কপোট্রনিক বিভ্ৰান্তি (দুই)
ল্যাবরেটরির করিডোর ধরে কে যেন হেঁটে আসছিল। পায়ের শব্দ শুনে বুঝরে পারলাম ৫টি একটি রবোট-মানুষের পায়ের শব্দ এত ভারী আর এরকম ধাতব হয় না। অবাক হবার কিছু নেই। এই ল্যাবরেটরিতে সব মিলিয়ে দু শর উপর রবোট কাজ করছে। শুধুমাত্র গাণিতিক বিশেষজ্ঞ রবোটই আছে পঞ্চাশটি। এ ছাড়া যান্ত্রিকবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, পরমাণুবিষয়ক বিদ্যা ইত্যাদি তো রয়েছেই। এরা বিভিন্ন প্রয়োজনে অহরহ এখান থেকে সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মানুষের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে লিফট বেয়ে উঠে যাচ্ছে, সিঁড়ি বেয়ে নামছে, দরজা খুলে এ-ঘর থেকে সে-ঘরে কাজ করছে। কাজেই করিডোর ধরে কোনো রবোট যদি হেঁটে আসে, তাতে অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিলাম। এই রবোটটির বিশেষ ধরনের পায়ের শব্দ শুনে। প্রতিটি পদশব্দ হবার আগে একটা হাততালি দেবার মতো শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল প্রতিবারই মেঝেতে পা রাখার আগে রবোটটি একবার করে হাতে তালি দিয়ে নিচ্ছে। আমি ভারি অবাক হলাম।
কিছুতেই যখন এই বিচিত্র পদশব্দের কোনো সমাধান বের করতে পারলাম না, তখন ভীষণ কৌতূহলী হয়ে ঘরের দরজা খুলে করিডোরে এসে দাঁড়ালাম। যে-দৃশ্য আমার চোখে পড়ল তাতে আমার রক্ত শীতল হয়ে গেল। প্রাচীন আমলের একটি অতিকায় গাণিতিক রবোট করিডোর ধরে হেঁটে আসছে। হাঁটার সময় প্রতিবারই যখন তার পা মেঝের ছয় ইঞ্চির কাছাকাছি নেমে আসছিল, তখনই একটি অতিকায় নীলাভ বিদ্যুৎফুলিঙ্গ সশব্দে পা থেকে ছুটে গিয়ে মেঝেতে আঘাত করছিল। এর শব্দটিই আমার কাছে হাততালির শব্দ মনে হচ্ছিল। শুধু পা নয়, রবোটটির হাত দুটি ধাতব শরীরের যেখানেই স্পর্শ করছিল, সেখানেই কড়কড় করে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ ছুটে যাচ্ছিল। রবোটটি এসব বিষয়ে নির্বিকার। আমি আতঙ্কিত হয়ে অনুভব করলাম, এই বিদ্যুৎফুলিঙ্গের জন্যে করিডোরে ওজেনের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
আমার মাথায় দুটি চিন্তা খেলে গেল। প্রথমত, এই রবোটটির কপোট্রনের উচ্চচাপের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী তারটি কোনোভাবে ধাতব শরীরের কোথাও স্পর্শ করে ফেলেছে। ফলে পুরো রবোটটিই বিদ্যুতায়িত হয়ে গেছে। এই বিদ্যুতের চাপের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ ভেন্টের মতো। দ্বিতীয়ত, এই রবোটটিকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে যে-ই স্পর্শ করুক, সে-ই মারা যাবে।
আমি বুঝতে পারলাম কোনো সর্বনাশ ঘটানোর আগে এই রবোটটিকে থামান দরকার-যে-কোনো মূল্যে।
দরজায় দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে ডাকলাম, হেই, হেই রবোট।।
রবোটটি বিদ্যুৎ চমকাতে চমকাতে ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে আমার দরজার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, কি?
আমি ছিটকে ঘরের ভিতরে সরে এলাম। সবসময় এই রবোটটি থেকে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় হাত দূরে থাকা দরকার। বুঝতে পারলাম কোনো-একটা ক্রটি ঘটিয়ে এটির সারা শরীর বিদ্যুতায়িত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কপোট্রনটি ঠিকই আছে। রবোটটি আবার বলল, কি?
আমি ঘরের ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি। বলে রবোটটি দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি টের পাচ্ছ না যে তোমার সারা শরীর ইলেকটিফাইড হয়ে গেছে?
না।
কোথায় যাচ্ছ?
দু, শ এক নাম্বার রুমে।
আমার মনে পড়ল দু শ এক নাম্বার রুমে এক্সরে ডিফ্লেকশান নিয়ে কাজ চলছে। নিরাপত্তার জন্যে সারা ঘর সীসা দিয়ে ঢাকা। সীসা বিদ্যুৎ পরিবাহী, কাজেই রবোটটি সে—ঘরের দরজা স্পর্শ করা মাত্র সমস্ত ঘর, যন্ত্রপাতি বিদ্যুতায়িত হয়ে যাবে। মূল্যবান যাত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবার কথা ছেড়েই দিলাম-বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত তরুণ বিজ্ঞানী কয়জন, টেকনিশিয়ানরা সবাই কিছু বোঝার আগেই মারা পড়বে। আমি নিজের অজান্তে শিউরে উঠলাম। এটিকে যেভাবেই হোক থামাতে হবে।
তোমার সেখানে যাওয়া চলবে না।
আমাকে যেতে হবে। বলে রবোটটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। আমার মনে পড়ল, এই প্রাচীন রবোটটির যুক্তিতর্কের বালাই নেই। একে যে-আদেশ দেয়া হয়, সেটি পালন করে মাত্র। এখন ও নিশ্চিতভাবে দু, শ এক নাম্বার কক্ষে হাজির হবে। আমি আবার চিৎকার করে ডাকলাম, রবোট, হেই রবোট।
রবোটটি থামল। তারপর আবার ঘুরে আমার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি কপালের ঘাম মুছে বললাম, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
বলুন।
কিন্তু আমি কী বলব? এমন কোনো কথা নেই যেটি বলে ওকে নিবৃত্ত করা সম্ভব। একমাত্র জটিল গাণিতিক সমস্যা দিয়েই এটিকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই মুহূর্তে সেরকম সমস্যা আমি কোথায় পাব? আমার মাথায় পদার্থবিদ্যার হাজার হাজার সমস্যা ঝিলিক দিয়ে গেল, কিন্তু তার একটিও একে বলার মতো নয়। এটির যুক্তিতৰ্ক নেই—নীরস একঘেয়ে হিসেবই শুধু করতে পারে। বড় গুণ-ভাগ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটি তো মুহূর্তে সমাধান করে ফেলবে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। রবোটটি আবার আমাকে তাগাদা দিল, বলুন।
তারপর সে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল। আমার কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই আমি চিৎকার করে ওকে থামতে বললাম, থাম। দাঁড়াও।
রবোটটি দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, বলুন কী বলবেন।
কিন্তু আমি কী বলব? এই করিডোর দিয়ে কদাচিৎ কেউ যাতায়াত করে। আমি যে অন্য কারো সাহায্য পাব, তারও ভরসা নেই। হাত বাড়ালেই অবশ্যি ফোন স্পর্শ করতে পারি। ফোন করে আমি ওদেরকে সতর্ক করেও দিতে পারি। আমাকে ফোনের দিকে হাত বাড়াতে দেখলেই রবোটটি ঘুরে তার যাত্রাপথে রওনা দেবে। দু শ এক নাম্বার কক্ষে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার আগেই রবোটটি সেখানে পৌঁছে যাবে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, এই যুক্তিতর্কহীন নির্বোধ রবোটটিকে কেউ থামাতে পারবে না। এ ছাড়াও আমার দ্বিতীয় বিপদটির কথা মনে হল। রবোটটি নিশ্চিতভাবে লিফট ব্যবহার করবে। বিদ্যুৎপরিবাহী হালকা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরী লিফটে পা দেয়ার সাথে সাথে পুরো লিফটু বিদ্যুতায়িত হয়ে যাবে। সাথে সাথে লিফটের সব কয়জন যাত্রী মারা যাবে। আমি অনুভব করলাম, আমার গলা শুকিয়ে এসেছে।
কী বলবেন। রবোটটি আবার তাগাদা দিল।
আমি শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিলাম। বললাম, দু, শ এক নাম্বার রুমে যাবার আগে আমার একটি অঙ্ক করে দাও।
বেশ, কী অঙ্ক?
এখন ওকে কী অঙ্ক করতে দিই? বললাম, একটু অপেক্ষা কর। ভেবে ঠিক করে নিই।
বেশ।
আমি ভাবতে লাগলাম। এমন কোনো সমস্যা নেই, যা ওকে অনির্দিষ্ট সময় আটকে রাখতে পারে? কিছুদিন আগে ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে বুলার বুদ্ধিতে একটি রবোটকে বিভ্ৰান্ত করে দিয়েছিলাম। সেটি কাজে লাগবে কি? সে-রবোটটির তৃতীয় শ্রেণীর যুক্তিতর্ক ছিল বলেই বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। এর তো স্থা রকম যুক্তিতর্ক নেই। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী? বললাম, আমি মিথ্যা কথা বলছি।
বলুন। আমাকে আশাহত করে এই গবেট রবোটটি ভঙ্গিতে আমার বক্তব্যের পুরো হেঁয়ালিটুকু এড়িয়ে গেল। আমি অসহায়ভাবে ঢোঁক। এখন কী করি?
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটি চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল। যদিও এতক্ষণেও কোনো কিছু করতে না পেরে আমি মোটামুটি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, তবুও মনের গোপনে একটি আশা ছিল যে আমার মস্তিষ্ক আমাকে প্রতারণা করবে না নিশ্চয়ই। শেষ মুহূর্তে একটা সমাধান বের করে দেবে। সমাধানটি অতি সরল। রবোটটিকে একটি মজার অঙ্ক করতে দিতে হবে। অন্ধটি এত সাধারণ যে, এতক্ষণ মনে হয় নি দেখে আমি বিক্ষিত হলাম।
আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেছে। মন হালকা হয়ে গেছে। হাসিমুখে ঠাট্টা করে বললাম, তোমাকে যে—অঙ্কটি করতে দেব, সেটি ভীষণ জটিল।
বেশ তো।
নিখুঁত উত্তর চাই।
বেশি।
অন্ধটি সাধারণ রাশিমালার। যতদূর সম্ভব নিখুঁত উত্তর বলবে।
দশমিকের পর কয় ঘর পর্যন্ত?
যতদূর পার।
অঙ্কটি কি?
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম, বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করলে কত হয়?
রবোটটি এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল। তারপর বলল, তিন দশমিক এক চার দুই আট পাঁচ সাত…
তারপর?
এক চার দুই আট পাঁচ সাত…এক চার…
বলে যাও।
দুই আট পাঁচ সাত এক চার দুই আট…
রবোটটি একটানা বলে যেতে লাগল। আমি মিনিট দুয়েক শুনে নিশ্চিত হলাম যে এটি হঠাৎ থেমে পড়বে না। তারপর ফোন তুলে অফিসের কর্মকর্তকে বললাম, বিদ্যুৎ অপরিবাহী পোশাক-পরা এক জন টেকনিশিয়ান পাঠাতে। রবোটটির পারমাণবিক ব্যাটারি খুলে বিকল করতে হবে। ভদ্রলোক এখুনি পাঠাচ্ছেন বলে ফোন রাখতে গিয়ে বললেন, আপনার ঘরে নামতা পড়ছে কে?
নামতা নয়। আমি হাসলাম, রবোটটি বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করছে।
রবোটটি তখনও বলে চলছে, পাঁচ সাত এক চার দুই আট…
আমি ফোন নামিয়ে রেখে ভাবলাম, ভাগ্যিস বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করলে ভাগ কোনো দিনই শেষ হয় না। ভাগফলে ঘুরে ঘুরে একই সংখ্যা আসতে থাকে। না হলে যে কী উপায় হত।