শিবিরেতে গেল দুর্য্যোধন মহারাজ।
অর্জ্জুনের সহ রণে পেয়ে বড় লাজ।।
কাহার বাহন নাহি, কার নাহি ধনু।
অর্জ্জুনের বাণে সবে ছিন্নভিন্ন তনু।।
মুখে গদ গদ বাণী, বদন বিবর্ণ।
অপমানে বসিলেন ভূমিতলে কর্ণ।।
দশন ভাঙ্গিয়া যেন বারণ পলাল।
মহা ভূজঙ্গমে যেন বারণ পিষিল।।
সে মত কৌরবগণ মহালজ্জা পায়।
মনোদুঃখ দুর্য্যোধন শিবিরেতে যায়।।
নিঃশ্বাস ছাড়িয়া রাজা দুর্য্যোধন বলে।
কি করিব, কি হইবে, বলহ সকলে।।
দুর্য্যোধন বলে, শুন রাধার তনয়।
তোমা হৈতে হৈল মম কুরুবল ক্ষয়।।
প্রতিজ্ঞা করিলে তুমি জিনিবে পাণ্ডবে।
সেনাপতি করিলাম বুঝি অনুভবে।।
তোমার বচনে আমি যুদ্ধ কৈনু পণ।
তুমি জয় করি দিবে পাণ্ডুর নন্দন।।
পুনঃ পুনঃ কহিলে যে করি অহঙ্কার।
আমার সাক্ষাতে যে পাণ্ডব কিবা ছার।।
তোমার সামর্থ্য যত, সব ব্যর্থ হৈল।
তব আগে পার্থ মোর সৈন্য নিপাতিল।।
যদ্যপি কহিতে আগে জিনিতে নারিবে।
শরণ লৈতাম আমি পাণ্ডবের তরে।।
অনেক নিন্দিয়া তবে রাজা দুর্য্যোধন।
ভূমিতলে বসিলেন বিরস-বদন।।
দেখিয়া শুনিয়া বীর কর্ণ মহাবল।
ক্রোধেতে জ্বলয়ে যেন জ্বলন্ত অনল।।
হাতে হাতে কচালয়ে, ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস।
অহঙ্কারে কর্ণ বীর চাহিছে আকাশ।।
দুর্য্যোধন-মুখ চাহি বলে বীর কর্ণ।
দেবাসুর মধ্যে যেন রুষিল সুপর্ণ।।
যোদ্ধা মধ্যে বুদ্ধিমন্ত অর্জ্জুন-বিশেষ।
সতত শ্রীকৃষ্ণ তারে দেন উপদেশ।।
করযোড়ে বলে কর্ণ, শুন মহাশয়।
কালি তার গর্ব্ব আমি ঘুচাব নিশ্চয়।।
কর্ণের বচনে হৃষ্ট হৈল দুর্য্যোধন।
উল্লাসিত হইলেক কৌরবের গণ।।
মহাবীর কর্ণ যুদ্ধে অপমান গণি।
ফুকারি ফুকারি চিত্তে কাটায় রজনী।।
প্রভাতে চলিয়া গেল সভা বিদ্যমানে।
মূত্তিমন্ত সর্প যেন, আপনা বাখানে।।
মোর সম বীর নাহি ভুবন ভিতরে।
কোন্ গুণে গুণী পার্থ, কিবা বল ধরে।।
আজি তোরে আমি পাঠাইব যমঘরে।
কিংবা সে মারুক মোরে সংগ্রাম ভিতরে।।
গাণ্ডীব নামেতে ধনু আছে তার করে।
বিজয় নামেতে ধনু রাম দিল মোরে।।
বিশ্বকর্ম্মা নির্ম্মিত বিজয় শরাসন।
ইন্দ্র যারে ধরি কৈল অসুর নিধন।।
বাসবেরে আরাধিয়ে পায় ভৃগুরাম।
রাম মোরে অর্পিলেন ধনু অনুপাম।।
দিব্যদিব্য অস্ত্র দিল রাম মহাবীর।
অক্ষয় কবচ যাহে অভেদ্য শরীর।।
অর্জ্জুনেরে মারি বাড়াইব তব যশ।
সাগরান্ত বসুমতী করি দিব বশ।।
পার্থের সারথি নিজে সেই নারায়ণ।
আমা হৈতে অধিক সে এইত কারণ।।
কৃষ্ণের সমান গুণ, সেই সে বিশাল।
আমার সারথি হোক শল্য মহীপাল।।
তবে সে নিমিষে আমি অর্জ্জুনে জিনিব।
অপর পাণ্ডবগণে বান্ধিয়া আনিব।।
মহা মহা রথী আর যত মহারাজে।
মুহূর্ত্তেকে জিনি দিব নিজ ভুজতেজে।।
শল্যেরে সারথি যদি করি দেহ মোরে।
নিষ্পাণ্ডব করি রাজ্য দিব ত তোমারে।।
ইহা শুনি দুর্য্যোধন চলে শীঘ্রগতি।
যথা বসিয়াছে রাজা মদ্র-অধিপতি।।
রাজারে দেখিয়া শল্য জিজ্ঞাসে কারণ।
কহ মহারাজ হেথা কেন আগমন।।
রাজা বলে, নিকটেতে আসিনু তোমার।
ভয়ার্ত্ত জনের তুমি হবে কর্ণধার।।
অবধান কর রাজা, করি নিবেদন।
পার্থ হতে বলাধিক রাধার নন্দন।।
পার্থের সারথি যেই নিজে নারায়ণ।
মহাবুদ্ধি সেই রথে মন্ত্রী বিচক্ষণ।।
যেন কৃষ্ণ তেন তুমি মহা মতিমান।
মহাতেজোবন্ত তুমি, ইথে নাহি আন।।
কর্ণ-রথে মন্ত্রী তুমি হও মহাশয়।
তবে পরাজিবে কর্ণ, কৃষ্ণ-ধনঞ্জয়।।
শল্য রাজা বলে, আমি বিদিত ভুবন।
কি ছার মনুষ্য কর্ণ, কহত রাজন।।
রথেতে সারথি আমি হইব তাহার।
হেন অপমান আর না কর আমার।।
পৃথিবী সহিতে নারে মোর অস্ত্রবল।
প্রতাপে শুষিতে পারি সমুদ্রের জল।।
মোর অপমান নাহি কর দুর্য্যোধন।
আজ্ঞা কর মহারাজ যাই নিকেতন।।
ইহা বলি শল্যরাজ উঠিয়া চলিল।
স্তুতি করি দুর্য্যোধন কহিতে লাগিল।।
আপনা হইতে যার হয় শ্রেষ্ঠ গুণ।
তাহারে সারথি করি সংগ্রামে নিপুণ।।
ত্রিপুর দহিতে যবে যান শূলপাণি।
ব্রহ্মারে সারথি কৈল পরাক্রম জানি।।
জানি তুমি মহাবীর পুরুষ-প্রধান।
মোর দলে বীর নাই তোমার সমান।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ শকুনি সৌবল।
অশ্বত্থামা ভদগত্ত তুমি মহাবল।।
এই সব বীর লয়ে মোর অহঙ্কার।
কৃপায় সারথ্য কর্ম্মে কর অঙ্গীকার।।
তুমি আর কর্ণ বীর দুই অবশেষ।
অর্জ্জুনে মারিতে যত্ন করহ বিশেষ।।