ইলিয়ট রোড আর সার্কুলার রোডের ঠিক মুখটায় দাঁড়িয়ে ছিল উৎপল। মিতিন আর টুপুরকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে এগিয়ে এল। হেসে সম্ভাষণ জানাল, হ্যালো ম্যাডাম! হাই ইয়াং লেডি! আপনারা যে আজকেই চলে আসবেন ভাবতেই পারিনি।
মিতিন হেসে বলল, ভাবলাম কেসটা যখন নেবই, তখন আর দেরি করা কেন?
সো কাইন্ড অফ ইউ। আসুন। ড্যাডিকে বলে রেখেছি, উনি আপনাদের জন্য ওয়েট করছেন।
কদ্দূর এখান থেকে?
বেশি নয়, মিনিট পাঁচ-সাত।
বেজায় গরম পড়েছে আজ। সূর্য যেন আগুন ছড়াচ্ছে। বিকেল চারটে বেজে গেছে, এখনও রোদের ঝাঁঝ এতটুকু মরেনি। পিচরাস্তা। থেকে ভয়ংকর তাত উঠছে। হাওয়াও আছে। লু-এর মতো। গা হাত পা যেন ঝলসে ঝলসে যায়।
গলগল ঘামতে ঘামতে হাঁটছিল টুপুর। দেখছিল চারদিক। এদিককার অধিকাংশ বাড়িই প্রায় পুরনো আমলের। চেহারায় জীৰ্ণ জীর্ণ ভাব। দোকানপাট অবশ্য মোটামুটি ঝকঝকে। স্কুল, চার্চ, মিনিপ্যালেস, কী নেই রাস্তাটায়। তবে গির্জাটা দেখে মনে হয় পরিত্যক্ত, এমনই মলিন দশা। রাস্তায় ভিড় নেই বটে, তবে অল্পস্বল্প পথচারীই মালুম দিচ্ছে এ অঞ্চলে হরেক কিসিমের মানুষের বাস। একই ফুটপাথ ধরে হাঁটছে বোরখাধারিণী আর মিনিস্কার্ট। অপরিসর রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে ট্রামলাইন। ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে টিমে তেলায় চলে যাচ্ছে ফাঁকা ট্রাম।
হাঁটতে হাঁটতে উৎপলের সঙ্গে কথা বলছিল মিতিন, আপনার আজ জিমনাসিয়ামে যাওয়া নেই?
মির্না আছে। মির্নাই সামলাচ্ছে আজ।
আপনারা কি চাকরিও একই জিমনাসিয়ামে করেন?
আমরা তো এখন চাকরি করি না। উৎপল হাসল, ও, আপনাদের কাল বলাই হয়নি। আমরাই একটা জিমনাসিয়াম খুলেছি।
ও মা, তাই? কবে খুললেন? কোথায়?
এই তো মাস আড়াই হল। ড্যাডির বাড়ির চারটে বাড়ি আগে। ভেবে দেখলাম পরের গোলামি করার চেয়ে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করা ভাল।
বাহ।
উৎপল লাজুক লাজুক মুখ করে হাসল সামান্য। ডানপাশের একটা গলিতে ঢুকেছে। উলটোদিক থেকে হনহনিয়ে আসছে এক জিল্স পরা ঝাঁকড়াচুলো তরুণ, চোখে সবুজ সানগ্লাস।
উৎপল হাত তুলল, হাই ডিক!
ছেলেটা দাঁড়িয়ে গেল, হাই!
মিতিনকে দেখিয়ে উৎপল ইংরিজিতে বলল, মিট মিসেস মুখার্জি। কাল এঁর কথাই বলছিলাম।
ডিক সানগ্লাস খুলল না, তবে চোয়াল সামান্য ফাঁক করে মাথা ঝোঁকাল, হাই!
উৎপল জিজ্ঞেস করল, যাচ্ছ কোথায়?
টু মিট সামওয়ান।
ফিরছ কখন?
ডিক উত্তর না দিয়ে ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকাল।
একটু থাকবে না? ম্যাডাম কিন্তু তোমাদের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছেন।
ইংরিজির মেলট্রেন ছুটিয়ে দিল ডিক, উনি আমার সঙ্গে মোটেই দেখা করতে আসেননি। যাঁর কাছে যাচ্ছেন তিনি তো বাড়িতেই আছেন। তা ছাড়া আমার না থাকাই ভাল, কী বলতে কী বলে ফেলব, ড্যাডি চটে যাবেন।
বলেই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে ডিক। মিতিন আর টুপুর ঘুরে তাকানোর আগেই ডিক ভ্যানিশ।
মিতিন আলগাভাবে জিজ্ঞেস করল, কোন হোটেলে চাকরি করে ডিক?
রাসেল স্ট্রিটের হোটেল ফ্লোরেন্স।
সে তো বেশ বড় হোটেল!
হুঁ। উৎপলকে ঈষৎ অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। বলল, দেখলেন তো কেমন ছেলে! বাড়িতে বিপদ, ভ্রূক্ষেপ নেই! কোনও ঝঞ্ঝাটে থাকতে চায় না, সুটসাট কেটে পড়ে।
মিতিন হুঁ হ্যাঁ করল না। হাঁটছে আবার। গলিতে একটা বাড়ির গায়ে বড় সাইনবোর্ড দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল, এটাই বুঝি আপনাদের জিমনাসিয়াম?
হ্যাঁ। এই আমাদের রুটিরুজি।
নামটা তো খাসা দিয়েছেন। নাদিয়া!
টুপুর জিজ্ঞেস করল, নাদিয়া কোমানিচির নামে?
হ্যাঁ। মির্না ওঁর দারুণ ফ্যান। মির্নাই রেখেছে।
মিতিন বলল, চলুন না, আগে আপনাদের জিমনাসিয়ামটা দেখে নিই।
দেখবেন? এ তো আমার পরম সৌভাগ্য।
সরু একটা প্যাসেজ দিয়ে ঢুকতে হল পুরনো বাড়িটায়। ভেতরে গিয়ে টুপুর হাঁ। রীতিমতো এক প্রকাণ্ড হলঘর। তবে চতুর্দিক চাপা বলে আলো বাতাস বোধহয় তেমন একটা ঢোকে না। সিলিং-এর ওপর থেকে ঝোলানো হয়েছে বেশ কয়েকটা জোরালো বালব, তাতেই অবশ্য ঝলমল করছে ঘরখানা। একদিকে স্ট্যান্ডফ্যান ঘুরছে ঝড়ের মতো। ইতস্তত সেট করা আছে জিমনাস্টিক্সের উপকরণ। প্যারালাল বার, হরাইজন্টাল বার, আনইন বিম….। উঁচু সিলিং থেকে টাঙানো হয়েছে রোমান রিং। ঘরের এক প্রান্তে ছোট করে হলেও ফ্লোর এক্সারসাইজের ম্যাট পাতা আছে। পাঁচটি মেয়ে আর তিনটি ছেলে কসরত করে চলেছে এপাশে-পাশে। মির্নাও রয়েছে। তার পরনে আজ আকাশি রঙের ট্র্যাকস্যুট। চুল পনিটেল করে বাঁধা। মির্নাকে দেখে আজ মিতিনমাসির থেকে যেন অনেক ছোট বলে মনে হয়।
মির্না হইহই করে এগিয়ে এসেছে, আপনারা ড্যাডির সঙ্গে মিট করে এলেন?
না। এইবার যাব। মিতিন হলঘরটায় চোখ ঘোরাল, দারুণ জিমনাসিয়াম বানিয়েছেন তো!
কোথায় দারুণ? এইটুকু জায়গায় কী হয়? পমেলড হর্স লাগাতে হবে, তার স্পেসই পাচ্ছি না।
যা আছে তাই বা কম কী? এত বড় রুম …
উৎপল পাশ থেকে বলল, চারটে ঘর ছিল। আমরা পার্টিশান ওয়ালগুলো ভেঙে নিয়েছি।
বাড়িঅলা অ্যালাও করলেন?
এই গ্রাউন্ড ফ্লোরটার মালিক মির্নার ছোটবেলার বন্ধু। তল্পিতল্পা গুটিয়ে সে এখন অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনিতে। মির্নার রিকোয়েস্ট সে। ফেলতে পারেনি।
ভাড়া কত?
নমিনাল ভাড়া। বলার মতো কিছু নয়। কপালজোরে পেয়ে গেছি।
বাহ্। সত্যি আপনারা লাকি। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা জিমনাস্টিক্স শিখতে আসছে দেখেও খুব ভাল লাগছে।
জিমনাস্টিক্সে অনেক বাচ্চারই আগ্রহ আছে। প্রপার ট্রেনার পেলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও মিরাকল দেখাতে পারে।
দেখুন, যদি একটা নাদিয়া কোমনিচি তৈরি করতে পারেন।
অত দূর না পারলেও ন্যাশনাল লেভেল অবদি যাবই। এবারেই তো আমাদের দুটো মেয়ে স্টেট মিটে যাচ্ছে। দেখবেন নাকি এদের প্রোগ্রেস?
অন্য একদিন হবে। আজ যে-কাজে এসেছি, সেটা বরং সেরে নিই।
মির্না বলল, আমি যাব সঙ্গে?
প্রয়োজন নেই। আপনি ট্রেনিং চালান। উৎপলবাবু তো আছেনই।
জিমনাসিয়াম থেকে বেরিয়ে বিশ পা যেতে না যেতে মিতিনের ব্যাগের মধ্যে বাজনা বেজে উঠেছে। মাসছয়েক হল মোবাইল ফোন নিয়েছে মিতিন। রাস্তাঘাটে যখন-তখন ফোন করার দরকার হয়, যন্ত্রটা সঙ্গে থাকলে অনেক সুবিধে।
মিতিন মোবাইল বার করে পরদায় ভেসে ওঠা নম্বরটা দেখল। পাৰ্থর ফোন। প্রেস থেকে।
টুপুরকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল মিতিন। আলতো হেসে বলল, তোর মেসো।
টুপুর ফোন কানে চাপল, আমি টুপুর। কী বলছ?
ওপারে পাৰ্থর কৌতূহলী স্বর, তোর মাসি কোথায়? যায়নি?
এই তো যাচ্ছি। আমরা পথে আছি। ইলিয়ট রোডেই।
উৎপলের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
সঙ্গেই আছেন।
মাসিকে টিপে দিস, আজ যেন কিছু নিয়ে নেয়। টুপুর চোরাচোখে একবার উৎপলকে দেখে নিয়ে বলল, আচ্ছা।
আর শোন। আমার ফিরতে রাত হবে। একজন কম্পোজিটার ড়ুব মেরে বসে আছেন। এদিকে আজই একটা স্যুভেনির ছাপা কমপ্লিট করতে হবে। পার্টিদের পরশু ফাংশান, কাল বিকেলের মধ্যে বাইন্ডিং করে ডেলিভারি না দিলে আমার পাঞ্জাবি খুলে নেবে বলে শাসিয়ে গেছে। কী ফ্যাসাদে যে পড়লাম।
টুপুর অনেক কষ্টে হাসি চাপল, আচ্ছা, মাসিকে জানিয়ে দিচ্ছি। এখন ছাড়ি?
ফোন অফ করে মিতিনকে যন্ত্রটা দিয়ে দিল টুপুর।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, দরকারি কথা?
তেমন কিছু নয়। ফিরতে রাত হবে। অনেক কাজ পড়েছে।
উৎপল সামান্য এগিয়ে গিয়েছিল। গলির শেষ প্রান্তে একটা ভাঙাচোরা লোহার গেটঅ উত্তরমুখে বাড়ির সামনে পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেছে।
টুপুররাও পায়ে পায়ে গেটের সামনে এল, এই বাড়ি?
ইয়েস। এটাই।
বাড়িটার নামটা ভারী অদ্ভুত তো! গেটের পাশে পাথরের ওপর প্রায় ক্ষয়ে আসা অক্ষরগুলো চোখে পড়ল টুপুরের। এম ই জি এন এ। মেগনা।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মেগনা মানে কী? বাংলাদেশের মেঘনা নদী?
বলতে পারব না। উৎপল সামান্য অপ্রতিভ, সত্যি বলতে কী, নামটা নিয়ে কখনও ভাবিইনি।
বাড়ির মালিক কি কখনও বাংলাদেশে ছিলেন? আগেকার পূর্ববাংলায়?
তাও তো বলতে পারব না।
গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল টুপুররা। বাড়িটা প্রাচীন, কিন্তু শ্ৰীহীন নয়। এককালের লাল রং মরে এলেও আভাসটুকু রয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য। মোটা মোটা থামখলা বারান্দা, দুপাশে দেওয়াল বেয়ে সিমেন্টের লতাপাতা উঠে গেছে, বারান্দার মাথা থেকে নেমে এসেছে সবুজ কাঠের খড়খড়ি। বাড়ি ঘিরে আধভাঙা পাঁচিলের ভেতরে বেশ খানিকটা জমি আছে। প্রায় ন্যাড়া। শুধু একদিকের এক কোণে গোটাকয়েক মরকুটে গোলাপগাছ শোভা পাচ্ছে। ওটাই কি মির্নার বাবার বাগান করার শখের নমুনা?
সাত-আটখানা চ্যাপটা সিঁড়ি ভেঙে চওড়া বারান্দায় উঠল তিনজনে। উৎপল চেঁচিয়ে ডাকল, ড্যাডি? মিসেস জোনস?
বারান্দার তিনদিকে তিনটে দরজা। বাঁদিকেরটা খুলে গেল। বেরিয়ে এসেছেন এক প্রবীণ মানুষ। বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারা, মাথার চুল বেশির ভাগই পাকা, গায়ের রং বাদামি। দেখতে একদমই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো নয়, বরং বাঙালি ঘরের দাদুদের সঙ্গেই ভদ্রলোকের বেশি মিল।
বয়স্ক মানুষটা এগিয়ে এলেন সামনে। চোখ সামান্য কুঁচকে টুপুর মিতিনকে দেখলেন। তারপর ঝরঝরে বাংলায় মিতিনকে প্রশ্ন করলেন, তুমিই বুঝি ডিটেকটিভ?
হ্যাঁ। প্রজ্ঞাপারমিতা।
আর এটি? তোমার বোন?
দিদির মেয়ে। ঐন্দ্ৰিলা।
তোমাদের আজকাল এরকম খটোমটো নাম হয় কেন?
এখন সকলের আনকমনের দিকে ঝোঁক তো। মিতিন হাসল।
ও। আমি জোনাথন জোনাথন মাইকেল। এসো, ঘরে এসো।
ঢুকেই ঘরখানা জরিপ করে ফেলল টুপুর। প্রকাণ্ড সাইজ। স্কোয়ার শেপ। বড় বড় দরজা জানলা। উঁচু উঁচু সিলিং। সবুজ স্কার্টিং করা ঝকঝকে লাল মেঝে। লাল-নীল-সবুজ-বেগুনি কাচ আৰ্চ করে বসানো আছে জানলার মাথায়। বন্ধ জানলায় দুটো করে পাল্লা। কাঠের। কাচের ঘরে কী সুন্দর সুন্দর আসবাব। এক দেওয়ালে তিন পাল্লার আয়না বসানো অপরূপ ডিসপ্লে ক্যাবিনেট। দুকোণে দুখানা কারুকাজ করা কাঠের কর্নার ক্যাবিনেট। প্রকাণ্ড প্ৰকাণ্ড সোফা, কাচ বসানো সেন্টার টেবিল। টেবিলের কাঠের রং মিশকালো। আবলুশ নাকি? ঘরের মধ্যিখানে পাতা আছে পুরু কাৰ্পেট। ভারী নরম, নিশ্চয়ই কাশ্মীরি। রংটা অবশ্য একদমই জ্বলে গেছে, ইরানি কাজ। প্রায় বোঝাই যায় না। গোটাতিনেক বেঁটে বেঁটে কাচের আলমারি আছে ঘরে, প্রত্যেকটাই পোর্সিলিনের পুতুল ঠাসা। আছে একখানা শ্বেতপাথরের টেবিল, তার ওপরে চোঙালা গ্রামাফোন। পাশেই। টেলিফোনটা অবশ্য ব্রিটিশ আমলের ফার্নিচারের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। আধুনিক স্ট্যান্ডের ওপর রাখা টিভিটাও। দেওয়ালেও কত কী যে আছে। মোষের শিং, হরিণের মাথা, ক্রস করা ঢাল তলোয়ার শিরস্ত্রাণ, ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি, বাঁধানো ফোটোগ্রাফে মাদার মেরির কোলে ছোট্ট যিশু।
ঘরের দুখানা ফ্যানই চালিয়ে দিলেন জোনাথন। টিউবলাইট জ্বালালেন। সোফায় বসতে বসতে উৎপলকে বললেন, মিসেস জোনসকে একটু চা-টা করতে বলো।
টুপুর তাড়াতাড়ি বলল, আমি চা খাই না।
তবে সফ্ট ড্রিংকস নাও। আজ খুব গরম, ভাল লাগবে।
ঘরে ঢুকে বাইরের উৎকট ততটা আর টের পাচ্ছিল না টুপুর। যা পুরু দেওয়াল। চার ব্লেডের পাখা দুটো আয়েশ করে ঘুরছে বটে, তবে হাওয়া ভারী মিঠে। শরীর জুড়িয়ে যায়।
উৎপল অন্দরে যাওয়া মাত্র জোনাথন টানটান হয়ে বসেছেন। গলা নামিয়ে বললেন, শোনো, তোমাদের প্রথমেই চুপি চুপি একটা কথা বলে নিই। আমার মেয়ে-জামাইয়ের ধারণা কিন্তু ভুল। আমার বাড়িতে কোনও প্রোমোটারের হামলা হচ্ছে না।
মিতিন বলল, কিন্তু উৎপলবাবুর মুখে যে শুনলাম আপনাকে কে ভয় দেখিয়ে গেছে?
সুরজমল? সে একদিন চেলাচামুণ্ডা নিয়ে এসেছিল বটে, কিন্তু সে তো লোভ দেখাতে। কত টাকার অফার দিয়ে গেছে জানো? পঞ্চাশ লাখ নগদ, প্লাস দুখানা ক্ল্যাট। জোনাথন মাইকেলকে ঈষৎ বিষণ্ন দেখাল, কিন্তু আমি কী করে রাজি হই বলো? এ বাড়িতে ন্যান্সি মারা গেছে, আমার মা মারা গেছেন…। ন্যান্সি মানে মির্নার মা। তাদের কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এ বাড়ির আনাচে কানাচে। বাড়ি ভাঙলে তারাও মুছে যাবে না?
হুম। কিন্তু শুনছিলাম যে সুরজমল লোক ভাল নয়, সে আপনার অনিষ্ট করতে পারে?
অনিষ্ট মানে কী? মেরে ফেলা? ফেলুক। মরলে তো দেখতে আসব না কী হচ্ছে। অবশ্য যদি আমিও না ভূত হয়ে ঘুরি।
আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?
ভূত তো আছেই। মানুষ যদি শান্তিতে না মরতে পারে, তা হলে তার আত্মা কখনওই তার প্রিয় জায়গা ছেড়ে যেতে পারে না। শুনেছ নিশ্চয়ই, এ বাড়িতেও সেরকম একজন রয়ে গেছেন।
জোনাথনের স্বর এমন দৃঢ়, যে টুপুরের গা শিরশির করে উঠল। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, মানে যিনি বন্ধ ঘরের ফার্নিচার নাড়ান?
ঠিক তাই। উৎপল নিশ্চয়ই বলেছে এ বাড়িতে একটা সুইসাইডের ঘটনা ঘটেছিল?
সুইসাইড বলেননি। ওঁরা বলছিলেন আনন্যাচারাল ডেথ।
নিজের পিস্তল নিজের গলায় ঠেকিয়ে গুলি করেছিলেন তিনি। মার কাছে শুনেছি, তিনিই নাকি এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা।
কী নাম? কত সালে মারা গেছেন?
রবার্ট ম্যাকগ্রেগর। আমার মার দিদিমার বাবা মারা গেছিলেন। এইটিন সিক্সটি ফোরে।
স্কটল্যান্ডের লোক?
ইয়েস। অ্যাবারডিনের। আমার মা অবশ্য আইরিশ। মাকে এ-বাড়ি উইল করে দিয়ে গেছিলেন আমার দিদিমা। বাড়িটা যে প্রোমোটারকে দিতে চাই না এটাও তার একটা কারণ। নিজের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি হলে যা খুশি করা যায়, কিন্তু মার উপহার পাওয়া বাড়ি আমি বেচব কোন স্পৰ্ধায়?
আপনার বাবার বাড়ি কোথায় ছিল?
গলপুরে।
আপনার বাবা বিহারি ক্রিস্টান?
না। তিনি বাঙালি হিন্দু। জোনাথন হাসলেন, নাম সুরেন ভাদুড়ি। মাকে বিয়ে করে বাবা ক্রিস্টান হন। মাইকেল মধুসূদনের খুব ভক্ত ছিলেন বাবা, তাই নাম নিয়েছিলেন সুরেন মাইকেল। সেই সূত্রে আমরাও মাইকেল। এবং আমিই ফার্স্ট জেনারেশান অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। টুপুর এতক্ষণে বুঝতে পারল কেন জোনাথন মাইকেলকে এত বাঙালি বাঙালি লাগছিল। কেনই বা প্রথম দর্শনে ইউরোপিয়ান মনে হয়েছিল মির্নাকে। নিৰ্ঘাত মির্না তার ঠাকুরমার মতো হয়েছে। ডিক মাঝামাঝি। গায়ের রঙে, চেহারায়, মুখশ্রীতে। না পুরোপুরি এদেশি, না পুরোপুরি ওদেশি।
মিতিন নড়েচড়ে বসেছে। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জন্ম থেকেই কলকাতায়?
না। ছোটবেলায় ভাগলপুরেই ছিলাম। বাবার মৃত্যু পর্যন্ত।
আপনার বাবা ভাগলপুরেই থেকে গেছিলেন?
বাবা ছিলেন খুব জেদি মানুষ। তিনি ইউরোপিয়ান বিয়ে করেছিলেন বলে আমার ঠাকুরদা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। ঠাকুরদাকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ভাগলপুরের পাট চোকাতে রাজি হননি বাবা। ভাগলপুরেই খেটেখুটে একটা বেকারি খুলেছিলেন। কারখানায় কেক প্যাটিস পাউরুটি বানানো হত। ক্ৰমে ক্ৰমে বিশাল নাম হয়ে যায় মাইকেল্স বেকারির। পরে অবশ্য ঠাকুরদার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক খানিকটা জুড়েছিল। ছেলেকে সম্পত্তি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করেননি তিনি, সামান্য কিছু ভাগ দিয়েছিলেন। মাই গ্র্যান্ডপা ওয়াজ এ ফেমাস ডক্টর। ভাগলপুরের খরমনচকে তার বিস্তর জমিজায়গা ছিল। মূল বাড়ির ভাগ না দিলেও বুড়ানাথ মন্দিরের কাছে ছোট্ট একটা বাড়ি তিনি বাবার নামে লিখে দিয়েছিলেন। বাবা নিজেও অবশ্য ভাগলপুরে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। ভিখানপুরে। চার্চ রোডের ওপর। বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যাওয়ার পর মা ভাগলপুরের বেকারিটা বেচে দেন। দু বাড়িতেই ভাড়া বসিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। আমার তখন বয়স সতেরো।
আপনি কি বাবা-মার একমাত্র সন্তান?
আমার এক দিদি ছিল। বাবার মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে প্ৰভু যিশু তাকে টেনে নেন। স্মল পক্স। পর পর দুটো বড় আঘাত পেয়ে মার ভাগলপুর থেকে মন উঠে গিয়েছিল, আর কখনও ওখানে ফিরে যাননি। আমাদের বেকারির ম্যানেজার গণপতি চৌধুরী খরমনচকে থাকেন। উনিই কিনে নিয়েছিলেন বেকারিটা। ভাল লোক। আমাদের বাড়ি দুটোরও দেখাশুনো করতেন, মানি অর্ডার করে ভাড়াও পাঠিয়ে দিতেন নিয়মিত।
দিতেন কেন? এখন ভাড়া পান না?
এই তো জানুয়ারির শেষে দুটো বাড়িই বিক্রি হয়ে গেল। মেয়ে-জামাইকে সঙ্গে নিয়ে আমিও শেষবারের মতো ভাগলপুর ঘুরে এলাম। অবশ্য শেষ যাওয়াটা সুখের হয়নি।
মিতিন জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কেন? কথা থমকে গেল। কাচের ঐলিতে একগাদা খাবার-দাবার সাজিয়ে ঘরে এসেছেন এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলা। বয়স বছর পঞ্চাশ, কালো মতন, মোটাসোটা, পরনে ছিটের গাউন। মিসেস জোনস। সঙ্গে উৎপল।
মধুর হেসে মিসেস জোনস বললেন, গুড ইভনিং গার্লস। কথা পরে হবে। আগে খেয়ে নাও।