ঋগ্বেদ-সংহিতা : পার্থিব সম্পদের কামনা
আফ্রিকার দিন্করা সাহিত্য রচনা করে, কিন্তু তা মুখেমুখে। কেননা, লেখার হরফ তারা আবিষ্কার করেনি। পশুপালনজীবী পর্যায়ে লেখার হরফের আবিষ্কার হয়নি।
বৈদিক আর্যরাও সাহিত্য রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা লিখতে জানতেন না। তাই মুখেমুখে সাহিত্য রচনা করতেন। ঘোর-পুত্র কন্ব ঋষি মরুৎগণকে উদ্দেশ্য করে বলছেন :
মিমীহি শ্লোকমাস্যে পর্জন্যইব ততনঃ গায় গায়ত্রমুক্থ্যম্ ॥
অর্থাৎ, —মুখেতে শ্লোক রচনা কর, মেঘের মত তাহাকে বিস্তারিত কর, গায়ত্রীছন্দে উক্থ্য গান কর॥ ঋগ্বেদ : ১.৩৮.১৪ ॥
কিসের গান? কামনার গান, কামবর্ষী গান। আদিম সমাজে কামনা ছাড়া গান নেই। কিসের কামনা? অন্নের কামনা, ধনের কামনা, পশুর কামনা, সন্তানের কামনা, নিরাপত্তার কামনা। মোক্ষলাভের কথা নয়, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের কথা নয়—আফ্রিকার দিন্কদের মতোই বৈদিক সাহিত্যেও সহজ সরলভাবে নেহাতই পার্থিব, নেহাতই লোকায়তিক কামনা প্রকাশ করবার আয়োজন।
অস্মে রায়ো দিবেদিবে সং চরন্তু পুরস্পৃহঃ।
অস্মে বাজাস ঈরতাম্॥
অর্থাৎ, —হে অগ্নি! অতিশয় কাম্য ধনসমূহ আমাদিগের নিকট প্রতিদিন সঞ্চরণ করুক। অন্নসমূহ আমাদিগকে কর্মের প্রেরণা দিক। ঋগ্বেদ : ৪.৮. ৭॥
প্র যংসি হোতর্বৃহতীরিষো নোহগ্নে মহি দ্রবিণমা যজস্ব।
অর্থাৎ, —হে অগ্নি! তুমি আমাদিগকে অন্ন দান কর। হে অগ্নি! তুমি আমাদিগকে মহৎ ধন দান কর॥। ঋগ্বেদ : ৩.১.২২ ॥
ব্রহ্মণস্পতে সুষমস্য বিশ্বহা রায়ঃ স্যাম রথ্যো বয়স্বতঃ।
বীরেষু বীরাঁ উপ পৃঙ্ধি নস্ত্বং যদীশানো ব্রহ্মণা বেষি মে হবম্॥
অর্থাৎ, —হে ব্রহ্মণস্পতি, সুনিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাপী অন্নযুক্ত ধনের আমরা যেন অধিপতি হই; আমাদের বীরগুলিকে তুমি বীর (পুত্র) উৎপাদন কর; তুমি সকলের শ্রেষ্ঠ এবং আমাদের অন্নযুক্ত স্তুতির অভিলাষী॥। ঋগ্বেদ : ২.২৪.১৫ ৷।
হুবহু এই জাতীয় পার্থিব কামনাই সুবিশাল ঋগ্বেদ-সংহিতাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
এখানে আরো কিছু নমুনা উদ্ধৃত করা যায়।
ত্বং নঃ সোম বিশ্বতো রক্ষা রাজন্নঘায়ঃ।
ন রিতষ্যেত্বাবতঃ সখা ॥
অর্থাৎ, —হে রাজন সোম! আমাদের দুঃখদানে অভিলাষী সকল লোক হইতে রক্ষা কর। ত্বৎসদৃশ ব্যক্তির সখা কখনো বিনাশপ্রাপ্ত হয় না॥ ঋগ্বেদ : ১.৯১.৮॥
সোম যাস্তে ময়োতুব ঊতয়ঃ সন্তি দাণ্ডষে।
তাভির্নোহবিতা ভব॥
অর্থাৎ, —হে সোম! যজমানের সুখজনক তোমার যে সকল রক্ষণ আছে তারা আমাদিগকে রক্ষা কর॥ ঋগ্বেদ : ১.৯১.৯।
ইমং যজ্ঞমিদং বচো জুজুষাণ উপাগহি।
সোম ত্বং নো বুধে ভব।
অর্থাৎ, —হে সোম! তুমি আমাদের এই যজ্ঞ ও এই স্তুতি দ্বারা প্রীত হইয়া আগমন কর এবং আমাদের বর্ধন কর॥ ঋগ্বেদ : ১.৯১.১০৷।
আ প্যায়স্ব সমেতু তে বিশ্বতঃ সোম বৃষ্ণ্যম্।
ভবাং বাজস্য সংগথে॥
অর্থাৎ, —হে সোম! তুমি বর্ধিত হও, তোমার বীর্য দ্বারা সকলে সংযুক্ত হউক; তুমি আমাদের অন্নদাতা হও॥ ঋগ্বেদ : ১.৯১.১৬ ৷।
আ প্যায়স্ব মদিন্তম সোম বিশ্বেভিরংশুভিঃ।
ভবা নঃ সুপ্রবস্তমঃ সখা বৃধে।
অর্থাৎ, —অত্যন্ত মদযুক্ত হে সোম! সমস্ত লতাবয়বদ্বারা বর্ধিত হও; শোভন অন্নযুক্ত হইয়া তুমি আমাদের সখা হও ও বর্ধিত হও। ঋগ্বেদ : ১.৯১.১৭॥
স শ্রুধি য: স্মা পৃতনাসু কানু চিদ্দক্ষায্য ইন্দ্র
ভরহুতয়ে নৃভিরসি প্রতুর্তয়ে নৃভিঃ।
যঃ শূরৈঃ স্বঃ সনিতা যো বিপ্রৈর্বাজং তরুতা।
তমীশানাস ইরধস্ত বাজিনং পৃক্ষমত্যং ন বাজিনম্॥
অর্থাৎ, –হে ইন্দ্র! তুমি যুদ্ধের নেতা; তুমি প্রধান প্রধান যুদ্ধে মরুৎগণের সহিত স্পর্ধাপুর্বক শক্রসংহারে সমর্থ; তুমি পূরগণের সহিত স্বয়ং (সংগ্রামন্থখ) অনুভব কর। ঋত্বিকগণ স্তব করিলে তুমি তাহাদিগকে অন্নপ্রদান কর; আমাদিগের স্তুতি শ্রবণ কর। অভ্যর্থনা-সমর্থ ঋত্বিকগণ গমনশীল অল্পবান ইন্দ্রকে অশ্বের ন্যায় সেবা করে॥ ঋগ্বেদ : ১.১২৯.২ ॥
দস্মো হি ষ্মা বৃষণং পিন্বলি ত্বচং কং
চিদ্যাবীরররুং শূর মর্ত্যং পরিবৃণক্ষি মর্ত্যম্।
ইন্দ্রোত ভুভ্যং তদ্দিবে তদ্রুদ্রায় স্বযশসে।
মিত্রায় বোচং বরুণায় সপ্রথঃ সুম্বলীকায় সপ্রথঃ॥
অর্থাৎ, –হে ইক্স! তুমি শক্ৰক্ষয়কারক অতএব বৃষ্টিপূর্ণ ত্বক্-রূপ জলের আবরণকে (মেঘকে) ভেদ করিয়া (জল) সেচন কর; এবং মর্ত্যের ন্যায় গমনশীল মেঘকে ধরিয়া বৃষ্টিশূন্য করিয়া ছাড়িয়া দাও, যেমন কোন বীর গমনকারী শক্রকে নিগৃহীত করে। হে ইন্দ্র! তোমার এই কাৰ্য আমরা তোমার নিকট, দ্যুর নিকট, যশোযুক্ত রুদ্রের নিকট ও প্রজাদিগের স্থখদায়ী মিত্র ও বরুণের নিকট বলিব॥। ঋগ্বেদ : ১.১২৯.৩ ॥
অস্মাকং ব ইন্দ্রমুশ্মসীষ্টয়ে সখায়ং বিশ্বায়ুং প্রাসহং যুজং বাজেয়ুপ্রাসহং যুজম্। অস্মাকং ব্রহ্মোতয়েহবা পৃৎসুষু কাসু চিৎ।
ন হি ত্বা শক্রঃ স্তৃরতে স্কৃণোষি যং বিশ্বং শক্ৰং স্তৃণোষি যম্।
অর্থাৎ, —হে ঋত্বিকগণ! আমাদিগের যজ্ঞে ইন্দ্রকে কামনা করি। ইন্দ্র আমাদিগের সখা, সর্বগামী, শত্রুদিগের অভিভবকারী এবং তিনি আমাদিগকে অন্নসমূহদ্বারা যুক্ত করেন। তিনি আমাদিগের সহায়ভূত হইয়া শত্রুবিনাশ করেন এবং মরুৎগণের সহিত মিলিত হন। হে ইন্দ্ৰ! তুমি আমাদের পালনার্থ আমাদের কর্ম রক্ষা কর। সংগ্রামে শক্ৰ তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারে না। তুমিই সমস্ত শক্রকে নিবারণ কর। ঋগ্বেদ : ১.১২৯.৪ ॥
এতা বো বশ্ম্যুদ্যতা যজত্ৰা অতক্ষন্নায়বো নব্যসে সম্
শ্রবস্যবো বাজং চকানাঃ সপ্তির্ন রথ্যো অহ ধীতিমশ্যাঃ॥
অর্থাৎ, —হে যজনীয় বিশ্বদেবগণ! আমি তোমাদের উদ্যত স্তুতিগুলিকে কামনা করি। তোমরা নূতনতর স্তুতির যোগ্য। আমাদিগের ন্যায় অল্প ও বলাভিলাষী মনুষ্যগণ তোমাদের জন্য স্তুতি রচনা করিয়াছে। রথের অশ্বের ন্যায় তোমাদের দল আমাদের কর্মে আগমন করুক। ঋগ্বেদ : ২.৩১.৭ ॥
অস্য মে দ্যাবাপৃথিবী ঋতায়তো ভূতমবিত্রী
বচস: সিষাসতঃ।
যযোরায়ুঃ প্রতরং তে ইদং পুর উপস্তুতে
বসুয়ুর্বাং মহো দধে॥
অর্থাৎ,—হে দ্যাবাপৃথিবী! যে স্তোতা ঋত অনুযায়ী তোমাদিগকে বাক্যের দ্বারা প্রত করিতে ইচ্ছা করে, তোমরা তাহাদের আশ্রয়স্বরূপ হও। তোমাদের অল্প সর্বাপেক্ষ উংকৃষ্ট। দ্যাবাপৃথিবীকে সকলে স্তুতি করে, অল্পকাম হইয়া মহা স্তোত্রদ্বারা তোমাদের স্তব করিব॥ ঋগ্বেদ : ২.৩২.১॥
মাকির্নেশন্মাকীং রিযন্মাকীং সং শারি কেবটে।
অথারিষ্টাভিরা গহি ॥
অর্থাৎ, —(হে পূষন), আমাদিগের গরুগুলি যেন নষ্ট না হয়, তাহারা যেন হিংসিত না হয়, তাহারা যেন গর্তে না পড়িয়া যায়; এইরূপে অমঙ্গলহীন গরুগুলির সহিত তুমি আগমন কর। ঋগ্বেদ : ৬.৫৪.৭॥
নূ গৃণানো গৃণতে প্রত্ন রাজন্নিষল পিন্ব বসুদেয়ায় পূর্বীঃ।
অপ ওষধীরবিষা বনানি গা অৰ্বতো নৃন্বচলে রিরীহি।
অর্থাৎ, —হে পুরাতন রাজা (ইন্দ্র), তুমি স্তুত হইয়া তোমার দেয় যে ধনসমূহ সেইগুলি এবং অন্নসমূহ শীঘ্র আমাদিগকে দাও; এবং বৃষ্টি, ওষধিসমূহ নির্বিষ বৃক্ষগুলি, গরুগুলি, অশ্বগুলি এবং মনুষ্যগুলি আমাদিগকে দাও॥ ঋগ্বেদ : ৬.৩৯.৫ ॥
উদ্ধৃতিগুলি খুব কিছু সযত্ন-চয়নের পরিচায়ক নয়—প্রায় এলোমেলোভাবে নমুনা-পরিদর্শন বা sample survey-র মতো করেই গ্রহণ করা হয়েছে। এর থেকেই অনুমান করা যাবে ঋগ্বেদের কবির যে-কামনা অবলম্বন করে কবিতা বা গান রচনা করতেন সেগুলির স্বরূপ মূলতই লোকায়তিক; পরলোক বা পরকাল-সম্পর্কিত কামনা নয়, মোক্ষপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে প্রার্থনা-উপাসনা নয়।
অবশ্যই দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত এই সাহিত্য। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, আধুনিক আধ্যাত্মিক অর্থে ঋগ্বেদের দেবতাদের দেবত্বপ্রাপ্তি হয়নি। উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলির মধ্যেই তাদের সখা বা বন্ধুভাবে আহ্বান করবার পরিচয় রয়েছে। এখানে সে-প্রসঙ্গে আরো কিছু দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যায়।
হয়ে দেবী যুয়মিদাপয় স্থ তে মূলত নাধমানায় মহ্যম্।
মা বো রথো মধ্যমবালৃতে ভূন্মা যুষ্মাবৎস্বাপিষ্ণু শ্রমিষ্ম॥
অর্থাৎ, —হে দেবগণ (বিশ্বদেবগণ)! তোমরাই আমাদের বন্ধু। আমরা, যাহারা যাঞ্চা করিতেছি, তাহাদের অভিমত ফল প্রদান কর। তোমাদের রথ আমাদের যজ্ঞে যেন মন্দগতি না হয়। তোমাদের ন্যায় বন্ধু পাইয়া আমরা যেন শ্রান্ত না হই॥ ঋগ্বেদ : ২.২৯.৮ ॥
নিষষিধ্বরীন্ত ওষধীরুতাপো রয়িং ত ইন্দ্র পৃথিবী বিভর্তি।
সখায়স্তে বামভাজঃ স্যাম মহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্॥
—অর্থাৎ,–হে ইন্দ্র, ওষধিসমূহ এবং জল তোমারই নির্মিত, তোমার ধন পৃথিবী ধারণ করে; আমরা তোমার সখা এবং তোমার ঈপ্সিত ধনের ভাগী (বামভাজঃ); তুমি শ্রেষ্ঠ দেবগণের মধ্যে একমাত্র অসুর॥ ঋগ্বেদ : ৩.৫৫.২২ ৷।
পুরাণমোকঃ সখ্যং শিবং বাং যুবোর্নরা দ্রবিণং জহ্নাব্যাম্।
পুনঃ কৃন্বানাং সখ্যা শিবানি মধ্বা মদেম সহ নু সমানাঃ॥
অর্থাৎ, (হে অশ্বিদ্বয়!) তোমাদিগের বাসস্থান পুরাতন, তোমাদিগের সখ্য মঙ্গলকর, তোমাদিগের ধন জাহ্নবীতে অবস্থিত; পুনরায় তোমাদের বন্ধুত্ব মঙ্গলময় হউক, আমরা মধুদ্বারা তোমাদের সহিত সমানভাবে আনন্দ করি। ঋগ্বেদ; ৩.৫৮.৬॥
সংক্ষেপে : ঋগ্বেদ সংহিতা মুখেমুখে রচনা-করা কবিতা বা গানের সংকলন। কেননা, বৈদিক মানুষেরা তখনো লেখার হরফ আবিষ্কার করেননি—লেখার হরফ পশুপালনজীবী পর্যায়ের পরের আবিষ্কার। এ-সাহিত্য তবুও বিলুপ্ত হয়নি; কেননা কানে শুনে পরম যত্নে মুখস্থ করে রাখবার ব্যবস্থা ছিলো। তাই নাম শ্রুতি। কামনাই হলো এ-সাহিত্যের প্রাণবস্তু। এবং তা হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, পৃথিবীতে আজো যে-সব মানবদল পিছিয়ে-পড়া অবস্থায় আটকে রয়েছে তাদের পরীক্ষা করলে দেখা যায়, প্রাচীন সমাজে কামনা ছাড়া গান হয় না। শুধু তাই নয়; প্রাচীন মানুষদের কাছে সমস্ত গানেরই একটা প্রয়োগের দিক আছে, কাজের সঙ্গে সম্পর্কের দিক আছে। ঋক-মন্ত্রগুলিরও যে এককালে এই বৈশিষ্ট্য ছিলো তার স্মৃতি উত্তরযুগেও বৈদিক মানুষদের মন থেকে মুছে যায়নি : “প্রত্যেক মন্ত্রের কোনও-না-কোন কর্মে, কোনও-না-কোন অনুষ্ঠানে, বিনিয়োগ হইত। যাজ্ঞিকদের মতে প্রত্যেক মন্ত্রই কোনও-না-কোন কাজে লাগিবে, কোনও-না-কোন অনুষ্ঠানে প্রযুক্ত হইবে। অকেজো মন্ত্রের কোন সার্থকতা নাই।”(২৫) অবশ্যই পরের যুগে ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলির যে-বিনিয়োগ নির্দিষ্ট হয়েছে বৈদিক সংস্কৃতির আদিপর্বেও যে এগুলি সেই ভাবেই এবং সেই কাজেই প্রযুক্ত হতো সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কেননা, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী(২৬) যে-রকম বলছেন, এই ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে বৈদিক যজ্ঞের আদি-তাৎপর্যের পরিচয় পাওয়া যায় না : “আর্যেতর অন্যান্য জাতির মধ্যেও যজ্ঞানুষ্ঠান কোনও-না-কোন প্রকারে বিদ্যমান ছিলো এবং এখনো আছে…। ভারতবর্ষে বেদপন্থী সমাজে যজ্ঞানুষ্ঠান কালক্রমে অত্যন্ত পল্পবিত হইয়া অত্যন্ত জটিলতা পাইয়াছিল। বহু অনুষ্ঠানের গোড়ার তাৎপর্য লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাৎপর্য আরোপ-করিবার লোকের অভাব ছিল না!” আচার্য রামেন্দ্রসুন্দরের মতে ব্ৰহ্মবাদী বা ব্রাহ্মণগ্রন্থের লেখকের উত্তরযুগে যজ্ঞের উপর এইভাবে নিজেদের কল্পনা-প্রসূত তাৎপর্য আরোপ করেছিলেন। যজ্ঞকথার আলোচনায় আমরা পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত আমাদের মন্তব্য শুধু এই যে, প্রাচীন সমাজের সাহিত্য বলেই আধুনিক কালের অসভ্য মানুষদের সাহিত্যের মতোই ঋগ্বেদের ছন্দোবদ্ধ রচনাগুলির একটা প্রয়োগের দিক—কর্মের সঙ্গে সম্পর্কের দিক—ছিলো; এবং উত্তরকালের ওই বিনিয়োগব্যবস্থার মধ্যে তারই স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়, যদিও তার আদিতাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় কিনা সে-বিষয়ে বিদ্বানের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তৃতীয়ত, যে-কামনাগুলিকে কেন্দ্র করে ঋগ্বেদের এই কবিতা বা গানগুলি গড়ে উঠেছিলো তা মূলতই পার্থিব বস্তুর কামনা : ধন, অন্ন, পশু, পুত্র, নিরাপত্তা, ইত্যাদি। এমন কি যে-দেবতাদের কাছে এই কামনার চরিতার্থতা চাওয়া হয়েছে তাদেরও তখনো আধুনিক আধ্যাত্মিক অর্থে দেবত্বপ্রাপ্তি ঘটেনি। এদিক থেকে, ঋগ্বেদ-কে আমরা বহুলাংশেই প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী চেতনার পরিচায়ক বলবো। এবং বর্তমান পরিচ্ছেদে আমাদের মূল যুক্তি হবে, এই প্রাক-অধ্যাত্মবাদী চেতনা প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন সমাজ-জীবনেরই পরিচায়ক।
———–
২৫. রামেন্দ্রমুন্দর ত্রিবেদী : রচনাবলী ৩:৪৯৬ ।
২৬. ঐ ৩:৪৯৪।