জো—সে হলো ফার্গুসনের চিরসাথী ও বিশ্বস্ত অনুচর! যারাই জোকে জানে, তারাই একবাক্যে সমস্বরে এ-কথা বলে যে, তার মতো ভৃত্য আর হয় না। অনেকদিন থেকেই সে ফার্গুসনের সঙ্গে আছে, আর সে-যে কেবল অদ্ভুত বিশ্বাসী, তা-ই নয়, তার মতো প্রভুভক্তও অতি বিরল। ফার্গুসনকে সে দেবতার চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ফার্গুসনের চালচলন, কথাবার্তা–সব তার কাছে মহৎ বলে প্রতিভাত হয়। তিনি যা-ই করেন, তা-ই তার ধারণায় একমাত্র ধ্রুব সত্যি। এর আগে ফার্গুসনের সঙ্গে সবকটি অভিযানেই সে অংশ নিয়েছিলো বলে অভিযান-সংক্রান্ত নানা ব্যাপারে সে যথেষ্ট ক্ষমতা ও বিচারবুদ্ধি অর্জন করেছে : অনেকের কাছে যে-সব কাজ বিপজ্জনক ও দুঃসাধ্য বলে মনে হবে, অতি সহজে অবলীলাক্রমে জো সেগুলি করতে পারে। আর সে পারে না, এ-হেন কাজ কিছু আছে কি না সন্দেহ। কাজেই কোনো দুরূহ অভিযানে তার মতো লোকের সাহায্য ও সাহচর্যের তুলনা হয় না। ফার্গুসন তাকে মুখ ফুটে কখনোই বলেননি যে তাকে তিনি সঙ্গে নেবেন, কিন্তু তবু জো নিশ্চিতভাবেই জানে যে সে সঙ্গে যাবে। কোথায় যাবে, কেন যাওয়া হবে, কতদিনের জন্যে—এ-সব কথা তার কাছে বাহুল্য, অবান্তর ও অনাবশ্যক, এ-সব ব্যাপারে কোনোই কৌতূহল নেই তার; সে কেবল জানে, ডক্টর ফার্গুসন নতুন অভিযানে বেরুবেন, কাজেই সে যে সঙ্গে যাবে তা তো স্বতঃসিদ্ধ, এ-সম্বন্ধে আর-কোনো আবোলতাবোল কথা উঠতে পারে বলে সে মনে করে না।
জো-র চেহারাও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো—যেমন লম্বা-চওড়া তেমনি স্বাস্থ্যবান, কিন্তু গোটা শরীরে মেদের বাহুল্য নেই, অতিরিক্ত চর্বি নেই কোথাও, কেবল পেশী আর হাড়-ইস্পাতের মতো পিটিয়ে তৈরি, পাথরের মূর্তির মতো ঋজু ও দৃঢ়। শরীরের কোনো অংশে বাহুল্য নেই বলে ক্ষিপ্রতায় সে নেকড়ের মতো। কথা খুব কম বলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টু-শব্দও উচ্চারণ করে না কিছুতেই, আর ই-হা করেই পারতপক্ষে কাজ চালিয়ে দেয়। ফার্গুসনের প্রতি তার শ্রদ্ধা অসীমে পৌঁছেছিলো বলেই ফার্গুসনের সঙ্গে পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক কোণে যেতেও তার দ্বিরুক্তি ছিলো না।
স্বভাবতই সে অতি শান্ত, তার জীবনের মূসূত্ৰ হলো নিয়মনিষ্ঠা; কাজকর্মের ব্যাপারে সে ক্ষিপ্র, চটপটে। জীবনে যে অভাবনীয়ের কোনো স্থান আছে, তা তার মুখ দেখে কেউ কল্পনাও করবে না। যত বিস্ময়কর পরিস্থিতিতেই পড়ুক না কেন, কিছুতেই সে স্তম্ভিত হয় না। অতি দ্রুত চলে তার দক্ষ হাত আর যে-কোনো কাজেই সে পারঙ্গম; আর যেটা তার সবচেয়ে বড় গুণ তা এই : গায়ে পড়ে সে কখনও উটকো পরামর্শ দেয় না, এমনকী, যখন তার পরামর্শ চাওয়া হয়, তখনও সম্ভব হলে নির্বাক থাকে।
গত কয়েক বছর ধরে সে ফার্গুসনকে ছায়ার মতো পায়ে-পায়ে অনুসরণ করেছে। কিন্তু কোনোদিনও সে ভুলেও এমন-কোনো অভিযোগ করেনি যে পথ বড়ো লম্বা, কি পথশ্রম সহ্যের সীমা ছাড়ালো; পৃথিবীর যে-কোনো কোণের জন্যেই তাকে বাক্স-তোরঙ্গ গোছাতে হোক না কেন—তা সে তিব্বতের দুর্গমতম স্থানই তোক কি আমাজোনের সবচেয়ে মারাত্মক অঞ্চলই হোক—কোনো কথাই সে মুখ ফুটে বলে না, কোনো প্রশ্ন না-করেই প্রভুকে সে সর্বত্র অনুসরণ করে। সমস্ত রোগকেই অবলীলায় প্রতিরোধ করে তার স্বাস্থ্য; প্রত্যেকটি পেশী আঁটো আর কঠিন—কিন্তু স্নায়ু বলে তার যেন কিছুই নেই—অন্তত তার মানসের ওপর স্নায়ুর নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই। সেইজন্যেই তুমুলতম বিপদের মুহূর্তেও তাকে পাথরের মূর্তির মতো নির্বিকার ও অবিচল দেখায়।
ঠিক ছিলো জানজিবার থেকেই যাত্রা শুরু হবে। জানজিবার অবস্থিত আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে-বিষুবরেখা থেকে প্রায় তিনশো ষাট মাইল দক্ষিণে, ভারত মহাসাগরের তীরে। জানজিবার পর্যন্ত যাওয়া হবে জাহাজে। সরকার থেকে এই উদ্দেশ্যে আটশো টনের জাহাজ রেজোলিউট নিয়োজিত করা হয়েছিলো—এই জাহাজই ফার্গুসন ও তার সঙ্গীদের নিয়ে যাবে সুদূর জানজিবার দ্বীপে; যার হাতে জাহাজ পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছিলো তার নাম ক্যাপ্টেন পিনেট। তার নেতৃত্বে ১৮৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ষোলো তারিখে যাত্রার জন্যে সর্বপ্রকারে প্রস্তুত হয়ে রেজোলিউট গ্রীনউইচে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করছিলো—এখন সব প্রয়োজনীয় জিনিশপত্র বোঝাই করা হবে জাহাজে, তারপর ফেব্রুযারির একুশ তারিখে সেই দুঃসাহসিক অভিযানের সূচনা হবে।
ফার্গুসন তো একদিন অভিযানের নানা ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন। এক মুহূর্তও অবসর নেই—কতরকম ব্যবস্থা করতে হবে, এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, ওঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তার সঙ্গে বহু বিষয়ে আলোচনা করছেন–এক ফার্গুসন যেন অনেক হয়ে গিয়ে নিজের সব জিনিশের তদারক করতে লাগলেন।
হিশেব-নিকেশ করে আগেই তিনি দেখেছিলেন,–খাদ্য, পানীয়, নানারকম যন্ত্রপাতি কলকজা ও আনুষঙ্গিক অন্যসব জিনিশ মিলিয়ে প্রায় চার হাজার পাউণ্ড হবে, কাজেই বেলুনের মাপ ও ক্ষমতা এমন হওয়া চাই যাতে সে এই ওজন বহন করতে পারে। ওজনের হিশেবে যাতে সুক্ষ্মতম গলদও না-থাকে, এইজন্যে ফার্গুসন নিজেদের ওজন পর্যন্ত আগে থেকে নিয়ে রেখেছিলেন। ওজনের হিশেব হলো এই রকম: ডক্টর ফাণ্ডসন স্বয়ং ১৩৫ পাউণ্ড, ডিক কেনেডি ১৫৩ পাউণ্ড আর জো-র ওজন ২২০ পাউণ্ড।
ফার্গুসনের বিচক্ষণ পরিকল্পনা অনুযায়ী আলাদা মাপের দুটি বেলুন তৈরি করা হয়েছিলো, একটি বড়ো ও একটি ছোটো ছোটোটি থাকবে বড়ো বেলুনটির ভেতর। দুটি বেলুনই তৈরি করা হলো শক্ত রেশম দিয়ে, ওপরে থাকলো গাটাপার্চারের আবরণ। মজবুত একটা লোহার নোঙর আর খুব টেকশই রেশম দিয়ে পঞ্চাশ ফুট লম্বা একটি দড়ির মইও সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা করা হলো। বড়ো বেলুনটির ওজন হললা সাড়ে-ছয়শো পাউণ্ড আর ছোটো বেলুনটির হলো পাঁচশো পাউণ্ডের কিছু বেশি। যাতে বসে যাবেন, সেই দোলনা বা কারএর ওজন হলো দুশো আশি পাউণ্ড। যন্ত্রপাতি কলকজা, তাঁবু, নোঙর, বন্দুক প্রভৃতি নানারকম আনুষঙ্গিক জিনিশপত্র দুশো পাউণ্ড। শুকনো মাংস, কফি, বিস্কুট প্রভৃতি খাবার-দাবার প্রায় চারশো পাউণ্ড, পানীয় জলও তাই, পোশাকপরিচ্ছদ সাতশো পাউণ্ড, হাইড্রোজেন গ্যাসের ওজন দুশো আশি পাউণ্ড, আর বস্তায় করে দুশো পাউণ্ড ওজনের পাথরের টুকরো (কখনও বেলুনকে ওপরে তুলতে হলে বেলুন থেকে তো ওজন কমাতে হবে, তাই এই পাথর অর্থাৎ ব্যালাস্ট)–একুনে চার হাজার পাউণ্ড।
এতসব জিনিশপত্রের বিলি-ব্যবস্থা করতে গিয়ে ফার্গুসন যখন দম ফেলবার সময়টুকুও পাচ্ছেন না, ডিক কেনেডি কিন্তু তখন অত্যুৎসাহী উপসর্গদের উৎপাতে অস্থির। ঝাঁকে-ঝাঁকে লোকজন এসে প্রশ্নের পর প্রশ্নে কেনেডিকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে মারলে। উত্ত্যক্ত হবার একটা সীমা আছে। সেই সীমা ছাড়িয়ে গেলে স্নায়ুগুলি পর্যন্ত বিকল হয়ে গিয়ে কোনো-কিছু বোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফ্যালে। শেষটায় কেনেডিরও তা-ই হলো। লোকজনেরা এসে হাজার জ্বলাতন করলেও শেষদিকে তিনি যেন কিছুই করতে পারতেন না। প্রথমটায় তিনি খবরকাগজগুলোর মুণ্ডপাত করতেন–যত নষ্টের গোড়া এই কাগজগুলো, সম্ভব-অসম্ভব নানা বিবরণী ছাপিয়ে এরাই একের পর এক হুজুগ তুলে লোকজনকে খেপিয়ে তোলে। আর, সবচেয়ে আশ্চর্য হলো, সমস্ত পরিকল্পনা সংগোপন রাখার জন্যে যতই সযত্ন চেষ্টা করা হোক না কেন, শেষটায় তারা কী করে যেন সব টের পেয়ে যায়। আফ্রিকার রহস্যময় অরণ্য সম্বন্ধে জল্পনা-কল্পনা ও আজগুবি বিবরণেরও শেষ নেই। অসংখ্য সব হাস্যকর মতামত, কয়েক লক্ষ গুজব আর আকাশস্পর্শী সব বুজরুকির খবর ছড়িয়ে গেলো। তারা যেন অদৃশ্য থেকেও সর্বত্র তাদের অসহ্য অস্তিত্বের ঘোষণা করতে লাগলো। শেষটায় প্রায় পাগলই হয়ে গেলেন কেনেডি, কবে একুশে ফেব্রুয়ারি আসে, কবে জাহাজ ছাড়ে, দিনরাত কেবল সে-কথাই ভাবতে লাগলেন।
বেলুন দুটি, কার, নোঙর, দড়ি, জলের পিপে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব আনুষঙ্গিক জিনিশ সবই অবশেষে একদিন জাহাজে তোলা হলো, ফার্গুসন আর কেনেডির জন্যে দুটি ক্যাবিন ভালো করে সাজানো-গোছানো হলো, জো-র জন্যেও উপর্যুক্ত ব্যবস্থা করা হলো। আর এরই মধ্যে একদিন রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি তাদের বিদায় অভিনন্দন জানাবার জন্যে সোসাইটির মস্ত সভাঘরে ফার্গুসনদের বিরাট একটি ভোজে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে শুভেচ্ছা জানালে। সেখানে বিভিন্ন বক্তা তাদের যাত্রার সাফল্য কামনা করার পর অভিযাত্রীদের পক্ষ থেকে ফার্গুসন সবিনয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি যখন নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ ছাড়লো তখন জাহাজঘাটায় লোকে লোকারণ্য। রেজোলিউট নোঙর তুলে নড়ে উঠতেই অসংখ্য লোক সম্মিলিত গলায় অভিযাত্রীদের নামে জয়ধ্বনি দিলে আর সেই প্রবল ধ্বনির মধ্য দিয়ে জাহাজ তার গন্তব্যপথের দিকে স্থির গতিতে এগিয়ে চললো।