০৩. অম্বা-স্তোত্রম্

কা ত্বং শুভে শিবকরে সুখদুঃখহস্তে
আঘূর্ণিতং ভবজলং প্রবলোর্মিভঙ্গৈঃ।
শান্তিং বিধাতুমিহ কিং বহুধা বিভগ্নাং
মাতঃ প্রযত্নপরমাসি সদৈব বিশ্বে॥

হে কল্যাণকারিণী মাতঃ, তোমার দুই হাতে সুখ ও দুঃখ। কে তুমি? সংসাররূপ জল প্রবল তরঙ্গসমূহ দ্বারা ঘূর্ণায়মান হইতেছে। তুমি কি সর্বদাই নানাপ্রকারে ভগ্ন শান্তিতে জগতে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য যত্নপর হইতেছ?

সম্পাদয়ন্ত্যবিরতং ত্ববিরামবৃত্তা
যা বৈ স্থিতা কৃতফলং ত্বকৃতস্য নেত্রী।
সা মে ভবত্বনুদিনং বরদা ভবানী
জানাম্যহং ধ্রুবমিয়ং ধৃতকর্মপাশা॥

যে নিয়তক্রিয়াশীলা দেবী সর্বদা কৃতকর্মের ফল সংযোজনা করিয়া অবস্থিতা, যাঁহাদের কর্মক্ষয় হইয়া গিয়াছে, তাঁহাদিগকে যিনি মোক্ষপদে লইয়া যান, সেই ভবানী আমাকে সর্বদা বর প্রদান করুন। আমি নিশ্চয়ই জানি, তিনি কর্মরূপ রজ্জু ধারণ করিয়া আছেন।

কিং বা কৃতং কিমকৃতং ক্ব কপাললেখঃ
কিং কর্ম বা ফলমিহাস্তি হি যাং বিনা ভোঃ
ইচ্ছাগুণৈর্নিয়মিতা৮ নিয়মাঃ স্বতন্ত্রৈঃ
যস্যাঃ সদা৯ ভবতু সা শরণং মমাদ্যা॥

এ জগতে যাঁহা ব্যতীত ধর্ম বা অধর্ম অথবা কপালের লেখা বা কর্ম বা (তাহার) ফল, এ সকল কিছুই হইতে পারে না, যাঁহার স্বাধীন ইচ্ছারূপ রজ্জু দ্বারা নিয়মসমূহ পরিচালিত, সেই আদিকারণস্বরূপা দেবী সর্বদা আমার আশ্রয়স্বরূপা হউন।

সন্তানয়ন্তি জলধিং জনিমৃত্যুজালং
সম্ভাবয়ন্ত্যবিকৃতং বিকৃতং বিভগ্নম্।
যস্যা বিভূতয় ইহামিতশক্তিপালাঃ
নাশ্রিত্য তাং বদ কুতঃ শরণং ব্রজামঃ॥

এই সংসারে যাঁহার অপরিমিতশক্তিশালী বিভূতিসমূহ জন্মমৃত্যু-জালরূপ সমুদ্র বিস্তার করিতেছে এবং অবিকারী বস্তুকে বিকৃত ও ভগ্ন করিতেছে, বল, তাঁহার আশ্রয় না লইয়া কাহার শরণাপন্ন হইব?

মিত্রে রিপৌ ত্ববিষমং তব পদ্মনেত্রং
স্বস্থেঽসুখে ত্ববিতথস্তব১০ হস্তপাতঃ।
ছায়া মৃতেস্তব দয়া ত্বমৃতঞ্চ মাতঃ১১
মুঞ্চন্তু মাং ন১২ পরমে শুভদৃষ্টয়স্তে॥

তোমার পদ্মনেত্রের দৃষ্টি—শত্রু-মিত্র উভয়ের প্রতিই সমভাবে পতিত হইতেছে, সুখী দুঃখী উভয়কে তুমি একই ভাবে স্পর্শ করিতেছ। হে মাতঃ, মৃত্যুচ্ছায়া ও জীবন—উভয়ই তোমার দয়া। হে মহাদেবী, তোমার শুভদৃষ্টিসমূহ আমাকে যেন পরিত্যাগ না করে।

ক্বাম্বা শিবা ক্ব গৃণনং মম হীনবুদ্ধেঃ
দোর্ভ্যাং বিধর্তুমিব যামি জগদ্বিধাত্রীম্১৩
চিন্ত্যং শ্রিয়া১৪ সুচরণং ত্বভয়প্রতিষ্ঠং
সেবাপরৈরভিনুতং১৫ শরণং প্রপদ্যে॥

সেই মঙ্গলময়ী মাতাই বা কোথায় এবং হীনবুদ্ধি আমার এই স্তববাক্যই বা কোথায়? আমি আমার এই ক্ষুদ্র দুই হস্ত দ্বারা জগতের বিধাত্রীকে যেন ধরিতে উদ্যত হইয়াছি। লক্ষ্মী যাঁহার চিন্তা করেন, যাঁহার সুন্দর পাদপদ্মে মুক্তি প্রতিষ্ঠিত, সেবাপরায়ণ জনগণ যাঁহার বন্দনা করেন, আমি সেই জগন্মাতার আশ্রয় লইলাম।

যা মাং চিরায়১৬ বিনয়ত্যতিদুঃখমার্গৈঃ
আসংসিদ্ধেঃ স্বকলিতৈর্ললিতৈর্বিলাসৈঃ।
যা মে মতিং১৭ সুবিদধে সততং ধরণ্যাং
সাম্বা শিবা১৮ মম গতিঃ সফলেঽফলে বা॥

সিদ্ধিলাভ না হওয়া পর্যন্ত চিরদিন যিনি আমাকে নিজকৃত মনোহর লীলাদ্বারা অতি দুঃখময় পথ দিয়া লইয়া যাইতেছেন, যিনি সর্বদা পৃথিবীতে আমার বুদ্ধিকে উত্তমরূপে পরিচালিত করিতেছেন, আমি সফলই হই আর বিফলই হই, সেই কল্যাণময়ী জননীই আমার গতি।


(স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ-কৃত পদ্যানুবাদ)
তুলি ঘোর ঊর্মিভঙ্গে,          মহাবর্ত তার সঙ্গে
এ ভবসাগরে কে মা, খেলিতেছ বল না?
শিবময়ী মূর্তি তোর               শুভঙ্করি, একি ঘোর,
সুখ দুঃখ ধরি করে কর সবে ছলনা।
এতই কি তোর কাজ,          সদা ব্যস্ত বিশ্বমাঝ,
অশান্ত ধরায় কি গো শান্তিদান বাসনা?

যে ছিঁড়েছে কর্মপাশ,          তারে করি চিরদাস
নিত্যশান্তি সুধারাশি পিয়াতেছ, জননী,
কার্য করি ফল চায়,          কৃত ফল দিতে তায়
সদাই আকুল তুমি, ওগো হরঘরণী,
জানি মা, তোমায় আমি,          কর্মপাশে বাঁধো তুমি
বেঁধো না বরদে, মোরে, নাশো দুঃখরজনী!

কি কারণে কার্যচয়,          জগতে প্রকট হয়,
সুকৃত দুষ্কৃত কিম্বা ললাট-লিখিত রে,
কেহ না দেখিয়া কূল,          কহয়ে অদৃষ্ট-মূল,
ধর্মাধর্মে সুখ-দুঃখ এ নহে নিশ্চিত রে,
স্বতন্ত্র বিধান যাঁর,           বদ্ধ আছে এ সংসার,
সে মূল শক্তির আমি সদাই আশ্রিত রে।
যাঁহার বিভূতিচয়,          লোকপাল সমুদয়,
যাঁদের অমিত শক্তি কোন বাধা মানে না,
জন্ম মৃত্যু জরা ব্যাধি,          যে সাগরে নিরবধি
সে অনন্ত জলনিধি যাঁহাদের রচনা,
প্রকৃতি-বিকৃতিকারী           এই সব কর্মচারী,
যাঁর বলে বলীয়ান্, কর তাঁরি অর্চনা।

মা তোমার কৃপাদৃষ্টি          সমভাবে সুধাবৃষ্টি,
শত্রু মিত্র সকলের উপরেই কর গো,
সমভাবে ধনী দীনে,          রক্ষা কর নিশিদিনে,
মৃত্যু বা অমৃত, দুয়ে তব কৃপা ঝরে গো,
যাচি পদে, নিরুপমে,          ভুল না মা, এ অধমে,
শুভদৃষ্টি তব যেন সর্বতাপ হরে গো।

বিশ্বপ্রসবিনী তুমি,          ক্ষুদ্রবুদ্ধি জীব আমি,
করিব তোমার স্তুতি বৃথা এই কল্পনা।
সীমাহীন দেশকালে,          ধরে আছ বিশ্বজালে,
তোমায় ধরিতে হাতে উন্মাদের বাসনা,
অকিঞ্চন ভক্তিধন,           রমাভাব্য যে চরণ,
সে পদে শরণ পাই, এই মাত্র কামনা।
স্বচরিত লীলাগার,           মনোহর এ সংসার,
সুখ দুঃখ লয়ে সদা নানা খেলা খেলিছ,
পূর্ণ জ্ঞান দিবে তাই,          জন্ম হতে সুখ নাই,
দুঃখপথ দিয়া মোর করে ধরি চলিছ,
সফল নিষ্ফল হই,           কভু বুদ্ধিহারা নই,
তোমারি প্রসাদে তুমি সদা মোরে রাখিছ,
তুমি গতি মোর, তাই স্নেহে মাগো পালিছ।