয়ং সংগ্রহ করিয়া তাহাকে খাওয়াইতে লাগিলেন। সংসারত্যাগী রাজর্ষির পিতৃসুলভ যত্নে হরিণশিশুটি দিন দিন বাড়িতে লাগিল। ক্রমে সে একটি সুন্দরকায় হরিণ হইয়া দাঁড়াইল। যে রাজা নিজের মনের বলে পরিবার রাজ্যসম্পদ অতুল বৈভব ও ঐশ্বর্যের উপর চিরজীবনের মমতা কাটাইয়াছিলেন, তিনি এখন নদী হইতে বাঁচান মৃগশিশুর উপর আসক্ত হইয়া পড়িলেন। হরিণের উপর তাঁহার স্নেহ যতই বর্ধিত হইতে লাগিল, ততই তিনি ঈশ্বরে চিত্তসমাধান করিতে অসমর্থ হইলেন। বনে চরিতে গিয়া যদি হরিণটির ফিরতে বিলম্ব হইত, তাহা হইলে রাজর্ষির মন তাহার জন্য অতিশয় উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল হইত। তিনি ভাবিতেন—আহা, বুঝি আমার প্রিয় হরিণটিকে বাঘে আক্রমণ করিয়াছে, হয়তো বা তাহার অন্য কোনপ্রকার বিপদ হইয়াছে, তাহা না হইলে এত বিলম্ব হইতেছে কেন?
এইরূপে কয়েক বৎসর কাটিয়া গেল। অবশেষে কালচক্রের পরিবর্তনে রাজর্ষির মৃত্যুকাল উপস্থিত হইল। কিন্তু তাঁহার মন মৃত্যুকালেও আত্মতত্ত্বধ্যানে নিবিষ্ট না হইয়া হরিণটির চিন্তা করিতেছিল। নিজ প্রিয়তম মৃগটির কাতর নয়নের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে তাঁহার জীবাত্মা দেহত্যাগ করিল। মৃত্যুকালে হরিণ-ভাবনার ফলে পরজন্মে তাঁহার হরিণ-দেহ হইল। কিন্তু কোন কর্মই একেবারে ব্যর্থ হয় না। সুতরাং রাজর্ষি ভরত গৃহস্থাশ্রমে রাজারূপে এবং বানপ্রস্থাশ্রমে ঋষিরূপে যে-সকল মহৎ ও শুভ কার্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাহারও ফল ফলিল। যদিও তিনি বাক্শক্তিরহিত হইয়া পশু-শরীরে বাস করিতেছিলেন, তথাপি তিনি জাতিস্মর হইলেন অর্থাৎ পূর্বজন্মের সকল কথাই তাঁহার স্মৃতিপথে উদিত রহিল। তিনি নিজ সঙ্গিগণকে পরিত্যাগ করিয়া পূর্বসংস্কারবশে ঋষিগণের আশ্রমের নিকট বিচরণ করিতে যাইতেন; সেখানে প্রত্যহ যোগ, হোম ও উপনিষদ্ আলোচনা হইত।
মৃগরূপী ভরত যথাকালে দেহত্যাগ করিয়া পরজন্মে কোন ধনী ব্রাহ্মণের কনিষ্ঠ পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করিলেন। ঐ জন্মেও তিনি জাতিস্মর হইলেন, সুতরাং পূর্ববৃত্তান্ত সর্বদা স্মৃতিপথে জাগরূক থাকায় বাল্যকাল হইতেই তাঁহার এই দৃঢ়সঙ্কল্প হইল যে, তিনি আর সংসারের ভালমন্দে জড়িত হইবেন না। শিশুর ক্রমে বয়োবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তিনি বেশ বলিষ্ঠ ও হৃষ্টপুষ্ট হইলেন, কিন্তু কাহারও সহিত কোন বাক্যালাপ করিতেন না; পাছে সংসারজালে জড়িত হইয়া পড়েন—এই ভয়ে তিনি জড় ও উন্মত্তের ন্যায় ব্যবহার করিতেন। তাঁহার মন সেই অনন্তস্বরূপ পরব্রহ্মে সর্বদা নিমগ্ন থাকিত, প্রারব্ধ কর্ম ভোগদ্বারা ক্ষয় করিবার জন্যই তিনি জীবনযাপন করিতেন। কালক্রমে পিতার মৃত্যুর পর পুত্রগণ পিতৃ-সম্পত্তি আপনাদের মধ্যে ভাগ করিয়া লইলেন। তাঁহারা ঐ সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতাকে জড়প্রকৃতি ও অকর্মণ্য জ্ঞান করিয়া তাঁহার প্রাপ্য সম্পত্তি হইতে তাঁহাকে বঞ্চিত করিয়া নিজেরাই তাহা গ্রহণ করিলেন। তাঁহারা ভ্রাতার প্রতি এইটুকুমাত্র অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন যে, তাঁহাকে দেহধারণের উপযোগী আহারমাত্র দিতেন। ভ্রাতৃজায়াগণ সর্বদাই তাঁহার প্রতি অতি কর্কশ ব্যবহার করিয়া তাঁহাকে গুরুতর শ্রমসাধ্য কার্যে নিযুক্ত করিতেন; আর যদি তিনি তাঁহাদের ইচ্ছানুরূপ সকল কার্য করিতে না পারিতেন, তবে তাঁহারা তাঁহার সহিত নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতেন। কিন্তু ইহাতেও তাঁহার কিছুমাত্র বিরক্তি বা ভয় হইত না, তিনি একটি কথাও বলিতেন না। যখন অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়া যাইত, তখন তিনি গৃহ হইতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া যাইতেন, ও তাঁদের ক্রোধের উপশম না হওয়া পর্যন্ত ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃক্ষতলে বসিয়া থাকিতেন। তাঁহাদের রাগ পড়িয়া গেলে আবার শান্তভবে গৃহে ফিরিতেন।
একদিন জড়ভরতের ভ্রাতৃবধূগণ তাঁহাকে অতিরিক্ত তাড়না করিলে তিনি গৃহের বাইরে গিয়া এক বৃক্ষচ্ছায়ায় বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। সেই সময় সেই দেশের রাজা শিবিকারোহণে সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। হঠাৎ একজন শিবিকা-বাহক অসুস্থ হইয়া পড়িলেন রাজার অনুচরবর্গ তাহার স্থানে শিবিকাবাহন-কার্যের জন্য আর একজন লোক অন্বেষণ করিতে লাগিল; অনুসন্ধান করিতে করিতে জড়ভরতকে বৃক্ষতলে উপবিষ্ট দেখিতে পাইল। তাহাকে সবল যুবাপুরুষ দেখিয়া তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘রাজার এক শিবিকাবাহকের পীড়া হইয়াছে; তুমি তাহার পরিবর্তে রাজার শিবিকা বহন করিতে রাজী আছ?’ ভরত তাহাদের প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। রাজার অনুচরগণ দেখিল এ ব্যক্তি বেশ হৃষ্টপুষ্ট; অতএব তাহারা তাহাকে বলপূর্বক ধরিয়া লইয়া শিবিকাবাহনে নিযুক্ত করিল। ভরতও নীরবে শিবিকা বহন করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে রাজা দেখিলেন, শিবিকা বিষমভাবে চলিতেছে। শিবিকার বহির্দেশে দৃষ্টিপাত করিয়া তিনি নূতন বাহককে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘মূর্খ, কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম কর্, যদি তোর স্কন্ধে বেদনাবোধ হইয়া থাকে, তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর্, যদি তোর স্কন্ধে বেদনাবোধ হইয়া থাকে, তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর্।’ তখন ভরত স্কন্ধ হইতে শিবিকা নামাইয়া জীবনে এই প্রথম মৌনভঙ্গ করিয়া রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেনঃ হে রাজন্, কাহাকে আপনি মূর্খ বলিতেছেন? কাহাকে আপনি শিবিকা নামাইতে বলিতেছেন? কে ক্লান্ত হইয়াছে, বলিতেছেন? কাহাকে ‘তুই’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন? হে রাজন্, ‘তুই’ শব্দের দ্বারা যদি আপনি এই মাংসপিণ্ড— দেহটাকে লক্ষ্য করিয়া থাকেন, তবে দেখুন, আপনার দেহ যেমন পঞ্চভূতনির্মিত, এই দেহও তেমনি। আর দেহটা তো অচেতন, জড়; ইহার কি কোন প্রকার ক্লান্তি বা কষ্ট থাকিতে পারে? যদি ‘মন’ আপনার লক্ষ্য হয়, তবে আপনার মন যেরূপ, আমারও তো তাহাই—উহা তো সর্বব্যাপী। আর যদি ‘তুই’ শব্দে দেহমনেরও অতীত বস্তুকে লক্ষ্য করিয়া থাকেন, তাহা হইলে তো ইহা সেই আত্মা—আমার যথার্থ স্বরূপ ব্যতীত আর কিছুই নহে, তাহা আপনাতে যেমন, আমাতেও তেমনি; জগতের মধ্যে ইহা সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ তত্ত্ব। রাজন্ আপনি কি বলিতে চাহেন, আত্মা কখনও ক্লান্ত হইতে পারেন? আপনি কি বলিতে চাহেন, আত্মা কখনও আহত হইতে পারেন? হে রাজন্, অসহায় পথসঞ্চারী কীটগুলিকে পদদলিত করিবার ইচ্ছা আমার এই দেহটার ছিল না, তাই যাহাতে তাহারা পদদলিত না হয়, সেজন্য এইভাবে সাবধান হইয়া চলতেই শিবিকার গতি বিষম হইয়াছিল। কিন্তু আত্মা তো কখনও ক্লান্তি অনুভব করে না, দুর্বলতা বোধ করে না; কারণ আত্মা সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান্। এইরূপে তিনি আত্মার স্বরূপ, পরাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়-সম্বন্ধে ওজস্বিনী ভাষায় অনেক উপদেশ দিলেন।
রাজা পূর্বে বিদ্যা ও জ্ঞানের জন্য গর্বিত ছিলেন, তাঁহার অভিমান চূর্ণ হইল। তিনি শিবিকা হইতে অবতরণ করিয়া, ভরতের চরণে পতিত হইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘হে মহাভাগ, আপনি যে একজন মহাপুরুষ, তাহা না জানিয়াই আপনাকে শিবিকাবাহন-কার্যে নিযুক্ত করিয়াছিলাম, সেজন্য আমি আপনার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছি।’ ভরত তাঁহাকে আশীর্বাদ করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন এবং পূর্ববৎ নিজের ভাবে নীরবে জীবনযাপন করিতে লাগিলেন। যখন ভরতের দেহপাত হইল, তিনি চিরদিনের জন্য জন্মমৃত্যুর বন্ধন হইতে মুক্ত হইলেন।