০৩. ছেলেটি হাবাগোবার মতো

ছেলেটি হাবাগোবার মতো। কিছু কিছু বয়স্ক মানুষ আছে, যাদের দেখলেই মনে হয় এরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা হাস্যকর কিছু করবে। এবং এটা যে হাস্যকর, তা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকাবে। একেও সে রকম লাগছে। মোটা ফ্রেমের চশমা। সেই চশমা নাকের ডগায় চলে এসেছে। দেখতে অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে চশমা এই বুঝি খুলে পড়ল।

আমি কি আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?

ছেলেটি বিরক্তি স্বরে বলল, একবার তো বললাম। আমি ঘুমুব।

আপনার ঘুম এতই জরুরি? ঘুম জরুরি না! ঠিক সময়ে ঘুমুতে যাওয়া উচিত এবং ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা উচিত।

আজি না হয় একটু ব্যতিক্রম হল। বসব?

আমি না বললে কি তুমি শুনবে?

ছেলেটির মুখে তুমি শব্দটি খুব স্বাভাবিক শোনাল। খট করে কানে বাজল না। যেন এ অনেকদিন থেকেই ইরিনাকে চেনে, তুমি করে ডাকে।

জরুরী কথাটি কি?

আপনি যেখানে যাচ্ছেন আমিও সেখানে যাচ্ছি। আমি নিষিদ্ধ নগরীতে যাচ্ছি।

ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, এটা এমন কি জরুরি কথা! আপনার কাছে খুব জরুরি মনে হচ্ছে না?

না তো!

আপনি খুবই বোকা।

তা ঠিক না। আমি বোকা হব কেন? আমার অনেক বুদ্ধি। এই জন্যেই তো আমাকে নিষিদ্ধ নগরীতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি বোকা হলে আমাকে নিয়ে যেত? ইরিনার ইচ্ছে হল উঠে চলে যেতে। যাবার আগে এই হাঁদারামের গালে প্ৰচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিতে।

ছেলেটি বেশ অবাক হয়েই বলল, একি খুকী, আমার যে বুদ্ধি আছে, এটা তুমি বিশ্বাস করছ না কেন?

কোনো বুদ্ধিমান লোক কখনো বলে না, আমার খুব বুদ্ধি। শুধুমাত্র হাদারাই সে রকম বলে।

একজন বুদ্ধিমান লোক যদি বলে আমার খুব বুদ্ধি, তাতে দোষের কি?

না, কোনো দোষ নেই, আপনি যত ইচ্ছা বলুন। আর দয়া করে আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন না।

ইরিনা সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়াল। ছেলেটি দুঃখিত স্বরে বলল, তুমি আমার ওপর রাগ করে চলে যােচ্ছ, এই জন্যে আমার খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর নি। আমি প্রমাণ করে দেব যে আমার বুদ্ধি আছে?

আপনাকে কিছু প্ৰমাণ করতে হবে না।

না না শোন, শুনে যাও। আমার সম্পর্কে তোমার একটা ভুল ধারণা থাকবে, এটা ঠিক না। আমি এই ঘণ্টাখানেক আগে কী করে একটা বুদ্ধিমান রোবটকে বোকা বানালাম এটা শোন।

ইরিনা কৌতূহল হয়ে তাকাচ্ছে। ছেলেটি খুব উৎসাহের সঙ্গে বলছে, ট্রেনে একটা রোবট আছে দেখ নি? ব্যাটা আমার সাথে রসিকতা করবার চেষ্টা করছিল, আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করল।

আর আপনি চট করে জবাব দিয়ে দিলেন?

না। আমি উল্টো তাকে একটা এমন ধাঁধা দিলাম ব্যাটার প্রায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়।

কি ধাঁধা?

আমি বললাম, একটা সাপ হঠাৎ তার নিজের লেজটা গিলতে শুরু করল। পুরোপুরি যখন গিলে ফেলবে, তখন কী হবে? রোবটটার আক্কেল গুড়ুম। ভেবে পাচ্ছে না। কী হবে। একবার বলছে সাপটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। পরীক্ষণেই মাথা নেড়ে বলছে, তা কি করে হয়?

এই আপনার বুদ্ধির নমুনা?

হ্যাঁ। দ্বৈত সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছি মাথায়। একটা রোবটকে বোকা বানানোর এই বুদ্ধি কি তোমার মাথায় আসত?

না, আসত না।

তাহলে তোমার কি মনে হয়, আমি বুদ্ধিমান?

ইরিনা হাসবে না। কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছা হল বলে, আপনি এর কোনোটাই না, আপনি পাগল। তা বলা গেল না।

তোমার নামটা যেন কি? আমাকে কি আগে বলেছিলে, না বল নি?

আমার নাম ইরিনা। শুরুতেই একবার বলেছি।

আমার নাম জানতে চাও?

আপনি ঘুমুতে চাচ্ছিলেন- ঘুমান। আমি এখন যাব।

আমার ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। একবার ঘুম নষ্ট হলে অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম আসে না। শোন আমার নাম অখুন-মীর। তুমি আমাকে মীর ডাকবে। আমার বন্ধুরা আমাকে মীর ডাকে। মীর উচ্চারণটা হবে একটু টেনে টেনে মী—র-এ রকম বুঝতে পারলে?

পারলাম।

বস এখানে।

ইরিনা বসল। কেন বসিল নিজেই জানে না। বসার তার কোনো রকম ইচ্ছা ছিল না।

শোন ইরিনা, নিষিদ্ধ নগরীতে যেতে হচ্ছে বলে তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? আমাদের ওদের প্রয়োজন বলেই নিয়ে যাচ্ছে। শাস্তি দেয়ার জন্যে নিশ্চয়ই নিচ্ছে না। শাস্তি দেবার হলো হলে প্ৰথম শহরেই দিতে পারত। পারত না?

হ্যাঁ পারত।

যে-কোনো কারণেই হোক। ওদের প্রয়োজন।

ইরিনা বলল, ওরা মানে কারা?

মীর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইল। যেন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবছে, উত্তরটা মাথায় এলেই বলবে। বসে আছে তো বসে আছে। ইরিনার ক্ষীণ সন্দেহ হল, লোকটি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির ঢুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়া বিচিত্র নয়। কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে মানুষটাকে। কুঁজো হয়ে বসেছে। থুতনিটা ওপরের দিকে তোলা। হাত দুটি এলিয়ে দিয়েছে।

আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

না। ভাবছি।

ভেবে কিছু পেলেন? আপনি তো বুদ্ধিমান লোক, পাওয়া উচিত।

তা উচিত, কিন্তু পাচ্ছি না। নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

কেন জানি না?

এই জিনিসটা নিয়েই আমি ভাবছিলাম। কেন জানি না?

ভেবে কিছু বের করতে পারলেন?

না। শুধু একটা জিনিস বুঝতে পারছি, আমরা আসলে কিছুই জানি না। আমাদের যখন অসুখ হয়, একজন রোবট ডাক্তার এসে আমাদের চিকিৎসা করে। কেন আমাদের অসুখ হয়, কিভাবে আমাদের অসুখ সারানো হয়- তার কিছুই আমরা জনি না। কোনো যন্ত্রপাতি যখন নষ্ট হয়, একজন রোবট এসে তা ঠিক করে। যন্ত্রপাতিগুলো কী? কিভাবে কাজ করে-তাও আমরা জানি না। এখন কথা হল, কেন জানি না।

কেন?

কারণ আমাদের জানতে দেয়া হয় না। আমরা স্কুলে পড়াশোনা করি। কী পড়ি? লিখতে পড়তে শিখি। সামান্য অঙ্ক শিখি। প্রথম শহরে বিধিগুলো মুখস্থ করি। ব্যাস, এই পর্যন্তই। তাই না?

হ্যাঁ তাই।

বুঝলে ইরিনা, আমি একবার আমার স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—স্যার টেলিফোন কিভাবে কাজ করে? স্যার অবাক হয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, টেলিফোন তৈরি করা হয়েছে মানুষের সেবার জন্যে। তৈরি হয়েছে নিষিদ্ধ নগরে। নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে কৌতূহল সপ্তম বিধি অনুসারে একটা প্রথম শ্রেণীর অপরাধ। তুমি একটি প্রথম শ্রেণীর অপরাধ করেছ। এই বলে তিনি আমার কার্ডে একটা দাগ দিয়ে দিলেন। হা হা হা।

ইরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, হাসছেন কেন? এটা কি হাসার মতো কোনো ঘটনা? কার্ডে দাগ পড়া তো খুবই কষ্টের ব্যাপার। পনেরটার বেশি দাগ পড়লে আপনি কখনো দ্বিতীয় শহরে যেতে পারবেন না।

এই জন্যেই তো হাসছি। আমার কার্ডে মোট দাগ পড়েছে তেতাল্লিশটি। স্কুলে সবাই আমাকে কি বলে জান? সবাই বলে মিস্টার তেতাল্লিশ?

বিধি ভঙাই বুঝি আপনার স্বভাব?

না, তা না। আমার স্বভাবের মধ্যে আছে কৌতূহল। আমি কৌতূহল মেটাবার চেষ্টা করি। একবার কি করেছিলাম জান? পানি গরম করার একটা যন্ত্র খুলে ফেলেছিলাম।

কি বলছেন আপনি!

হ্যাঁ সত্যি। প্রথম খুব ভয় লাগল। কত বিচিত্র সব জিনিস। একটা চাকতি নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরছে। তিন বার ঘুরবার পর অন্য একটা বলের মতো জিনিস চলে আসে সেটা খুব গরম।

আপনি হাত দিয়েছিলেন!

হাত না দিলে বুঝব কি করে এটা গরম না ঠাণ্ডা।

এর জন্যে আপনার কী শাস্তি হল?

কোনো শাস্তি হল না।

শাস্তি হল না কেন?

শাস্তি হল না। কারণ আমি আবার তা লাগিয়ে ফেলেছিলাম।

ইরিনা বিস্মিত হয়ে বলল, কীভাবে লাগালেন?

যেভাবে খুলেছিলাম সেভাবে লাগালাম।

বলেন কি আপনি!

এসব কাজ শুধু রোবটরা পারবে, আমরা পারব না, তা ঠিক না। আমাদের শেখালে আমরাও পারব। কিন্তু আমাদের কেউ শেখাচ্ছে না। এবং নানারকম বিধি-নিষেধ দিয়ে দিয়েছে যাতে আমরা শিখতে না পারি। যেন আমরা এসব শিখে ফেললে কোনো বড় সমস্যা হবে।

এই হাবাগোবা ধরনের মানুষটির প্রতি ইরিনার শ্রদ্ধা হচ্ছে, এ আসলেই বুদ্ধিমান। সবাই যেভাবে একটা জিনিসকে দেখে, এ সেভাবে দেখছে না। অন্যরকম করে দেখছে। সেই দেখার সবটাই যে ভুল, তাও না।

ইরিনা।

জি বলুন।

তুমি কি লক্ষ করেছ। এই রোবটগুলো শুধু দিনে কাজ করে, রাতে কিছু दGद क्रा?

না, আমি সেভাবে লক্ষ করি নি।

এরা দিনে কাজ করে। যখন এদের কোনো কাজ থাকে না, তখন রোদে দাড়িয়ে থাকে। এর মানে কি বলতো?

জানি না।

কাজ করবার জন্যে যে শক্তি লাগে তা তারা রোদ থেকে নেয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। একার পরপর চারদিন ধরে খুব ঝড়বৃষ্টি হল। সূর্যের মুখ দেখা গেল না। তখন অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, রোবটগুলো কোনো কাজ করতে পারছে না।

কিন্তু কিছু কিছু রোবট তো রাতেও কাজ করে। যেমন ডাক্তার রোবট।

হ্যাঁ, তা অবশ্যি করে।

অখুন-মীর একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। যেন এই কথাটা তার খুব মনে লেগেছে। ডাক্তার রোবটরা রাতে কাজ না করলেই যেন সে বেশি খুশি হত। ইরিনা মানুষটিকে খুশি করার জন্যে বলল, হয়তো আপনি আপনার অনেক প্রশ্নের জবাব নিষিদ্ধ নগরীতে পেয়ে যাবেন। মীর ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, জানি না। পাব বলে মনে হয় না। প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে চায় না। এবং মজার ব্যাপার কি জান ইরিনা, মানুষের মাথায় যেন এই জাতীয় কোনো প্রশ্ন না আসে। সেই চেষ্টা করা হয়।

কিভাবে করা হয়?

কঠিন পরিশ্রমের মধ্যে তাদের রাখা হয়। কোনোরকম অবসর নেই। মানুষ চিন্তাটা করবে। কখন? খাবার টিকিট জোগাড় করার দুশ্চিন্তাতেই মানুষের সব সময় কেটে যায়। জীবন কাটিয়ে দিতে চায় কার্ডে কোনো দাগ না ফেলে। চিন্তার সময় কোথায়?

তবুও কেউ কেউ তো এর মধ্যেই চিন্তা করে।

হ্যাঁ তা করে। আমি করি। আমার মতো আরো কেউ কেউ হয়ত করে। এমন কাউকে যদি পেতাম, কত ভালো হত। কত কিছু জানার আছে।

মীর হাই তুলল। ইরিনা বলল, আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?

হ্যাঁ পাচ্ছে।

আমি কি তাহলে চলে যাব?

মীর হেসে ফেলে বলল, তোমার মনে হয় যেতে ইচ্ছা করছে না।

ইরিনা লজ্জা পেয়ে গেল। তার সত্যি সত্যি যেতে ইচ্ছা করছে না। এই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে আরো কিছু সময় থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু এই লোকটা তা টের পাওয়ায় খুব অস্বস্তি লাগছে।

ইরিনা।

জি বলুন।

তুমি কি বিয়ের পারমিট পেয়েছ?

না, পাই নি। আমার বয়স উনিশ, একুশের আগে তো পারমিট পাব না।

আমার তেত্রিশ। আমিও পাই নি। সম্ভবত আমাকে পারমিট দেবে না। এই ব্যাপারটাও কিন্তু রহস্যময়। ওরা যাকে ঠিক করে দেবে, তাকেই বিয়ে করতে হবে। এতে নাকি সুস্থ সুন্দর নীরোগ মানুষ তৈরি হবে। সুখী পৃথিবী।

আপনি তা বিশ্বাস করেন না?

না, করি না। ওদের বেশির ভাগ কথাই বিশ্বাস করি না। আমি নিজের মতো চলতে চাই, নিজের মতো ভাবতে চাই। নিজের পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই।

এ রকম কোনো পছন্দের মেয়ে কি আপনার আছে?

না নেই। তোমাকে কিছুটা পছন্দ হয়। তবে তোমার মুখ গোলাকার। এ রকম মুখ আমার পছন্দ না।

আর আপনি বুঝি রাজপুত্ৰ?

কি মুশকিল, তুমি রাগ করছ, কেন? তোমাকে আমার কিছুটা পছন্দ হয়েছে, এই খবরটা বললাম। এতে তো খুশি হবার কথা।

আপনাকেও তো আমার পছন্দ হতে হবে? আপনার নিজের চেহারাটা কেমন আপনি জানেন? আয়নায় কখনো নিজের মুখ দেখেছেন?

খুব খারাপ?

না, খুব ভালো। একেবারে রাজপুত্র।

এত রাগছ কেন তুমি? তোমাকে আমার কিছুটা পছন্দ হয়েছে, এটা বললাম। আমাকে তোমার অপছন্দ হয়েছে, এটা তুমি বললে। ব্যাস, ফুরিয়ে গেল।

আমি এখন যাচ্ছি।

খুব ভালো কথা, যাও। শুভ রাত্রি।

শুভ রাত্ৰি।

শোন ইরিনা, এরকম রাগ করে চলে যাওয়াটা ঠিক না। যাবার আগে মিটমাট করে ফেলা যাক।

কিভাবে মিটমাট করবেন?

চলো খাবার গাড়িতে যাই। চা-কফি বা অন্য কোন পানীয় খাওয়া যাক।

যাবে?

আমার ইচ্ছা করছে না।

ইচ্ছা না করলে থাক।

আচ্ছা ঠিক আছে চলুন।

ইচ্ছা করছে না। তবু যেতে চোচ্ছ কেন?

ইচ্ছা না করলেও তো আমরা অনেক কিছু করি। যাকে সহ্য হয় না। সরকারি নির্দেশে তাকে বিয়ে করি। ভালোবাসতে চেষ্টা করি।

তা করি। চল যাওয়া যাক।

এ্যাটেনডেন্ট রোবটটির সঙ্গে করিডোরে দেখা হল। মীর হাসিমুখে বলল, কি ধাঁধাটি পারলে?

চেষ্টা করছি, তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি একটি অবাস্তব সমস্যা দিয়েছেন। একটা সাপ নিজেকে পুরোপুরি গিলে ফেলবে কী করে?

বেশ, তাহলে একটা বাস্তব সমস্যা দিচ্ছি। একটি বস্তু এক সেকেন্ডে চার ফুট যায়। পরবতী সেকেন্ডে যায় দুই ফুট, তার পরবতী সেকেন্ডে এক ফুট। এভাবে অর্ধেক করে দূরত্ব কমতে থাকে। বিশ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করতে তার কত সময় লাগবে?

রোবটটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মীর বলল, তুমি একটি মহাগৰ্দভ। এই ধাঁধার সমাধান করা তোমার কর্ম না। যাও ভাগো। ইরিনা খিলখিল করে হেসে উঠল। রোবটটির মনে হচ্ছে আত্মসম্মানে লেগেছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, চট করে তো আর সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমাকে ভাববার সময় দিন।

সময় দেয়া হল। অনন্তকাল সময়। বসে বসে ভাব।

 

দুজন মুখোমুখি বসেছে।

মীর কোনো কথা বলছে না। কপাল কুঁচকে কি জানি ভাবছে। গাড়ির গতি আগের চেয়ে কম। বাইরে নিকষ অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই বিদ্যুতের আলোয় ধ্বংসস্তুপ মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে। বীভৎস দৃশ্য, তাকান যায় না।

ইরিনা লক্ষ করল অরচ লীওন ঠিক আগের জায়গায় বসে। তার হাতে পানীয়ের গ্লাস। গ্লাসে গাঢ় সবুজ রঙের কি-একটা জিনিস- ক্ৰমাগত বুদবুদ উঠছে। অরচ লীওন তাকিয়ে আছেন তাঁর গ্রাসের দিকে। একবার ইরিনার সঙ্গে তার চোখাচৌখি হল। তিনি এমনভাবে তাকালেন, যেন চিনতে পারছেন না।

ইরিনা মৃদু স্বরে মীরকে বলল, ঐ লোকটিকে কি আপনি চেনেন?

কোন লোকটি?

ঐ যে কোণার দিকে বসে আছে। তক্ষকের মতো চোখ।

চিনব না কেন? উনি আমার বাবা।

কী বলছেন!! আমি তো জানতাম। উনি অবিবাহিত।

উনি আমার বাবা। ইন্টেলিজেন্সের সবচে বড়ো অফিসার। এরা হাসি মুখে রাতকে দিন করে। চেহারার মধ্যে তুমি মিল দেখছি না? অবিবাহিত হবে কেন? ইরিনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মীর খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল, বাবার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।

নেই কেন?

আমার জন্মের দ্বিতীয় বছরে বাবাকে প্ৰথম শহর থেকে দ্বিতীয় শহরে নিয়ে যাওয়া হল। আমার যখন আঠার বছর বয়স, তখন জানলাম তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। তৃতীয় শহরের নাগরিক হয়ে বসেছেন।

আপনার খোঁজখবর করেন না?

কী করে করবে, তৃতীয় শহরের নাগরিক না? তৃতীয় শহরের নাগরিকেরা কি আর প্রথম শহরের কাউকে খুঁজতে পারে, আইনের বাধা আছে না? তাছাড়া সে নিজেই হচ্ছে আইনের লোক।

আইনের লোক বলেই তো আইন ভাঙা সহজ।

তা ঠিক। সে আইন ভেঙেছে। আমার কার্ডে তেতাল্লিশটি দাগ পড়ার পরও কিন্তু আমি বেঁচে আছি। চল্লিশটি দাগ পড়ার পর সরকারি নিয়মে দোষী লোকটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। অবাঞ্ছিত কেউ বেঁচে থাকে না, অথচ আমি আছি। হা হা হা।

মীর এত শব্দ করে হেসে উঠল যে লীওন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখলেন। তিনি বিরক্ত হয়েছেন। কিনা তা বোঝা গেল না। তার গ্রাসের পানীয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, সুইচ টিপে তিনি আরো পানীয় আনতে বললেন।

ট্রেনের গতি আবার বাড়তে শুরু করেছে। বাইরে রীতিমতো ঝড় হচ্ছে। মুষল-ধারে বৃষ্টি পড়ছে। ঘনঘন বাজ পড়ছে। বজপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা। ইরিনা লক্ষ করল। মীর চোখ বন্ধ করে আছে। হয়তো ঘুমুচ্ছে কিংবা কোনো কিছু নিয়ে ভাবছে। কি ভাবছে কে জানে।

ইরিনার এখন আর কেন জানি লোকটির চেহারা খারাপ লাগছে না। হয়তো চোখে সয়ে গেছে। ইরিনারও ঘুম পেয়ে গেল।