[‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় লিখিত ইংরেজী প্রবন্ধের অনুবাদ]
সত্যই, এ এক নৃতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। হয়তো সম্প্রতি আবিষ্কৃত সুমাত্রার অর্ধবানরের কঙ্কালটিও এখানে পাওয়া যাইবে। ডলমেনেরও অভাব নাই। চকমকি-পাথরের অস্ত্রশস্ত্রও যে-কোন স্থানে মাটি খুঁড়িলেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাইবে। হ্রদ-অধিবাসিগণ, অন্ততঃ নদীতীরবাসিগণ—নিশ্চয়ই কোন কালে সংখ্যায় প্রচুর ছিলেন। গুহাবাসী এবং বৃক্ষপত্র-পরিহিত মানুষ এখনও বর্তমান। বনবাসী আদিম মৃগয়াজীবীদের এখনও এদেশের নানা অঞ্চলে দেখিতে পাওয়া যায়। তাছাড়া নেগ্রিটো-কোলারীয়, দ্রাবিড় এবং আর্য প্রভৃতি ঐতিহাসিক যুগের নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যও উপস্থিত। ইহাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে তাতার, মঙ্গোলবংশসম্ভূত ও ভাষাতাত্ত্বিকগণের তথাকথিত আর্যদের নানা প্রশাখা-উপশাখা আসিয়া মিলিত হয়। পারসীক, গ্রীক, ইয়ুংচি, হুন, চীন, সীথিয়ান—এমন অসংখ্য জাতি মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে; য়াহুদী, পারসীক, আরব, মঙ্গোলীয় হইতে আরম্ভ করিয়া স্কাণ্ডিনেভীয় জলদস্যু ও জার্মান বনচারী দস্যুদল অবধি—যাহারা এখনও একাত্ম হইয়া যায় নাই—এই-সব বিভিন্ন জাতির তরঙ্গায়িত বিপুল মানবসমুদ্র—যুধ্যমান, স্পন্দমান, চেতনায়মান, নিরন্তন পরিবর্তনশীল—ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়া ক্ষুদ্রতর জাতিগুলিকে আত্মসাৎ করিয়া আবার শান্ত হইতেছে—ইহাই ভারতবর্ষের ইতিহাস।
প্রকৃতির এই উন্মাদনার মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিযোগী জাতি একটি পন্থা উদ্ভাবন করিয়া আপন উন্নততর সংস্কৃতির সাহায্যে ভারতের অধিকাংশ জনগণকে আয়ত্তে আনিতে সমর্থ হইল। এই উন্নত জাতি নিজেদের ‘আর্য’ বলিত এবং তাহাদের পন্থা ছিল ‘বর্ণাশ্রমাচার’—তথাকথিত জাতিভেদ-প্রথা।
আর্যজাতির জনসাধারণ অবশ্য জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অনেকগুলি সুবিধা নিজেদের হাতে রাখিয়া দিয়াছিল। তবু জাতিভেদ-প্রথা চিরদিনই খুব নমনীয় ছিল; মাঝে মাঝে নিম্নস্তরের জাতিগুলির সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য ইহা একটু অতিরিক্ত নত হইয়া পড়িত।
ধনসম্পদ বা তরবারি দ্বারা নয়—আধ্যাত্মিকতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও শোধিত বুদ্ধি দ্বারাই এই আর্যজাতি অন্ততঃ তত্ত্বগতভাবে সমগ্র ভারতবর্ষকে চালিত করিয়াছিল। ভারতের প্রধান জাতি আর্যদের শ্রেষ্ঠ বর্ণ—ব্রাহ্মণ।
অন্যান্য দেশের সামাজিক পদ্ধতি হইতে আপাততঃ পৃথক্ মনে হইলেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করিলে আর্যদের জাতবিভাগপ্রথা দুইটি ক্ষেত্র ছাড়া খুব পৃথক্ বলিয়া মনে হইবে না।
প্রথমতঃ অন্য সব দেশে শ্রেষ্ঠ সম্মান লাভ করেন অস্ত্রধারী ক্ষত্রিয়েরা। রাইন নদীর তীরবর্তী কোন অভিজাতবংশীয় দস্যুকে নিজের পূর্বপুরুষরূপে আবিষ্কার করিতে পারিলে রোমের পোপ খুবই খুশি হইবেন। ভারতবর্ষে সর্বোচ্চ সম্মান লাভ করেন প্রশান্তচিত্ত পুরুষগণ—শ্রমণ, ব্রাহ্মণ, সাধক ও মহাপুরুষেরা।
ভারতের শ্রেষ্ঠ নরপতি অতীতের কোন অরণ্যচারী সংসারবিরাগী, সর্বস্বত্যাগী, ভিক্ষান্নজীবী, ইহকাল ও পরকালের তত্ত্বালোচনায় জীবনযাপনকারী ঋষিকে পূর্বপুরুষ বলিতে পারিলে আনন্দিত হইবেন।
দ্বিতীয়তঃ মাত্রাগত পার্থক্য। অন্য সব দেশে জাতিনির্ধারণের একক মাত্রা হিসাবে একজন নর বা নারীই যথেষ্ট। ধন, ক্ষমতা, বুদ্ধি বা সৌন্দর্যের দ্বারা যে-কেহ নিজ জন্মগত জাতির ঊর্ধ্বে যে-কোন স্তরে আরোহণ করিতে পারে।
ভারতবর্ষে সমগ্র গোষ্ঠীটিই জাতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে একক-রূপে গৃহীত। এখানেও নিম্নজাতি হইতে উচ্চতর বা উচ্চতম জাতিতে উন্নীত হইতে পারা যায়, তবে এই পরার্থবাদের জন্মভূমিতে নিজ জাতির সকলকে লইয়া একত্র উন্নত হইতে হইবে।
ভারতবর্ষে ব্যক্তিগত ঐশ্বর্য, ক্ষমতা বা অন্য কোন গুণের দ্বারা নিজ গোষ্ঠীর লোকেদের পশ্চাতে ফেলিয়া উন্নত জাতির লোকেদের সঙ্গে স্বাজাত্যের দাবী করিতে পার না। যাহারা তোমার উন্নতিতে সহায়তা করিয়াছে, তাহাদিগকে বঞ্চিত করিয়া ঘৃণা করিতে পার না। যদি কেহ উচ্চতর জাতিতে উন্নত হইতে চায়, তবে তাহার স্বজাতিকেও উন্নত করিতে হইবে—তাহা হইলে আর কোন কিছু বাধা দিতে পারিবে না।
ইহাই ভারতীয় স্বাঙ্গীকরণপদ্ধতি—সুদূর অতীত হইতে এই প্রচেষ্টা চলিয়া আসিতেছে। অন্য যে-কোন দেশ অপেক্ষা ভারতবর্ষের পক্ষে এ-কথা আরও বেশী করিয়া খাটে যে, আর্য ও দ্রাবিড়—এই বিভাগ কেবল ভাষাতাত্ত্বিক বিভাগমাত্র, করোটিতত্ত্বগত (craniological) বিভাগ নহে, সে-ধরনের বিভাগের পক্ষে কোন দৃঢ় যুক্তিই নাই।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় নামগুলির ক্ষেত্রেও এইরূপ। উহারা কেবল গোষ্ঠীর মর্যাদাসূচক, এই গোষ্ঠীও সর্বদা পরিবর্তনশীল, এমন কি পরিবর্তনের শেষ ধাপে উপনীত হইয়া যখন বিবাহনিষেধ (non-marriage) প্রভৃতির মধ্যেই অন্য সব প্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ হইয়া আসিতেছে, তখনও নিম্নতর জাতি বা বিদেশ হইতে আগত লোকদিগকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করিয়া এই গোষ্ঠীগুলি প্রসারিত হইতেছে।
যে-বর্ণের হস্তে তরবারি রহিয়াছে, সেই বর্ণই ক্ষত্রিয় হইয়া দাঁড়ায়; যাহারা বিদ্যাচর্চা লইয়া থাকে, তাহারাই ব্রাহ্মণ; ধনসম্পদ্ যাহাদের হাতে তাহারাই বৈশ্য।
যে-গোষ্ঠী আপন অভীষ্ট পর্যায়ে উন্নীত হইয়াছে, স্বাভাবিকভাবেই সে-গোষ্ঠী নবাগতদিগের নিকট হইতে নানা উপ-বিভাগের দ্বারা নিজেদের পৃথক্ করিয়া রাখে। কিন্তু শেষ অবধি মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া যায়। আমাদের চোখের উপর ভারতের সর্বত্র এইরূপ ঘটিতেছে।
স্বাভাবিকভাবেই যে-গোষ্ঠীটি নিজেদের উন্নীত করিয়াছে, তাহারা নিজেদের জন্য সব সুবিধা সংরক্ষিত করিয়া রাখিতে চায়। সুতরাং উচ্চবর্ণেরা—বিশেষতঃ ব্রাহ্মণেরা—যখনই সম্ভব হইয়াছে, রাজার সাহায্য এবং প্রয়োজন হইলে অস্ত্রের দ্বারাও নিম্নবর্ণের লোকেদের উচ্চাশা দমন করিবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু প্রশ্ন এই, তাহারা কি সফল হইয়াছিল?নিজেদের পুরাণ ও উপ-পুরাণগুলি যত্ন সহকারে লক্ষ্য দেখ—বিশেষতঃ বৃহৎ পুরাণগুলির স্থানীয় সংস্করণগুলির প্রতি লক্ষ্য কর; দৃষ্টির সম্মুখে ও চারিদিকে যাহা ঘটিতেছে, ভাল করিয়া লক্ষ্য কর—উত্তর পাইবে।
আমাদের বিভিন্ন বর্ণবিভাগ এবং নানা উপ-বিভাগের মধ্যে বর্তমান বিবাহ-প্রথাকে সীমাবদ্ধ রাখা (যদিচ এই রীতি সর্বত্র পালিত হয় না) সত্ত্বেও আমরা পুরাপুরি মিশ্রিত জাতি।
ভাষাতাত্ত্বিকদের ‘আর্য’ ও ‘তামিল’ এই শব্দ দুইটির নিহিত তাৎপর্য যাহাই হউক না কেন, এমন কি বাদ ধরিয়াও লওয়া যায় যে, ভারতীয়দের এই দুই বিশিষ্ট শাখা ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্ত-পার হইতে আসিয়াছিল, তবু অতি প্রাচীনকাল হইতে এই বিভাগ ভাষাতত্ত্বগত—রক্তগত নহে। বেদে দস্যুদের কুৎসিত আকৃতি সম্বন্ধে যে-সকল বিশেষণ প্রয়োগ করা হইয়াছে, তাহাদের কোনটিই মহান্ তামিলভাষীদের সম্বন্ধে প্রযোজ্য নহে। বস্তুতঃ আর্য ও তামিলদের মধ্যে কাহাদের দৈহিক সৌন্দর্য বেশী—এ সম্বন্ধে যদি কোন প্রতিযোগিতা হয়, তবে উহার ফলাফল সম্বন্ধে কোন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিই ভবিষ্যদ্বাণী করিতে সাহসী হইবে না।
বর্ণ-বিশেষের উৎপত্তি সম্বন্ধে দাম্ভিকতাপূর্ণ মতবাদ অসার কল্পনামাত্র। দুঃখের সহিত বলিতে হয়, এই মতবাদ দাক্ষিণাত্যের মত অন্য কোথাও এতটা সাফল্য-লাভ করে নাই।
ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণের উৎপত্তির ইতিহাস লইয়া আমরা যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করি নাই, সেইরূপ ইচ্ছা করিয়াই আমরা দাক্ষিণাত্যের এই সামাজিক অত্যাচারের কথা বেশী আলোচনা করিব না। মান্দ্রাজ-প্রদেশে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণদের মধ্যে যে উত্তেজনা বিদ্যমান, তাহার উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে।
আমরা বিশ্বাস করি যে, ভারতবর্ষের বর্ণাশ্রমধর্ম মানবজাতিকে প্রদত্ত ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সম্পদসমূহের অন্যতম। আমরা ইহাও বিশ্বাস করি যে, অনিবার্য ত্রুটিবিচ্যুতি, বৈদেশিক অত্যাচার, সর্বোপরি ব্রাহ্মণ-নামের অযোগ্য কিছুসংখ্যক ব্রাহ্মণের পর্বতপ্রমাণ অজ্ঞতা ও দম্ভের দ্বারা বর্ণাশ্রমধর্মের স্বাভাবিক সুফল-লাভ ব্যাহত হইলেও এই বর্ণাশ্রমধর্ম ভারতে আশ্চর্য কীর্তি স্থাপন করিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও ভারতবাসীকে পরম লক্ষ্যের অভিমুখে পরিচালিত করিবে।
ভারতের আদর্শ পবিত্রতাস্বরূপ ভগবৎকল্প ব্রাহ্মণদের একটি জগৎসৃষ্টি—মহাভারতের মতে পূর্বে এইরূপ ছিল, ভবিষ্যতেও এইরূপ হইবে। দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণগণের প্রতি আমরা সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইতেছি, তাঁহারা যেন ভারতবর্ষের এই আদর্শ ভুলিয়া না যান—মনে রাখেন।
যিনি নিজেকে ব্রাহ্মণ বলিয়া দাবী করেন, তিনি নিজের সেই পবিত্রতার দ্বারা এবং অপরকেও অনুরূপ পবিত্র করিয়া নিজের দাবী প্রমাণ করুন। ইহার বদলে বেশীর ভাগ ব্রাহ্মণই ভ্রান্ত জন্মগত গর্ব লালন করিতেই ব্যস্ত; স্বদেশী অথবা বিদেশী যে-কোন পণ্ডিত এই মিথ্যাগর্ব ও জন্মগত আলস্যকে বিরক্তিকর কুতর্কের দ্বারা লালন করেন, তিনিই ইহাদের সর্বাপেক্ষা প্রিয় হইয়া দাঁড়ান।
ব্রাহ্মণগণ, সাবধান, ইহাই মৃত্যুর চিহ্ন। তোমাদের চারিপাশের অব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত করিয়া তোমাদের মনুষ্যত্ব—ব্রাহ্মণত্ব প্রমাণ কর, তবে প্রভুর ভাবে নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দূষিত গলিত অহঙ্কারের দ্বারা নয়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উদ্ভট সংমিশ্রণের দ্বারাও নয়—শুধু সেবাভাবের দ্বারা। যে ভালভাবে সেবা করিতে জানে, সে-ই ভালভাবে শাসন করিতে পারে।
অব্রাহ্মণেরাও বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করিতে সাহায্য করিতেছেন—মূল সমস্যা-সমাধানের পক্ষে এ ধরনের কাজ নিতান্ত বিঘ্নস্বরূপ। অহিন্দুরাও এই পারস্পরিক ঘৃণার বিস্তারে সহায়তা করিতেছেন মাত্র।
বিভিন্ন বর্ণের এই অন্তর্দ্বন্দ্বের দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হইবে না; যদি এই বিরোধের আগুন একবার প্রবলভাবে জ্বলিয়া উঠে, তাহা হইলে সর্বপ্রকার কল্যাণমূলক প্রগতিই কয়েক শতাব্দীর জন্য পিছাইয়া যাইবে। ইহা বৌদ্ধদের রাজনীতিক বিভ্রান্তির পুনরাবর্তন হইয়া দাঁড়াইবে।
এই ঘৃণা ও অজ্ঞতাপ্রসূত কোলাহলের মধ্যে পণ্ডিত শবরীরয়ন ১ একটিমাত্র যুক্তি ও বুদ্ধির পন্থা অনুসরণ করিতেছেন। মূর্খোচিত নিরর্থক কোলাহলে মহামূল্য প্রাণশক্তি নষ্ট না করিয়া তিনি ‘সিদ্ধান্তদীপিকা’য় ‘আর্য-তামিলগণের সংমিশ্রণ’ নামক প্রবন্ধে অতিসাহসিক পাশ্চাত্য ভাষাবিদগণের সৃষ্ট মতবাদের কুয়াশাই শুধু ভেদ করেন নাই, অধিকন্তু দাক্ষিণাত্যের জাতিসমস্যা-সমাধানে সহায়তা করিয়াছেন।
ভিক্ষার দ্বারা কেহ কখনও কিছু পায় নাই। আমরা যাহা পাইবার যোগ্য, তাহাই লাভ করিয়া থাকি। যোগ্যতার প্রথম ধাপ পাওয়ার ইচ্ছা; আমরা—নিজেদের যাহা পাওয়ার যোগ্য বলিয়া মনে করি, তাহাই লাভ করিয়া থাকি।
বিশেষতঃ দাক্ষিণাত্যবাসীদের জন্য তথাকথিত ‘আর্য’-মতবাদের জাল এবং ইহার আনুষঙ্গিক দোষগুলি শান্ত অথচ দৃঢ় সমালোচনার দ্বারা পরিশুদ্ধ করিয়া লওয়া প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রয়োজন আর্যজাতির পূর্ববর্তী মহান্ তামিল-সভ্যতা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ ও যথার্থ গৌরববোধ।
নানা পাশ্চাত্য মতবাদ সত্ত্বেও আমাদের শাস্ত্রসমূহে ‘আর্য’ শব্দটি যে-অর্থে দেখিতে পাই—যাহা দ্বারা এই বিপুল জনসঙ্ঘকে ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করা হয়—সেই অর্থটিই আমরা গ্রহণ করিতেছি। এ-কথা সব হিন্দুর সম্বন্ধেই প্রযোজ্য যে, এই আর্যজাতি সংস্কৃত ও তামিল এই দুই ভাষাভাষীর সংমিশ্রণে গঠিত। কয়েকটি স্মৃতিতে যে শূদ্রদিগকে এই অভিধা হইতে বাদ দেওয়া হইয়াছে, তাহা দ্বারা ইহাই বুঝায় যে, ঐ শূদ্রেরা এখনও নবাগত শিক্ষার্থী মাত্র, ভবিষ্যতে উহারাও আর্যজাতিতে পরিণত হইবে।
যদিও আমরা জানি যে, পণ্ডিত শবরীরয়ন কিছুটা অনিশ্চয়তার পথে বিচরণ করিতেছেন, যদিও বৈদিক নাম ও জাতিসমূহ সম্বন্ধে তাঁহার ক্ষিপ্র মন্তব্যসমূহের সহিত আমরা একমত নহি, তবুও আমরা এ-কথা জানিয়া আনন্দিত যে, তিনি ভারতীয় সভ্যতার মহান্ উৎস সংস্কৃতির (সংস্কৃতভাষী জাতিকে যদি সভ্যতার জনক বলা যায়) পূর্ণ পরিচয়লাভের পথে অগ্রসর হইয়াছেন।
তিনি যে প্রাচীন তামিলগণের সঙ্গে আক্কাদো-সুমেরীয়গণের জাতিগত ঐক্য-সম্বন্ধীয় মতবাদের উপর জোর দিয়াছেন, তাহাতেও আমরা আনন্দিত। ইহার ফলে অন্য সমুদয় সভ্যতার পূর্বে যে-সভ্যতাটি বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল—যাহার সহিত তুলনায় আর্য ও সেমিটিক সভ্যতাদ্বয় শিশুমাত্র—সেই সভ্যতার সহিত আমাদের রক্তসম্বন্ধের কথা ভাবিয়া আমরা গৌরব বোধ করিতেছি।
আমরা মনে করি, মিশরবাসীদের পন্ট্ই মালাবার দেশ নয়, বরং সমগ্র মিশরীয়গণ মালাবার-তীর হইতে সমুদ্র পার হইয়া নীলনদের বদ্বীপ-অঞ্চলে প্রবেশ করিয়া তীরে তীরে উত্তর হইতে দক্ষিণের দিকে গিয়াছিল। এই পন্ট্কে তাহারা পবিত্রভূমিরূপে সাগ্রহে স্মরণ করিত।
এই প্রচেষ্টাটি ঠিক পথে চলিয়াছে। সংস্কৃত সাহিত্য, দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রসমূ্হের মধ্যে তামিল ভাষা ও উপাদান যতই আবিষ্কৃত হইবে, ততই আরও বিশদ ও নিখুঁত আলোচনা দেখি দিবে। তামিল-ভাষার বৈশিষ্ট্য যাঁহারা মাতৃভাষার ন্যায় আয়ত্ত করিয়াছেন, তাঁহাদের অপেক্ষা এ-কাজে যোগ্যতর আর কাহাকে পাওয়া যাইবে?
আমরা বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী—আমরা বেদের সংস্কৃতভাষী পূর্বপুরুষদের জন্য গর্ব অনুভব করি; এ পর্যন্ত পরিচিত সর্বপ্রাচীন সভ্যজাতি তামিলভাষীদের জন্য আমরা গর্বিত, এই দুই সভ্যতার পূর্ববর্তী অরণ্যচারী মৃগয়াজীবী কোল পূর্বপুরুষগণের জন্য আমরা গর্বিত, মানবজাতির যে আদিপুরুষেরা প্রস্তরনির্মিত অস্ত্রশস্ত্র লইয়া ফিরিতেন, তাঁহাদের জন্য আমরা গর্বিত, আর যদি বিবর্তনবাদ সত্য হয়, তবে আমাদের সেই জন্তুরূপী পূর্বপুরুষদের জন্যও আমরা গর্বিত—কারণ তাহারা মানবজাতিরও পূর্ববর্তী। জড় অথবা চেতন—এই সমগ্র বিশ্ব-জগতের উত্তরপুরুষ বলিয়া আমরা গর্বিত। আমরা যে জন্মগ্রহণ করি, কাজ করি, যন্ত্রণা পাই, এজন্য আমরা গর্ব বোধ করি—আবার কর্মাবসানে আমরা মৃত্যুর মধ্য দিয়া মায়াতীত জগতে প্রবেশ করি, এজন্য আরও বেশী গর্ব অনুভব করি।