০৩. আইসল্যাণ্ডে
কোপেনহেগেন শহরটা দেখতে ভারি সুন্দর। রাজপ্রাসাদটা কী বড়ো! চারধারে তার পরিখা। পরিখার উপরে একটা সেতু। ষোলো শতকে তৈরি হয়েছিলো।
আমরা কোপেনহেগেনে এসে পৌঁছেছিলাম বেলা দশটার সময়। স্টেশন। থেকে সমস্ত মালপত্র ফিনিক্স হোটেলে পাঠিয়ে দিলেন কাকামণি। তারপর আমায় নিয়ে তখুনি চললেন মিউজিয়ামের দিকে।
সুন্দর শহরটা দেখতে-দেখতে চলেছি। এক্সচেঞ্জ আপিসের দালানের গম্বুজটা চমৎকার লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন চারটে সোনালি ড্রাগনের ল্যাজ জড়িয়ে-জড়িয়ে তৈরি। কাকামণির চোখ কিন্তু সেদিকে পড়লো না। কিছু দূরে যে আকাশ-ছোঁয়া গিঞ্জের চুড়ো দেখা গেলো, সেদিকে নিয়ে চললেন আমাকে।
গির্জের চুড়োটা এতো উঁচু যে, মনে হয় আকাশের মেঘ এসে ছুঁয়েছে ওর গা। গিঞ্জের গা বেয়ে একটা ঘোরানো সিঁড়ি সেই উঁচু চুড়োকে লক্ষ্য করে আকাশে উঠে গেছে।
কাকামণি যখন বললেন যে এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা যাক, তখন সত্যিসত্যিই আমি আঁৎকে উঠলাম। কিন্তু কাকামণি আমার কোন কথায় কান দিলেন না। বললেন, উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে আমাদের। উঁচুতে ওঠা অভ্যেস করতে হবে তো!
কোনো বারণ না শুনে কাকামণি আমায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। যততক্ষণ পর্যন্ত সিঁড়িটা ভিতর দিয়ে ঘুরে-ঘুরে উপরে উঠেছিলো ততক্ষণ বেশ সহজেই ওঠা গেলো। কিন্তু প্রায় দেড়শোটা সিঁড়ি ভেঙে ওঠবার পর খোলা জায়গায় এসে হাজির হলাম। এখান থেকে গির্জের গা বেয়ে সিঁড়ি গম্বুজের চুড়ো অবধি উঠে গেছে।
কোনোরকমে রেলিং ধরে ধরে আস্তে-আস্তে উঠতে লাগলাম। এলোমেলো হাওয়া এসে ছুলো শরীর। তাতে আরো ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হতে লাগলো যেন হাওয়ায় গির্জেটা কাঁপছে, থর-থর করে দুলছে গির্জের চুড়ো। খানিকক্ষণ উঠেই মাথা ঘুরতে লাগলো। আর দাঁড়াতে পারলাম না, ধপ করে সিঁড়ির উপরে বসে পড়লাম।
তারপরে কী করে যে কাকামণির ধমক শুনতে-শুনতে চুড়োর মাথায় এলাম, তা আমি নিজেই জানি নে। কিন্তু চুড়োয় উঠেও নিস্তার নেই। কাকামণির নির্দেশ শোনা গেলো, এবারে বেশ সাহস করে নিচের দিকে তাকা দিকিন! না, না, ভয় পেলে চলবে কী করে? পাহাড়ের চূড়ো থেকে এমনি করেই পাতাল-ছোঁয়া গহ্বরের দিকে তাকাতে হবে। এখন থেকে তা অভ্যেস করে না। নিলে চলবে কেন?
ভয়ে-ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ঘরবাড়ি সমস্তই যেন ধোয়ার চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। পুতুলের দেশের মতো ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি, পিপড়ের মতো সারি-সারি চলমান জনস্রোত। এতো উঁচুতে উঠেছি বলে মনে হতে লাগলো আকাশের মেঘের ভেলাগুলি স্থির নিষ্কম্প, গিঞ্জের চুড়ো-সমেত আমিই বরং বে-বো করে ঘুরছি। দূরে দিগন্তে তমালতালীবনরাজিনীলা, অন্য দিকে ধারানিবদ্ধলবণাম্বুরাশির কলঙ্করেখা। সবই যেন বনৃবন্ করে লাটুর মতো ঘুরছে।
সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা 1 কাঁপতে লাগলো পা-দুটি। কিন্তু তবু কাকামণির নির্দেশমতো পুরো একটি ঘণ্টা কাটাতে হলো ওখানে। যখন গিঞ্জের চুড়ো থেকে নেমে এলাম, তখন দেখি পা-দুটি ব্যথায় টনটন করছে।
জাহাজ-আপিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, আমাদের জাহাজ ছাড়তে আরো পাঁচদিন বাকি। ভেবেছিলাম এই পাঁচ দিন বেশ জিরোনো যাবে। কিন্তু কাকামণি নাছোড়বান্দা। এই পাঁচ দিনই আমাকে দিয়ে স্টেজ রিহার্সাল দেওয়ালেন। পাঁচ দিনই আমাকে উঠতে হলো গির্জের চুড়োয়। সত্যি বলতে কি, এতে কাজও হয়েছিল প্রথম দিনের চেয়ে পঞ্চম দিনে যে অনেক বেশি সাহস ও জোর পেয়েছিলাম, তা নিঃসন্দেহ।
পাঁচদিন পর ভলকিরিয়া জাহাজে উঠে কাকামণি রীতিমতো একটা কাণ্ড করে ফেললেন; উল্লাসে অধীর হয়ে তিনি এতো জোরে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে শেকহ্যাণ্ড করলেন যে ক্যাপ্টেনকে বেশ কয়েকদিন ধরে কজির ব্যথা অনুভব করতে হয়েছিলো। কাকামণির রকম-শকম দেখে ক্যাপ্টেন বেশ একটু আশ্চর্যও হয়েছিলেন। অবশ্য আমি এতে অবাক হইনি। আইসল্যাণ্ড যাওয়ার আনন্দে কাকামণি যে এমনি একটা কিছু করবেন, তা আমি আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।
দশ-এগারো দিনের মধ্যেই আইসল্যাণ্ডের রাজধানী রিজকিয়াভিকে পৌঁছুনো গেলো। জেটি থেকেই আঙুল দিয়ে কাকামণি আমাকে স্নেফেল দেখালেন। বরফে মোড়া পাহাড়টির চুড়ো যেন আকাশের মেঘ ভেদ করে কোন্ মহাশূন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো।
আগেকার ব্যবস্থা-মতো রিজকিয়াভিকের বিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্রিদিকসনের অতিথি হলাম আমরা। ফ্রিদিকসনের বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কাকামণি বেরোলেন লাইব্রেরির সন্ধানে, যদি দৈবাৎ সাকৃত্যুউজমের লেখা কোনো পুঁথি-টুথি পাওয়া যায়, তাই দেখতে। আর আমি বেরোলাম শহরটা ঘুরে বেড়াতে।
শহরটা ছোটো, মাত্র দুটি রাজপথ। ভালো লাগলো না শহরটা। যতদূর চোখ গেলো শুধু আগ্নেয়গিরির মেলা দেখা গেলো। হয়তো সেই কারণেই শহরটা আমার ভালো লাগলো না। কারণ, এখান থেকেই তো আমাদের রওনা হতে হবে পাতালের পথে।
অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাসায় এসে দেখি দুই বৈজ্ঞানিকের মধ্যে জোর কথা চলছে। বলা বাহুল্য, কাকামণি যথেষ্ট সতর্ক হয়ে আমাদের আইসল্যাণ্ডে আসার উদ্দেশ্য গোপন রাখতে চেষ্টা করছেন।
কথায় কথায় কাকামণি প্রশ্ন করলেন : আর সাফউমের কোনো বই কি আপনাদের লাইব্রেরিতে আছে?
গর্বের স্বরে ফ্রিদিকসন বললেন : যিনি যে-কোনো ধাতুকেই সোনা করতে পারতেন, ষোলো শতকের সেই অসাধারণ বিজ্ঞানীর কথা বলছেন তো? আইসল্যাণ্ডের গৌরব উনি। এদেশের বিজ্ঞান আর সাহিত্যের সম্রাট। পৃথিবীর সর্বত্রই পুজো ওর।
কাকামণি বললেন : হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তারই বই দেখতে চাইছি।
ফ্রিদিকসন আফশোস করে বললেন : কিন্তু এখানে তো ওঁর কোনো বই পাবেন না। শুধু এখানে কেন, দুনিয়ার কোথাও পাবেন না। এটা কি কম দুঃখের কথা? ম্লেচ্ছ, ধর্মবিদ্বেষী বলে পনেরো শো তিয়াত্তর সালে ওঁর যে লাঞ্ছনা হয়েছিল, সে কথা ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আইসল্যাণ্ডের, তথা পৃথিবীর দুর্ভাগ্য যে সেই সময়েই ওঁর সব বই কোপেনহেগেনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো।
আপন মনেই কাকামণি বললেন : হুঁ! এখন বুঝতে পারছি কেন উনি হেঁয়ালির মধ্য দিয়ে অতো বড়ো আবিষ্কারটার কথা লিখে গেছেন।
আর বুঝি কিছু গোপন থাকে না! এ-কথা শুনেই ফ্রিদিকসন অবাক গলায় শুধদলেন : হেঁয়ালি! আবিষ্কার!–তার মানে? আপনি কি ওঁর কোনো গুপ্তলিপি পেয়েছেন?
কাকামণি কথা ঘুরোবার চেষ্টায় আমতা আমতা করে বললেন : না, না। আমি পাব কোত্থেকে? ও একটা অনুমান মাত্র!
ও, অনুমান! তাই বলুন।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন কাকামণি। বললেন, আইসল্যাণ্ডে আসতে আমার বোধকরি দেরি হয়ে গেলো। অনেকেই বোধহয় আগে এখানে এসে সব-কিছু দেখে-শুনে গেছেন।
তাতে কী হলো? বললেন ফ্রিদিকসন : আইসল্যাণ্ড তো ভূতত্ত্বের দেশ। এখনো যে কতো কী দ্রষ্টব্য আছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখানে যে কত পাহাড়-পর্বত, আগ্নেয়গিরি, হিমশৈল আছে কে তার খোঁজ রাখে? বেশি দূরে যাওয়ারই বা কী দরকার? ঐ যে স্নেফেল পর্বত, ও-রকম আশ্চর্য আগ্নেয়গিরি দ্বিতীয় আর নেই দুনিয়ায়। তবু তো পাঁচশো বছর হলো নিভে গেছে।
তাই নাকি? বিপুল আনন্দ চেপে কোনোরকমে কাকামণি বললেন : আমি তাহলে ঐ স্নেফেলেই যাবে। কিন্তু কী করে যাওয়া যায় বলুন তো?
স্থলপথে যেতে হবে আপনাকে। বললেন ফ্রিদিকসন, পথ অবশ্য খুব সোজা, —সমুদ্রতীর ধরে নাক-বরাবর চলে গেলেই হলো।
কিন্তু এখানকার পথ-ঘাট তো জানিনে। একজন গাইড না হলে চলবে কী করে?
গাইডের জন্যে আর ভাববার কী আছে? একটি লোকের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। ওকে বললে ও ঠিক নিয়ে যাবে। লোকটি খুব চালাক আর বিশ্বাসী।
ফ্রিদিকসনকে ধন্যবাদ জানালেন কাকামণি। তা, লোকটির সঙ্গে এক্ষুনি আলাপ করে নেয়া যাবে তো?
না, আজ আর ওকে পাওয়া যাবে না। কোথায় যেন কী-একটা কাজে গেছে। কাল ভোরে ফিরে আসবে। তখনই আলাপ করে নেবেনখন। বললেন ফ্রিদিকসন।
কাকামণি এইভাবে যে নিজের উদ্দেশ্যের কথা একটুও ফাস না করে সমস্ত ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন, তা আমি আগে কল্পনাও করতে পারিনি।