আঙ্গিক (আরণ্যক)
প্রাচীন দেবতাদের উদ্দেশে নিবেদিত সূক্তগুলি সাধারণভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পঙক্তিতে গ্রথিত, আহুতি গ্ৰহণের জন্য সেখানে দেবতাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সর্বত্রই প্রকৃত যজ্ঞানুষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রক্ষিত হয়েছে। অন্যের পক্ষে ক্ষতিকর ইন্দ্ৰজাল এতে তাৎপৰ্যপূর্ণ ভূমিকা গ্ৰহণ করেছে; চতুর্থ অধ্যায়ের অধিকাংশ স্থানেই ভবিষ্যদবাণী, শুভাশুভ লক্ষণ গণনা, ব্যাধি ও স্বপ্ন আলোচিত হয়েছে। তাছাড়া, লোকায়াত ধর্মের উপাদানলব্ধ অসুর এবং রাক্ষস-রাক্ষসী প্রাধান্য পেয়েছে।
যথার্থ আরণ্যক অংশগুলিতে ব্ৰাহ্মণ্য অনুষ্ঠানসমূহ একধরনের ছদ্মযুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে ব্যাঘাত হয়েছে। সপ্তম অধ্যায়ের সূচনা ব্যাকরণ ও শিক্ষা আলোচনা দিয়ে, কিন্তু অল্প পরেই এই প্ৰস্তাব উত্থাপিত হয়েছে যে, সংহিতার ‘উপনিষদ’ বাখ্যা করা হবে। এই কথাটি বিশেষ তাৎপর্যবহ, কারণ এখানে সর্বপ্রথম বলা হল যে, সংহিতাগুলির একটি গোপন তাৎপর্য (উপনিষদ) আছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক অতীন্দ্ৰিয় রহস্যযুক্ত আধ্যাত্মিক বিবৃতিকে উপনিষদ নামে অভিহিত করেছে। সপ্তম অধ্যায় পাঁচটি বিভাগে বিন্যস্ত–প্ৰাকৃতিক, অতিজাগতিক, বিদ্যাচর্চা বিষয়ক, পারিবারিক ও আধ্যাত্মিক; শেষোক্ত অধ্যায়ের লক্ষ্য হ’ল উন্নততর জ্ঞান অর্জন ও প্রজ্ঞার অনুশীলন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের কিছু কিছু শ্লোক কয়েকটি উপনিষদেও পাওয়া যায়; তবে, এসব ক্ষেত্রে পারস্পরিক ঋণ গ্রহণের সম্ভাবনার চেয়ে জনসমাজে দীর্ঘকালব্যাপী ভাসমান আধ্যাত্মিক বা অতীন্দ্ৰিয় উপলব্ধির সাহিত্যভাণ্ডার থেকে এদের উৎপত্তির সম্ভাবনাই প্রবলতর। ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্ত থেকে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ইচ্ছামতো উদ্ধৃত করে। পরম্পরের সঙ্গে মিশ্রিত করার সময়ে কখনো কখনো সেগুলির ঈষৎ পরিবর্তনও করা হয়েছে।
দশম অধ্যায়ে একটি কৌতুহলজনক ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন দেবতা নারায়ণের গৌরবায়নের অব্যবহিত পরে রুদ্রের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। ফলে, এই সিদ্ধান্ত অনিবাৰ্য হয়ে পড়ে যে, সংহিতার প্রাচীনতর দেবতারা এই পর্বে পৃথক পৃথক ধর্মগোষ্ঠীগত ধর্মচর্চার কেন্দ্ৰবিন্দু হয়ে পড়েছেন। সমাজে অনিবাৰ্যভাবে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছিল,-তা ধর্মতত্ত্বের স্তরে এবার প্রতিফলিত হ’ল।
আঙ্গিক ও ভাষাগত বিচারে ঐতরেয় আরণ্যক সম্পূর্ণতই ব্রাহ্মণচরিত্রযুক্ত, যদিও এর বহু আঙ্গিকগত দিক ঋগ্বেদীয় পর্যায় থেকে উদ্ভূত এবং স্পষ্টত এতে সেই সময়ের অভিব্যক্তি ঘটেছে। যখন যজ্ঞীয় ধর্ম পরিপূর্ণভাবে বিকশিত। রচনার সাধারণ কাঠামো হ’ল কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মন্ত্রসমূহের উদ্ধৃতি এবং পরে সেই অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যা। উদীচ্য বা উত্তরাঞ্চলের উপভাষার তখনও প্রাধান্য আছে, ‘র’ ধবনির বিকল্পরূপে খুব কম ক্ষেত্রেই ‘ল’ ধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, তবে মধ্যদেশের উপভাষার প্রভাব বহুক্ষেত্রে প্রত্যক্ষগোচর। তখনও উপসর্গ ক্রিয়াপদ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে প্ৰযুক্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণ সাহিত্যের ঐতিহ্যনুযায়ী শব্দসমষ্টির পুনরাবৃত্তি তখন পর্যন্ত সাধারণভাবে প্রচলিত। কখনো কখনো কয়েকটা নূতন ছন্দও ব্যবহৃত হয়েছে।
শাঙ্খায়ন আরণ্যকের মধ্যে আমরা ব্যাকরণ-সচেতনতার প্রমাণ পাই, ঐতরেয় আরণ্যকের রচনা-শৈলীর মতো এই গ্রন্থের শৈলী ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সর্বতোভাবে গতানুগতিক এবং একই কারণে এখানে সূত্রকারে দীর্ঘস্তবকের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে বহু শ্লোক গ্রথিত হয়েছে, কিন্তু গদ্য সাধারণভাবে নিম্প্রাণ। পরবর্তীকালের অধিকাংশ ব্ৰাহ্মণের সমসাময়িক পাণিনির নিয়মাবলীর সঙ্গে এই আরণ্যকে প্রতিফলিত ব্যাকরণের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
তৈত্তিরীয় আরণ্যকের প্রধান ছন্দ হ’ল অনুষ্টুপ, এই তথ্য থেকে সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করা যায় যে, আলোচ্য আরণ্যকের শ্লোকগুলি পরবর্তীযুগের মহাকাব্য এবং সমাজদেহে ভাসমান গীতিকাগুলির ভিত্তি রচনা করেছে। আলোচ্য আরণ্যকে কিছু কিছু কাব্যগুণান্বিত চিত্রকল্প পাওয়া যায়; মোটামুটিভাবে ভাষার প্রাচীনতার অনেক লক্ষণ থাকায় তার সঙ্গে অব্যবহিত উত্তরসূরীর উপনি স্থািদ অপেক্ষা সংহিতার সঙ্গে অধিকতর সাদৃশ্য পরিস্ফুট হয়েছে। ভাষা ব্যবহারের অভ্যন্তরীণ প্রমাণ থেকে মধ্যদেশের উপভাষার প্রমাণ পাওয়া যায়। গায়ত্রী যে ইতোমধ্যে বিধিবদ্ধ হয়ে পড়েছে, তা এর বহু বিকল্প প্রয়োগ থেকে সুস্পষ্ট।
আরণ্যকের সাহিত্যগত তাৎপর্য যদিও নিতান্ত ক্ষীণ, তবুও কখনো কখনো কাব্যিক সৌন্দর্য্যের আভাস পাওয়া যায়, যা অভিজ্ঞতার গভীরতা ও মহিমা এবং জীবন সম্পর্কিত অস্তদৃষ্টির উপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল; শুধু আলঙ্কারিক প্রয়োগ বা প্রকৃতি-বর্ণনাকে এতে পৃথক গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। তবে, অতি দীর্ঘায়িত সূত্র এবং ঐন্দ্ৰজালিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত শব্দা ‘স্বরের পুনরাবৃত্তি অধিকস্থান অধিকার করার ফলে চিত্ৰকল্প ও প্রেরণালব্ধ রচনার মান রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বহু সীমাবদ্ধতার মধ্যে দৈনন্দিন জীবন থেকে আহত উপমা কিংবা পর্যবেক্ষণলব্ধ বর্ণনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।