শরীরগত অভাব পূরণ করিয়া অপরকে সাহায্য করা মহৎ কর্ম বটে, কিন্তু অভাব যত অধিক এবং সাহায্য যত সুদূরপ্রসারী, উপকারও তত মহত্তর। যদি এক ঘন্টার জন্য কোন ব্যক্তির অভাব দূর করিতে পারা যায়, অবশ্যই তাহার উপকার করা হইল; যদি এক বৎসরের জন্য তাহার অভাব দূর করিতে পারা যায়, তবে তাহা অধিকতর উপকার; আর যদি চিরকালের জন্য অভাব দূর করিতে পারা যায়, তবে তাহাই মানুষের শ্রেষ্ঠ উপকার। একমাত্র অধ্যাত্মজ্ঞানই আমাদের সমুদয় দুঃখ চিরকালের জন্য দূর করিতে পারে; অন্যান্য জ্ঞান অতি অল্প সময়ের জন্য অভাব পূরণ করে মাত্র। কেবল আত্মবি়ষয়ক জ্ঞান দ্বারাই অভাব-বৃত্তি চিরতরে বিনষ্ট হইতে পারে; অতএব আধ্যাত্মিক সাহায্য করাই মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্য করা। মানুষকে যিনি পরমার্থ-জ্ঞান প্রদান করিতে পারেন, তিনিই মানুষের শ্রেষ্ঠ উপকারক। আমরা দেখিতেও পাই, মানুষের আধ্যাত্মিক অভাব পূরণ করিবার জন্য যাঁহারা সাহায্য করিয়াছেন, তাঁহারাই সর্বাপেক্ষা শক্তিমান্ পুরুষ; কারণ আধ্যাত্মিকতাই আমাদের জীবনে সকল কর্মপ্রচেষ্টার প্রকৃত ভিত্তি। আধ্যাত্মিক দিক দিয়া যিনি সুস্থ ও সবল, ইচ্ছা করিলে তিনি অন্যান্য বিষয়েও দক্ষ হইতে পারেন। ভিতরে আধ্যাত্মিক শক্তি না জাগা পর্যন্ত মানুষের শারীরিক অভাবগুলিও ঠিক ঠিক পূর্ণ হয় না। আধ্যাত্মিক উপকারের পরই হইতেছে বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি-বিষয়ে সাহায্য। অন্ন-বস্ত্রদান অপেক্ষা জ্ঞানদান উচ্চতর-প্রাণদান অপেক্ষাও উহা মহৎ, কারণ জ্ঞানই মানুষের প্রকৃত জীবন। অজ্ঞান মৃত্যুতুল্য, জ্ঞানই জীবন। জীবন যদি অন্ধকারে কাটাইতে হয়-অজ্ঞান ও দুঃখের মধ্য দিয়া চলাই যদি জীবন হয়, তবে জীবনের কোন মূল্যই নাই। ইহার পর অবশ্য শারীরিক অভাব পূরণে সাহায্য করার স্থান। অতএব অপরকে স্যহায্য করার বিষয় বিচার করিবার সময় আমরা যেন এই ভ্রমে পতিত না হই যে, শারীরিক সাহায্যই একমাত্র সাহায্য। শারীরিক সাহায্যের স্থান শুধু সর্বশেষে নয়-সর্বনিম্নও, কারণ ইহা স্থায়ী তৃপ্তি দিতে পারে না। ক্ষুধার্ত হইলে যে কষ্ট পাই, খাইলেই তাহা চলিয়া যায়; কিন্তু ক্ষুধা আবার ফিরিয়া আসে। দুঃখ তখনই নিবৃত্ত হইবে, যখন আমার সর্ববিধ অভাব দূর হইবে। তখন ক্ষুধা আমাকে কষ্ট দিতে পারিবে না, কোনরূপ দুঃখ বা যন্ত্রণা আমাকে বিচলিত করিতে পারিবে না। অতএব যাহা আমাদিগকে আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন করে, তাহাই সর্বশ্রেষ্ঠ উপকার; তার পর মানসিক উপকার, তার পর শারীরিক।
কেবল শারীরিক সাহায্য দ্বারা জগতের দুঃখ দূর করা যায় না। যতদিন না মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তিত হইতেছে, ততদিন এই শারীরিক অভাবগুলি সর্বদাই আসিবে এবং দুঃখ অনুভূত হইবেই হইবে। যতই শারীরিক সাহায্য কর না কেন, কোনমতেই দুঃখ একেবারে দূর হইবে না। জগতের এই দুঃখ-সমস্যার একমাত্র সমাধান
মানবজাতিকে শুদ্ধ ও পবিত্র করা। আমরা জগতে যাহা কিছু দুঃখকষ্ট ও অশুভ দেখিতে পাই, সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যা হইতে প্রসূত। মানুষকে জ্ঞানালোক দাও, সকল মানুষ পবিত্র আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়। দেশে প্রত্যেকটি গৃহকে আমরা দাতব্য আশ্রমে পরিণত করিতে পারি, হাসপাতালে দেশ ছাইয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু যতদিন না মানুষের স্বাভার বদলাইতেছে, ততদিন দঃখ-কষ্ট থাকিবেই থাকিবে।
গীতায় আমরা পুনঃপুনঃ পাঠ করি-আমাদিগকে অবিরত কর্ম করিতে হইবে। সকল কর্মই স্বভাবতঃ শুভাশুভ-মিশ্রিত। আমরা এমন কোন কর্ম করিতে পারি না, যাহা দ্বারা কোথাও কিছু না কিছু ভাল হয়, আবার এমন কোন কর্ম হইতে পারে না, যাহা হইতে কোথাও না কোথাও কিছু অনিষ্ট হয়। প্রত্যেক কর্মই অপরিহার্যভাবে শুভাশুভ-মিশ্রিত, তথাপি শাস্ত্র আমাদিগকে অবিরত কর্ম করিতে বলিতেছেন। শুভাশুভ উভয়ই নিজ নিজ ফল প্রসব করিবে। শুভ কর্মের ফল শুভ, অশুভ কর্মের ফল অশুভ হইবে; কিন্তু এই শুভাশুভ উভয়ই আত্মার বন্ধন। গীতায় ইহার এই মীমাংসা করা হইয়াছে যে, যদি আমরা কর্মে আসক্ত না হই, তবে কর্ম আমাদের বন্ধন হইতে পারিবে না। এখন ‘কর্মে অনাসক্তি’ বলিতে কি বুঝায়, আমরা তাহাই বুঝিতে চেষ্টা করিব।
গীতার মূলভাব এই : নিরন্তর কর্ম কর,-কিন্তু তাহাতে আসক্ত হইও না। ‘সংস্কার’ শব্দের প্রায় কাছাকাছি অর্থ ‘সহজাত প্রবণতা’। মনকে যদি একটি হ্রদের সহিত তুলনা করা হয়, তবে বলা যায়-মনের মধ্যে যে-কোন তরঙ্গ উঠে, তাহা প্রশমিত হইলেও একেবারে লুপ্ত হয় না, কিন্তু উহা চিত্তের উপর একটা দাগ রাখিয়া যায় এবং সেই তরঙ্গটির পুনরাবির্ভাব-সম্ভাবনা থাকে। এই দাগ এবং ঐ তরঙ্গের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনার একত্র নাম-‘সংস্কার’। আমরা যে-কোন কর্ম করি-আমাদের প্রত্যেক অঙ্গ-সঞ্চালন, আমাদের প্রত্যেক চিন্তা-চিত্তের উপর এইরূপ সংস্কার রাখিয়া যায়; যখন সংস্কারগুলি উপরিভাগে থাকে না, তখনও এত প্রবল থাকে যে, তাহারা অবচেতন মনে অজ্ঞাতসারে কার্য করিতে থাকে। আমরা প্রতি মুহুর্তে যাহা, তাহা আমাদের মনের উপর এই সংস্কার-সমষ্টির দ্বারা নিরূপিত হয়। এই মুহুর্তে আমার ‘আমি’ বলিতে যাহা বুঝায়, তাহা আমার অতীত জীবনের সংস্কার-সমষ্টির ফল মাত্র। ইহাকেই প্রকৃতপক্ষে ‘চরিত্র’ বলে। প্রত্যেক ব্যক্তির চরিত্র এই সংস্কার-সমষ্টির দ্বারা নিরূপিত হয়। যদি শুভ সংস্কারগুলি প্রবল হয়, তবে চরিত্র সৎ হয়; অসৎ সংস্কারগুলি প্রবল হইলে চরিত্র অসৎ হয়। যদি কোন ব্যক্তি সর্বদা মন্দ কথা শোনে, মন্দ চিন্তা করে, মন্দ কাজ করে, তাহার মন মন্দ সংস্কারে পূর্ণ হইয়া যাইবে এবং ঐগুলিই অজ্ঞাতসারে তাহার কর্ম ও চিন্তাকে প্রভাবিত করিবে। বাস্তবিক পক্ষে এই মন্দ সংস্কারগুলি সর্বদাই কাজ করিতেছে, সুতরাং ইহাদের ফলও মন্দ হইবে এবং ঐ ব্যক্তি একটি মন্দ লোক হইয়া দাঁড়াইবে-সে ঐরূপ না হইয়া পারে
না। তাহার মনের এই সংস্কার-সমষ্টি মন্দ কাজ করিবার প্রবল প্রেরণা-শক্তি উৎপন্ন করিবে। এই সংস্কারগুলির হাতে সে যন্ত্রতুল্য হইবে, এগুলি তাহাকে জোর করিয়া মন্দ কার্যে প্রবৃত্ত করিবে। এইরূপে যদি কেহ ভাল বিষয়ে চিন্তা করে এবং ভাল কাজ করে, সংস্কারগুলির সমষ্টি ভালই হইবে এবং অনুরুপভাবে ঐগুলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তিকে সৎকার্যে প্রবৃত্ত করিবে। যখন মানুষ এত বেশী ভাল কাজ করে এবং এত বেশী সৎ চিন্তা করে যে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহার প্রকৃতিতে সৎ কার্য করিবার অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হয়, তখন সে কোন অন্যায় কার্য করিতে ইচ্ছা করিলেও ঐ সকল সংস্কারের সমষ্টি-স্বরূপ তাহার মন তাহাকে উহা করিতে দিবে না, সংস্কারগুলিই তাহাকে মন্দ কর্ম হইতে ফিরাইয়া আনিবে; সে তখন সৎ সংস্কারগুলি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত হয়। যখন এইরূপ হয়, তখনই সেই ব্যক্তির চরিত্র গঠিত হইয়াছে বলা যায়।
যেমন কূর্ম তাহার পা ও মাথা খোলার ভেতরে গুটাইয়া রাখে-তাহাকে মারিয়া ফেলিতে পারো, খন্ড খন্ড করিয়া ফেলিতে পারো, তথাপি পা ও মাথা বাহিরে আসিবে না, তেমনি যে ব্যক্তির ইন্দ্রিয় ও প্রবৃত্তিগুলি সংযত হইয়াছে, তাহার চরিত্রও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। সে তাহার অন্তরিন্দ্রিয়গুলি সংযত করিয়াছে, তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছুই সেগুলিকে বহির্মুখী করিতে পারে না। এরূপ নিরন্তর সচ্চিন্তার প্রতিক্রিয়া দ্বারা শুভ সংস্কারগুলি তাহার মনের উপরিভাগে সর্বদা আবর্তিত হওয়ায় সৎকর্ম করিবার প্রবণতা প্রবল হয়; তাহার ফল এই হয় যে, আমরা ইন্দ্রিয়গুলি (জ্ঞানেন্দিয়ের যন্ত্র ও স্নায়ুকেন্দ্র) জয় করিতে সমর্থ হই। এভাবেই চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই মানুষ সত্য লাভ করিতে পারে। এরূপ লোকই চিরকালের জন্য নিরাপদ; তাহার দ্বারা কোন অন্যায় অশুভ কার্য সম্ভব হয় না। তাহাকে যেরূপ সঙ্গেই রাখো না কেন, তাহার কোন বিপদের সম্ভাবনা নাই। এই সৎপ্রবৃত্তি-সম্পন্ন হওয়া অপেক্ষা আরও এক উচ্চতর অবস্থা আছে-মুমুক্ষুত্ব। তোমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, সকল যোগের লক্ষ্য-আত্মার মুক্তি এবং প্রত্যেক যোগই সমভাবে একই লক্ষ্যে লইয়া যায়। বুদ্ধ প্রধানতঃ ধ্যানের দ্বারা, খ্রীষ্ট প্রার্থনা দ্বারা যে অবস্থা লাভ করিয়াছিলেন, মানুষ কেবল কর্মের দ্বারাই সেই অবস্থা লাভ করিতে পারে। বুদ্ধ ছিলেন কর্মপরায়ণ জ্ঞানী, আর খ্রীষ্ট ছিলেন ভক্ত; কিন্তু উভয়ে একই লক্ষ্যে উপনীত হইয়াছিলেন। এটুকুই বুঝা কঠিন। মুক্তির অর্থ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-যেমন অশুভ বন্ধন হইতে, তেমনি শুভ বন্ধন হইতেও মুক্তি। সোনার শিকলও শিকল, লোহার শিকলও শিকল। আমার আঙুলে একটি কাঁটা ফুটিয়াছে, আর একটি কাঁটা দ্বারা ঐ কাঁটাটি তুলিয়া ফেলিলাম, তোলা হইয়া গেলে দুটি কাঁটাই ফেলিয়া দিলাম। দ্বিতীয় কাঁটাটি রাখিবার দরকার নাই, কারণ দুটিই তো কাঁটা! এইরূপ অশুভ সংস্কারগুলি শুভ সংস্কার দ্বারা ব্যাহত করিতে হইবে। মনের মন্দ সংস্কারগুলি দূরীভূত করিয়া সেখানে ভাল সংস্কারের তরঙ্গ প্রবাহিত করিতে হইবে-যতদিন না যাহা কিছু মন্দ, তাহা প্রায়
অন্তর্হিত হয়, অথবা নিয়ন্ত্রিত হইয়া মনের এক কোণে বশীভূত ভাবে থাকে; কিন্তু তারপর শুভ সংস্কারগুলিও জয় করিতে হইবে। এরূপে ‘আসক্ত’ মন ক্রমে ‘অনাসক্ত’ হইয়া যায়। কর্ম কর, কিন্তু ঐ কর্ম বা চিন্তা যেন মনের উপর কোন গভীর সংস্কার উৎপন্ন না করে। ছোট ছোট তরঙ্গ আসুক, পেশী ও মস্তিষ্ক হইতে বড় বড় কর্মতরঙ্গ উৎপন্ন হউক, কিন্তু তাহারা যেন আত্মার উপর গভীর সংস্কার উৎপন্ন না করে।
ইহা করিবার উপায় কি? আমরা দেখতে পাই, যে কার্যে আমরা আসক্ত হই, তাহারই সংস্কার থাকিয়া যায়। সারা দিনে শত শত ব্যক্তিকে দেখিয়াছি, তাহাদের মধ্যে এমন একজনকে দেখিয়াছি, যাহাকে আমি ভালবাসি। রাত্রে যখন শয়ন করিতে গেলাম, তখন আমার দৃষ্ট মুখগুলির বিষয় চিন্তা করিবার চেষ্টা করিতে পারি কিন্তু এক মিনিটের জন্য যে-মুখখানি দেখিয়াছিলাম, যাহাকে আমি ভালবাসি, সেই মুখখানিই আমার মনে ভাসিয়া উঠিল, আর সব মুখগুলি কোথায় অন্তর্হিত হইল। ঐ ব্যক্তির প্রতি আমার বিশেষ আসক্তিবশতঃ অন্যান্য মুখগুলি অপেক্ষা ঐ মুখখানিই আমার মনে গভীর চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে। শারীরিক দিক দিয়া মুখগুলি দেখার কাজ একরূপই, যে মুখগুলি আমি দেখিয়াছি সবগুলির ছবিই আমার অক্ষিজালের(Retina) উপর পড়িয়াছিল, মস্তিষ্ক ঐ ছবি গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু মনের উপর উহাদের প্রভাব একরূপ হয় নাই। বেশির ভাগ মুখ হয়তো সম্পূর্ণ নূতন ছিল; এমন সব নূতন মুখ হয়তো দেখিয়াছি, যেগুলি সম্বন্ধে আমি পূর্বে কখন চিন্তাই করি নাই; কিন্তু যে-মুখখানির একবার মাত্র চকিত দর্শন পাইয়াছি, তাহার সহিত চিত্তের বিশেষ যোগাযোগ ছিল। হয়তো কত বৎসর ধরিয়া মনে মনে তাহার ছবি আঁকিতেছিলাম, তাহার সম্বন্ধে শত শত বিষয় জানিতাম, এখন এই নতূন করিয়া দেখায়-মনের শত শত স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। অন্য বিভিন্ন মুখগুলি দেখার সমবেত ফলে মনে যে সংস্কার পড়িয়াছে, ঐ একখানি মুখ মানসপটে তদপেক্ষা শতগুণ অধিক সংস্কার ফেলিয়া মনের উপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করিবে।
অতএব ‘অনাসক্ত’ হও, সব ব্যাপার চলিতে থাকুক, মস্তিষ্ক-কেন্দ্রগুলি কর্ম করুক। নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু একটি তরঙ্গও যেন মনকে পরাভূত না করিতে পারে। তুমি যেন সংসারে বিদেশী পথিক, যেন দুদিনের জন্য আসিয়াছ-এইভাবে কর্ম করিয়া যাও। নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু নিজেকে বন্ধনে ফেলিও না; বন্ধন বড় ভয়ানক। এই জগৎ আমাদের বাসভূমি নয়। নানা অবস্থার ভিতর দিয়া আমরা চলিয়াছি, এই সংসার-এ পৃথিবী সেগুলিরেই একটি। সাংখ্যের সেই মহাকাব্য স্মরণ রাখিও ‘সমুদয় প্রকৃতি আত্মার জন্য, আত্মা প্রকৃতির জন্য নয়।’১ আত্মার শিক্ষার জন্যই প্রকৃতির প্রয়োজন। ইহার অন্য কোন অর্থ নাই। আত্মা যাহাতে জ্ঞানলাভ
করিতে পারে এবং জ্ঞানের দ্বারাই আত্মা নিজেকে মুক্ত করিতে পারে-ইহাই প্রয়োজন। যদি সর্বদাই এ-কথা স্মরণ রাখি, তবে কখনই প্রকৃতিতে আসক্ত হইব না; আমরা বুঝিব যে, প্রকৃতি আমাদের একটি পাঠ্যপুস্তকমাত্র। উহা হইতে জ্ঞানলাভ করিবার পর, আমাদের নিকট ঐ গ্রন্থের আর কোন মূল্য থাকে না। তাহা না করিয়া প্রকৃতির সহিত আমরা নিজেদের মিশাইয়া ফেলিতেছি, ভাবিতেছি আত্মাই প্রকৃতির জন্য। চলিত কথায় আছে, আমরাও মনে করি- মানুষ ‘খাবার জন্যই বাঁচে’; ‘বাঁচার জন্য যে খায়’-তা নয়। আমরা ক্রমাগত এই ভুল করিতেছি; প্রকৃতিকেই ‘আমি’ ভাবিয়া উহাতে আসক্ত হইতেছি। এই আসক্তি হইতেই আত্মার উপর গভীর সংস্কার পড়ে। এই সংস্কারই আমাদিগকে বদ্ধ করে এবং স্বাধীনভাবে কর্ম করিতে না দিয়া ক্রীতদাসের মতো কর্ম করায়।
এই শিক্ষার সারমর্ম এই যে প্রভুর মতো কর্ম করিতে হইবে, ক্রীতদাসের মতো নয়। সর্বদা কর্ম কর, কিন্তু দাসের মতো কর্ম করিও না। সকলে কিভাবে কর্ম করিতেছে, তাহা কি দেখিতেছ না? কেহই সম্পূর্ণভাবে কর্মহীন হইতে পারে না। শতকরা নিরানব্বই জন লোক ক্রীতদাসের মতো কর্ম করিয়া থাকে-তাহার ফল দুঃখ; ঐরূপ কর্ম স্বার্থপর। স্বাধীনতার সহিত কাজ কর, প্রেমের সহিত কাজ কর! ‘প্রেম’ শব্দটি হূদয়ঙ্গম করা বড় কঠিন। স্বাধীনতা না থাকিলে কখনও প্রেম আসিতে পারে না। ক্রীতদাসের পক্ষে যথার্থ প্রেম সম্ভব নয়। একটি ক্রীতদাস কিনিয়া শৃঙ্খলে বাঁধিয়া তাহাকে দিয়া কাজ করাও, সে বাধ্য হইয়া একটানাভাবে কাজ করিবে, কিন্তু তাহার অন্তরে কোন ভালবাসা থাকিবে না। এইরূপ আমরাও যখন সাংসারিক ব্যাপারে ক্রীতদাসের মতো কাজ করি, আমাদেরও অন্তরে কোন ভালবাসা থাকে না; আমাদের এই কাজ প্রকৃত কর্ম নয়। আমাদের আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের জন্য আমরা যে কাজ করি, এমন কি, আমাদের নিজেদের জন্য যে কাজ করি, তাহার সম্বন্ধেও ঐ কথা খাটে।
স্বার্থের জন্য কৃত কর্ম দাসসুলভ কর্ম, আর কোন কর্ম স্বার্থের জন্য কৃত কিনা, তাহার পরীক্ষা এই যে, প্রেমের সহিত যে-কোন কাজ করা যায়, তাহাতে সুখই হইয়া থাকে। প্রেম-প্রণোদিত এমন কোন কাজ নাই, যাহার ফলে শান্তি ও আনন্দ না আসে। প্রকৃত সত্তা, প্রকৃত জ্ঞান, প্রকৃত প্রেম অনন্তকালের জন্য পরস্পর-সম্বন্ধ-ইহারা একে তিন। ইহাদের একটি যেখানে আছে, অপরগুলি সেখানে অবশ্য থাকিবে। ইহারা সেই অদ্বিতীয় সচ্চিদানন্দেরই ত্রিবিধ রূপ! যখন সেই(নিরপেক্ষ) সত্তা আপেক্ষিকভাবাপন্ন হয়, তখন উহাকে আমরা জগৎরূপে দেখিয়া থাকি। সেই জ্ঞানই আবার জাগতিক বস্তুবিষয়ক জ্ঞানে পরিবর্তিত হয় এবং সেই আনন্দই মানবহূদয়ে সর্ববিধ ভালবাসার ভিত্তিস্বরূপ। অতএব প্রকৃত প্রেম কখনও প্রেমিক অথবা প্রেমাস্পদ কাহারও দুঃখের কারণ হইতে পারে না।
মনে কর, একজন পুরুষ একটি মেয়েকে ভালবাসে। সে একাই তাহাকে পরিপূর্ণ ভাবে ভোগ করিতে চায়; তাহার প্রতিটি গতিবিধি সম্বন্ধে পুরুষটির মনে ঈর্ষার উদয় হয়। সে চায়-মেয়েটি তাহার কাছে বসুক, তাহার কাছে দাঁড়াক, তাহার ইঙ্গিতে খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা প্রভৃতি সব কাজ করুক। সে ঐ মেয়েটির ক্রীতদাস, এবং মেয়েটিকেও নিজের দাসী করিয়া রাখিতে চায়। ইহা ভালবাসা নয়, ইহা একপ্রকার দাসসুলভ অনুরাগের বিকার। ভালবাসার মতো দেখাইতেছে, বস্তুতঃ ইহা ভালবাসা নয়। উহা ভালবাসা হইতে পারে না, কারণ উহা যন্ত্রণাদায়ক। যদি মেয়েটি তাহার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ না করে, তবে তাহার কষ্ট হইবে। ভালবাসায় কোন দুখঃকর প্রতিক্রিয়া নাই। ভালবাসার প্রতিক্রিয়ায় কেবল আনন্দই হইয়া থাকে। ভালবাসিয়া যদি আনন্দ না হয়, তবে উহা ভালবাসা নয়; অন্য কিছুকে আমরা ভালবাসা বলিয়া ভুল করিতেছি। যখন তুমি তোমার স্বামীকে, স্ত্রীকে,পুত্রকন্যাকে, সমুদয় পৃথিবীকে, বিশ্বজগৎকে এমনভাবে ভালবাসিতে সমর্থ হইবে যে, তাহাতে কোনরূপ দুঃখ ঈর্ষা বা স্বার্থপরতার প্রতিক্রিয়া হইবে না, তখনই তুমি প্রকৃতপক্ষে অনাসক্ত হইতে পারিবে।
______________________
১ তুলনীয়ঃ সংহতানাং পরার্থত্বাৎ
শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, ‘হে অর্জুন, আমাকেই দেখ না, আমি যদি এক মুহুর্ত কর্ম হইতে বিরত হই, সমগ্র জগৎ ধ্বংস হইবে। কর্ম করিয়া আমার কোন লাভ নাই। আমিই জগতের একমাত্র প্রভু, তবে আমি কর্ম করি কেন? -জগৎকে ভালবাসি বলিয়া।’১ ঈশ্বর ভালবাসেন বলিয়াই তিনি অনাসক্ত। প্রকৃত ভালবাসা আমাদিগকে অনাসক্ত করে। যেখানেই দেখিবে আসক্তি-পার্থিব বস্তুর প্রতি এই আকর্ষণ, সেখানেই জানিবে উহা প্রাকৃতিক আকর্ষণ, কতকগুলি জড়বিন্দুর সহিত আরও কতকগুলি জড়বিন্দুর ভৌতিক আকর্ষণ মাত্র-কিছু যেন দুইটি বস্তুকে ক্রমাগত নিকটে আকর্ষণ করিতেছে; আর উহারা পরস্পর খুব নিকটবর্তী হইতে না পরিলেই যণ্ত্রণার উদ্ভব হয়; কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা ভৌতিক বা শারীরিক আকর্ষণের উপর কিছুমাত্র নির্ভর করে না। এরূপ প্রেমিকগণ পরস্পরের নিকট হইতে সহস্র মাইল ব্যবধানে থাকিতে পারেন, কিন্তু তাহাতে তাহাদের ভালোবাসা অটুট থাকিবে, উহা বিনষ্ট হইবে না এবং উহা হইতে কখনও কোন যন্ত্রণাদায়ক প্রতিক্রিয়া হইবে না।
এই অনাসক্তি লাভ করা একরূপ সারা জীবনের সাধনা বলিলেও হয়, কিন্তু উহা লাভ করিতে পারিলেই আমরা প্রকৃত প্রেমের লক্ষ্যস্থলে উপনীত হইলাম এবং মুক্ত হইলাম। তখন আমাদের প্রকৃতিজাত বন্ধন খসিয়া পড়ে এবং আমরা প্রকৃতির যথার্থ রূপ দেখিতে পাই। প্রকৃতি আমাদের জন্য আর বন্ধন সৃষ্টি করিতে পারে না; আমরা তখন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে দাঁড়াইতে পারি এবং কর্মের ফলাফল আর গণ্য করি না। কি ফল হইল, কে তখন গ্রাহ্য করে?
শিশুসন্তানদিগকে কিছু দিলে তোমরা কি তাহাদের নিকট হইতে কিছু প্রতিদান চাও?
১ তুলনীয়ঃ গীতা, ৩।২২-২৪
তাহাদের জন্য কাজ করাই তোমার কর্তব্য-ঐখানেই উহার শেষ। কোন বিশেষ ব্যক্তি নগর বা রাষ্ট্রের জন্য যাহা কর, তাহা করিয়া যাও, কিন্তু সন্তানদের প্রতি তোমার যেরূপ ভাব উহাদের প্রতিও সেই ভাব অবলম্বন কর, উহাদের নিকট হইতে প্রতিদানস্বরূপ কিছু আশা করিও না। যদি সর্বদা দাতার ভাব অবলম্বন করিতে পারো, প্রত্যুপকারের কোন আশা না রাখিয়া জগৎকে শুধু দিয়া যাইতে পারো, তবেই সেই কর্ম হইতে তোমার কোন বন্ধন বা আসক্তি আসিবে না। যখন আমরা কিছু প্রত্যাশা করি, তখনই আসক্তি আসে।
যদি ক্রীতদাসের মতো কাজ করিলে তাহাতে স্বার্থপরতা ও আসক্তি আসে, তাহা হইলে প্রভুর ভাবে কাজে করিলে তাহাতে অনাসক্তিজনিত আনন্দ আসিয়া থাকে। আমরা অনেক সময ন্যায়ধর্ম ও নিজ নিজ অধিকারের কথা বলিয়া থাকি, কিন্তু দেখিতে পাই-এ-সংসারে ঐগুলি শিশুসুলভ বাক্যমাত্র। দুইটি ভাব মানুষের চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করিয়া থাকে-ক্ষমতা ও দয়া। ক্ষমতাপ্রয়োগ চিরকালেই স্বার্থপরতা দ্বারা চালিত হয়। সকল নরনারীই-তাহাদের শক্তি ও সুবিধা যতটা আছে, তাহার যতটা পারে তাহা প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করে। দয়া স্বর্গীয় বস্তু; ভাল হইতে গেলে আমাদের সকলকেই দয়াবান্ হইতে হইবে। এমন কি ন্যায়বিচার এবং অধিকারবোধ দয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। কর্মের ফলাকাঙ্ক্ষাই আমাদের আধ্যত্মিক উন্নতির প্রতিবন্ধক; শুধু তাই নয়, পরিণামে ইহা দুঃখের কারণ হয়। আর এক উপায় আছে, যাহা দ্বারা এই দয়া ও নিঃস্বার্থপরতা কার্যে পরিণত করা যাইতে পারে; যদি আমরা সগুণ ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, তবে কর্মকে ‘উপাসনা’ বলিয়া চিন্তা করিতে হইবে। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের সমুদয় কর্মফল ভগবানে অর্পন করিযা থাকি। এইরূপে তাঁহাকে উপাসনা করিলে-আমাদের কর্মের জন্য মানবজাতির নিকট কিছু প্রত্যাশা করিবার অধিকার আমাদের নাই। প্রভূ স্বয়ং সর্বদা কর্ম করিতেছেন এবং তাঁহার আসক্তি নাই। জল যেমন পদ্মপত্র ভিজাইতে পারে না, ফলে আসক্তি উৎপন্ন করিয়া কর্ম তেমনি নিঃস্বার্থ ব্যক্তিকে বদ্ধ করিতে পারে না। অহং-শূন্য ও অনাসক্ত ব্যক্তি জনপূর্ণ পাপসঙ্কুল শহরের অভ্যন্তরে বাস করিতে পারেন, তাহাতে তিনি পাপে লিপ্ত হইবেন না।
এই সম্পূর্ণ স্বার্থত্যাগের ভাবটি এই গল্পটিতে ব্যাখ্যাত হইয়াছে : কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের অবসানে পঞ্চপান্ডব এক মহাযজ্ঞ করিয়া দরিদ্রদিগকে নানাবিধ বহুমূল্য বস্তু দান করিলেন। সকলেই এ-যজ্ঞের জাঁকজমক ও ঐশ্বর্যে চমৎকৃত হইয়া বলিতে লাগিল, জগতে পূর্বে এরূপ যজ্ঞ আর হয় নাই। যজ্ঞশেষে এক ক্ষুদ্রকায় নকুল আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার অর্ধশরীর সোনার মতো রঙ, বাকী অর্ধেক পিঙ্গল। নকুলটি সেই যজ্ঞভূমিতে গড়াগড়ি দিতে লাগিল, এবং সেখানে উপস্থিত সকলকে বলিল, ‘তোমরা সব মিথ্যাবাদী, ইহা যজ্ঞই নয়।’ তাহারা বলিতে লাগিল, ‘কি তুমি বলিতেছ-ইহা যজ্ঞই নয়? তুমি কি জান না, এই যজ্ঞে দরিদ্রদিগকে কত ধনরত্ন প্রদত্ত হইয়াছে,
সকলেই ধনবান্ ও সন্তুষ্ট হইয়া গিয়াছে? ইহার মতো অদ্ভুত যজ্ঞ আর কেহ কখনও করে নাই।’ নকুল বলিল :
শুনুন-এক ক্ষুদ্র গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ স্ত্রী পুত্র ও পুত্রবধূ সহ বাস করিতেন। ব্রাহ্মণ খুব গরীব ছিলেন; শাস্ত্রপ্রচার ও ধর্মোপদেশ দ্বারা লব্ধ ভিক্ষাই ছিল তাঁহার জীবিকা। সেই দেশে একদা পর পর তিন বৎসর দুর্ভিক্ষ হইল, গরীব ব্রাহ্মণটি পূর্বাপেক্ষা অধিকতর কষ্ট পাইতে লাগিলেন। অবশেষে সেই পরিবারকে পাঁচ দিন উপবাসে থাকিতে হইল। সৌভাগ্যক্রমে ষষ্ঠ দিনে পিতা কিছু যবের ছাতু সংগ্রহ করিয়া আনিলেন এবং উহা চার ভাগ করিলেন। তাঁহারা উহা খাদ্যরূপে প্রস্তুত করিয়া ভোজনে বসিয়াছেন, এমন সময় দরজায় ঘা পড়িল । পিতা দ্বার খুলিয়া দেখিলেন যে, এক অতিথি দাঁড়াইয়া। ভারতবর্ষে অতিথি বড় পবিত্র ও মাননীয়; সেই সময়ের জন্য তাঁহাকে ‘নারায়ণ’ মনে করা হয় এবং তাঁহার প্রতি সেইরূপ আচরণ করা হয়। দরিদ্র ব্রাহ্মণটি বলিলেন, ‘আসুন, মহাশয় আসুন, স্বাগত!’ ব্রাহ্মণ অতিথির সন্মুখে নিজ ভাগের খাদ্য রাখিলেন। অতিথি অতি শীঘ্রই উহা নিঃশেষ করিয়া বলিলেন, ‘মহাশয়, আপনি আমাকে একেবারে মারিয়া ফেলিলেন দেখিতেছি। আমি দশ দিন ধরিয়া উপবাস করিতেছি-এই অল্প পরিমাণ খাদ্যে আমার জঠরাগ্নি আরও জ্বলিয়া উঠিল!’ তখন ব্রাহ্মণী স্বামীকে বলিলেন, ‘আমার ভাগও উঁহাকে দিন।’ স্বামী বলিলেন, ‘না, তা হইবে না।’ কিন্তু ব্রাহ্মণ-পত্নী জোর করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এ দরিদ্র অতিথি আমাদের নিকট উপস্থিত, আমরা গৃহস্থ-আমাদের কর্তব্য তাঁহাকে খাওয়ানো, আপনার যখন আর কিছু দিবার নাই, তখন সহধর্মিণীরূপে আমার কর্তব্য তাঁহাকে আমার ভাগ দেওয়া।’ এই বলিয়া তিনিও নিজ ভাগ অতিথিকে দিলেন। অতিথি তৎক্ষণাৎ তাহা নিঃশেষ করিয়া বলিলেন, ‘আমি এখনও ক্ষুধায় জ্বলিতেছি।’ তখন পুত্রটি বলিল, ‘আপনি আমার ভাগও গ্রহণ করুন। পুত্রের কর্তব্য-পিতাকে তাঁহার কর্তব্যপালনে সহায়তা করা।’ অতিথি তাহারও অংশ খাইয়া ফেলিলেন, কিন্তু তথাপি তাঁহার তৃপ্তি হইল না। তখন পুত্রবধূও তাঁহার ভাগ দিলেন। এইবার তাঁহার আহার পর্যাপ্ত হইল। অতিথি তখন তাঁহাদিগকে আশীর্বাদ করিতে করিতে চলিয়া গেলেন।
সেই রাত্রে ঐ চারিটি লোক অনাহারে মরিয়া গেল। ঐ ছাতুর গুঁড়া কিছু মেঝেয় পড়িয়াছিল। যখন আমি উহার উপরে গড়াগড়ি দিলাম, তখন আমার অর্ধেক শরীর সোনালী হইয়া গেল; আপনারা সকলে তো ইহা দেখিতেছেন। সেই অবধি আমি সমগ্র জগৎ খুঁজিয়া বেড়াইতেছি; আমার ইচ্ছা যে এইরূপ আর একটি যজ্ঞ দেখিব। কিন্তু আর সেরূপ যজ্ঞ দেখিতে পাইলাম না। আর কোথাও আমার শরীরের অপরার্ধ সুবর্ণে পরিণত হইল না। সেই জন্যই আমি বলিতেছি, ইহা যজ্ঞই নয়।
ভারত হইতে এরূপ স্বার্থত্যাগ ও দয়ার ভাব চলিয়া যাইতেছে; মহৎ ব্যক্তিগণের
সংখ্যা ক্রমশঃ কমিয়া যাইতেছে। নূতন ইংরেজী শিখিবার সময় আমি একটা গল্পের বই পড়িয়াছিলাম। উহাতে একটি গল্প ছিল-কর্তব্যপরায়ণ বালকের গল্প; সে কাজ করিয়া যাহা উপার্জন করে, তাহার কতকাংশ তাহার বৃদ্ধা জননীকে দিয়াছিল। বই-এর তিন-চার পৃষ্ঠা ধরিয়া বালকের এই কাজের প্রশংসা করা হইয়াছে। কিন্তু ইহাতে অসাধারণত্ব কি আছে? এই গল্প যে কি নীতি শিক্ষা দেয়, কোন হিন্দু বালকই তাহা ধরিতে পারে না। এখন পাশ্চাত্য দেশের ভাব-‘প্রত্যেকেই নিজের জন্য’ শুনিয়া আমি ব্যাপারটা বুঝিতে পারিতেছি! এদেশে এমন লোক অনেক আছে, যাহারা নিজেরাই সব ভোগ করে, বাপ-মা-স্ত্রী-পুত্রদিগের একেবারে ভাসাইয়া দেয়। কোথাও কখনও গৃহস্থের এরূপ আদর্শ হওয়া উচিত নয়।
এখন তোমরা বুঝিতেছ, কর্মযোগের অর্থ কি। উহার অর্থ-মৃত্যুর সন্মুখীন হইয়াও মুখটি বুজিয়া সকলকে সাহায্য করা। লক্ষ লক্ষ বার লোক তোমাকে প্রতারণা করুক, কিন্তু তুমি একটি প্রশ্নও করিও না, এবং তুমি যে কিছু ভাল কাজ করিতেছ, তাহা ভাবিও না। দরিদ্রগণকে তুমি যে দান করিতেছ, তাহার জন্য বাহাদুরি করিও না, অথবা তাহাদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতা আশা করিও না, বরং তাহারা যে তোমাকে তাহাদের সেবা করিবার সুযোগ দিয়াছে, সেইজন্য তাহাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অতএব স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, আদর্শ সন্ন্যাসী হওয়া অপেক্ষা আদর্শ গৃহী হওয়া কঠিন। যথার্থ ত্যাগীর জীবন অপেক্ষা যথার্থ কর্মীর জীবন কঠোরতর না হইলেও সত্যই সমভাবে কঠিন।