ঐ ঘটনারই পরের দিন সজল আবার হঠাৎ এলো বিকেলের দিকে মিত্রানীদের ওখানে। শেষের ক্লাস দুটো মিত্ৰানীকে নিতে হয়নি বলে একটু আগেই কলেজ থেকে চলে এসেছিল ও। গতকালের ঘটনার পর থেকেই মনটা তার ভাল ছিল না, টেলিফোনে সুহাসের কথাগুলোই যেন কেবল তার মনে পড়ছিল। মুখে কোনদিন কথাটা সে প্রকাশ না করলেও –সুহাস কেন বুঝতে পারলো না মনটা তার এত বছর ধরে কোথায় বাঁধা পড়েছে।
নিজের ঘরে ক্যামবিশের আরাম-কেদারাটার উপরে গা ঢেলে দিয়ে চোখ বুজে পড়ে ছিল মিত্রানী-সজলের জুতোর শব্দটা পর্যন্ত তার কানে প্রবেশ করেনি সজলের কণ্ঠস্বরে
সে চোখ মেলে তাকাল।
মিত্রানী!
কে? ও সজল, এসো,–মিত্রানী উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। কিন্তু সজল তাকে বাধা দিয়ে বললে, আর ব্যস্ত হতে হবে না তোমাকে, বসো বসো-বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সজল ওর মুখোমুখি বসে পড়ল।
মিত্রানী ভেবেছিল সেদিনকার তার ঐ স্পষ্ট কথার পর সজল বোধ হয় জীবনে আর তার সামনে এসে দাঁড়াবে না। কথাটা ভেবে তার একটু কষ্টও হয়েছিল, এখন সজলকে আসতে দেখে সে যেন একটু খুশিই হয়। শুধু তাই নয়, ঐ মুহূর্তে সজলের চোখমুখের ভাব দেখে মিত্রানীর মনেও হলো না, তার সেদিনকার সেই কথায় সজল এতটুকু অসন্তুষ্ট হয়েছে বা সে কথাগুলো তার মনে আছে!
কখন ফিরলে কলেজ থেকে? সজল শুধালো।
এই কিছুক্ষণ আগে–মিত্রানী বললে।
তোমাকে যেন একটু কেমন ক্লান্ত মনে হচ্ছে, মিত্রানী!
মিত্রানী মৃদু হেসে বলল, না। সে সব কিছু নয়—আচ্ছা সজল—
বল?
সুহাসের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল বুঝি?
শুধু সুহাস কেন, সকলের সঙ্গেই তো দেখা করেছি—কেন বল তো, হঠাৎ সুহাসের কথা কেন?
না, এমনি—
তা কই, আজ যে চায়ের কথা বললে না?
চা খাবে?
খাবো না মানে—এনি টাইম ইজ টি-টাইম।
বোসো—আমি আসছি–
মিত্রানী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সজল বসে বসে একা একা মিত্রানীর টেবিলের উপর রাখা বই ও খাতাপত্রগুলো ঘাঁটতে লাগল। একটু পরেই মিত্রানী ঘরে ফিরে এলো।
জানো মিত্রানী, একটা প্ল্যান করেছি,—সজল বললে।
প্ল্যান!
হ্যাঁ, কে কবে কোথায় কখন থাকি—বিশেষ করে আমি তো আজ এখানে কাল সেখানে, তাই ঠিক করেছি একদিন সকলে মিলে সারাটা দিন কোথাও হৈ-চৈ করা যাবে।
বেশ তো। মন্দ কি—নট এ ব্যাড আইডিয়া!
পরশু শনিবার কি যেন একটা ছুটি আছে—তাই বিদ্যুৎকে আজ সকালেই বলেছি—আমরা সকলে শনিবারের দিনটা বটানিকস-এ গিয়ে হৈ-চৈ করে কাটাবো! কেন, বিদ্যুৎ তোমাকে ফোনে কথাটা বলেনি? সে তো বলেছিল, সে-ই তোমাকে ফোনে আমাদের প্ল্যানটা জানিয়ে দেবে—
না, এখনো বলেনি। হয়ত আজ সন্ধ্যেবেলা বলবে। তা সবাইকে কথাটা জানানো হয়েছে?
বিদ্যুৎ সকলকে জানাবার ভার নিয়েছে—তার গাড়ি আছে, ফোনও আছে, তার পক্ষেই সুবিধা।
প্রৌঢ়া গোপালের মা, মিত্রানীদের বাড়ির দাসী ঐ সময় ট্রেতে করে দুকাপ চা ও একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।
মিত্রানী একটু নীচু টুল এনে সামনে রেখে বলল, এটার উপরে রাখ গোপালের মা!
গোপালের মা ট্রে-টা নামিয়ে রেখে চলে গেল।
সজল বললে, এ কি, এক প্লেট খাবার কেন—তুমি কিছু খাবে না মিত্রানী?
না। এ সময় আমি এক কাপ চা ছাড়া কিছু খাই না।
রাত্রি প্রায় আটটা পর্যন্ত মিত্রানীর সঙ্গে সজল এটা-ওটা নানা গল্প করে এক সময়। মিত্রানীকে গান গাইবার জন্য অনুরোধ করল।
মিত্ৰানী প্রথমটায় গান গাইতে চায়নি কিন্তু সজলের পীড়াপীড়িতে গাইতেই হলো। সজল বললে, সেই গানটা গাও মিত্রানী!
কোন্ গানটা?
সেই যে অতুলপ্রসাদের সেই গানটা—
অতুলপ্রসাদের তো অনেক গান আছে, কোন্টা শুনতে চাও তাই বলো না।
সেই যে একা মোর গানের তরী—
মিত্রানী গেয়ে শোনায় গানটা। তারপর এক সময় সজল বিদায় নেয় মিত্রানীর কাছ থেকে। সজলকে দুদিন আগে স্পষ্ট করে তার প্রস্তাবে না বলার পর থেকেই মিত্রানীর মনের মধ্যে স্বভাবতই যে সংকোচটা দেখা দিয়েছিল তার যেন বিন্দুমাত্রও আর অবশিষ্ট থাকে না। যাক্, শেষ পর্যন্ত তাহলে সজল ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয়নি। মনটা মিত্রানীর হালকা হয়ে যায়।
বিদ্যুৎ মিত্রানীকে ফোন করেছিল পরের দিন সকালে।
সজল কলকাতায় এসেছে কয়েক দিনের ছুটিতে তুমি তো জান মিত্রানী—বলেছিল বিদ্যুৎ।
জানি, মিত্রানী বললে।
সে বলেছিল, কাল শনিবার আমরা পুরানো দিনের বন্ধুরা একটা দিন বটানিস্-এ হৈ-চৈ করে কাটাববা—
হ্যাঁ, সে কাল আমার এখানে এসেছিল—বলছিল তোমাকে নাকি কথাটা বলেছে—তুমি সকলকে জানাবে।
জানিয়েছি। সবাই রাজী। সুহাস কি বললো?
সেও রাজী বৈকি। তাহলে তুমি আসছো তো মিত্রানী?
হ্যাঁ—যাবো। তা খাওয়াদাওয়ার কি হবে?
সে ব্যবস্থা আমিই করবো বলেছি সকলকে। তা কি মেনু করা যায় বল তো? কাজল বলছিল—
কি বলছিল?
একে এই বৈশাখের প্রচণ্ড গরম—কোন কিছু হেভী নয়–লাইট রিফ্রেশমেন্ট-এর মত কিছু–
তা সত্যি–সময়টা আউটিং-এর পক্ষে আদৌ ভাল নয়—যা প্রচণ্ড গরম চলছে—
তা অবিশ্যি ঠিক। তবে আজ কদিন থেকে প্রত্যেক দিনই তো সন্ধ্যায় কালবৈশাখী হচ্ছে—মেঘ করে কয়েক ফোটা বৃষ্টি পড়ছে—সন্ধ্যার দিকটা বেশ ঠাণ্ডাই মনে হয়।
আচ্ছা বিদ্যুৎ, কোল্ড ড্রিং-এর কিছু বন্দোবস্ত করলে হয় না?
বিদ্যুৎ বললে, সে ব্যবস্থা আমি করেছি–একটা আইস-বক্স নেবো—তার মধ্যে কোল্ড ড্রিংক্স থাকবে। আর থাকবে—কি বল তো?
বরফ।
না—আইসক্রীম—
ওঃ, হাউ লাভলি! তবে একটু বেশি করে নিও কিন্তু–
নেবো।
হ্যাঁ বাবা, আমার দুটো-একটায় হবে না। যত খুশি যেন পাই–
এসময়ে আউটিং-এর ব্যবস্থা হলেও সজলের পরিকল্পনাটা কিন্তু সকলেই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। বহুদিন সকলে একত্রে মিলে আড্ডা দেয়নি।
কলেজ-জীবনের সেই আনন্দময় দিনগুলো যেন হারিয়েই গিয়েছিল প্রত্যেকের জীবন থেকে।
কথা ছিল যে যার মত বটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে পৌঁছবে এবং সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের তলে গিয়ে একত্রে মিলিত হয়ে জায়গা একটা বেছে নেওয়া হবে। তবে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই সকলকে পৌঁছতে হবে।
মিত্রানীর পৌঁছতেই মিনিট পনেরো দেরি হয়ে গিয়েছিল। মিত্রানীকে দেখে সকলে হৈ হৈ করে উঠলো। মিত্রানী সকলের দিকে তাকাল।
সবাই এসেছে বিদ্যুৎ, ক্ষিতীশ, অমিয়, মণি, সতীন্দ্র, সুহাস, পাপিয়া, কাজল—কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে মিত্রানী বললে, ব্যাপার কি, বিদ্যুৎ-আমাদের আজকের আউটিং-এর পরিকল্পনাকারী সজলকে দেখছি না যে—সজল আসেনি?
বিদ্যুৎ বললে, ভেরী স্যাড!
স্যাড! কি ব্যাপার? সজলের কিছু হয়েছে নাকি?
না—
তবে?
হঠাৎ একটা জরুরী ট্রাংক কল পেয়ে তাকে তার কর্মস্থলে আজকেই সকালের প্লেনে চলে যেতে হচ্ছে।
এতক্ষণে হয়ত এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে—বলছিল সকাল সাড়ে দশটায় বাগডোগরার প্লেন। বিদ্যুৎ বললে।
বেচারী—তারই উৎসাহে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হলো—অথচ সে-ই আসতে পারল না!
হ্যাঁ, খুব ভোরে আজ আমার ওখানে এসেছিল সজল, বললে, আমাকে হঠাৎ চলে যেতে হচ্ছে ভাই। জনই তো, পরের চাকরি—রেসপনসিবল পোস্টে আছি—সকালের প্লেনেই ফিরে যেতে হচ্ছে। তাতে আমি বলেছিলাম, প্রোগ্রামটা তাহলে ক্যানসেল করে দিই। সজল বললে, না, তা করো না–নাই বা থাকলাম আমি তোমাদের মধ্যে—তোমরা সকলে এনজয় করবেটার লাক নেক্সট টাইম! তাই আর কাউকে কথাটা জানাইনি—তা ছাড়া সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গিয়েছে।
বেচারী সজল!