একটা বিশাল জেনারেটরের বড় বড় নাট এবং বল্টগুলো আমরা সবাই মিলে খুলছিলাম। কেন খুলছি আমরা জানি না। আমাদেরকে খুলতে বলেছে তাই খুলছি। আবার যখন লাগাতে বলবে তখন লাগাব। জেনারেটরের ভেতরে কী হয়, কেমন করে কাজ করে সেগুলো জানে মাহা। মাহা আমাদের থেকে মাত্র দুই বছরের বড়, মাথার মাঝে ক্রেনিয়াল লাগানোর পর সে কয়েকদিনের মাঝে জেনারেটর ঠিক করা শিখে গেছে। সে একটা নষ্ট জেনারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে তার মিটারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর এখানে সেখানে ঠোকা দেয়। কিছু একটা শোনে তারপর আমাদের হাতে বড় বড় রেঞ্জ দিয়ে নাটবল্টগুলো দেখিয়ে সে আমাদেরকে বলে, “এগুলো খোলো।” আমরা সেগুলো খুলি, তখন সে জেনারেটরের ভেতর ঢুকে যায়। নানারকম তার ধরে টানাটানি করে, তারপর আমাদের বড় বড় মোটা মোটা তার ধরিয়ে দিয়ে একটা ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে বলে, “ওয়েল্ড করো।” আমরা বড় বড় আর্ক জ্বালিয়ে ওয়েল্ড করি। তারপর মাহা আবার জেনারেটরের ভেতরে ঢুকে কুটুর কুটুর করে কাজ করে, তারপর কালিঝুলি মেখে বের হয়ে আমাদের নাটবল্টগুলো দিয়ে বলে “এগুলো লাগাও।” আমরা সেগুলো লাগাই। লাগানো শেষ হলে মাহা ঘুরে ঘুরে দেখে, তারপর আমাদেরকে বলে, “দূরে সরে যাও।” আমরা দূরে সরে যাই। তখন মাহা বড় বড় সুইচ গায়ের জোরে টেনে ধরে, তখন কড়াত কড়াত শব্দ করে স্পার্ক হয়, কালো ধোঁয়া বের হয় তারপর হঠাৎ করে ঘর ঘর শব্দ করে বিশাল জেনারেটর চালু হয়ে যায়। জেনারেটর ঘরের বড় বড় আলোগুলো জ্বলে ওঠে। আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠি, শুধু মাহা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে হাসে না, কথা বলে না, গম্ভীর মুখে জেনারেটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমাদের দিকে না তাকিয়ে সে হেঁটে হেঁটে চলে যায়। আমরা পেছন থেকে দেখি তার মাথায় একটা গর্ত, সেই গর্তে একটা ধাতব সিলিন্ডার। এটা হচ্ছে ক্রেনিয়াল, এই ক্রেনিয়াল দিয়ে তার মাথার মাঝে জেনারেটরের সব কিছু ঢোকানো হয়েছে। আমাদের বন্ধু মাহা এখন বড় ইঞ্জিনিয়ার। সে এখন আমাদের সাথে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না। আগে সে সারাক্ষণ গুনগুন করে গান গাইত, এখন গান তো অনেক দূরের কথা সে কখনো কথাই বলে না। আমি বুঝতে পারি না একজন ক্রেনিয়াল লাগিয়ে অনেক কিছু শিখে গেলে কেন সে আর তার পুরোনো বন্ধুদের সাথে কথা বলতে পারে না?
জেনারেটরের বড় বড় নাটবল্টগুলো খুলতে খুলতে দুপুর হয়ে গেল। আমরা তখন কাজ বন্ধ করে বাইরে এসে দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আমাদের খাবারের প্যাকেট বের করে খেতে থাকি। শুকনো রুটি, শুকনো কৃত্রিম প্রোটিনের টুকরা আর বোতলে করে ঝাঝালো পানীয়। বিস্বাদ খাবার, কটু পানীয় কিন্তু সেগুলোই আমরা শখ করে খাই। খাবারগুলো অনেক হিসাব করে তৈরি করা হয়, এগুলো খেলে শরীরের যা যা দরকার সব পেয়ে যায়। অসুখ হয় না, মাংসপেশি গড়ে ওঠে, হাড় শক্ত হয়। তাই আমরা সেই বিস্বাদ খাবার হইচই করে খাই, খেতে খেতে গল্প করি।
শুধু টিশা আমদের গল্পে যোগ দেয় না। সে তার ছোট ভিডি রিডার হাতে নিয়ে একটার পর একটা বই পড়ে যায়। সে কী বই পড়ে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভেবেছিলাম প্রাচীন রোমান্টিক কাব্য আসলে তা নয়, সে কঠিন কঠিন বই পড়ে। মানুষের মস্তিষ্কে কী থাকে, বীজ থেকে গাছ কেমন করে জন্মায়, অণুপরমাণুর গঠন কী রকম, আকাশ থেকে বিদ্যুৎ কেমন করে হয় এই সব নিয়ে বই। তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর আগেই সবকিছু শিখে ফেলতে চায়।
টিশা কারো সাথে খুব বেশি কথা বলে না, কমিউনের সেই সভায় কমান্ড্যান্টের সাথে তার সেই কথোপকথনের পর অন্যেরাও তার সাথে কথা বলার সাহস পায় না। কে জানে কখন কে কী বিপদে পড়বে, কাকে আবার ডিটিউন করে দেবে!
দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে খেতে খেতে আমি দেখতে পেলাম টিশা ধসে পড়া একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে তার ভিডি রিডারে বই পড়ছে। পাশে তার ভোলা খাবারের প্যাকেট, সেখান থেকে একটা রুটির টুকরো বের করে আধখানা খেয়ে মনে হয় খেতেই ভুলে গেছে।
আমি দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে নেমে টিশার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার পায়ের শব্দ শুনে টিশা মুখ তুলে তাকাল। যদিও সে বুঝতে দিতে চায় না তারপরেও আমি বুঝতে পারলাম আমাকে দেখে তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের ছায়া পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী পড় টিশা?”
“সময় পরিভ্রমণের উপর একটা বই।”
“সময় পরিভ্রমণ? সেটা আবার কী?”
“এই মনে করো ভবিষ্যতে না হলে অতীতে চলে যাওয়া।”
আমি হেসে বললাম, “যাও! সেটা কি আবার সম্ভব নাকি?”
টিশা মুখ গম্ভীর করে বলল, “বিজ্ঞানীরা মনে করেন সম্ভব।”
আমি টিশার পাশে বসে বললাম, “ঠিক আছে সম্ভব হলে সম্ভব। তাতে তোমার আমার কী? তুমি কি ভবিষ্যতে যেতে পারবে? অতীতে যেতে পারবে?”
“যেতে না পারলে নাই, কিন্তু জানতে তো ক্ষতি নেই।”
“তার জন্য এত তাড়াহুড়ার কী আছে? ক্রেনিয়াল লাগালে একদিনে সব জেনে যাবে। এত কষ্ট করে ভিডি রিডারে বই পড়তে হবে কেন?”
টিশা হাসল, বলল, “বই পড়তে আমার কষ্ট হয় না। আমি দিনরাত বই পড়তে পারব।”
আমি বললাম, “তুমি পাগল।”
টিশা হাসল, বলল, “মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। মনে হয় আমি আসলেই পাগল।”
টিশা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দূরে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় যদি আমাদের পড়তে না শেখাত তাহলে কী হতো?”
আমি তার কথা বুঝতে পারলাম না। বললাম, “কেন? পড়তে শেখাবে না কেন?”
“হতেও তো পারত! সবাই মিলে ঠিক করত কাউকে পড়াতে শেখানোর দরকার নেই। যখন যোলো বছর বয়স হবে তখন মাথার মাঝে ক্রেনিয়াল বসিয়ে সেখান দিয়ে পড়তে শেখাবে!”
আমি বিষয়টা এভাবে চিন্তা করিনি। টিশা ঠিকই বলেছে আমাদেরকে ছোট থাকতে পড়তে শিখিয়েছে। না শেখালেও ক্ষতি ছিল না। পড়তে শিখে আমাদের অবশ্যি খুব বেশি লাভ হয়নি, ক্ষতিও হয়নি। টিশার অনেক লাভ হয়েছে, সে দিনরাত বই পড়তে পারে। কে জানে এটা হয়তো লাভ না, এটা হয়তো ক্ষতি। পড়তে পড়তে টিশা অন্যরকম হয়ে গেছে, এখন সে অন্যভাবে চিন্তা করে। সে জন্য টিশা কোনদিন কোন বিপদে পড়বে কে জানে!
আমি টিশার পাশে বসে রইলাম, টিশাও চুপচাপ বসে রইল। আমি বললাম, “তুমি খাচ্ছ না কেন? খাও।”
টিশা বলল, “হ্যাঁ খাব।” কিন্তু টিশা খেল না, বসেই রইল।
বিকেল বেলা যখন আমাদের কাজ শেষ হলো তখন আমরা সবাই দল বেঁধে পুরোনো জেনারেটরের বিল্ডিং থেকে বের হয়ে এলাম। সবাই গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু টিশা একা একা হাঁটছে। আমি টিশার কাছে গিয়ে বললাম, “টিশা! বিকেল বেলা তুমি কী করবে?”
“কী করব? কিছু না।”
“চলো তাহলে প্রাচীরে যাই।” আমি জানি কংক্রিটের স্থূপ দিয়ে ঘেরাও করে তৈরি করা প্রাচীরে উঠে দূরে তাকিয়ে থাকতে টিশা খুব পছন্দ করে।
টিশার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “চলো, যাই।”
আমরা দুজন তখন ভাঙা ধসে যাওয়া দালান, ইট পাথর কংক্রিটের জঞ্জাল, জং ধরা ভাঙা যন্ত্রপাতি পার হয়ে প্রাচীরের নিচে এসে দাঁড়ালাম। এখানে কংক্রীটের মাঝে ছোট একটা ফাঁক আছে। অনেকদিন আগে আমি আর টিশা এই ফাঁক আবিস্কার করেছি। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ এই ফাঁকটুকুর কথা জানে না। ইচ্ছে করলে এই ফাঁকটুকু দিয়ে শহর থেকে বের হওয়া সম্ভব-কিন্তু বের হওয়ার কোনো প্রয়োজন হয়নি বলে কখনো বের হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমরা একবার ভেতরে উঁকি দিলাম তারপর টিশা কংক্রিটের ভাঙা টুকরোগুলোয় পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রাচীরের উপরে উঠে যেতে থাকে। আমি তার মতো এত সহজে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে পারি না, তাই টিশার পিছু পিছু সাবধানে প্রাচীরের উপর উঠে দাঁড়ালাম। শহরের ভেতর একটা বন্ধ বন্ধ ভাব আছে, উঁচু উঁচু দালানগুলো মনে হয় সবকিছু আটকে রেখেছে। এই প্রাচীরের উপর উঠলে দেখা যায় চারদিক খোলা, যতদূর চোখ যায় শুধু লালচে বালি। মনে হয় আকাশটা একটা বাটির মতো পুরো পৃথিবীটা ঢেকে রেখেছে।
আমি আর টিশা যখন প্রাচীরের উপর হাঁটছি তখন হঠাৎ করে টিশা বলল, “রিহি! দেখো, দেখো।”
আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, বহুদূর থেকে ধুলো উড়িয়ে একটা গাড়ি ছুটে আসছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, এর আগে কখনো আমরা কেউ একটা গাড়িকে ছুটে যেতে দেখিনি। বাইরে দস্যুদল, বুনো পশু, কত রকম বিপদ, সেখানে কেউ একা যায় না। যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় সবাই দল বেঁধে যায়। একসাথে তখন অনেক গাড়ি থাকে। সেই গাড়ির সামনে-পিছে অস্ত্র হাতে প্রহরী থাকে। এখানে কিছু নেই, শুধু একটা গাড়ি। কী আশ্চর্য!
গাড়িটা ধুলা উড়িয়ে ঠিক আমাদের শহরের দিকেই আসছে, দেখতে দেখতে গাড়িটা স্পষ্ট হলো। এটা আমাদের দেখা কোনো গাড়ির মতো না, এটা অন্য রকম গাড়ি। দেখে মনে হয় জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা গাড়ি, ভুল করে তৈরি করা গাড়ি। মনে হয় একটা বড় সাইজের খেলনা গাড়ি। গাড়ির ভেতরে কারা বসে আছে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, মনে হয় দস্যুদল। আমরা শুধু দস্যুদলের নাম শুনেছি তাদের সম্পর্কে ভয়ানক ভয়ানক গল্প শুনেছি কিন্তু কখনো তাদেরকে দেখিনি। তাই ভালো করে দেখার জন্য আমরা প্রাচীরের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকি। দস্যুদল দূর থেকে আমাদেরকে গুলি করে দেবে কি না সেটা নিয়ে একটু ভয় করছিল, তাই চেষ্টা করছিলাম কংক্রিটের আড়ালে আড়ালে থাকতে।
গাড়িটা আমাদের শহরের গেটের দিকে আসছিল। তাই আমি আর টিশাও গেটের কাছাকাছি চলে এলাম। গাড়িটা কাছাকাছি চলে এসেছে এবারে ভেতরেও দেখা যাচ্ছে। স্টিয়ারিং হাতে একজন মাত্র মানুষ–আর কেউ কোথাও নেই। একজন মানুষ একটা অদ্ভুত খেলনা গাড়িতে করে আমাদের শহরের দিকে আসছে। কেন আসছে?
ঠিক তখন আমরা প্রথম গুলির শব্দ শুনলাম, আমাদের শহরের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেন্ট্রি গুলি করেছে। বিদঘুঁটে খেলনার মতো গাড়িটা তখন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। আমি আর টিশা কংক্রিটের আড়াল থেকে দেখতে পেলাম গাড়ির ভেতর থেকে মানুষটা খুব ধীরেসুস্থে বের হয়ে এল, এবার আমরা তার চেহারা দেখতে পেলাম, মাথায় একটা হ্যাঁট, মুখে দাড়ি আর গোঁফ। তার কাঁধে বিচিত্র একটা পাখি বসে আছে। মানুষটা গাড়ির ভেতর থেকে একটা ছোট লাঠি বের করল, লাঠির মাথায় এক টুকরো সাদা কাপড় বেঁধে একটা পতাকার মতো তৈরি করল, তারপর সেটা নাড়াতে নাড়াতে হেঁটে হেঁটে গেটের দিকে আসতে থাকে। মানুষটার ভেতরে কোনো ভয়-ডর নেই, কোনো দুশ্চিন্তা নেই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “সাদা পতাকা দিয়ে কী করছে মানুষটা?”
টিশা বলল, “সাদা পতাকা হচ্ছে শান্তির পতাকা। মানুষটা বোঝাতে চাইছে সে মারামারি করতে আসেনি।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“আমি বইয়ে পড়েছি।”
“মানুষটার কাঁধে ওটা কী পাখি?”
টিশা বলল, “বাজপাখি”
“কেন?”
“শখ। আগে মানুষ বাজপাখি পুষত।”
আমি আর টিশা কংক্রিটের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে কী হয় দেখতে থাকি। মানুষটা পতাকা দুলিয়ে দুলিয়ে কাছে আসতে থাকে। তখন গেট থেকে সেন্ট্রি চিৎকার করে বলল, “দাঁড়াও।”
মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল। সেন্ট্রি বলল, “আর কাছে আসবে না। খবরদার।”
মানুষটা মাথা নেড়ে রাজি হয়ে সেখানে পা ছড়িয়ে বসে গেল। আমরা দেখলাম মানুষটার বিদঘুঁটে গাড়ির ভেতর থেকে দুটো কুকুর লাফ দিয়ে নেমে এদিক-সেদিক গন্ধ শুকতে শুকতে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মানুষটার কাছে এসে কুকুর দুটো তার শরীর ঘেঁষে বসে পড়ল। মানুষটা তখন কুকুরগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে।
সেন্ট্রিগুলো যখন দেখল মানুষটা একা, তার সাথে কোনো অস্ত্র নেই, সঙ্গী হচ্ছে একটা পাখি আর দুটো কুকুর তখন তারা অনুমান করল একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তখন তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে লোকটার কাছে গেল, তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল, আমরা দূর থেকে তাদের কথাগুলো ঠিক শুনতে পেলাম না। একটু পরে দেখলাম মানুষটা উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের শহরের গেটের দিকে হেঁটে হেঁটে আসছে, তার পিছু পিছু দুটি কুকুর অলস ভঙ্গিতে হাঁটছে। আমাদের শহরের সেন্ট্রিরা তাদের ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র মানুষটার দিকে তাক করে ধরে রেখেছে।
টিশা বলল, “চলো যাই।”
“কোথায়?”
“নিচে। দেখি মানুষটা কী করে।”
আমি বললাম, “তুমি ভেবেছ মানুষটা কী করে সেটা তোমাকে দেখতে দেবে? নিশ্চয়ই কমান্ড্যান্টের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।”
“নিলে নেবে। আমাদের কাছে যেতে না দিলে চলে আসব। সমস্যা কোথায়?” কথা শেষ করে আমি কী বলি সেটার জন্য অপেক্ষা না করে টিশা কংক্রিটের টুকরোর উপর লাফ দিতে দিতে নিচে নামতে থাকে। আমি আর কী করব? তার পিছু পিছু নামতে শুরু করলাম।
গেটের কাছাকাছি গিয়ে দেখি সেখানে মানুষের ছোটখাটো একটা জটলা। মনে হচ্ছে এই মানুষটার খবর পেয়ে অনেকেই মজা দেখতে চলে এসেছে। আমি আর টিশাও মানুষের ভিড়ের মাঝে মিশে গিয়ে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করলাম।
দূর থেকে মানুষটাকে যত বিচিত্র মনে হয়েছিল, কাছে থেকে তাকে আরো বিচিত্র মনে হলো। মাথার হ্যাঁটটা খুলে পেছনে ঝুলিয়ে নিয়েছে। মাথায় লম্বা চুল ঝুঁটির মতো বেঁধে রেখেছে। মুখ বোঝাই কাঁচাপাকা দাড়ি আর গোঁফ। রোদে পোড়া চেহারা, শুধু চোখ দুটো কেমন জানি ঝকঝক করছে। খাকি একটা শার্ট, ভুসভুসে খাকি প্যান্ট। পায়ের জুতো খুবই অদ্ভুত, আমরা কখনো এরকম জুতো দেখিনি। মনে হয় গাড়ির টায়ার কেটে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে।
একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?”
মানুষটা বলল, “আমি যাযাবর।”
যাযাবর শব্দটার অর্থ বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারল না। আমিও বুঝতে পারলাম না, টিশার দিকে তাকালাম, টিশা ফিসফিস করে বলল, “যারা ঘুরে বেড়ায় তারা যাযাবর।”
“ঘুরে বেড়ায়?”
“হ্যাঁ”
“ঘুরে কী করে?”
“কিছু করে না।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”
তখন সেন্ট্রি তার অস্ত্র ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কোনো কথা না। কমান্ড্যান্ট আসার আগে কোনো কথা না।”
আমাদেরকে তাড়িয়ে না দিয়ে শুধু কথা বলতে নিষেধ করেছে, তাতেই আমরা খুশি।
কিছুক্ষণের মাঝেই কমান্ড্যান্ট আর তার সাথে দুজন সহকারী চলে এল। একজন রুপালি চুলের মহিলা অন্যজন কঠিন চেহারার
একজন পুরুষ। কমান্ড্যান্ট আমাদের এভাবে জটলা করে থাকতে দেখে একটু বিরক্ত হলো কিন্তু চলে যেতে বলল না। সোজাসুজি বিচিত্র মানুষটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ঠিক কী কারণ জানা নেই তখন কুকুর দুটো উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় চাপা গর্জন করল। ঘাড়ে বসে থাকা বাজপাখিটাও প্রথমবার মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে দেখে ডানা ঝাঁপটে তীক্ষ্ণ এক ধরনের শব্দ করল।
কমান্ড্যান্ট যাযাবর মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী চাও?”
মানুষটি বলল, “আমি কিছু চাই না।”
“তাহলে কেন এসেছ?”
“এমনি।”
কমান্ড্যান্ট কঠিন গলায় বলল, “এমনি কেউ আসে না।”
যাযাবর মানুষটি সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল, বলল, “আমি আসি!”
“কেন?”
“আমি ঘুরে বেড়াই। ঘুরে ঘুরে দেখি। দেখাতেই আমার আনন্দ। দূর থেকে দেখলাম তোমাদের শহর, তাই দেখতে এসেছি।”
কমান্ড্যান্ট কেমন যেন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, বলল, “আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।”
যাযাবর মানুষটা আবার সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল, বলল, “তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না। আমি তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতেও বলব না।”
কমান্ড্যান্ট মুখ আরো শক্ত করে বলল, “তুমি আসলে দস্যুদলের গুপ্তচর। তুমি আমাদের শহরের ভেতরে খোঁজ নিতে এসেছ।”
মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি যদি তাই বিশ্বাস করতে চাও, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“তোমাকে আমরা অ্যারেস্ট করব।”
“করতে চাইলে করো। আমার জন্য সেটাও হবে এক ধরনের অভিজ্ঞতা। আমি কখনো কোথাও অ্যারেস্ট হইনি।”
কমান্ড্যান্ট তখন কেমন যেন কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কী চাও ঠিক করে বলো।”
বিচিত্র মানুষটা প্রথমবার গম্ভীর মুখে বলল, “আমি কিছু চাই না। যদি অনুমতি দাও তোমাদের শহরটা দেখব। যদি না দাও, এখানে এক-দুইদিন বসে থাকব, রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে গিটার বাজিয়ে তোমাদের গান শোনাব। যদি সেটাও না চাও চলে যাব।” মানুষটা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আর, তুমি যদি চাও তাহলে—”
“তাহলে কী?”
“আমি তোমাদের ভাঙা অকেজো গাড়ি বাইক লরি এসব ঠিক করে দিতে পারি। আমি খুব ভালো গাড়ির মেকানিক।”
কমান্ড্যান্ট মাথা নাড়ল, “তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের ক্রেনিয়াল লাগানো মানুষ আছে। যে কোনো বিষয়ে আমরা তথ্য মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে পারি।”
বিচিত্র মানুষটা কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হাসতে থাকে। কমান্ড্যান্ট ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো? তুমি এভাবে হাসছ কেন?”
“এমনি! তোমাদের ক্রেনিয়ালের বাইরে অনেক তথ্য আছে! যেগুলো অভিজ্ঞতা থেকে জানতে হয়। ক্রেনিয়াল লাগানো ইঞ্জিনিয়াররা যে গাড়ি ঠিক করতে পারেনি সেরকম একটা গাড়ি নিয়ে এসো, আমি তোমাকে দেখাই।”
“তোমাকে কিছু দেখাতে হবে না।” কমান্ড্যান্ট কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে, তোমাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা এখানে থাকার অনুমতি দিলাম, কিন্তু তোমাকে কয়েকটা আদেশ মানতে হবে।”
“কী আদেশ?”
“তুমি এখানেই বসে থাকবে, শহরের ভেতরে ঢুকতে পারবে।”
“ঢুকব না।”
“গানবাজনা হইহুল্লোড় চলবে না।”
“ঠিক আছে।”
“তোমার এই ঘেয়ো কুকুর আর প্যাঁচা–”
“এটা প্যাচা না। এটা বাজপাখি।”
“যাই হোক, এই জন্তু-জানোয়ার শহরের সীমানার বাইরে রাখবে। আমি চাই না এগুলো এখানে রোগ-জীবাণু আর ব্যাকটেরিয়া ছড়াক।”
মানুষটি হেসে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?”
“শহরের মানুষের সাথে কোনো গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর চলবে। কোনো ষড়যন্ত্র কোনোরকম গুজব ছড়ানো চলবে না।”
মানুষটাকে এবারে একটু দুশ্চিন্তিত দেখাল, বলল, “তার মানে আমি কারো সাথে কথা বলতে পারব না?”
“কথা বলতে পারবে কিন্তু গুজব ছড়াতে পারবে না।”
“কিন্তু কোনটাকে তোমরা কথাবার্তা বলবে আর কোনটাকে তোমরা গুজব বলবে, আমি সেটা কেমন করে বুঝব?”
“তোমার বুঝতে হবে না। তোমার সব কথাবার্তা আমরা মনিটর করব। যখন দেখবে তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দিচ্ছি, বুঝবে তুমি গুজব ছড়াচ্ছ।”
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”