০৩. আজ ঘুম ভেঙে গেল সাতসকালে

আজ ঘুম ভেঙে গেল সাতসকালে। একটু আলস্য লাগছিল বলে অর্জুন মর্নিং ওয়াকে বের হল না। বিছানায় শুয়ে ডরোথির কথা ভাবল সে। কাল রাত্রে মেয়েটা ঠিকঠাক ছিল কিনা খোঁজ নিতে হবে। অমল সোম যখন তার কাছে পাঠিয়েছেন তখন একটা দায়িত্ব তো থাকছেই। তারপর তারিণী সেনের কথা মনে এল। কমলাকান্ত রায় অথবা দেবদাস মিত্রের চেয়ে তারিণী সেন অনেক বেশি আকর্ষক চরিত্র।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই তারিণী সেন অপরাধী ছিল। কুখ্যাত ডাকাত। তার কাছে ক্ষমা চাইবেন কেন রিচার্ডসাহেব? এই লোকটি তাই রিচার্ডসাহেবের ডায়েরিতে লেখা লোক নাও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, অমন কুখ্যাত মানুষের বিরুদ্ধে যখন সাক্ষ্য দেওয়ার মানুষ পাওয়া যায়নি, তখন তার দুটো হাত কেটে ফেলার সাহস কে দেখাবে? বিপ্লবীরা বদলা নেয়নি তো? দোমহনি থেকে ময়নাগুড়ি অঞ্চলটায় সে ঘুরে বেড়াত! ডাকাতি ছেড়ে দেওয়ার পর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খবর সাহেবদের দিত। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু এ সবের সঙ্গে রিচার্ড সাহেবের সম্পর্ক কোথায়? তবু, এত বছর পরেও চরিত্রটা তাকে টানছে। অর্জুন ঠিক করল সে ময়নাগুড়িতে গিয়ে হরিদাস বর্মণের সঙ্গে দেখা করবে।

মা ঘরে ঢুকলেন, কী রে, শরীর খারাপ নাকি? অর্জুন হাসল, না। আরাম করছি।

তোকে এক ভদ্রলোক ডাকছেন। ওঠ।

কে?

নাম জিজ্ঞেস করিনি। বয়স্ক মানুষ। সেই মেয়েটার জন্যে জলখাবার করে দিচ্ছি। হ্যাঁ রে, আমার রান্না ওর পছন্দ হয়েছে তো?

অর্জুন বিছানা থেকে নামল, খুব। তবে জলখাবার লাগবে না। ওখানেই ব্যবস্থা হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে গেল।

বাইরের ঘরে এসে অর্জুন অবাক! সুধীর মৈত্র বসে আছেন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রলোক খুব বিচলিত। সে জিজ্ঞেস করল, এ কী, আপনি?

আসতে হল। খোঁজ খবর নিয়ে চলে এলাম। খুব সমস্যা।

বলুন।

কাল মাঝরাতে দুজন লোক এসেছিল বাড়িতে।

মাঝরাত্রে?

হ্যাঁ। তখন প্রায় বারোটা। আমি অবশ্য জেগে ছিলাম। হারু সান্যাল মশাইয়ের দি রাজবংশীস অফ নর্থবেঙ্গল বইটা আবার পড়ছিলাম। আটষট্টি সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল বইটা। এই সময় ওরা দরজায় নক করল।

তারপর?

আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। ওরা ক্ষমা চেয়েছিল। অনেক কষ্ট করে আমার সন্ধান পেয়ে শিলিগুড়ি থেকে এসেছে ওরা। তারিণী সেন নামে কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথা আমি জানি কি না তা ওরা জানতে চেয়েছিল।

সে কী? অর্জুন চমকে উঠল।

হ্যাঁ। আমিও অবাক হয়ে যাই। এত বছরে কেউ আমাকে ওই প্রশ্ন করেনি। আর একই দিনে দুজন, তুমি এবং ওরা, তারিণী সেনের খবর জানতে চাইল। বুঝলাম এর পেছনে রহস্য আছে। তুমি জলপাইগুড়ির ছেলে। আমার কাছে আশা করব মিথ্যে কথা বলবে না। তারিণী সেন সম্পর্কে যারা আগ্রহী, তাদের মতলব ভাল হতে পারে না।

অর্জুন ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, আমি আপনার কাছে সত্যি কথা বলেছি। ওই বিদেশিনী আমাকে বলেছেন যে, তাঁর দাদু তিনজন মানুষের নাম ডায়েরিতে লিখে গেছেন যাঁদের কাছে ক্ষমা চাইতে তিনি এদেশে এসেছেন।

তুমি এটা বিশ্বাস করছ?

এখনও অবিশ্বাস করার মতো কোনও কারণ ঘটেনি। অবশ্য শুনলে একটু অবাক হতেই হয়। তবে মানুষ তো অনেক অদ্ভুত কান্ড করে।

কাল রাত্রে লোক দুটোকে আমি কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা বলল তারিণী সেনের কাহিনী ভাসা-ভাসা শুনে মনে হয়েছে ভাল সিনেমা করা যায়। কিন্তু আরও বিস্তৃত জানার জন্যে লোকটার কাছে যাওয়া দরকার বলেই মিথ্যে কী আছে, তারিণী আমাকে এসেছে।

আপনি বললেন ওরা শিলিগুড়ি থেকে এসেছিল।

তাই বলেছে।

বাঙালি?

একজন বাঙালি, অন্যজন নয়। তার কথা জিজ্ঞেস করিনি।

তারপর?

আমি যখন জানালাম ওই নামের কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীকে চিনি না, তখন ওরা কিছুক্ষণ শক্ত মুখে বসে রইল। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়জন ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, স্বাধীনতার আগে যে তারিণী সেনের নাম আপনি জানেন, তার কথা বলুন।

আমি খুব রেগে গেলাম। এত রাত্রে যেচে বাড়িতে ঢুকে ওরা যেন আমাকে আদেশ করছে। আমি কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। বাঙালিটি বলল, আপনি এত রাগ করছেন কেন? আপনি বলুন এবং তার জন্যে পারিশ্রমিক পাবেন।

কথাটা শুনে আমি এত রেগে গিয়েছিলাম যে, ওরা আর অপেক্ষা করেনি। আমি রাত্রে ভাল করে ঘুমাতে পারিনি। এই লোকগুলোর অ্যাটিচুড মোটেই ভাল নয়। তুমি না-হয় ম্যাক সাহেবের নাতনির অনুরোধে তারিণী সম্পর্কে জানতে আমার কাছে এসেছিলে, কিন্তু ওরা এল কেন? আমার কাছে কে পাঠাল?

আমাকে সন্তুদা বলেছিলেন আপনার কথা। অর্জুন বিনীত গলায় বলল।

ওদের কে বলেছে আমার কথা? শিলিগুড়ি থেকে মাঝরাত্রে সোজা আমার বাড়ির দরজায়? আমি যেন ইনফরমেশন সেন্টার। সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বসে আছি। বিড়বিড় করলেন সুধীর মৈত্র। আপনি থানায় একটু বলে রাখুন।

সকালে ফোন করেছিলাম। পঞ্চাশ বছর আগের একটা মানুষ সম্পর্কে জানতে এসেছিল শুনে ওরা পাত্তাই দিল না।

মা ভেতর থেকে ডাকতে অর্জুন ক্ষমা চেয়ে নিয়ে উঠল। চা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ট্রেতে দুধ, চিনি, চা আলাদা পটে নিয়ে ফিরল অর্জুন। সুধীর মৈত্র

সেদিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কালো চা খাই।

চুপচাপ চা খেলেন সুধীরবাবু। অর্জুনও কথা বলেনি। চা শেষ করে সুধীরবাবু বললেন, লোকটাকে নিয়ে সিনেমা বানাবে! ক্রিমিন্যালদের ছবি লোকে দ্যাখে?

দ্যাখে। খুব অ্যাকশন থাকে তো!

তারিণী সেনকে পুলিশ ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে নাইনটিন থার্টি এইটে। কিন্তু কোনও শাস্তি হয়নি তার। আমি কাল এটুকুই জানতে পেরেছি।

অর্জুন মাথা নাড়ল। সে যে মিল হোড়ের কাছ থেকে আরও কিছু তথ্য পেয়েছে, সেটা বলল না। সুধীরবাবু উঠে দাঁড়ালেন, আমি নিজের মনে পড়াশোনা করতে ভালবাসি, বাইরের লোক এসে ডিস্টার্ব করলে খুব অসুবিধে হয়। তা বলে ভেবো না তোমাকে আমি বাইরের লোক বলছি। চলি।

অর্জুন ভদ্রলোককে এগিয়ে দিল খানিকটা। ফিরে আসার সময় সে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সুধীরবাবুর বাড়িতে অত রাত্রে কারা গিয়েছিল? সন্তুদা যেভাবে তাকে সুধীরবাবুর খবর দিয়েছিল সেইভাবেই কি লোক দুটো খবর পেয়েছিল? সিনেমার ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। তার জন্য ওরা সকালবেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। বোঝাই যাচ্ছে, ওদের ধৈর্য ধরার মতো সময় ছিল না। কেন?

ডরোথি যেমন তারিণী সেনকে খুঁজছে ওর দাদুর শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে, তেমনই এদের কী কারণে একই সঙ্গে লোকটাকে দরকার হয়েছে? ব্যাপারটা যেহেতু রহস্যময়, তাই ডরোথিকে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, গত রাতে যারা সুধীব মৈত্রের কাছে গিয়েছিল, তারা ডরোথির জলপাইগুড়ির আসার খবর পেয়েছে এবং কোনও অজানা ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছে।

তৈরি হয়ে বাইক নিয়ে বের হল অর্জুন। তিস্তা ভবনের গেটে পৌঁছে সে ডরোথিকে দেখতে পেল। এই সকালবেলায় নরম রোদে লনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। পরনে হলদে ছোপ দেওয়া চমৎকার স্কার্ট। মাথায় রিবন। বয়স অনেক কম লাগছে।

গুড মর্নিং। অর্জুন হাসল।

গুড মর্নিং। সত্যি, সকালটা খুব সুন্দর! ওটা কী পাখি?

অর্জুন দেখল কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচু ডালে পাখিটা বসে আছে, আমি ইংরেজি নাম জানি না। বাংলায় বলে নীলকণ্ঠ।

ডরোথি মনে-মনে নামটা উচ্চারণের চেষ্টা করল, কিন্তু পাখিটা উড়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে তাকে বেশ হতাশ দেখাচ্ছিল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। ডিম সেদ্ধ, টোস্ট আর চা।

তোমার জন্যে একটা খবর আছে। ডরোথির মুখে হাসি ফুটল, তিন নম্বরের খবর পেয়েছ?

কিছুটা। কিন্তু খবর হচ্ছে ওই তারিণী সেন সম্পর্কে তুমি ছাড়া আরও দু জন মানুষ ইন্টারেস্টেড। তাঁরা ওর ওপর সিনেমা তৈরি করবেন।

ডরোথির মুখ শক্ত হয়ে গেল, কে বলল একথা?

ওরাই। অবশ্য আমাকে নয়। গতকাল আমি যে ভদ্রলোকের কাছে তারিণী সেনের খবর আনতে গিয়েছিলাম, তাঁর কাছেই ওরা রাত বারোটার সময় গিয়েছিল। আমার কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হচ্ছে না, ওরা সুধীরবাবুর কাছেই গেল কেন? জলপাইগুড়ি শহরে অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন যাঁরা পুরনো দিন নিয়ে কথা বলতে ভাল পারেন। তাঁদের কারও কাছে না গিয়ে ওরা! এটা কাকতালীয় ঘটনা বলে মনে করি না।

ডরোথি বলল, তোমাকে যিনি ওঁর কথা বলেছিলেন তেমনই আর-একজন ওদের একই নাম বলতে পারেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য তো আলাদা।

হ্যাঁ। তবে সেটা একই সময়ে বলে অস্বস্তি হচ্ছে। বিশেষ করে লোকটার অতীত ভাল নয়। তারিণী সেন কুখ্যাত ডাকাত ছিল। অর্জুন তাকাল ডরোথির দিকে। মেয়েটা পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা একটু সহজ করার জন্য সে বলল, আসলে সত্যসন্ধান করতে করতে এমন অভ্যেস তৈরি হয়েছে যে, কোনও কিছুকেই সহজ মনে গ্রহণ করতে পারি না।

তারিণী সেন কি এখনও বেঁচে আছে? ডরোথি জিজ্ঞেস করল।

জানি না। না থাকারই সম্ভাবনা। সময় তো কম বয়ে যায়নি।

উনি কোথায় থাকতেন?

ময়নাগুড়ি থেকে দোমহনির মধ্যে।

আমরা নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে পারি। কত দূরে?

বেশি দূর নয়। তিস্তা ব্রিজ পার হলেই দোমহনি। মিনিট কুড়ির পথ।

তা হলে চলো।

আমি বলি কি, তুমি গেস্ট হাউসেই থাকো; আমি ঘুরে আসি।

না। একা থাকতে একঘেয়ে লাগছে। আমি যাব।

অতএব ডরোথিকে পেছনের সিটে বসাতে হল। জলপাইগুড়ি শহরের রাস্তায় সাইকেল রিকশার ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। টাউন ক্লাবের পাশ দিয়ে অর্জুন তিস্তা ব্রিজের পথ ধরল। রাস্তায় অধিকাংশ মানুষ ঘুরে-ঘুরে তাদের দেখছে। এটা যে ডরোথির কারণে, তা বলা বাহুল্য। ডরোথি এখন রোদচশমা পরে নিয়েছে। ফলে তার মনের ভাব বোঝা সম্ভব নয়। কী রকম নির্বিকার দেখাচ্ছে।

এখন দুপাশে ফাঁকা মাঠ, নীল আকাশ মাথার ওপর, আর চমৎকার বাতাস শরীরে আলতো আঘাত করছে। পেছনে বসে ডরোথি বলল, কী আরাম।

অর্জুন কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছিল মেয়েটার বয়স নিশ্চয়ই বেশি নয়, শরীরটাই বড় হয়েছে শুধু। নইলে ওই দুটো লোককে নিয়ে সে এবং সুধীরবাবু যতটা বিচলিত হয়েছে, তার বিন্দুমাত্র ও হচ্ছে না কেন? সহজ-সরল মানুষদের। সুবিধে হল দুশ্চিন্তা চট করে তাদের আঁকড়ে ধরে না, ফলে ভাল থাকে।

তিস্তা ব্রিজে টোল ট্যাক্স দিতে থামতেই হল। টিকিট নিয়ে অর্জুন বলল, এটা হল তিস্তা নদী। এখন বেশি জল নেই বলে ভেবো না সারা বছর এইরকম চেহারা থাকে। ভরা বর্ষায় এপার-ওপার দেখা যায় না।

ডরোথি নেমে পড়েছিল। কয়েক পা হেঁটে ব্রিজের ওপর রেলিং ধরে দাঁড়াল সে। হাওয়ায় তার পোশাক উড়ছে। বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে অর্জুন পাশে চলে গেল, যখন এই ব্রিজ তৈরি হয়নি তখন বর্ষাকালে নৌকোয় মানুষ এপার থেকে ওপারে যেত। প্রচুর সময় লাগত তখন। শীতকালে শুনেছি একপাশে নৌকো আর বাকিটা চরের ওপর ট্যাক্সি চলত। ওদিকটা হল বার্নিশ। কমলাকান্ত রায়কে ওখানে পাওয়া গিয়েছিল।

ডরোথি অনেক দূরের গাছপালার দিকে তাকাল। এখান থেকে সেটা প্রায় অস্পষ্ট।

ডরোথি জিজ্ঞেস করল, আমার ঠাকুর্দাও তা হলে নৌকো করে পার হতেন?

নিশ্চয়ই। তখন মোটরবোট চালু হয়নি।

আবার বাইক চালু করে অর্জুন ব্যাপারটা ভাবতে আরম্ভ করল। মায়ের কাছে সে শুনেছে তখন নদী পার হতে ঘণ্টা দেড়েক লেগে যেত। রিচার্ড অথবা ম্যাকসাহেব প্রায়ই তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট করে কোন কারণে বার্ণিশের দিকে যেতেন, সেটা বোধ হয় কখনও জানা যাবে না। মানুষ অকারণে এত কষ্ট করে না।

দোমহনির মোড় জমজমাট। আগে এখানে রেল লাইন ছিল, আটষট্টির বন্যার পর ট্রেন চলে না। ডান দিকে বাইপাসের পথ ছেড়ে অর্জুন সোজা চলে এল ময়নাগুড়িতে। তেমাথার মোড়ে বাইক থামিয়ে সে জায়গাটার নাম বলল ডরোথিকে। বেশ হতশ্রী চেহারা। দোকানপাটগুলো যে সচ্ছল নয় বোঝা যায় সাজগোজ দেখে। বাইপাস হওয়ার পর থেকে ময়নাগুড়ির গুরুত্ব কমে গেছে।

ওদের দাঁড়াতে দেখে ভিড় জমে গেল। মফস্বলের বেকার মানুষেরা গোল হয়ে ঘিরে ওদের দেখতে লাগল। কালো চামড়ার মানুষের পেছনে সাদা চামড়ার এক মেমসাহেব দেখে ওরা কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। অর্জুন এক জনকে জিজ্ঞেস করল, হরিদাস বর্মণকে চেনেন?

সঙ্গে-সঙ্গে গুঞ্জন উঠল। এরা হরিদাস বর্মণের বাড়িতে এসেছে অতএব আর কোনও কৌতূহল থাকতে পারে না, এমন ভাব। একজন জবাব দিলেন, ওই যে রাস্তাটা, চারটে বাড়ি বাদ দিলেই ডানহাতি দোতলা বাড়ি। কোনও কাজ আছে বুঝি?

মফস্বলের লোকেরা প্রশ্ন করার সময় ভাবে না করাটা ঠিক কিনা। মুখ আর মনের ফারাক নেই। অর্জুন বাইক ঘোরাতেই রাস্তা করে দিল লোকগুলো। ঠিক চতুর্থ বাড়িটির সামনে পৌঁছে অর্জুন বাইক থেকে নামল।

ডরোথি জিজ্ঞেস করল, এটা কার বাড়ি?

হরিদাস বর্মণ। অনেক পুরনো মানুষ। কপাল ভাল থাকলে এর কাছে খবর পাব। অর্জুন এগোল। বাড়িটার সামনে কোনও ফেন্সিং অথবা গেট নেই। রাস্তা ছেড়ে কিছুটা এগোলেই বারান্দা। ওদের এগোতে দেখে এক ভদ্রমহিলা মাথায় ঘোমটা তুলে দ্রুত ঢুকে গেলেন ঘরে। ওরা বারান্দায় উঠতেই একটি বয়স্ক গলা ভেসে এল, কাকে চাই?

অজুর্ন চার পাশে কাউকে দেখতে পেল না। গলার স্বর ভেসে এসেছিল যেদিক থেকে, সেদিকে তাকিয়ে বলল, আমরা হরিদাসবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

জলপাইগুড়ির বিমল হোড়মশাই পাঠিয়েছেন।

ও, কথা বলছি।

আচ্ছা! আপনিই হরিদাসবাবু?

আজ্ঞে হ্যাঁ। এখন আমি পুজো করছি, পরনে গামছা। এই অবস্থায় পুরুষমানুষের সামনে যাওয়া গেলেও কোনও মহিলার সামনে নয়।

ঠিক আছে। আপনি পুজো শেষ করুন, আমরা অপেক্ষা করছি।

ইতিমধ্যে একজন মেমসাহেব আগমনের সংবাদ ছড়িয়েছে মহল্লায়। হরিদাস বর্মণের কণ্ঠ চুপ করে গেলেও ইজের-পরা খালি গায়ের শিশু থেকে বয়স্ক মানুষের ভিড় জমতে শুরু করেছে সামনে। ডরোথি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এরা আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছে?

সম্ভবত তোমার চামড়া!

মাই গড! চামড়া দেখার কী আছে? আঁতকে উঠল ডরোথি।

ওটা তুমি বুঝবে না। দুশো বছর ধরে তোমার পূর্বপুরুষ আমাদের মনে যে কমপ্লেক্স ঢুকিয়ে দিয়েছে, এটা তারই ফল। উপেক্ষা করো, ঠিক হয়ে যাবে।

এই সময় ভেতর থেকে একটি মিহি নারীকণ্ঠ ভেসে এল, আপনারা ঘরে এসে বসুন। বাইরে থাকলে ভিড় বাড়বে।

সামনের দরজাটা খুলে গিয়েছিল। ওরা ঘরে ঢুকল। ঘরে কেউ নেই।

চেয়ারে বসে ডরোথি জিজ্ঞেস করল, এরা কেউ সামনে আসছে না কেন?

মনে হয় বাড়িতে হরিদাসবাবু ছাড়া কোনও পুরুষ নেই।

আমি তো মেয়ে, মেয়েরা আসতে পারত!

অর্জুন উত্তর দিল না। উত্তরবাংলার অনেক পরিবারে এখনও রক্ষণশীলতা ভালভাবে রয়েছে। একজন ইংরেজ মেয়েকে এই ব্যাপারটা বোঝানো যাবে না।

খড়মের আওয়াজ হল। ভেতরের দরজায় এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ দেখা দিলেন। সাদা ফতুয়ার নিচে লুঙ্গি। মাথার চুল ধবধবে সাদা। অর্জুন উঠে দাঁড়াতেই হরিদাস বর্মণ হাতের ইশারায় বসতে বললেন। তাঁর নজর ডরোথির দিকে গেল, ইনি কোন দেশের মেয়ে?

ইংল্যান্ড। ওর নাম ডরোথি। আমি অর্জুন।

ভদ্রলোক বসলেন। ডরোথির দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে এখন মেমসাহেব দেখা যায় না বলে বাইরে অত ভিড় হয়েছে। আমি তো ইংরেজি জানি না, কৃষক মানুষ। খেতি খামারির ভাষা বুঝি। বিমলবাবু আপনাদের পাঠিয়েছেন?

অর্জুন বলল, হ্যাঁ। আপনি তো ময়নাগুড়িতে অনেকদিন আছেন?

হ্যাঁ। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে আমার জন্ম।

অর্জুন ডরোথিকে বলল, ইনি ইংরেজি জানেন না। আমি পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলব। ডরোথি মাথা নেড়ে সায় দিল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমরা একজন মানুষের কথা জানতে চাই। ওঁর নাম তারিণী সেন। শুনেছি এককালে উনি খুব কুখ্যাত ছিলেন।

তারিণী সেনের নাম শুনে সোজা হয়ে বসলেন বৃদ্ধ, ওর কথা কে বলল?

আমরা খোঁজখবর নিয়েছি।

অদ্ভুত কাণ্ড! এখন কেউ তারিণীর খবর নেবে ভাবতেই পারি না। হ্যাঁ, কী জানতে চান ওর সম্পর্কে?

উনি এক সময় ডাকাতি করতেন?

হ্যাঁ। সে একটা সময় ছিল যখন তারিণীর ভয়ে মানুষ কাঁপত। ওর একটা টাট্ট ঘোড়া ছিল। সেই ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনলে লোকে ঘরের দরজা বন্ধ করত। তখন এদিকে শুধুই জঙ্গল। এই আমার বাড়ির সামনে বাঘ আসত। অবশ্য বাড়িটা মাটির ছিল। মাটির একতলা। তারিণী সম্পর্কে জানতে চান কেন? বইটই লিখবেন নাকি?

না। ইনি একটা ডায়েরিতে তারিণী সেনের নাম পড়েছেন। সেই সুবাদেই এখানে এসেছেন আরও খোঁজখবর নিতে। ওর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে?

না। নেই। দু-দুটো বিয়ে করেছিল, বাচ্চা হয়নি। এখন বউরাই ওকে খাওয়ায়।

এখন খাওয়ায় মানে? উনি কি জীবিত আছেন?

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, মাস তিনেক আগেও ওকে দেখেছি।

অর্জুনের উত্তেজনা লক্ষ করে ডরোথি জিজ্ঞেস করল, কী বললেন উনি?

অর্জুন ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তারিণী সেন বেঁচে আছে।

রিয়েলি? চিৎকার করে উঠল ডরোথি।

অর্জুন হকচকিয়ে গেল। ডরোথি যে এত উত্তেজিত হতে পারে, সে ভাবেনি। ডরোথি বলল, ওঁকে জিজ্ঞেস করো, কোথায় গেলে দেখা পাওয়া যেতে পারে?

অর্জুন হরিদাসবাবুর দিকে তাকাল, উনি কোথায় থাকেন?

তারিণীর বাড়ি হুচলুডাঙার কাছে। হুচলুডাঙা চেনেন?

না।

এখান থেকে সাত মাইল পূর্বে জলঢাকা নদীর আগে হুডাঙা। সেখান থেকে তিন মাইল কাঁচা পথ ধরে এগোলে পূর্বদহর মন্দির। সেখানে গিয়ে হাতকাটা তারিণীর খোঁজ নিলে যে-কেউ বলে দেবে।

হচলুডাঙা নামটা অনেকদিন মনে থাকবে। এ-অঞ্চলে অভিনব নামের গ্রাম ছড়িয়ে রয়েছে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তারিণী সেনের যখন বয়স হয়েছে। তখন তাঁর স্ত্রীদের তো একই অবস্থা হওয়ার কথা। তাঁরা কী করে রোজগার করেন?

কিছু জমি আছে। সেখানে চাষ হয়। আর বাকিটা ফাইফরমাশ খেটে। কোনও মতে বেঁচে আছে বলতে পারেন। আপনি বললেন, ডায়েরিতে নাম পেয়ে উনি এদেশে এসেছেন। তারিণী কি এই বয়সে কারও সম্পত্তি পাচ্ছে? এ রকম তো হয় শুনেছি।

অর্জুন ইচ্ছে করেই রিচার্ডসাহেবের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। বলল, না, না। আমাদের দেশের একজন কুখ্যাত ডাকাতকে দেখার লোভেই উনি এসেছেন।

তা হলে নিয়ে যাবেন না। খুব হতাশ হবেন। ভাল খেতে না পেয়ে তার চেহারা প্রায় হাড় জিরজিরে। ডাকাত বলে মনেই হবে না। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন, আগে প্রায়ই আমার কাছে আসত টাকা চাইতে। বলতাম এমনি-এমনি দেব না। কাজ করো, টাকা নাও। আমার জোতে সুপুরি, নারকেল গাছ আছে অনেক। দু হাতে পাঞ্জা কাটা। তবুও সড়সড় করে উঠে যেত নারকেল গাছে। কনুইয়ের ভাঁজে কাটারি গুজে ফল কাটত। এ সব অবশ্য অনেক দিন আগের কথা।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওর হাত দুটো কাটা গেল কী করে?

এটা কেউ জানে না। তারিণীও কাউকে বলেনি। নিশ্চয়ই কেউ প্রতিশোধ নিয়েছিল। ও যা করত তাতে তো শত্রুর কোনও অভাব ছিল না।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। খানিকটা বিরক্ত করে গেলাম। আচ্ছা, নমস্কার।

বাইরে বেরিয়ে এল এরা। তখনও দর্শকরা অপেক্ষা করছে ডরোথিকে দেখবে বলে। ডরোথি কিছু বলতে যেতেই অর্জুন বাধা দিল, এখান থেকে বেরিয়ে কোনও ফাঁকা জায়গায় গিয়ে কথা বলব আমরা।

ময়নাগুড়ি শহর থেকে খানিকটা পূর্ব দিকে যেতেই দু পাশে ফাঁকা মাঠ। পিচের রাস্তা ছেড়ে বাইক দাঁড় করিয়ে একটু আগে শোনা তথ্যগুলো ডরোথিকে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিল অর্জুন। সব শুনে ডরোথি নোটবুক বের করে কিছু নোট করে নিয়ে বলল, আমরা কি এখন ওই হুচলুডাঙায় যাব?

আমার কোনও আপত্তি নেই। বেশি দূর তো নয়।

ডরোথি ঘড়ি দেখল, তোমার কি? পাচ্ছে না?

খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল অর্জুন। এখন মনে হল লাঞ্চের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ডরোথির জন্য রান্না করে মা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এখন যদি ওরা জলপাইগুড়িতে লাঞ্চের জন্য ফিরে যায়, তা হলে সব চুকিয়ে আবার এদিকে ফিরে আসতে-আসতে বিকেল হয়ে যাবে। সে বলল, কাছাকাছি একটা বোডসাইড ফাস্ট ফুডের দোকান আছে। তোমার একটু অসুবিধে হতে পারে, তবুও সেখানেই ট্রাই করবে নাকি?

ডরোথি হেসে জবাব দিল, আই ডোন্ট মাইন্ড।

ওরা ময়নাগুড়ি বাইপাসে নির্জন মাঠের গায়ে তৈরি নতুন ধাবায় চলে এল। খোলা আকাশের নীচে পাতা খাটিয়ায় বসে শুকনো মুরগির মাংস আর রুটি দিতে বলল অর্জুন। মাংসে যাতে ঝাল না দেওয়া হয় সেটা বারবার মনে করিয়ে দিল।

এরকম দোকানে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা ডরোথির নেই। তার যে মজা লাগছে বোঝা যাচ্ছিল মুখ দেখে। অর্জুন বলল, তোমার দাদু কেন যে তারিণী সেনের নাম ডায়েরিতে লিখলেন তা আমি বুঝতে পারছি না। যা জানা যাচ্ছে তাতে লোটা এত গুরুত্ব পেতে পারে না।

ডরোথি গম্ভীর গলায় বলল, আমি শুধু কর্তব্য করছি। তবে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি বলে আমার খারাপ লাগছে।

আমারও তো লাভ হচ্ছে। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারলাম।

খাওয়া সুবিধে হল না ডরোথির। অর্জুনের ভাল লাগলেও সে মাংস প্রায় ধুয়ে নিয়ে খানিকটা খেল। ধাবাওয়ালার কাছ থেকে আর-একবার চলুডাঙায় পোঁছবার পথ জেনে নিয়ে ওরা বাইকে উঠল।

প্রায় সাত মাইল পথ পেরিয়ে আসার পর ওরা হুচলুডাঙায় পৌঁছল। একটা ছোটখাটো গ্রাম। কোনও বৈচিত্র্য নেই। পূর্বদহর মন্দিরের কথা জিজ্ঞেস করতেই পথ দেখিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব হল না। শোনা গেল তিন মাইল কাঁচা পথ ধরে যেতে হবে।

রাস্তা ভাল নয়। বাইক লাফাচ্ছিল বেশ। ডরোথি সিট আঁকড়ে বসে ছিল। এই পথে জিপ ছাড়া যাওয়া বেশ কষ্টকর। গ্রামের লোক এখনও গোরুর গাড়ি ব্যবহার করে। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে যেতে হবে এবং পৌঁছবার আগে হাড়গোড় ভেঙে যাবে।

শেষ পর্যন্ত পূর্বদহে পৌঁছন গেল। মন্দির দেখতে পেল ওরা। বিশাল ঢিবির ওপরে কাটা পাথরে তৈরি মন্দির। পাশেই একটা দিঘি, যা কাদা এবং পানায় ঢাকা। মন্দির চত্বরে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওদের নামতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, আসুন। ওপাশে যে নদীটা রয়েছে, জল নেই অবশ্য, তার নাম চুকচুকা নদী। আর এই দিঘির নাম পদ্মদিঘি। আমি এই মন্দিরে আছি অনেক বছর। আপনাদের সব ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।

অর্জুন বুঝল লোকটি গাইড অথবা পাণ্ডা হতে চাইছে। যদিও এই পাণ্ডববর্জিত মন্দিরে কোনও টুরিস্ট সচরাচর আসে না, তবু লোকটাকে নিশ্চয়ই কিছু কথা মুখস্থ করে রাখতে হয়েছে। সে হেসে বলল, সঙ্গে মেমসাহেব আছে দেখছেন, ইংরেজি বলতে পারবেন?

ইয়েস সার, তবে সেইসঙ্গে নো সার। লিটু-লিট্‌ল বলতে পারি।

তা হলে বাংলায় বলুন। এটি কার মন্দির?

আজ্ঞে, ইনি জটিলেশ্বর। এই যে গ্রাম পূর্বডহর, এর মানে হল প্রথম পুজো করা। ডহর মানে পুজো করা। এই মন্দিরের পাশে দেখুন একটা লাল রঙের ছোট্ট মন্দির আছে। কোনও এক রাজা এই মন্দির দুটো তৈরি করেছেন। তবে এখন তো আর সে দিন নেই। সরকার এখান থেকে কুবেরের মূর্তি আর একটা বিষ্ণুপট্ট নিয়ে গেছে। লোকজন যায় জল্পেশের মন্দিরে। এখানে আসে খুব কম। এদিকে আসুন।

লোকটি এগিয়ে গেল মন্দিরের কাছাকাছি। এই দেখুন, মন্দিরের গায়ে নানান ভঙ্গিমায় নারীমূর্তি রয়েছে। ইনি নৃত্যরত গণেশ, উনি ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট বুদ্ধ। খুব প্রাচীন মন্দির এটি। ওই যে দিঘি দেখেছেন, ওখান থেকে মাটি কাটার সময় এগারোটি প্রাচীন দেবতার মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। যেমন, শিব, গণেশ, বুদ্ধ, বিষ্ণুচণ্ডী। লোকটা চোখ বন্ধ করে নমস্কার করল কপালে দুটো হাত ঠেকিয়ে, তাও সরকার নিয়ে গিয়েছেন।

অর্জুন একটু অবাক হচ্ছিল। হিন্দু মন্দিরের গায়ে বুদ্ধের মূর্তি কেন? কোথায় যেন সে পড়েছিল এক কালে এদিকের বৌদ্ধরা কিছু হিন্দু দেবদেবীকে নিজেদের ধর্মে গ্রহণ করেছিল। এই গ্রহণ করা একেবারে স্থানীয়ভাবে। শিব এবং চামুণ্ডাকে বৌদ্ধরা উপাসনা করত বলে নাকি শোনা যায়। কিন্তু এখন মন্দির দেখার বদলে যে-কাজের জন্য তারা এসেছে তাই করা যাক। ডরোথি যেভাবে মন্দির থেকে মুখ ঘুরিয়ে মজা দিঘির দিকে তাকিয়ে আছে তাতে স্পষ্ট যে, তার এসব ভাল লাগছে না।

অর্জুন মন্দির ছাড়িয়ে একটু হাঁটল। লোকটি পেছনে ছুটে এল, এ কী, পুজো দেবেন না? মন্দিরের প্রবেশদ্বারে দুই বিশালাকার দ্বারপালের একটি এখনও ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে আছে, অন্যটির দুটো পা নেই। সেদিকে তাকিয়ে অর্জুন বলল, উনি খ্রিস্টান আর আমি খুব নাস্তিক। আপনি তো এখানে থাকেন, তারিণী সেনকে চেনেন?

লোকটি হকচকিয়ে গেল, কোন তারিণী?

যার দুটো হাত নেই।

ও, হাতকাটা তারিণী! ওকে কে না চেনে!

কোথায় থাকেন উনি?

ওই যে বাড়িগুলো দেখছেন, ওখানে। কিন্তু আমি যে আপনাদের এত কথা বললাম–?

অর্জুন পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে লোকটার হাতে দিল, লোকটা যেন তাতেও খুশি হল না। অর্জুন ডরোথিকে ডাকল। ডরোথি তখন লাল মন্দিরটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ডাক শুনে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ও এতক্ষণ তোমাকে কী বলছিল?

মন্দিরটার বর্ণনা দিচ্ছিল। তুমি ইন্টারেস্টেড?

না। ওকে তারিণী সেনের কথা জিজ্ঞেস করেছ?

হ্যাঁ। ওইদিকে। বাইক নিয়ে যাওয়া যাবে না। চলো হাঁটি।

ওরা হাঁটা শুরু করতে দেখল লোকটা পেছন-পেছন আসছে। ইতিমধ্যে গ্রামের কিছু ছেলে বুড়ো জড়ো হয়ে গেছে মেমসাহেব দেখতে।

অর্জুন হেসে বলল, তোমাকে দেখার জন্যে সবারই দেখছি বেশ কৌতূহল।

ডরোথি বলল, হাঁ, এখানে এসে নিজেকে বেশ দামি বলে মনে হচ্ছে।

তারিণী সেনের বাড়িটিকে দেখিয়ে দিল সঙ্গে আসা লোকটি। এক বৃদ্ধা মহিলা দাওয়ায় বসে সুপুরি ছাড়াচ্ছিলেন; ওদের দেখে ময়লা শাড়ির আঁচল মাথায় তুললেন।

লোকটা বলল, ও জেঠি, এঁরা শহর থেকে এসেছেন। জ্যাঠার খোঁজ করছেন।

তার শরীর খারাপ। জ্বর।

এই সময় ভেতর থেকে আর-একজন বৃদ্ধা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কারা তোমরা?

দ্বিতীয়জনের চেহারা প্রথমজনের চেয়ে ভাল, বয়স সামান্য কম হতে পারে।

অর্জুন একই কথা বলল। এদিকে পেছনে ভিড় জমছে। মন্দিরে দেখা হওয়া লোকটা এগিয়ে গেল বৃদ্ধার সামনে, তাড়াতাড়ি ডাকো জ্যাঠাকে। চেয়ে দেখছ না, খোদ মেমসাহেব এসেছেন।

বৃদ্ধা ভেতরে চলে গেলেন। এবার লোকটি ঘুরে দাঁড়াল, এই, হট হট। এখানে কী চাই? যেন মেলা বসেছে এমনভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই। যা, সরে যা।

দু-একজন সরল, বাকিরা কয়েক পা পিছিয়ে গেল মাত্র। লোকটি অর্জুনের দিকে তাকাল, গাঁয়ের মানুষ তো! সব ব্যাপারে নাক গলানো অভ্যেস।

অর্জুন জবাব দিল না। সে দেখল দ্বিতীয় বৃদ্ধা দু হাতে কোনও রকমে ধরে বাইরে নিয়ে আসছেন একজন অসুস্থ মানুষকে। মানুষটির হাত কনুইয়ের ওপরেই শেষ হয়ে গেছে। মুখে সাদা দাড়ি, মাথার চুল অনেকখানি উঠে গেছে। দাওয়ায় বসিয়ে দেওয়ার পর মানুষটি সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু তাঁর অসুস্থতা এখন স্পষ্ট।

অর্জুন ডরোথিকে ইংরেজিতে বলল, ইনিই তারিণী সেন।

ডরোথি দেখছিল। বলল, তুমি কি নিশ্চিত? ওর নাম জিজ্ঞেস করেছ?

অর্জুন কয়েক পা এগিয়ে দাওয়ার ধারে গেল, আপনার নাম কী?

বৃদ্ধ মুখ তুললেন, ঘোলাটে চোখ, ঠোট চাটলেন, তিনদিন জ্বর।

মানুষটি হয়তো কানে কম শোনেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?

নাম? অ। তারিণী, লোকে বলে হাতকাটা তারিণী।

অর্জুন এবার দ্বিতীয় বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করল, ওঁকে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন?

ঘরে গুলি-ওষুধ ছিল, তাই খেয়েছে।

গুলি-ওষুধ মানে?

বৃদ্ধা ভেতরে গিয়ে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি নিয়ে এলেন। অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, আপনাদের গ্রামে ডাক্তার নেই?

মন্দির থেকে আসা লোকটি বলল, থাকবে না কেন, আছে। বাড়িতে এসে দেখলে কুড়ি টাকা নেয়। ওষুধ কিনতে হয় ধুপগুড়ি, নয় ময়নাগুড়ি যেতে হয়। গরিব মানুষের পক্ষে এসব কি সম্ভব বাবু? আমরা যখন দেখি খুব অবস্থা খারাপ, তখন কোনও মতে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এইভাবেই তো সবাই বেঁচে আছি।

অর্জুন বলল, আপনি এক্ষুনি গ্রামের ডাক্তারকে ডেকে আনুন তো।

আমি? লোকটা হকচকিয়ে গেল।

টাকার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি, আপনি শুধু ডেকে আনুন।

অ। তাই বলুন। লোকটি কয়েক পা হেঁটে একটি তরুণকে নির্দেশ দিতে সে দৌড়ল। অর্জুন এবার বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি কথা বলতে পারবেন?

কথা? কী কথা? বিড়বিড় করলেন বৃদ্ধ।

পুরনো দিনের, যা আপনার মনে আছে।

বসে থাকতে নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছিল, তারিণী সেন ধীরে ধীরে দাওয়ায় শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করলেন। ডরোথি ছুটে এল অর্জনের পাশে। ভীত স্বরে ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, উনি কি মারা যাচ্ছেন?

না, না, মারা যাবেন কেন? অসুস্থ বলে দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

থ্যাঙ্ক গড, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!

শুয়ে-শুয়েই চোখ খুললেন তারিণী সেন। অর্জুন দেখল ওঁর চোখের মণি ডরোথির দিকে স্থির হয়েছে। সেই অবস্থাতেই গোঙানির গলায় জিজ্ঞেস করলেন, এ কে?

এর নাম ডরোথি। ইংল্যান্ড থেকে এসেছে আপনাকে দেখতে।

কালাপানি!

না, না, এখন আর কালাপানি পার হতে হয় না। আকাশ পথে বারো ঘণ্টাও লাগে না। এর ঠাকুরদাকে কি আপনি চিনতেন?

চোখের পাতা বন্ধ হল। বোঝা গেল আরও কাহিল হয়ে পড়েছেন। এবং তখনই ডাক্তারবাবু এলেন। বছর তিরিশের যুবক। শার্ট প্যান্ট পরা, হাতে ব্যাগ। এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

অর্জুন বলল, তারিণীবাবু অসুস্থ, আপনাকে তাই ডেকেছি।

ডাক্তারবাবু একবার অর্জুন আর একবার ডরোথির দিকে তাকালেন। তাঁর ইতস্তত ভাবটা কেটে গেল। দাওয়ায় উঠে ভদ্রলোক মাটিতেই বসে পড়লেন। পাস এবং চোখের পাতা টেনে দেখার পর স্টেথো ব্যবহার করলেন।

তারপর মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ঠান্ডা লাগল কী করে?

দ্বিতীয় বৃদ্ধা বললেন, ঠান্ডার দোষ কী? রোজ চার বেলা স্নান করে। বললেও শুনতে চায় না। বলে, পাপ ধুয়ে ফেলি।

ডাক্তারবাবু বললেন, বুকে সর্দি বসেছে আর তা থেকে জ্বর। বয়স তো অনেক, শরীরে রেজিস্টেন্স পাওয়ার বলে কিছু নেই। তবে ওষুধ পড়লে ভয়ের কিছু নেই।

লিখে দিন। অর্জুন বলল।

ডাক্তার ব্যাগ খুলে কাগজ বের করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের চিনতে পারলাম না।

অর্জুন বলল, আমরা একটু আগে এখানে এসেছি। ইনি ডরোথি, ইংল্যান্ডে থাকেন। আমি অর্জুন, জলপাইগুড়িতে বাড়ি।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি সেই অর্জুন? ডাক্তারের চোখমুখে বিস্ময়।

সেই অর্জুন মানে?

আপনি তো সত্যসন্ধানী?

ঠিক শব্দটা উচ্চারণ করেছেন।

আরে ব্বাস। আপনার দেখা পেলাম এখানে! কী সৌভাগ্য। আপনার কথা আমি কাগজে পড়েছি। আপনি এখানে কোনও সত্যসন্ধানে নাকি?

তেমন কিছু নয়।

ডাক্তার প্রেসক্রিবশন না লিখে ব্যাগের ভেতরে হাত দিলেন। দুরকম ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল বের করে বৃদ্ধাকে বললেন, এখনই এর একটা ওর একটা খাওয়াবেন। বিকেলে আবার একইভাবে খাওয়াতে হবে। বাকি দুটো কাল সকালে। মনে হয় তার মধ্যে জ্বর কমে যাবে। কাল সকালে আর এক বার দেখার পর ওষুধের কথা বলব। আমার কাছে না থাকলে ময়নাগুড়ি থেকে আনাতে হবে। এখন একটা কিছু খাইয়ে তবে ওষুধ খাওয়ান।

কিছুই খেতে চায় না।

চায় না বললে তো হবে না। জোর করে খাওয়ান।  ডাক্তার বৃদ্ধার হাতে ওষুধ দিয়ে দাওয়া থেকে নামতেই অর্জুন পার্স বের করল।

ডাক্তার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, না, না। আমাকে টাকা দিতে হবে না।

সে কী, আপনি এলেন, ওষুধ পর্যন্ত দিয়ে দিলেন।

মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক, হ্যাঁ, আমি বাড়িতে এসে রুগী দেখতে কুড়ি টাকা নিই। কারণ আমাকেও সংসার চালাতে হয়। এদিকের অধিকাংশ বাড়িতে গিয়ে রুগী দেখার পর শুনতে হয় পরে টাকা দেব। যা কখনও পাওয়া যায় না। সঙ্গে ওষুধ না থাকলে তো ওঁকে দিতে পারতাম না। কিন্তু আপনার কাছে আমি টাকা নিতে পারব না। আপনার সঙ্গে আলাপ হল এটাই আমার বড় পাওয়া।

কিন্তু আপনার তো ক্ষতি হয়ে গেল।

পকেট থেকে তো কিছু গেল না। ওষুধগুলো সেলসম্যানদের দেওয়া। ছাড়ুন তো এসব কথা। কোন রহস্য সন্ধানে এসেছেন শুনতে পারি কি?

কোনও রহস্য নেই। ওঁর কথা উনি ইংল্যান্ডে বসে শুনেছিলেন, তাই দেখতে এসেছেন।

মন্দিরের লোকটি বলল, তারিণী জ্যেঠার নাম সাহেবদের দেশে শোনা যায়?

অর্জুন নিঃশব্দে মাথা নাড়ল।

কপাল বটে। এলেন বলে পেটে ওষুধ যাচ্ছে। জেঠি, ওষুধ খাওয়াও।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওঁর সঙ্গে কালকের আগে ভাল করে কথা বলা যাবে, না?

না। অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা তো লাগবেই। ডাক্তার বললেন।

অর্জুন ডরোথিকে ব্যাপারটা জানাল। ওদিকে তখন বৃদ্ধা মুড়ি খাওয়াবার চেষ্টা করছেন তারিণী সেনকে। ডরোথি বলল, তুমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করো, ওঁর মরে যাওয়ার কোন আশঙ্কা নেই তো?

ডাক্তারবাবু সেটা শুনতে পেয়ে ইংরেজিতে বললেন, যা বয়স হয়েছে তাতে কেউ কোনও প্রেডিক্ট করতে পারে না। তবে এই জ্বরের জন্যে যে মারা যাবেন না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। চলুন, আমার ওখানে গিয়ে একটু চা খাবেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, আজ নয়। আমাদের তো আবার আসতেই হবে। তখন নিশ্চয়ই আপনার কাছে যাব। ধরুন, কাল বিকেলে। আপনি কিন্তু কাল সকালে এসে একবার ওঁকে দেখে যাবেন।

বিকেল হয়ে এসেছিল। বাইকে চেপে তিস্তা ব্রিজ পার হওয়ার সময় ডরোথি বলল, আমরা খুব লাকি। মাসখানেক পরে এলে হয়তো লোকটা মরে গেছে বলে শুনতাম। এত গরিব মানুষ আমি ভাবতে পারিনি। এত গরিব তবু দু-দুটো বিয়ে করেছে। অদ্ভুত। অর্জুন হাসল। ডরোথিকে বোঝানো যাবে না এক সময় গ্রাম বাংলায় কী রকম কুসংস্কার চেপে বসেছিল। তার কানে এল ডরোথি নিজের মনে বলছে, কিন্তু লোকটার অবস্থা এ রকম হওয়ার কথা নয়।

অর্জুনও তাই মনে করল। যে সারা জীবন ডাকাতি করে রোজগার করেছে প্রচুর, তার অবস্থা এমন হবে কেন? হঠাৎ খেয়াল হল। কথাটা ডরোথি জানল কী করে? রিচার্ড সাহেব কি তাঁর ডায়েরিতে তারিণী সেনের ডাকাতি করার কথা লিখেছেন? লিখলে সেই কথা ডরোথি তাকে বলেনি কেন? উলটে কমলাকান্ত রায়দের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীর সঙ্গে একইভাবে তারিণী সেনের নাম উচ্চারণ করেছে। এটা কী রকম হল?