০৩. গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল

গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল, হঠাৎ সোমনাথ ভাদুড়ী তোমাকে ফোন করে ডেকেছিলেন কেন?

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চল, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

আহারাদির পর দুজনে এসে বসবার ঘরে দুটো সোফায় মুখখামুখি বসল।

জংলী এসে দুকাপ কফি রেখে গেল। কফির পাত্র শেষ করে কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।

বাইরে শীতের রাত্রি-ঝিমঝিম করছে যেন।

কিরীটী একসময় বললে, ভাদুড়ী মশায় একটা খুনের মামলার ব্যাপারে আমাকে ডেকেছিলেন। তবে আদালতে একপ্রস্থ ব্যাপারটার চরম নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে—মানে আজ আদালত তার রায় দিয়েছে। হত্যাকারী বলে যে ব্যক্তি ধৃত হয়েছিল—দীর্ঘদিন ধরে যার বিচার হয়েছে—আদালত তাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে মুক্তি দিয়েছে।

তবে?

সেই তবেই ভাদুড়ী মশায়ের প্রশ্ন, কৃষ্ণা।

বুঝলাম না ঠিক। কৃষ্ণা বলল।

মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণাদি ছিল যে সোমনাথ ভাদুড়ীর মত উঁদে লইয়ারও হালে পানি পাচ্ছিলেন না। এমন সময় এক সাক্ষীর আবির্ভাব–

কি রকম?

সে এসে সোমনাথ ভাদুড়ীকে বলল, আসামী নির্দোষ—সে সাক্ষী দেবে। সোমনাথ ভাদুড়ী কিন্তু খুশি হলেন না—যদিও আসামীর স্ত্রী চোখের জলের মিনতিতে তিনি তখন। রীতিমত বিচলিত–আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আইনের কোন ফাঁক বের করতে, যাতে করে আসামীকে মুক্ত করে আনতে পারেন।

তারপর–

আসামী ওই লোকটির সাক্ষ্যর জোরেই শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেল কিন্তু ভাদুড়ী মশাইয়ের মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব থেকে গিয়েছে।

কিসের দ্বন্দ্ব? সাক্ষী যা বলছে তা পুরোপুরি সত্য নয়। দেখ, যা বুঝলাম, তা হচ্ছে—

কি?

ওই সাক্ষীকেই সোমনাথ ভাদুড়ী সন্দেহ করছেন।

সত্যি?

হ্যাঁ।

ওই ফাইলটা বোধ হয় সেই মামলার? কৃষ্ণা শুধালো।

হ্যাঁ।

রাত্রের ঘুমও তাহলে গেল আজ—

না, না—তুমি শুয়ে পড়গে কৃষ্ণা—আমি ফাইলগুলো একটু উল্টেই আসছি।

ঠিক আছে। বেশী দেরি করো না কিন্তু!

কিরীটী সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

ফাইলের টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে অন্যমনস্কভাবে একটা পাতায় এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।

আদালতের প্রশ্ন : আপনার নাম?

উত্তর : শ্ৰীমতী দেবিকা মিত্র।

আসামীর কাঠগড়ায় যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আপনি চেনেন?

চিনি। আমার স্বামী।

কতদিন আপনাদের বিবাহ হয়েছে?

সাত বছর।

ছেলেপুলে?

না। কোন সন্তান হয়নি আদৌ।

সন্তান চান না আপনারা?

চাই বৈকি।

তা কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেননি?

নিয়েছিলাম। ডাঃ গোরাদ নন্দী, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।

তিনি কি বলেছিলেন পরীক্ষা করে?

বলেছিলেন—

বলুন।

আমাদের নাকি কখনো কোন সন্তানাদি হবার আশা নেই।

কেন?

তা তিনি বলেননি।

 

কিরীটী দ্রুত কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে গেল। নিশ্চয়ই আদালত ডেকেছিল ডাঃ নন্দীকে তার সাক্ষ্য দেবার জন্য। তার অনুমান মিথ্যা নয়।

পাওয়া গেল—-ডাঃ নন্দী তার পুরাতন রেকর্ড দেখে বলেছেন, ওদের সন্তান হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ-বিবাহের আগেই বিজিত মিত্র কুৎসিত এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু তখন চিকিৎসা করেননি ভদ্রলোক—ফলে সেই রোগ স্ত্রীর দেহে সংক্রামিত হয়, পরে অবিশ্যি বেশ কিছুদিন পরে চিকিৎসা করান দুজনই। কিন্তু ঐ রোগ যা ক্ষতি করবার করে দিয়েছিল—স্বামীর প্রজনন-শক্তি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আদালতের প্রশ্ন, আপনি কথাটা বলেননি ওদের?

স্বামীকে বলেছিলাম।

চিকিৎসা কোনরকম করেননি?

করেছিলাম কিন্তু কোন ফল হয়নি।

লোকটির চরিত্র কিরীটীর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিরীটী একটা সিগারে নতুন করে অগ্নিসংযোগ করে।

দেওয়াল-ঘড়িটা ঢং করে একটা শব্দ তুলে থেমে গেল সময়ের সমুদ্রে।

বাইরে শীতের ঝিমঝিম রাত।

কিরীটী আবার অন্যমনস্কভাবে ফাইলের পাতা ওল্টাতে থাকে আর মনের মধ্যে তার অলক্ষ্যে একটা অদেখা মানুষের ছবি যেন একটু অন্ধকারে স্পষ্ট আকার নিতে থাকে, আজ রাত্রেই সোমনাথ ভাদুড়ীর মুখ থেকে শোনা কাহিনী থেকে।

মানুষটার চেহারা–সোমনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন, অত্যন্ত সাদামাটা-মোস্ট আনইমপ্রেসিভ যাকে বলে। গাল দুটো ভাঙা কিছুটা যেন গর্তে ঢোকানো। পাতলা ভ্র। গোল বর্তুলাকার দুটি চক্ষু। কিন্তু চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। গালের হনু দুটো বদ্বীপের মত যেন ঠেলে উঠেছে।

মাথায় পাতলা চুল। শরীরটার উপর মনে হয় অনেক অত্যাচার হয়েছে।

কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি রায়মশাই, ওই হত্যা-মামলা আমার হাতে নেবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না, নিতামও না, কিন্তু মেয়েটি এসে হঠাৎ একদিন আমার চেম্বারে দুপা জড়িয়ে ধরে কেঁদে পড়ল।

কে? কি ব্যাপার? আরে, উঠুন—উঠুন।

আমার স্বামীকে আপনি বাঁচান, বাবা।

উঠুন—বলুন কি হয়েছে আপনার স্বামীর?

না। আগে বলুন দয়া করবেন।

কি হয়েছে আপনার স্বামীর?

খুনের মামলার আসামী সে আজ।

খুনের মামলা!

হাঁ বাবা, আমার স্বামীর চরিত্রের মধ্যে যত দোষই থাক—সে ওই তপন ঘোষকে খুন করেনি।

উঠে বসুন। ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলুন।

আগে আমাকে কথা দিন।

ঠিক আছে, তুমি উঠে বসো।

মেয়েটি উঠে বসে মাথার ঘোমটা খুলে দিল। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে—কিন্তু মধ্যযৌবন অতিক্রান্ত হতে চললেও যেমন এখনও দেহের বাঁধুনি, তেমনি রূপ, রূপের যেন। অবধি নেই। দুচোখে অবিরত অশ্রু ঝরে চলেছে।

মেয়েটি বলল, বাবা, এ সংসারে আমার আর কেউ নেই—ওই স্বামী ছাড়া। গরীবের মেয়ে। দয়া করে উনি আমাকে বিয়ে না করলে হয়ত শেষ পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হতো—কিংবা—

কি নাম তোমার স্বামীর?

বিজিত মিত্র–

সোমনাথ ভাদুড়ীর মনে পড়লো মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই আদালতে এক অ্যাডভোকেটের মুখে শুনেছিলেন ওই কেসটা সম্পর্কে।

বিচার চলেছে তার আদালতে।

মেয়েটি তখন আবার বলল, বাবা, আপনার ফিস দেবার ক্ষমতা আমার নেই। তবু এসেছি আপনার কাছে—এই গরীবকে দয়া করুন।

সোমনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন, তুমি দুদিন বাদে এসো।

বাবা! ব

ললাম তত দিন দুই বাদে এসো।

মেয়েটির হাতে দুগাছি সোনার বালা ছিল। সে দুটি হাত থেকে খুলতে দেখে সোমনাথ ভাদুড়ী বাধা দিলেন, কি করছো–

মেয়েটি বলল, বাবা, এই বালা জোড়া রাখুন; এ দুটো বেচে–

না—ও তুমি হাতে পরে নাও, কোন টাকা-পয়সা লাগবে না তোমার। কি নাম তোমার?

দেবিকা।

মেয়েটি সোমনাথ ভাদুড়ীর পায়ের ধুলো নিয়ে চলে গেল।

সোমনাথ ভাদুড়ী পরে বলেন, পরের দিন আদালতের যে ঘরে মামলাটা চলছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আসামীর কাঠগড়ায় লোকটা দাঁড়িয়েছিল, ভেরি ফারস্ট শাইটেই আমার মনে হয়েছিল রায়মশাই, লোকটা দুশ্চরিত্র এবং যে কোন ক্রাইমই ওর দ্বারা সম্ভব। ভাঙা গাল, হনু দুটো ঠেলে উঠেছে? বাঁদিককার গালে একটা জজুল আছে—সেই জড়লে গোটা দুই বড় বড় লোম।

কিরীটী মনে মনে ভাবে, ভাদুড়ী মশাইয়ের অনুমান হয়ত মিথ্যা নয়, তপন ঘোষকে যখন হত্যা করা হয় সেরাত্রে ওই বিজিত হয়ত সেখানে উপস্থিত ছিল।

মৃণাল মেয়েটি একটি বারবনিতা। দুশ্চরিত্রা মেয়ে।

অনেকেই রাত্রে তার ঘরে যেত। তাদের দলে হয়ত বিজিত, সুদীপ ও তপন ঘোষ ছিল। তারাও হয়ত ওই মৃণাল নামে বারবনিতার ঘরে যাতায়াত করত।

সুদীপ যে তার জবানবন্দিতে বলেছে তপন ঘোষকে সে চিনত না, কথাটা হয়ত মিথ্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বার ভয়েই হয়ত সুদীপ সত্য কথাটা প্রকাশ করেনি।

তাছাড়া সত্যিই যদি সুদীপ সম্পূর্ণ নির্দোষ থাকত—বন্ধু ও সহকর্মীকে বাঁচানোর জন্য সে অনেক আগেই বিজিতের নির্দোষিতা প্রমাণের চেষ্টা করত।

সম্ভবত ওই খুনের ব্যাপারে সুদীপ জড়িত ছিল বলেই কোন-না-কোন ভাবে প্রথমটায় সে আদালতের ধারে-কাছেও যায়নি।

পরে যে সে সোমনাথ ভাদুড়ীর কাছে গিয়ে সাক্ষী দেবার কথা বলেছে ওই মামলায়, তার পশ্চাতেও হয়ত কোন কারণ ছিল।

কোন গুঢ় স্বার্থ!

যাহোক, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুদীপ এবং বিজিত দুজনাই ওই হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িত।

ওই হত্যা-মামলায় সবচাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে ওই বারবনিতা মেয়েটি—মৃণাল।

গুলির শব্দের পর পাশের ঘরের লোকেরা ভীত হয়ে পুলিসকে খবর দেয়। পুলিস এসে দেখে তপন ঘোষ মৃত, রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে আর তার পাশে। জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে বিজিত মিত্র।

তার জামা কাপড়ে রক্তের দাগ। হাতে ধরা পিস্তল একটি, সে পিস্তল থেকে গুলি চালিয়েই তপন ঘোষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ঘরের মধ্যে মৃণাল নামে মেয়েটি নেই।

মৃণাল একেবারে উধাও।

কোথায় গেল মৃণাল?

সে কি পালিয়েছে না কারোর পরামর্শে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে? যদি কারো পরামর্শেই গা-ঢাকা দিয়ে থাকে তো কার পরামর্শে?

পুলিস নাকি এখনো চারিদিকে মৃণালকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সোমনাথ ভাদুড়ীর ধারণা—মৃণাল হত্যাকারী নয়। তবে সম্ভবত মৃণাল হয়ত হত্যা করতে দেখেছে।

কিগো, আজ কি শুতে যাবে না?

কৃষ্ণার গলা শুনে কিরীটী তাকাল কৃষ্ণার মুখের দিকে।

কিরীটী বলল, অনেক রাত হয়েছে, না!

অনেক রাত মানে-সোয়া তিনটে বাজে।

বল কি!

চল! এবারে একটু শোবে চল।

আর কি ঘুম হবে কৃষ্ণা, বেড়াতে বেরুবার সময় হলো।

সারাটা রাত না ঘুমিয়ে এখন বেড়াতে বেরোবে! কৃষ্ণা বললে।

তাহলে আজ আর না হয় না-ই বেড়াতে বেরুলাম। জংলীকে বললা কফি দিতে।

কৃষ্ণা কোনো কথা বললো না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

জংলীকে তোলেনি কৃষা, নিজেই কফি করে নিয়ে এল দুকাপ।

কফির কাপটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় বসলো কৃষ্ণা।

রাত্রিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে। হাওয়ায় এখনো বেশ শীতের আমেজ আছে—যদিও ফাল্গুন মাস পড়ে গিয়েছে।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে কৃষ্ণা বললে, দেখ ভাবছিলাম, কিছুদিনের জন্য এ সময় বেনারস গিয়ে ঘুরে এলে কেমন হয়, ঠাণ্ডা আছে কিন্তু তীব্রতা নেই।

তা মন্দ হয় না–কিন্তু–

ভাদুড়ী মশাইয়ের মামলার কথা ভাবছো?

হ্যাঁ। মানে—

ওখানে বসেই না হয় ভাববে।

কেবল ভাবলেই তো হবে না, একটা কনকুশনে পৌঁছতে হবে তো?

কৃষ্ণা হেসে বললে, বাবা বিশ্বনাথের চরণে বসে দেখো, তোমার কনক্লশন ঠিক এসে যাবে। তাছাড়া–

কি, থামলে কেন, বল। কথাটা বলে কিরীটী কৃষার মুখের দিকে তাকাল।

তোমার কাহিনীর ঐ মৃণাল মেয়েটি—এমনও তো হতে পারে শেষ-মেশ গিয়ে ঐ বিশ্বনাথের চরণেই আশ্রয় নিয়েছে

মৃণালের জন্য আমি তত ভাবছি না কৃষ্ণা।

ভাবছে না!

না। ঘটনাস্থলে সে ছিলই সে-রাত্রে। কাজেই নিহত তপন ঘোষের দু-এক ফোটা রক্ত কি তার গায়ে আর লাগেনি! লেগেছে নিশ্চয়ই—সে-রক্তের দাগ সে মুছবে কেমন করে। সেই রক্তের দাগ থেকেই ঠিক তাকে আমি চিনে নিতে পারবো। যাকগে সে কথা। তুমি টিকিটের ব্যবস্থা করো-আমরা যাবো।

ঠিক তো?

ঠিক।

 

পরের দিন বিকালে।

কিরীটী আবার গোড়া থেকে মামলার কাগজগুলো পড়ছিল—সোমনাথ ভাদুড়ী আদালত-ফেরতা এসে কিরীটীর গৃহে হাজির হলেন।

আসুন আসুন ভাদুড়ী মশাই। মনে হচ্ছে কোন সংবাদ আছে।

ভাদুড়ী একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, সংবাদটা বোধ হয় তেমন কিছু নয় রায়মশাই। তবু মনে হলো—আপনাকে যাবার পথে জানিয়ে যাই—তাই এলাম।

কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল ভাদুড়ী মশাইয়ের দিকে।

আজ দুপুরে আদালতে বিজিতের স্ত্রী—

কে, দেবিকা—

হ্যাঁ। দেবিকা এসেছিল আমার কাছে।

কেন?

বিজিত নাকি ঘরে ফিরে যায়নি জেল থেকে খালাস পাবার পর।

যায়নি।

না। সে জানত না বিজিত ছাড়া পেয়েছে। আজ আলিপুর সেনট্রাল জেলে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারে গতকালই বিকালের দিকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে আদালতের রায় বেরুবার পরই বেলা পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু আজও সে ঘরে ফেরেনি—তাই দেবিকা এসেছিল আদালতে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন সেনট্রাল জেলে অমিয়নাথবাবুকে ফোন করি।

তিনি কি বললেন?

জেল-গেটের অদূরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এক ভদ্রমহিলা নাকি অপেক্ষা করছিলেন—

ভদ্রমহিলা।

জেলের প্রহরী সেইরকমই বলেছে। ভদ্রমহিলার মাথায় নাকি ঘোমটা ছিল। গায়ে একটা ব্লু রঙের ব্যাপার ছিল।

তারপর–

বিজিত মিত্র জেল থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তার দিকে চলেছে, ভদ্রমহিলা ট্যাক্সি থেকে নেমে বিজিতের নাম ধরে ডাকতেই সে সোজা গিয়ে ট্যাক্সিতে নাকি উঠে বসে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে।

ট্যাক্সি–গুনবতী মহিলা।

হ্যাঁ।

কিন্তু সেই মহিলা ঠিক ওই সময়ই বিজিত মিত্রকে ছাড়া হবে জানলেন কি করে? কিরীটীর প্রশ্ন।

ঐ ভদ্রমহিলাই কিনা জানা যায়নি, তবে আগের দিন নাকি এক ভদ্রমহিলা বেলা পাঁচটা নাগাদ এসেছিলেন জেলখানায়—জেলারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জেলারের মুখ থেকেই নাকি সে শুনেছিল আদালতের রায়ে তাকে মুক্তি দিলেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে জেল থেকে।

মামলার রায় পরের দিনই বেরুবে আপনার অমিয়বাবু কি জানতেন?

জানতেন আর এ-ও জানতেন বিজিত মিত্র বেকসুর খালাস পাবে।

কি করে জানলেন?

আমিই বলেছিলাম। আপনি?

হ্যাঁ। অমিয়বাবু যেদিন রায় বের হয় তার আগের দিন সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন।

আশ্চর্য!

কি?

হঠাৎ অমিয়বাবু আপনাকে ফোন করতে গিয়েছিলেন কেন, বিশেষত ওই বিচারাধীন কয়েদী সম্পর্কে! কথাটা তাকে জিজ্ঞাসা করেননি?

না।

কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, চলুন।

কোথায়?

অমিয়বাবুর কোয়ার্টারে তার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।

বেশ, চলুন। কিন্তু এখুনি যাবেন?

হ্যাঁ।

সোমনাথ ভাদুড়ী উঠে দাঁড়ান।

 

জেলের নিকটেই অমিয়বাবুর কোয়ার্টার। অমিয়বাবু গৃহেই ছিলেন। সোমনাথ ভাদুড়ী কিরীটীকে নিয়ে এসে তার গৃহে প্রবেশ করলেন।

অমিয় চক্রবর্তী তার বসবার ঘরে বসে ওইদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছিলেন। বয়স্ অনুমান চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে হবে তার।

বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট গোলগাল চেহারা। একজোড়া বেশ ভারী গোঁফ। লম্বা জুলপী। জুলপীর চুলে কিছু কিছু পাক ধরেছে। চোখে চশমা।

সোমনাথ ভাদুড়ীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সহাস্যে সম্বোধন করলেন, মিঃ ভাদুড়ী যে—আসুন—আসুন। তারপরই কিরীটীর প্রতি নজর পড়াতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

পরিচয় করিয়ে দিই অমিয়বাবু

অমিয়বাবু বললেন, পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না মিঃ ভাদুড়ী। সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও ওঁকে আমি চিনি। আজ ওঁকে চেনে নাই বা কে? কিরীটীবাবু, বসুন-বসুন।

সোমনাথ ভাদুড়ী ও কিরীটী উপবেশন করে।

অমিয়বাবু! সোমনাথ বললেন।

বলুন–

তপন ঘোষ হত্যা মামলার আসামী বিজিত মিত্রকে কাল বিকালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ—আপনাকে তো সে-কথা বলেছি।

সেজন্য আমরা আসিনি অমিয়বাবু। এসেছি অন্য একটা ব্যাপারে, কিরীটী এবার কথা বললে।

কি বলুন তো?

পরশু, মানে বিজিতবাবুকে যেদিন ছেড়ে দেওয়া হয় তার আগের দিন এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ—আমার কোয়ার্টারে—বিজিতবাবুর সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতে। মানে যদি সে আদালত থেকে মুক্তি পায় তো কখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে সেটাই জানতে।

সেই মহিলার ঠিক বয়স কত হবে বলে আপনার মনে হয় অমিয়বাবু? প্রশ্ন করল কিরীটী।

বোধ হয় ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দোহারা পাতলা চেহারা, বেশ সুন্দর দেখতে। পরনে একটা দামী শাড়ি, পায়ে চপ্পল।

আচ্ছা অমিয়বাবু, তার চেহারার মধ্যে বিশেষ কিছু আপনার নজরে পড়েছিল কি? কিরীটী প্রশ্ন করল।

না। সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না। তবে—

কি? কিরীটী সোৎসুক ভাবে তাকাল অমিয়বাবুর মুখের দিকে।

আমার নজরে পড়েছিল তার বাঁ হাতে উল্কিতে লেখা ছিল একটা ইংরেজী অক্ষর এম।

এম! কথাটা মৃদু গলায় উচ্চারণ করে কিরীটী সোমনাথের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। অমিয়বাবু বললেন।

আর কিছু তার মুখের ঢংটা?

না। তার মুখটা আমি দেখতে পাইনি।

কেন?

মুখে ঘোমটা ছিল। চিবুকটা কেবল নজরে পড়েছে। উপরের ও নীচের ঠোট ও চিবুকের কিছুটা অংশ।

তার চলার বা বসবার—দাঁড়াবার ভঙ্গি?

না, আমি সেটা তেমন লক্ষ্য করিনি কিরীটীবাবু। আর তিনি বসেননি—আগাগোড়া। দাঁড়িয়েই ছিলেন মুখে ঘোমটা টেনে। মনে হচ্ছিল তিনি যেন আত্মপ্রকাশে অনিচ্ছুক।

তার নামটা জিজ্ঞেস করেননি? কোন পরিচয় দেন নি?

নাম বলেননি। আমি জিজ্ঞাসাও করিনি। তবে অবিশ্যি বলেছিলেন তিনি বিজিতবাবুর স্ত্রী।

কিরীটী সোমনাথ ভাদুড়ীর দিকে তাকাল।

দুজনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো।

চলুন ভাদুড়ী মশাই, এবার যাওয়া যাক। কিরীটী বললে।