এ রকম অসম্ভব ঘটনাও ঘটে।
অয়ু সমগ্র ব্যাপারটি চোখের সামনে ঘটতে দেখল। প্ৰকাণ্ড বড় জিনিস থেকে ছোট্ট জিনিসটি নেমে এল মাটিতে। তার মধ্যে দুটি কী যেন বসে আছে। তারা কে? দু জনের কম্পনাঙ্ক রকম। এক জনের মধ্যে আরে এ কি! অয়ুর মনে হল একজনের সমস্ত চিন্তাভাবনা সে বুঝতে পারছে।
এতে অবাক হবার কিছু নেই, অয়ু লী বা নীম দুজনের মনের কথাই বুঝতে পারে। কিন্তু যে জিনিসটির কথা সে বুঝতে পারছে, সে জিনিসটি অয়ু বা লীর মতো নয়। ওর একটি নাম আছে, জনি, কুলম্যান–অদ্ভুত নাম। জনি কুলম্যান অসম্ভব ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে কেন? ছোট্ট ঘর থেকে ভয়ে ভয়ে নামছে। তার সঙ্গে যে আছে, তার মনের কথা অয়ু কিছুই বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, ঐটির মধ্যে আবার অসংখ্য তরঙ্গ। তরঙ্গগুলির দৈর্ঘ্য একেকটি একেক রকম। ওর নাম কি অয়ু বুঝতে পারছে না। তবে বুঝতে পারছে, তার সঙ্গে আকাশের মহাকাশযানটির সম্পর্ক আছে। অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে সম্পর্কটি রাখা হচ্ছে সর্বক্ষণ। অন্য লোকটি, যার নাম জনি কুলম্যান, সেও মাঝে মাঝে মহাকাশযানটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। তবে তা রাখা হচ্ছে অনেক বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তরঙ্গ দিয়ে। অর্থাৎ সে কথা বলছে। কথা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। তবে অয়ু যদি বেশ কিছু সময় এই সমস্যাটি নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে বুঝতে পারবে। ইস, লী আর নীম যদি থাকত, তাহলে নিমিষের মধ্যে সমস্যাটির সমাধান হত।
অয়ু মন দিল জনি কুলম্যানের দিকে–এত ভয় পাচ্ছে কেন? কী যেন বলল অন্যটিকে। হাঁটছে সামনের দিকে। হাতে এটি কী? অয়ু ভাবতে লাগল। পরিষ্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কেমন যেন অস্পষ্ট। অয়ু তার খগুলি ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল। যে খ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বুঝতে পারে, সেটিকে বিভিন্ন তরঙ্গমাত্রায় দোলাতে শুরু করল। হ্যাঁ, এইবার বুঝতে পারা যাচ্ছে। জনি কুলম্যান এক জন ভূতত্ত্ববিদ। মাটি সম্পর্কে জানে। মাটি কী? জনি কুলম্যান পাথরগুলি সম্পর্কে ভাবছে। পাথরগুলি সিলিকা ও এলুমিনিয়ামের, তার মধ্যে আছে অক্সাইড। সিলিকা কী, এলুমিনিয়াম কি, আবার কপার অক্সাইডই-বা কী? কপার অক্সাইড দেখে জনি কুলম্যান অবাক। কারণ এখানে অক্সিজেন নেই। অক্সিজেন না থাকলে কপার অক্সাইড থাকবে না কেন? এই দুটির মধ্যে সম্পর্ক কী? আহ, এই জনি কুলম্যান কত সুখী! কত রকম সমস্যা আছে তার মাথায়। নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে ভাবছে। তাদের মতো না, একই সমস্যা নিয়ে তাদের মতো ভাবতে হয় না। আচ্ছা, ঐ জনি কুলম্যান কি বলতে পারবে আকাশের বাইরে কী আছে? নিশ্চয়ই পারবে, কারণ তারা এসেছে আকাশের বাইরে থেকে।
অয়ু হঠাৎ পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে এল। তার প্রকাণ্ড শরীরটিকে অতি দ্রুত নিয়ে এল জনিকুলম্যানের সামনে। তারপর স্থির হয়ে দাঁড়াল সেখানে।
জনি কুলম্যান, আমাদের তিন বন্ধুর তরফ থেকে তোমাকে জানাচ্ছি। অভিনন্দন।
জনি প্রথম খানিকক্ষণ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। এসব কি সত্যি, না স্বপ্ন! জনির মাথা ঝিমঝিম করছে। বুক-মুখ শুকিয়ে কাঠ। সিডিসির গলা শোনা গেল,
জনি, ভয় পেও না, আমার হাতে আণবিক ব্লাস্টার আছে। ব্লাস্টার চালু করেছি।
সিডিসি, ওটি কী?
একটি প্রাণী নিঃসন্দেহে। প্রাণীটি লক্ষ করছে আমাদের। তুমি নড়াচড়া করবে না, যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানে দাড়িয়ে থাক।
সিডিসি, অপেক্ষা করছ কেন? আণবিক ব্লাস্টারের সুইচ টিপে দাও।
তুমি নার্ভাস হবে না। তোমার দিকে এগোলেই আমি ব্যবস্থা করব। আমি প্রাণীটির ছবি তুলব প্রথম। মহাকাশযান থেকে আরেকটি টিম আসছে। ওরা প্রাণীটিকে ধরার চেষ্টা করবে।
জনি খানিকটা সম্বিত ফিরে পেল। খুব সাবধানে–যাতে প্রাণীটির দৃষ্টি আকর্ষিত না হয়–যোগাযোগ-সুইচ টিপল। ক্যাপ্টেনের গলা ভেসে এল সঙ্গে সঙ্গে।
হ্যালো জনি, আমরা সব কিছু লক্ষ করছি। জীববিজ্ঞানীদের টিম নেমে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
কি করব আমি, মেরে ফেলব প্রাণীটিকে?
কী বলছ পাগলের মতো, জীবন্ত ধরতে হবে প্রাণীটিকে। এ রকম অদ্ভুত প্রাণী এর আগে কখনো পাওয়া যায় নি। জীববিজ্ঞানীরা খুবই অবাক।
জনি কুলম্যান দেখল, প্রাণীটি আরো খানিকটা এগিয়ে এসেছে। তার মনে হল, প্রাণীটি বলছে—আমাকে ভয় করার কিছুই নেই।
রোবট সিডিসি এক হাতে আণবিক রাস্টার ধরে রেখেই অন্য হাতে বেশ কয়েকটি কাজ করল। প্রাণীদের ছবি মহাকাশযানে রিলে করার ব্যবস্থা করল। একটি সার্ভেয়ার সিস্টেম চালু করল, যাতে অন্য যে কোনো দিক থেকে এই জাতীয় কোনো প্রাণী পাঁচ শ গজের ভেতরে এলে আগে থেকেই টের পাওয়া যায়। দ্বিতীয় স্কাউটশিপটি কোথায় নামবে, তাও তাকেই বের করতে হচ্ছে। সবচে ভালো হতো যদি প্রাণীটির পেছনে নামতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। জায়গাটি প্রকাণ্ড সব পাথরে ভর্তি। নামতে হবে প্রথম স্কাউটশিপটির কাছেই র্ব্যাপারটি বিপজ্জনক। প্রাণীটি দ্বিতীয় স্কাউটশিপ দেখে ভয় পেয়ে জনিকে আক্রমণ করে বসতে পারে।
আক্রমণের ধারা কী হবে কে জানে। জন্তুটি মনে হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক। স্বভাবতই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এতটা দূর থেকে তা সম্ভব হবে না। তাকে আরো কাছে এগিয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে। হাতে। আক্রমণের অন্য ধারায় এ হয়ত দূর থেকেই বিষ জাতীয় কিছু ছুড়ে ফেলবে। তা হলে ভয়ের কিছু নেই, জনির স্পেস-স্যুট আছে।
দ্বিতীয় স্কাউটশিপে ছিল টাইটেনিয়াম ইরিডিয়ামের তৈরি একটি প্রকাণ্ড খচা। খাচাটি আনা হচ্ছে প্রাণীটাকে বন্দি করার জন্যে। ডঃ জন ফেন্ডার (প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রধান) এবং মহাকাশযানের সিকিউরিটি বিভাগের এক জন অফিসার খাচাটাকে নিয়ে আসছে।
ডঃ জন ফেল্ডারের মুখ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ, এই অদ্ভুত প্রাণীটির এখানে থাকার কথা নয়। তবু সে আছে। তার মানে সে একা নয়, আরো অনেকেই নিশ্চয় আছে। কিন্তু এরা খায় কি? এই ঊষর গ্রহে এদের জন্যে কোনো খাদ্য থাকার কথা নয়।
ডঃ জন ফেভার অন্য আরেকটি কারণেও যথেষ্ট ব্ৰিত। তার মনে হচ্ছে প্রাণীটি বুদ্ধিমান। এ রকম মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রথমত, এই অবস্থাতে যে কোনো প্রাণীই পালিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করত, এটি তা করছে না, নিজ থেকে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আক্রমণ করছে না, বরং দূরে দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহের সঙ্গে সব কিছু লক্ষ করছে। ডঃ ফেভার লক্ষ করেছে, প্রাণীটির সমস্ত মনোযোগ জনির দিকে। মাঝে মাঝে সে অবশ্যি তাকাচ্ছে রোবটটির দিকে। তাও খুব অল্প সময়ের জন্যে। তাহলে সে কি বুঝতে পারছে, রোবটটি একটি যান্ত্ৰিক মানুষ।
ডঃ জন ফেভারের উদ্বেগ আরো বাড়ল, যখন সেন্ট্রাল কম্পিউটার থেকে হঠাৎ বলা হল–প্রাণীটির গা থেকে বিটা রেডিয়েশন হচ্ছে। জন ফেন্ডার অবাক হয়ে বলল, তা কী করে হচ্ছে।
কী করে হচ্ছে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, তবে হচ্ছে।
আরো কিছু আছে?
আছে, তবে তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা ঠিক হবে না।
ঠিক না হলেও বলে ফেল।
প্রাণীটির শরীরে একটি চৌম্বক শক্তি থাকার সম্ভাবনা আছে।
নিশ্চতভাবে কখন জানা যাবে?
যখন প্রাণীটি এগিয়ে আসবে।
জন ফেন্ডার শুকনো মুখে বলল, চৌম্বক শক্তিটি কি শক্তিশালী?
যথেষ্ট শক্তিশালী।
জন ফেডার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমার কি মনে হয় প্রাণীটি বুদ্ধিমান?
সিডিসি সঙ্গে সঙ্গে বলল, প্রাণীটি বুদ্ধিমান হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। তবে যেসব তথ্য আমার কাছে আছে, তা থেকে এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না।
মহাকাশযান সময় ১৫/৩৫ মিনিটে দ্বিতীয় স্কাউটশিপটি নামল। জন্তুটি লফিয়ে উঠল না, বা ভয় পেয়ে পালিয়েও গেল না। স্কাউটশিপ থেকে পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে জন ফেভারের মনে হল–প্রাণীটির নাম অয়ু, প্রাণীটির আরো দুটি বন্ধু আছে। একজনের নাম লী, অন্যজনের নাম নীম। এরা তিন জন ছাড়া এই গ্রহে অন্য কোনো প্রাণী নেই।
এই রকম মনে হওয়ার পেছনে কোনো কারণ নেই। তবু জন ফেডারের মনে হল, এ সব তথ্যের প্রতিটিই সত্য। জন ফেভার কাঁপা গলায় বলল, হ্যালো জনি, ঐ জটির নাম অয়ু নাকি?
হ্যাঁ, ওর নাম অয়ু।
জন ফেভার গম্ভীর হয়ে বলল, কী করে জানলে ওর নাম অয়ু? কথা বলেছ নাকি ওর সঙ্গে?
না, কথা বলি নি।
কথা না বলেই বুঝতে পারলে?
জনি থেমে থেমে বলল, তা পারলাম এবং আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পেরেছ।
জন ফেভার গম্ভীর হয়ে বলল, ব্যাপার কি জানি।
ব্যাপার তো তোমারই জানার কথা। তুমি জীববিজ্ঞানের লোক।
তা ঠিক। তা ঠিক।
জন ফেন্ডারম্যান স্কাউটশিপ থেকে অনেকখানি এগিয়ে গেল প্ৰাণীটির দিকে, তারপর স্পষ্ট স্বরে বলল,
হ্যালো আয়ু।