০৩. অবনীমোহনকে ফোন করে

অবনীমোহনকে ফোন করে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি খুব আফসোস করলেন, ইস। ওভাবে হাতে পেয়েও কিছু করা গেল না? কাল রাত্রেই আমাকে জানাতে পারতেন। আচ্ছা, এই মন্মথ দত্ত লোকটি কে?

আমি কখনও দেখিনি। বলল, এ-পাড়ায় গোল চত্বরের পাশে থাকে।

চেহারা?

গাঁট্টাগোট্টা, ট্রাকসুট পরে এসেছিলেন। বছর পঞ্চাশ বয়স।

আপনার কিছু চুরি যায়নি তো?

না, না। সেরকম কোনও সুযোগ তো ওরাং ওটাংটা পায়নি। কুকুর তাড়া করেছিল ওকে। ভয়ে আমার গবেষণার ঘরে ঢুকে পড়েছিল। মেশিনপত্র লণ্ডভণ্ড করেছে। আমি ফোন নামিয়ে রাখলাম। ইচ্ছে করেই অবনীমোহনকে মেয়র স্বর ফিরে পাওয়ার কথা বললাম না। এটা নিয়ে এখনই কোনওরকম প্রচার হোক আমি চাই না।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে গবেষণার ঘরে ঢুকেছিলাম। মেশিন ঠিক করতেই দুপুর গড়িয়ে এল। আজ আকাশ মেঘমুক্ত ভয় পাওয়া ওরাং ওটাং যদি এ-ঘরে না ঢুকত, তা হলে এই সময়টা নষ্ট হত না। দুপুরের খাবার আমি ঠিক সাড়ে বারোটায় খাই। দরজা খুলে বের হতেই দেখলাম গঙ্গাপদ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ডায়েরি। গঙ্গাপদ সামান্য লিখতে-পড়তে জানে দেখে আমি হুকুম দিয়েছি গবেষণাঘরে থাকার সময় যদি কোনও ফোন আসে তা হলে আমাকে বিরক্ত না করে নাম এবং টেলিফোন নাম্বার লিখে রাখতে। জরুরি কিছু মনে হলে আমি নিজেই তাদের ফোন করব।

ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। সাতজন সাংবাদিকের নাম লেখা রয়েছে, পাশে তাদের কাগজের নাম। শুধু কলকাতার নয়, দিল্লি, মুম্বই থেকেও ফোন এসেছিল। এই এত সাংবাদিক একসঙ্গে আমার কাছে কী জানতে চাইছেন? গঙ্গাপদকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কিছু বলেছেন?

হ্যাঁ। সবাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলেন। আপনি এখন কাজ করছেন শুনে সবাই জিজ্ঞেস করছিল এ বাড়ির বোবা কুকুরকে আপনি স্বর ফিরিয়ে দিয়েছেন একথাটা সত্যি কিনা? গঙ্গাপদ এক-নিশ্বাসে বলে গেল।

তুমি কী বলেছ?

আমি বলব কী! মেয়টা এমন চেঁচাচ্ছিল যে, ওরা ওর গলা শুনতে পেয়েছে। আমি বললাম, আপনারা বাবুর কাছেই যা শোনার শুনবেন।

তুমি কি আজ কাউকে বলেছ মেয় হঠাৎ ডাকাডাকি করছে?

না বাবু। আমি তো আজ বাড়ির বাইরে যাইনি। বলতে বলতেই ফোন বাজল। এগিয়ে গিয়ে আমিই রিসিভার তুললাম। কলকাতার এক নামী ইংরেজি কাগজের সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, সার, খবরটা কি সত্যি? সত্যি হলে এখনই আপনার ইন্টারভিউ চাই।

কী ব্যাপারে বলছেন?

আপনি নাকি শব্দ ব্যবহার করে আপনার বোবা কুকুরের গলায় স্বর আনতে পেরেছেন। এটা কি সত্যি?

এ-খবর আপনারা কোথায় পেলেন?

এক ভদ্রলোক নাকি বিবিসি-কে খবরটা জানিয়েছেন। বিবিসি আজ সকালেই খবরটা ব্রডকাস্ট করেছে। এখন তো সমস্ত পৃথিবীর মানুষ জানে। কিন্তু সার, আপনার সঙ্গে আমাদের যা সম্পর্ক তাতে আমরাই নিউজটার সঙ্গে আপনার ইন্টারভিউ ছাপার সৌভাগ্য পেতে পারি। আমি এখনই আপনার কাছে যেতে চাই।

আমি বিচলিত হলাম, দেখুন, আপনারা যা শুনেছেন, তা সত্যি নয়। আমি রিসিভার নামিয়ে রাখতেই ফোন বাজল। এবার বিবিসি থেকে। আমি তাদের খুব বকাবকি করলাম আমার সঙ্গে কথা না বলে ওরকম একটা খবর প্রচার করার জন্যে। বললাম, পুরোটাই মিথ্যে, একদম মিথ্যে।

কিন্তু আমি যাই বলি ফোন আসা বন্ধ হল না, উলটে বাড়িতে সাংবাদিক থেকে শুরু করে টেলিভিশনের লোক ভিড় জমাল। গঙ্গাপদকে আমি বলে দিয়েছিলাম, যে কেউ আসুক বলে দেবে আমি বাড়িতে নেই। পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড় আমার! গঙ্গাপদকে বাহবা দিতে হয়। সে মেয়ের মুখ বেঁধে ওকে চেনবন্দি করে রেখে সাংবাদিকদের সামলাল। আমি বাড়িতে নেই, কোথায় গিয়েছি সে জানে না। কিন্তু গদাপদ যতই বলুক, লোকজনের ভিড় লেগেই রয়েছে দরজায়। একজন প্রেস ফোটোগ্রাফার লুকিয়েচুরিয়ে সারের ছবি তুলে নিয়ে গেছে। ফোটো দেখে অবশ্য মেয়র সঙ্গে ওর তফাত করা মুশকিল হবে।

আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না প্রথমে, তারপর মনে হল ওই মন্মথ দত্ত এই কাণ্ডটা করেছে। ও-ই নিশ্চয়ই বিবিসি-কে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু লোকটাকে আমার খুবই সাধারণ বলে মনে হয়েছিল। বিবিসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে কজন বাঙালি চট করে পারে? মন্মথ দত্ত যখন পেরেছে তখন আর ওকে সাধারণ ভাবা ঠিক নয়। তারপরই মনে হল, ওরাং ওটাংটা ওর পোষা নয় তো? কায়দা করে আমার বাড়িতে ঢুকে প্রাণীটিকে পালাবার সুযোগ করে দিল! কেন যে লোকটাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিলাম।

বিকেলে অবনীমোহনকে ফোন করলাম। রিসিভার তুলে আমার গলা পেয়ে অবনীমোহন উত্তেজিত, আরে, অভিনন্দন। আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনার গবেষণা যে সফল হয়েছে তাতে আমি খুব আনন্দিত। তবে আজ সকালে যখন ফোন করেছিলেন তখন আপনি খবরটা প্রকাশ করেননি বলে একটু অভিমান হয়েছিল। পরে যতবার ফোন করেছি আপনাকে,গঙ্গাপদ একই বুলি আওড়ে গিয়েছে, আপনি বাড়িতে নেই।

বললাম, অবনীমোহন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে?

নিশ্চয়ই।

আমি এখন পর্যন্ত কোনও আবিষ্কার করিনি।

সে কী! আপনি যে শব্দ নিয়ে গবেষণা করছেন সে কথা তো আগেও আমায় বলেছেন। তা হলে? অবনীমোহন খুব অবাক হয়ে গেলেন।

গবেষণার কথা মিথ্যে নয়। কিন্তু আবিষ্কার করিনি কিছু। গত রাত্রে ওরাং ওটাং আমার গবেষণার ঘরে ঢুকে, যে দুর্ঘটনা ঘটায় তার ফলে মেয় স্বর পেয়েছে। এটা নিতান্তই দুর্ঘটনা। কিন্তু গুজব প্রচার হয়ে যাওয়ায় তা সত্যি বলে বিশ্বাস করছে যারা, তারা আমায় পাগল করে দিচ্ছে।

কিন্তু কে গুজব ছড়াল?

বুঝতে পারছি না। ভোরবেলায় মন্মথ দত্ত এসেছিল। ওর কথা তোমাকে বলেছি। তাকে বলেছিলাম মেয়র স্বর ফিরে পাওয়ার কথা। ও এসেছিল দুটো বোবা কুকুর কিনতে। মনে হয় ওই প্রচার করেছে।

কিন্তু মন্মথ দত্ত নামের কেউ আপনার পাড়ায় থাকে না।

থাকে না?

না। লোকটা একটা ঠগ।

সে কী?

হ্যাঁ। আর মনে হচ্ছে ওই ওরাং ওটাংটা লোকটার পোষা জীব। ও ধরা পড়তেই মুক্ত করতে আপনার বাড়িতে এসেছিল।

তার মানে ও জানত ওরাং ওটাং আমার বাড়িতে আছে।

তাই মনে হচ্ছে। চুরি করতেই পাঠিয়েছিল।

কিন্তু আমার বাড়িতে কী চুরি করবে?

তা তো জানি না। যদি কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হয়, বলবেন।

আমি ধন্দে পড়ে গেলাম। মন্মথ দত্ত ঠগ হতে পারে কিন্তু আমার বাড়িতে চুরি করতে চাইবে কেন? তারপরেই মনে পড়ল লোকটা মানুষের শখের জিনিস পাইয়ে দেওয়ার দালালি করে বলেছিল। বিদেশেও ওর ক্লায়েন্ট আছে। এমন হতে পারে আমার গবেষণার ঘরই ওর লক্ষ্য ছিল। এটা ভাবতেই খুব নার্ভাস হয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু ডক্টর বব উইলসকে ফোন করলাম। ববের গলা পাওয়া গেল। উচ্ছ্বসিত। বলল, ওহহ! কতবার তোমাকে ধরার চেষ্টা করেছি কিন্তু শুধু এনগেজড শুনেছি। তোমার খবরটা বিবিসি-তে শুনলাম।

আমি কথা না বাড়িয়ে সমস্ত ঘটনাটা সংক্ষেপে বললাম। শোনামাত্র বব উত্তেজিত হয়ে পড়ল, কী বললে? ওরাং ওটাং?

হ্যাঁ।

তা হলে তুমি খুব বিপদের মধ্যে আছ বন্ধু। তোমাদের দেশে এই প্রাণীটি জন্মায় না যখন, তখন কেউ বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে ওকে। তোমার গবেষণার ব্যাপারে যাদের আগ্রহ আছে তারাই এই কাণ্ডটি ঘটাতে পারে। সাবধান হও।

বব তে বলল, আমি কী করে সাবধান হব? রাত্রে গঙ্গাপদ এসে জানাল এক সাহেব ইংরেজিতে কথা বলছে টেলিফোনে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ভাবলাম বব বুঝি আবার ফোন করেছে। রিসিভার তুলতেই যে গলা পেলাম তা অবশ্যই কোনও ইংরেজের নয়। পরিচয় জানার পর খুব বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনার গবেষণার ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী। যদি একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই তবে ধন্য হব।

আপনি কে? কোনও বিজ্ঞানী?

না, না। সেই পাণ্ডিত্য আমার নেই। তবে আপনি যে বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তা শেষ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। স্লাপনার সরকারের কাছে যে আবেদন আপনি করেছেন তা এখনও লাল ফিতেয় আটকে আছে। আপনি সম্মত হলে আমি ফিনালের দায়িত্ব নিতে রাজি আছি।

আমি আপনাকে চিনি না, জানি না, এরকম প্রস্তাব কেন দিচ্ছেন?

আপনি বিজ্ঞানের সাধক। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে আমার সাহায্য যদি কাজ দেয় তা হলে ধন্য হব আমি। আপনি ভেবে দেখুন, আগামীকাল আবার ফোন করব। গুড নাইট। লাইন কেটে দিল লোকটা।

হ্যাঁ, আমার অর্থের প্রয়োজন আছে। এই বিশাল কর্মকাণ্ড কোনও ব্যক্তির নিজস্ব সঞ্চয় থেকে শেষ করা সম্ভব নয়। আমি সরকারের কাছে আবেদন করেছি। তাঁরা বিষয়টি বিবেচনা করছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু লাল ফিতের বাঁধন তো সহজে খোলার নয়। সমস্যা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউ আমাকে আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দেবে, এমনটাও কল্পনা করিনি। লোকটার কথা বলার ভঙ্গিতে বেশ দৃঢ়তা ছিল। আমার কাজের কথা অনেকেই জানেন। এ-নিয়ে হাসাহাসিও চলে বলে শুনেছি। কিন্তু এই কাজ শেষ করতে যে বিপুল অর্থের দরকার তা কি ফোনের ভদ্রলোক জানেন? তারপরই খেয়াল হল, অজানা কেউ খামোকা আমাকে অত টাকা দিতে যাবে কেন? কী স্বার্থ তার?

খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারলাম না। ভোরবেলায় মনে অন্য চিন্তা এল। মন্মথ দত্ত, ওরাং ওটাং এবং এই সাহেবের টেলিফোন, তিনটেই একসূত্রে বাঁধা নয় তো? দ্রুত গবেষণার ঘরে চলে এলাম। যে আলমারিতে আমার গবেষণার কাগজপত্র থাকে সেটা খুলে পরীক্ষা করলাম। না, সব ঠিক আছে।

গতকাল লোকটি বলেছে আজ আবার ফোন করে আমার অভিমত জানতে চাইবে। লোকটির উদ্দেশ্য যদি ভাল হয় তা হলে সাহায্য নিতে আমার আপত্তি থাকবে কেন? যদি তা না হয়? বব যে সন্দেহ মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে সেটা ছোবল মারতে লাগল। মনে হল, অবনীকে একটা ফোন করি।

অবনী তাঁর বাড়িতেই ছিলেন। শুনে বললেন, অদ্ভুত! লোকটা পরিচয় দেয়নি?

না।

আজ আবার ফোন করবে বলেছে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে, ফোন করলে ওর পরিচয়, ঠিকানা জিজ্ঞেস করবেন। আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি আছি। অবনী হাসলেন।

বুঝলাম, ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না তিনি। একটা ওরাং ওটাং ঢুকেছিল আর একজন উড়ো ফোন করেছিল। পুলিশের অনেক কাজ আছে, এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে কেন? কিন্তু মন থেকে অস্বস্তি যাচ্ছিল না। ঠিক এই সময় অমলের কথা মনে পড়ল। অমল সোম। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। বছর দশেক আগে কালিম্পং-এ ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সত্যসন্ধান করেন। দু-একবার চিঠিপত্রেও যোগাযোগ হয়েছে। উপন্যাসের বাইরে গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়ে আমার কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না এবং নেই, কিন্তু অমল সোমকে ভারী পছন্দ হয়েছিল। ঠিক করলাম ওঁকে সব কথা খুলে বলব। চিঠিতে নয়, টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এখানে আসতে বলি তাঁকে। গঙ্গাপদকে দিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলাম। ঠিক করলাম, অমল সোমের জবাব না পাওয়া পর্যন্ত নিজেকে আড়ালে রাখব, এমনকী টেলিফোনও ধরব না।