০৩. অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কাজ

অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কাজ শুরু হয়ে গেল। পার্ক স্ট্রিটের একটা ফোটোর দোকান থেকে বিশেষ সাইজের ছবি তুলতে হল আমেরিকার ভিসার জন্যে। সুধামাসিকে নিয়ে সকাল নটার মধ্যে আমেরিকান কনসুলেটে হাজির হয়ে অর্জুন দেখল, অরূপ লাহিড়ী নিজে দাঁড়িয়ে আছেন। কথা ছিল ওঁদের কোনও কর্মচারী অর্জুনদের সাহায্য করতে আসবেন।

সুধামাসির সঙ্গে পরিচিত হয়ে অরূপ লাহিড়ী বললেন, একটা কথা বলা হয়নি, আমেরিকানরা ওদের দেশে অবিবাহিতদের যেতে দিতে আদৌ ইচ্ছুক নয়। একলা কোনও মানুষ ওদেশে গেলে ওখানেই থেকে যাবে বলে এদের খুব ভয়।

সে কী! খামোকা থাকতে যাবে কেন?

পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর প্রচুর মানুষ মনে করে ওদের দেশে যেতে পারলে একটানা-একটা কাজ ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। এই কারণে ভিসা দেওয়ার ব্যাপারে এখন কড়াকড়ি আরম্ভ হয়েছে। ওরা নিজেদের দেশের জনসংখ্যা বাড়াতে চায় না।

সুধামাসি বললেন, আমরা কেন থাকতে যাব? জামাইকে দেখতে কদিনের জন্যে যাচ্ছি। এখানে আমাদের সবকিছু ফেলে ওখানে থাকতে যাব কেন?

অরূপ লাহিড়ী বললেন, সেটাই ওঁদের বোঝাতে হবে। অর্জুনবাবুর তো বিয়ে হয়নি, তাই তো? আপনি বলেছেন চাকরিবাকরি করেন না। আপনার প্রফেশন সার্টিফাই করবে এমন কোনও কাগজ কাছে আছে?

অর্জুন মাথা নেড়ে না বলল।

তা হলে কিন্তু আপনি ওদের চোখে অবিবাহিত বেকার। এমনিতে এক্ষেত্রে ভিসা ওরা দেবে না। তবে আপনার পাশপোর্টে আমেরিকান ইমিগ্রেশনের ছাপ আছে। ওটা প্রমাণ করছে আপনি ওদের দেশে গিয়েছিলেন এবং ফিরেও এসেছেন।

ও তো আমাকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে! সুধামাসি বললেন।

সেটাই ওদের বোঝাতে হবে।

তা যদি বলো, আমিও তো কাজকর্ম করি না।

হ্যাঁ। মেসোমশাই যখন জীবিত নন তখন কোনও পিছুটান নেই যে এদেশে ফিরে আসবেন। ওরা বলতেই পারে একথা। আপনার যেসব বিষয়সম্পত্তি আছে তার বিশদ বিবরণ দাখিল করলে ওরা ভাবতে পারে আপনি ফিরে আসবেন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তা হলে কী হবে? আমরা তো সত্যি ওদেশে থাকতে বা বেড়াতে যাচ্ছি না। প্রয়োজনটা যে জরুরি তাতে তো সন্দেহ নেই!

না নেই। গতকাল বিকেলে আমি আপনার মেয়েকে ফোন করেছিলাম। ওঁকে বলেছিলাম দুর্ঘটনার কথা লিখে আপনাকে এবং অর্জুনবাবুকে অবিলম্বে ওখানে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ জানিয়ে ফ্যাক্স করতে। আজ সকালে সেই ফ্যাক্স এসে গেছে। বলুন, এই ফ্যাক্স নিশ্চয়ই কাজে দেবে।

অরূপবাবু নিজে উদ্যোগী হয়ে ফ্যাক্স না আনলে সত্যি ভিসা পেতে অসুবিধে হত। ভিসা অফিসার প্রথমে আপত্তি তুলেছিলেন। শেষপর্যন্ত ফ্যাক্সটি নিয়ে ভেতরে গিয়ে মিনিট দশেক ওদের অপেক্ষায় রেখে বলেছিলেন ভিসার টাকা জমা দিতে। বিকেলবেলায় পাশপোর্ট ফেরত দেওয়া হবে ভিসার ছাপ মেরে।

সেদিনই দমদম থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনে উঠে বসল ওরা। এত দ্রুত সবকিছু হয়ে গেল যাঁর জন্য তাঁকে সুধামাসি প্রাণভরে আশীবাদ করলেন। বেল্ট বাঁধার পর সুধামাসি রললেন, আমার খুব ভয় করছে।

কেন? কী হয়েছে?

আমি এর আগে কখনও প্লেনে উঠিনি।

দার্জিলিং মেলে বসে থাকলে যতটা বিপদ হতে পারে এখানে তার থেকে বেশি বিপদ হবে না সুধামাসি। আমি তো পাশে আছি।

সুধামাসি হেসে ফেললেন।

হাসলে যে?

রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতার কথা মনে পড়ল।

অর্জুন হাসল। সত্যি, এখন আকাশে প্লেন বিপদে পড়লে তার কিছু করার নেই। অথচ কী সহজে সে সুধামাসিকে বলল, আমি তো পাশে আছি। অর্জুন চারপাশে তাকাল। এই প্লেন সরাসরি কলকাতা থেকে ছাড়ে বলে যাত্রীদের অনেকেই বাঙালি। মাসিমা বসেছেন জানলার ধারে, ও তাঁর পাশে। তারপরেই যাতায়াতের পথ, পথের পাশের সিটে থান পরা একজন মহিলা চোখ বন্ধ করে আছেন। অর্জুনের মনে হল, ইনিও ভয় পেয়েছেন। অর্জুন একটু ঝুঁকে বলল, কোনও অসুবিধে হচ্ছে?

বিধবা মহিলা খিঁচিয়ে উঠলেন, দেখছে আহিক করছি, তবু ঝামেলা।

অর্জুন সোজা হয়ে বসল।

প্লেন যখন তিরিশ হাজার ফুট উঁচুতে তখন অর্জুন টয়লেটে গেল। সে লক্ষ করল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের হোস্টেসরা সবাই বেশ লম্বা, সুন্দরী এবং প্রত্যেকের মুখে হাসি লেগে রয়েছে। গতবার আমেরিকা থেকে ফেরার সময় কিছুদিন মেজরের সঙ্গে লন্ডনে এবং আশেপাশে চমৎকার কেটেছিল তার। মেজর এখন কি আমেরিকায় আছেন? বিষ্ণু সাহেব? অর্জুনের হঠাৎ মনে হল, বিদেশবিভুঁই নয়, সে পরিচিত মানুষদের কাছেই বেড়াতে যাচ্ছে। সিটে ফিরে এসে সে দেখল ইতিমধ্যেই এয়ারহোস্টেসরা ট্রলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে খাবার পরিবেশন করতে। অরূপ লাহিড়ী টিকিট করার সময় বলে দিয়েছিলেন সুধামাসির জন্যে নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থা করতে। ওরা তাই দিল। পাশের বিধবা মহিলা কিন্তু খাবার নিলেন না। বাঁ হাত নেড়ে না বলে দিলেন নিঃশব্দে। খাওয়া শেষ করার পর অভিনব কাণ্ডটি দেখল অর্জুন। বিধবা মহিলা তাঁর ব্যাগ খুলে একটা বড় কৌটো বের করলেন। কৌটো খুলতেই দেখা গেল তাতে লুচি এবং আলুর হেঁচকি এবং সন্দেশ রয়েছে। তৃপ্তমুখে তিনি সেগুলো খেতে লাগলেন। ট্রেনে এই দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু প্লেনে কেউ বাড়ির খাবার নিয়ে ওঠে কিনা অর্জুন জানে না। বিধবা মহিলার খাবার দেখে ওঁর ডানপাশে বসা বিদেশিনী ঝুঁকে কিছু বলতেই তিনি সিঁটিয়ে এপাশে সরে এলেন। অর্জুন মন্তব্য শুনল, শান্তিতে খেতেও দেবে না। ভিখিরির দেশ নাকি?

হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে সুধামাসি জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের জিনিসপত্র?

অর্জুন বলল, চিন্তা কোরো না। ওগুলো নিউ ইয়র্কে সোজা চলে যাবে। আমরা ওখানে গেলে পেয়ে যাব। হাঁটতে-হাঁটতে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ওরা যখন ট্রানজিট লাউঞ্জের দিকে এগোচ্ছে তখন বিধবা মহিলা অন্য রাস্তা ধরলেন। অর্জুন বুঝতে পারল উনি লন্ডনেই থেকে যাবেন এবং এই পথে আসা যাওয়ার অভ্যেস আছে। একটাও ইংরেজি শব্দ না জেনেও বাঙালি বিধবা মহিলারা কীরকম বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন আজকাল।

ডিউটি ফ্রি দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে সুধামাসি জিজ্ঞেস করলেন,  রে, আমরা তা হলে বিলেতের মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছি?

অর্জুন হাসল, মাটি এখান থেকে অনেক নীচে। বিলেতের এয়ারপোর্টে বলো।

তোর মেলোমশাই কলেজে পড়ার সময় এখানে এসেছিলেন। সে কতদিন আগের কথা। আমাকে তখনকার গল্প করতেন। টেক্স না কী একটা নদী আছে এখানে?

টেম্‌স।

বিশাল কাচের দেওয়ালের ওপাশে দেখা যাচ্ছে অনেক প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ সুধামাসি প্রশ্ন করলেন, সিরাজের সময় তো প্লেন ছিল না, সমুদ্র বেয়ে যেতে হত। কতদিন লাগত কলকাতায় যেতে?

দু মাসের ওপর।

তখনকার একটা জাহাজে কত লোক ধরত?

ঠিক বলতে পারব না। তবে পাঁচ-সাতশো হবে।

এখান থেকে ইংরেজরা অতদূরে গিয়ে আমাদের দেশ দখল করল কী করে রে? আমি ভাবতেই পারছি না। সমুদ্রে অতদিন থাকলে কত বিপদের সামনে পড়তে হয়। নিশ্চয়ই শয়েশয়ে জাহাজ গিয়েছিল।

না সুধামার্সি। সরকারি সৈন্যরা তো যায়নি, গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন। তাদের জাহাজের সংখ্যাও খুব বেশি হওয়ার কথা নয়।

তা হলে? সিরাজের তো অনেক সৈন্য ছিল, সমুদ্রযাত্রা করে ইংরেজরা নিশ্চয়ই কাহিল ছিল, তবু তারা জিতে গেল কী করে?

মিরজাফরদের জন্যে। ভারতবর্ষে চিরকাল একদল মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে। কিন্তু এসব অতীতের কথা। এখনকার ইংরেজদের অতশত মনেও নেই। কিন্তু লন্ডন শহরে গেলে তোমার মনে হবে তুমি ভারতবর্ষের কোনও বড় শহরে আছ।

কেন?

সব চেনা-চেনা লাগবে। ডাবলডেকার বাস, রাস্তার নামগুলো। এমনকী শেক্সপিয়রের বাড়ি, ডিকেন্সের বাড়ির কথা বইয়ে এত পড়েছে সবাই যে, অচেনা বলে মনে হবে না। রাস্তায় চলার নিয়মগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের কোনও পার্থক্য নেই। আমেরিকায় আবার সব উলটো। ইংরেজরা যা-যা করে, ওরা তার উলটো করে। এমনকী সুইচ টিপে যে আলো জ্বালানো হয় তার পদ্ধতিও বিপরীত করে রেখেছে ওরা। কিন্তু আমাদের সবকিছু ব্রিটিশরা নিজেদের মতো তৈরি করেছে বলে লন্ডনে এলে ভারতীয়দের কোনও অসুবিধে হয় না।

সুধামাসি বললেন, না বাবা। ছেলেবেলা থেকে জেনে আসছি ইংরেজরা আমাদের শত্রু। ক্ষুদিরামকে ফাঁসি দিয়েছিল, সুভাষ বোসকে বন্দি করে রেখেছিল, কত বিপ্লবীকে মেরে ফেলেছে।

অর্জুন হেসে ফেলল।

অ্যাই, হাসছিস কেন?

তোমার শ্বশুরমশাই ছিলেন ইংরেজ আমলের রায়বাহাদুর।

তো কী হয়েছে?

কে না জানে, ইংরেজরা কোনও শিক্ষিত ভারতীয়দের ওপর সন্তুষ্ট হলেই রায়বাহাদুর উপাধি দিত। তা সন্তুষ্ট কেন হত?

সুধামাসির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, এইজন্যেই তো তোর মেলোমশাই-এর সঙ্গে তাঁর বাবার কোনও মিল ছিল না। নিজের বাবাকে তিনি একটুও পছন্দ করতেন না। মায়ের জন্যে তিনি বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি। জলপাইগুড়ির কলেজে চাকরি নিয়ে নিজের মতো ছিলেন। বলতেন, রায়বাহাদুরের ছেলে বলে ভাবতেই লজ্জা লাগে। শুধু ভাবতেনই না, বিশ্বাসও করতেন।

হিথরো এয়ারপোর্ট ঘণ্টা পাঁচেক কাটাতে হবে। সুধামাসিকে টয়লেটে পাঠিয়ে অর্জুন সিগারেট ধরাল। রোজই ভাবে এই সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দেবে। যাকে বলে নিয়মিত খাওয়া তা সে খায় না। কিন্তু হঠাৎ কোনও অলস মুহুর্তে মনে হয় একটা রাই। ঠিক নয়। আমেরিকায় গিয়ে সে একটাও সিগারেট খাবে না বলে ঠিক করল। পৃথিবীর সব ডাক্তাররা যখন বলছেন স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর তখন তা অমান্য করা আর আগুনে আঙুল দেওয়া একই ব্যাপার।

চেয়ারে বসে অর্জুনের মনে হল এ-যাত্রায় কোনও উত্তেজক কিছু ঘটবে না। শুধু যাওয়া-আসা, সুধামাসির কথা রাখা। মা বলেন, তোর কপালে সবসময় কোনও না কোনও গেরো লেগেই থাকে, না? তুই কোথাও বেড়াতে গেলেও ঠিক কেউ সেখানে বদমায়েশি করে বসে। এবার বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সে ঠাট্টা করে বলেছিল, তোমার কোনও চিন্তা নেই। এবারের যাত্রা একেবারে নিরামিষ।

মা বলেছিলেন, দ্যাখো, পেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান কোটে। দ্যাখো, কোথা থেকে কী হয়ে যায়। তবে দয়া করে জড়িয়ো না।

হিথরো এয়ারপোর্টের চেয়ারে বসে অর্জুন মনে-মনে বলল, তেমন হলে তো ভালই হত। কিন্তু মনে হচ্ছে এবারের যাত্রা নেহাতই আলুনি হবে।

সুধামাসি ফিরে এলে অর্জুন গেল পরিষ্কার হতে। পুরুষদের টয়লেটে লজ্জার বালাই বেশ কম। যারা কমোড়ে বসেছে তাদের জুতো পা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। বেসিনগুলোর সামনে নানা দেশের মানুষ। পরিষ্কার হওয়ার পর চুল আঁচড়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে অর্জুনের চোখে পড়ল পাশের বেসিনের কলে সন্তর্পণে দাঁত ধুচ্ছে একটা লোক। বাঁধানো দাঁতের পাটি এর আগেও দেখেছে সে। রাত্রে জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে পরিষ্কার করা হয়। এই লোকটির সেই সুযোগ না থাকায় কলের জলেই ধুয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ অর্জুনের চোখে পড়ল ধোয়ার সময় দাঁতের ভেতরের দিকে টুক করে সাদা রঙের কিছু আটকে ফেলল লোকটা। লম্বা লেবুর কোয়ার মতো বেঁকানো জিনিসটা কি প্লাস্টিকের তৈরি? লাগিয়েই মুখে পুরে ফেলে হাঁ করে দাঁতটা ঠিক বসেছে কিনা আয়নায় দেখল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়ে গরম বাতাস বেরনো মেশিনের নীচে হাত রেখে শুকিয়ে নিল। অর্জুন লোকটাকে দেখল। গায়ের চামড়া সাদা, রুমালে মুখ মুছে বেরিয়ে এল লোকটা।

অর্জুনও ওর পেছনে চলে এল। লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে অর্জুনকে দেখল, দেখে হাসল, পাকিস্তানি?

নো। ইন্ডিয়ান।

আ, ইন্ডিয়ান। গুড়। হোয়ার আর ইউ গোয়িং?

আমেরিকা।

আ। মি ট্র। টুরিস্ট?

ইয়েস।

আই স্টে দেয়ার।

লোকটার গলার স্বর জড়ানো। উচ্চারণে জড়তা আছে। এমনিতে বেশ হাসিখুশি কিন্তু ও যে দাঁতের ভেতর কিছু লুকিয়েছে তাতে অর্জুনের কোনও সন্দেহ নেই। লোকটা চলে যেতেই অর্জুন ফিরে এল সুধামাসির কাছে। সুধামাসি বললেন, কী চমৎকার বানিয়েছে রে। দোকানগুলোতে কতরকমের জিনিস, কিন্তু বড় বেশি দাম।

কিছু খাবে?

পাগল। প্লেনে যা খাইয়েছে তাতে গলা বন্ধ হয়ে গেছে।

এখানে যারা আছে তাদের কেউ লন্ডনে যাবে না?

না। এটাকে বলে ট্রানজিট লাউঞ্জ। যে যার গন্তব্যে যাওয়ার জন্যে প্লেন ধরবে এখান থেকে। তাই এখানে নামলে বিলিতি ভিসার দরকার হয় না। অর্জুন কথা শেষ করতেই রোগামতো এক মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। মহিলার বয়স বেশি নয়, দেখলেই রাগী মেমসাহেব বলে বোঝা যায়।

এক্সকিউজ মি জেন্টলম্যান। ইওর পাশপোর্ট প্লিজ! হাত বাড়ালেন মহিলা। সেইসঙ্গে নিজের আইডেনটিটি কার্ড দেখালেন তিনি। ঝটপট কিছুই পড়তে পারল না অর্জুন। সে পাশপোর্ট বের করে মহিলার হাতে দিল। তিনি কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলেন। তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ওই

লোকটিকে কী করে চিনলেন?

অবাক হয়ে গেল অর্জুন, কোন লোকটি?

যার সঙ্গে টয়লেট থেকে বেরিয়ে কথা বলছিলেন?

ও। ওকে আগে আমি চিনতাম না। টয়লেটেই প্রথম দেখি।

কী বলল লোকটা?

এমনি, সাধারণ কথাবার্তা। কোত্থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি, এইসব।

আর ইউ শিওর, ওকে আগে কখনও দ্যাখেননি?

না। কিন্তু কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন জানতে পারি?

ভদ্রমহিলা এবার হাসলেন, তেমন কিছু নয়। ইনি আপনার সঙ্গে আছেন?

হ্যাঁ। ইনি আমার মাসিমা।

ভদ্রমহিলা সুধামাসির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ঈষৎ হেসে। তারপর বললেন, অজানা লোকের সঙ্গে বেশি কথা না বলাই ভাল, বিশেষ করে যারা গায়ে পড়ে ভাব জমাতে আসে। ওয়েল? মাথা নাড়লেন মহিলা, এইসব কথা আর কাউকে না বললেই ভাল করবেন। ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।

ইংরেজিতে কথা হলেও সুধামাসি কিছু কিছু বুঝতে পারছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কে রে? কার সঙ্গে কথা বলেছিস?

একটা লোক আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আমি পাকিস্তানি কি না!

তাতে দোষ কী হল? এ কি মেয়ে-পুলিশ?

ওইরকমই কেউ হবে।

সময় কাটতে চায় না। সুধামাসিকে বসিয়ে রেখে অর্জুন সামনের দোকানে ঢুকল। কাচের দেওয়ালে আলো পড়ায়, ঝকঝক করছে। একদিকে চকোলেটের এগজিবিশন, অন্যদিকে নানান ধরনের সিগারেটের কার্টুন আর মদের বোতল।

এ-দোকান থেকে ও-দোকানে ঘুরতে-ঘুরতে একটা কফিশপে চলে এল সে। কফিশপ হলেও কোল্ড ড্রিঙ্কস বিক্রি হচ্ছে সে জানল এক কাপ কফির দাম এখানে দেড় পাউন্ড। তার মানে ভারতীয় টাকায় প্রায় চুরাশি টাকা। দোকানে ঢুকে না কিনে বেরিয়ে যেতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। কলকাতা থেকে আসার সময় সুধামাসির টাকায় কিছু ভুলার দুজনের নামে কিনে দিয়েছিলেন অরূপ লাহিড়ী। দাঁত মাজার পর চা বা কফি না খেলে খারাপ লাগে। অর্জুন এককাপ কফি নিয়ে চুমুক দিতেই শুনল, হাই!

সে দেখল ওই লোকটি হাত নেড়ে কাছে এল, কফি?

অর্জুন মাথা নাড়ল, ইয়েস। ড়ু ইউ লাইক ইট? ইচ্ছে করেই অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

ওঃ, নো নো। নো হট ড্রিঙ্ক! সরি! লোকটা হাসল।

ওর বাঁধানো দাঁতের দিকে তাকিয়ে অর্জুনের মনে পড়ল প্লাস্টিকের থলের কথা। গরম জিনিস মুখে গেলে সেই থলে কেটে যেতে পারে বলেই কি ও খাচ্ছে না। এই সময় দুজন লোক হঠাৎ লোকটার দুপাশে চলে এসে তাদের কার্ড দেখিয়ে টানতে-টানতে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দিল। একজন ওর জ্যাকেট, শার্ট প্যান্ট থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ সার্চ করতে লাগল। ওর জুতো খুলেও দেখল ওরা। জ্যাকেটের ভাঁজও পরীক্ষা করা হল। শেষপর্যন্ত কিছুই না পেয়ে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। লোকটা কিন্তু একটুও রাগল না। ফিরে এসে অর্জুনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এরা কী ভাবে বলো তো? সবাই ক্রিমিনাল?