৩য় অধ্যায় – কৌরব–পাণ্ডবের পুনঃ সমর–কৌরব পলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধার্থ পরস্পর মিলিত হইলে যেরূপে জনক্ষয় হইয়াছিল, আপনি অবহিত হইয়া তাহা শ্রবণ করুন। মহাবীর সূতপুত্র নিহত, হস্তী ও মনুষ্যসমুদয় বিনষ্ট এবং সৈন্যগণ বারংবার পলায়িত ও পুনঃপুনঃ সমানীত হইলে মহাত্মা ধনঞ্জয় সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। আপনার আত্মজগণ সেই ভীষণ শব্দ শ্রবণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইলেন। ফলতঃ কর্ণের নিধনানন্তর কৌরবপক্ষীয় কোন বীরই সৈন্যসন্ধান বা বিক্রমপ্রকাশ করিতে সমর্থ হইলেন না। আপনার আত্মজগণ নিতান্ত ভীত ও শস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত হইয়া, অগাধ সমুদ্রে নৌকা ভগ্ন হইলে বণিকেরা যেমন ভেলা-লাভের অভিলাষ করে, তদ্রূপ সেই অপার বিপদ্সাগরে আশ্রয়লাভ প্রত্যাশা করিতে লাগিলেন এবং অর্জুনের ভুজবলে পরাজিত হইয়া সায়াহ্নকালে ভগ্নশৃঙ্গ বৃষভের ন্যায়, শীর্ণদংষ্ট্র উরগের ন্যায় ও সিংহার্দিত মৃগযূথের ন্যায় পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহাদিগের বর্মসমুদয় ছিন্নভিন্ন ও শস্ত্রসকল খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল। তৎকালে তাহারা মোহে এমনই অভিভূত হইলেন যে, কোন দিকে গমন করিবেন, কিছুই নির্ণয় করিতে পারিলেন না। অন্যান্য বীরগণ ভয়ে বিহ্বল হইয়া দশদিক নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক পরস্পর প্রহারে প্রবৃত্ত হইলেন এবং কেহ কেহ ‘অৰ্জ্জুন আমারই অভিমুখে আগমন করিতেছে’ এবং কেহ কেহ বা ‘বৃকোদর আমার প্রতি ধাবমান হইতেছে’ এইরূপ বোধ করিয়া ম্লানমুখে ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিলেন। কোন মহারথ অশ্বে, কেহ কেহ মাতঙ্গে এবং কোন কোন বীর রথে আরোহণপূৰ্ব্বক ভীতমনে পদাতিকগণকে পরিত্যাগ করিয়া মহাবেগে পলায়ন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন কুঞ্জরদ্বারা রথ ভগ্ন, রথদ্বারা সাদী নিহত ও অশ্বসমূহদ্বারা পদাতিগণ সাতিশয় সমাহত হইল। এইরূপে তৎকালে আপনার পক্ষীয় বীরগণ ব্যাল [সর্প]-তস্কর [চোর] সমাকীর্ণ অরণ্যমধ্যে সার্থহীন [দলশূন্য- দলভ্রষ্ট] বণিকের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিলেন। কতকগুলি নাগ আরোহিবিহীন ও কতকগুলি ছিন্নশুণ্ড হইয়া ভীতচিত্তে চতুর্দ্দিকে অর্জ্জুনময় নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
সঙ্কুল যুদ্ধ—দুৰ্য্যোধনের পরাজয়
“অনন্তর মহারাজ দুর্য্যোধন সেই সৈন্যগণকে ভীমভয়ে ভীত ও পলায়নপরায়ণ অবলোকন করিয়া স্বীয় সারথিকে কহিলেন, “হে সূত! আমি ধনুর্ধারণপূৰ্ব্বক পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করিতেছি। সাগর যেমন তীরভূমি অতিক্রম করিতে পারে না, তদ্রূপ অৰ্জ্জুন আমাকে কদাচ অতিক্রম করিতে সমর্থ হইবে না; অতএব তুমি অবিলম্বে অসঞ্চালন কর। আজ আমি অৰ্জ্জুন, বাসুদেব, অভিমানী বৃকোদর এবং অবশিষ্ট শত্ৰুদিগকে নিহত করিয়া সূতপত্রের ঋণ হইতে নির্ম্মুক্ত হইব। সারথি রাজা দুৰ্য্যোধনের সেই শূরজনোচিত বাক্য শ্রবণ করিয়া সুবর্ণজালজড়িত অশ্বগণকে মন্দ মন্দ সঞ্চালন করিতে লাগিল। তখন হস্তী, অশ্ব ও রথহীন বীর এবং পঞ্চবিংশতিসহস্র পদাতি মৃদুভাবে ধাবমান হইল। মহাবীর ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া চতুরঙ্গবল-সাহায্যে তাহাদিগকে অবরোধ করিয়া শরনিকরে আহত করিতে লাগিলেন; তাহারাও ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল এবং বারংবার তাহাদিগের নাম গ্রহণ করিতে লাগিল। তখন মহাবীর বৃকোদর একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া গদাহস্তে সত্বর রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক তাহাদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে তিনি অধৰ্ম্মভয়ে রথস্থ হইয়া সেই ভূমিস্থ ব্যক্তিদিগের সহিত যুদ্ধ করিলেন না। তিনি স্বীয় ভুজবল অবলম্বন করিয়া যমদণ্ডসদৃশ সুবর্ণমণ্ডিত বিপুল গদাদ্বারা কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। তখন পদাতিগণ হতবান্ধব হইয়া বহ্নিমুখে পতনোন্মুখ পতঙ্গের ন্যায় প্রাণপণে ভীমের প্রতি ধাবমান হইল এবং ভূতসমুদয় যেমন কৃতান্তকে নিরীক্ষণ করিয়া বিনষ্ট হয়, তদ্রূপ ভীমের সমীপবর্তী হইয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। এইরূপে মহাবীর বৃকোদর কথন খড়্গ, কখন বা গদা গ্রহণপূর্ব্বক সমরাঙ্গনে শ্যেনপক্ষীর ন্যায় বিচরণ করিয়া দুৰ্য্যোধনের সেই পঞ্চবিংশতি সহস্র সৈন্য বিনষ্ট করিয়া ফেলিলেন এবং পরিশেষে ধৃষ্টদ্যুম্নকে পুরোবর্তী করিয়া পুনরায় যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইয়া রহিলেন।
“মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় রথীগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। নকুল, সহদেব ও মহারথ সাত্যকি শকুনির নিধনবাসনায় তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়া নিশিত শরে তাহার অশ্বগণকে বিনাশপূৰ্ব্বক তাঁহার অনুগমন করিলে তাহাদিগের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় বীরগণ কৃষ্ণসারথি শ্বেতাশ্ব অর্জ্জুনকে ত্রিলোকবিখ্যাত গাণ্ডীব শরাসন ধারণপূৰ্ব্বক রথসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিতে লাগিলেন। তখন রথাশ্বশূন্য শরনিকর-নিবারিত পঞ্চবিংশতি সহস্র পদাতি সৈন্য মহাবীর ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইল। পাঞ্চালবংশীয় মহারথগণ তদ্দর্শনে, ভীমসেনকে অগ্রসর করিয়া অবিলম্বে তাহাদিগকে বিনাশ করিলেন। অরাতিনিপাতন, মহাযশস্বী ও মহাধনুর্ধর পাঞ্চালতনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন পারাবতসবর্ণ হয়ে সংযোজিত রথারোহণে সমারঙ্গনে প্রবেশ করিলে কৌরবপক্ষীয় বীরগণ তাঁহাকে অবলোকন করিয়া ভয়ে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। মাদ্ৰীতনয় নকুল ও সহদেব সাত্যকিসমভিব্যাহারে লঘুহস্ত গান্ধাররা শকুনির অনুসরণক্রমে অচিরাৎ আমাদের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলেন। মহাবীর চেকিতান, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য সেনা বিনাশ করিয়া শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণকে রণপরাঙ্মুখ অবলোকন করিয়া, বৃষগণ যেমন বৃষকে পরাজয় করিয়া তাহার অনুগমন করে, তদ্রূপ তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় অবশিষ্ট সৈন্যগণকে রণস্থলে অবস্থিত অবলোকন করিয়া রোষভরে শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় রজোরাশি উত্থিত হওয়াতে আর কিছুই লক্ষিত হইল না; সমস্ত জগৎ অন্ধকারময় ও ধরাতল শরসমাচ্ছন্ন হইলে কৌরবসৈন্যগণ ভয়ে চতুর্দ্দিকে পলান করিতে লাগিল।
মরিয়া হইয়া দুৰ্য্যোধনের যুদ্ধ
“হে মহারাজ! এইরূপে সৈন্যগণ ছিন্নভিন্ন হইলে রাজা দুর্য্যোধন সংগ্রামে ধাবমান হইয়া, দানবরাজ বলি যেমন দেবগণকে আহ্বান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ পাণ্ডবগণকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডবগণও সমবেত হইয়া ক্রোধভরে নানাবিধ অস্ত্রপরিত্যাগ ও বারংবার দুর্য্যোধনকে ভৎর্সনা করিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। কুরুরাজ তদ্দর্শনে কিছুমাত্র ভীত না হইয়া সত্বর সেই শত্রুগণের প্রতি শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় আমরা আপনার পুত্রের অতি আশ্চৰ্য্য পরাক্রম অবলোকন করিলাম। পাণ্ডবগণ সকলে সমবেত হইয়া তাঁহাকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না।
“অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন অনতিদূরস্থ স্বীয় সৈন্যগণকে ক্ষতবিক্ষত ও পলায়নে কৃতনিশ্চয় অবলোকন করিয়া তাহাদিগকে রণস্থলে অবস্থাপন ও তাহাদিগের হর্ষোৎপাদন করিয়া কহিলেন, “হে যোধগণ! তোমরা লোকাল বা পৰ্বতমধ্যে যে কোন প্রদেশে পলায়ন করিবে, পাণ্ডবগণ সেই স্থানে গিয়া তোমাদিগকে বিনাশ করিবে। তবে তোমাদিগের পলায়নের প্রয়োজন কি? দেখ, এক্ষণে উহাদিগের বল অতি অল্পমাত্র অবশিষ্ট এবং কৃষ্ণ ও অর্জুনের কলেবর ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে। অতএব এক্ষণে যদি আমরা একত্র হইয়া এই সমরাঙ্গনে অবস্থান করি, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমাদিগের জয়লাভ হইবে। তোমরা সমর পরাঙ্মুখ হইয়া পলায়ন করিলে পাপাত্মা পাণ্ডবগণ অবশ্যই তোমাদের অনুগমন করিয়া তোমাদিগকে বিনষ্ট করিবে। অতএব সেরূপে প্রাণত্যাগ করা অপেক্ষা সমরস্থলে বিনষ্ট হওয়াই তোমাদের শ্রেয়ঃ। ক্ষত্রিয় ধর্মানুসারে সাংগ্ৰামিক মৃত্যুই অতীব সুখকর। সংগ্রামে মৃত্যু হইলে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করিতে হয় না, পরলোকেও অনন্ত সুখসম্ভোগের অধিকারী হওয়া যায়। হে সমাগত ক্ষত্রিয়গণ! সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া ক্রোধাবিষ্ট দুরাত্মা ভীমসেনের বশবর্তী হওয়াই তোমাদের কর্তব্য; কিন্তু কুলাচরিত ধৰ্ম্ম পরিত্যাগ করা কদাপি বিধেয় নহে। ক্ষত্রিয়ের রণস্থল হইতে পলায়ন অপেক্ষা পাপকর্ম আর কিছুই নাই এবং যুদ্ধ অপেক্ষা স্বর্গগমনেরও অন্য সদুপায় নাই। অন্যান্য লোকে বহুদিনে যে সমুদয় দুর্লভ লোক লাভ করে, যোধগণ অনায়াসে অতি অল্পক্ষণে তৎসমুদয় লাভ করিতে পারে।
“হে মহারাজ! মহারথগণ রাজা দুর্য্যোধনের সেই বাক্য শ্রবণ ও তাঁহার প্রশংসা করিয়া শকৃত পরাজয়-দুঃখ সহ্য করিতে না পারিয়া বিক্রমপ্রকাশে অভিনিবেশপূৰ্ব্বক পাণ্ডবগণের প্রতি পুনরায় যুদ্ধার্থে গমন করিলেন। তখন উভয়পক্ষে দেবাসুর সংগ্রামসদৃশ ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মহারাজ দুর্য্যোধন সৈন্যগণের সহিত যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ পাণ্ডবগণের প্রতি ধাবমান হইলেন।”