॥ ৩ ॥
অপ্সরা থিয়েটারে পৌঁছে দেখি লালমোহনবাবু অপেক্ষা করছেন।
‘কী ব্যাপার মশাই?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
‘আজ কাগজ দেখেননি?’
‘দেখেছি বৈ কি। মহীতোষ রায় ত হাওয়া।’
‘হাওয়া কেন, বোধহয় খতম।’
সংক্ষেপে লালমোহনবাবুকে সকালের ঘটনাটা বলে দিল ফেলুদা।
‘তাহলে এখন কি আমরা থিয়েটারে তদন্ত চালাবো?’
‘একবার অন্তত ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলি।’
আমরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, এবার গিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। গেটে দারোয়ান বলল ম্যানেজারের নাম কৈলাস বাঁড়ুজ্যে। তিনি তাঁর অফিসেই আছেন।
ম্যানেজারের আপিসে পৌঁছতে গেলে একটা ঘর পেরোতে হয়। সেখানে একজন ভদ্রলোক একটা টেবিলের সামনে বসে কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন, জিগ্যেস করলেন আমাদের কী দরকার।
ফেলুদা এবার তার একটা কার্ড বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বলল, ‘একবার যদি কৈলাসবাবুর সঙ্গে দেখা করতে পারি।’
ভদ্রলোক আমাদের অপেক্ষা করতে বলে গেলেন ভিতরের দিকে। মিনিটখানেক পরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আপনারা আসতে পারেন।’
আমরা তিনজনে গিয়ে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকলাম। বেঁটে, মোটা, কালো ভদ্রলোক। নাকের নীচে একটা সরু গোঁফ, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। বললেন, ‘আপনার নাম ত শুনেছি, কিন্তু হঠাৎ আমার এখানে আসার প্রয়োজন হল কেন সেইটেই ভাবছি।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনার একজন অভিনেতা সম্বন্ধে কিছু জানার ছিল—যিনি দুদিন হল নিখোঁজ।’
‘মহীতোষের কথা বলছেন? সে ব্যাপারে ত পুলিশ এসে এক দফা এনকোয়ারি করে গেছে।’
‘ভদ্রলোক আমার কাছে এসেছিলেন। কতকগুলো হুম্কি চিঠি পেয়েছিলেন সেই নিয়ে আমার পরামর্শ নিতে।’
‘হুম্কি চিঠি? তাহলে কি ও খুন হয়েছে নাকি? আমি ত ভাবলাম পাওনাদারের কাছ থেকে গা ঢাকা দিয়েছে।’
‘না। ঠিক সেরকম মনে হচ্ছে না।’
‘অবিশ্যি ও গিয়ে যে আমাদের একটা খুব বড় রকম ক্ষতি হয়েছে তা বলতে পারছি না। প্রশান্ত মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছে। পুলিশ কালকেই এসেছিল। আমরা বিশেষ কোনো ইনফরমেশন দিতে পারিনি। মহীতোষ একটু চাপা টাইপের চরিত্র ছিল। ওর কারুর সঙ্গে খুব একটা মাখামাখি ছিল না। অভিনয়টা মোটামুটি ভালোই করত। তবে ওর ইচ্ছে ছিল প্রফুল্লতে মেন রোল করবার; সে ক্ষমতা ওর ছিল না।’
‘ওঁর কোনো শত্রু ছিল না বলছেন?’
‘বলছি ত—শত্রুও না, বন্ধুও না।’
‘জগন্ময় ভট্টাচার্য বলে এককালে আপনাদের একজন অভিনেতা ছিলেন?’
‘ছিল, কিন্তু তাকে ত অনেকদিন আগেই ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘তাঁর জায়গাতেই মহীতোষকে নেওয়া হয়, তাই না?’
‘তা বটে। এটা আপনি ঠিক বলেছেন, আমার খেয়াল হয়নি।’
‘এই জগন্ময় ভট্টাচার্যের বাড়ির ঠিকানা আপনার কাছে আছে?’
‘পুরোন ঠিকানা আছে, সে ত এখন সেখানে নাও থাকতে পারে।’
‘তবু একটা চান্স নেওয়া যেতে পারে।’
কৈলাসবাবু একটা ঘণ্টা টিপলেন। পাশের ঘর থেকে একটি বছর পঁচিশ বয়সের ছেলে এসে দাঁড়াল।
‘এদের জগন্ময়ের ঠিকানাটা দিয়ে দাও ত।’
এক মিনিটের মধ্যেই ঠিকানা এসে গেল। সাতাশ নম্বর নির্মল বোস স্ট্রীট। লালমোহনবাবু বললেন রাস্তাটা ওঁর জানা। আমরা উঠে পড়লাম।
নির্মল বোস স্ট্রীট শ্যামবাজারেরই একটা গলি। জগন্ময়বাবুর বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ করে জানলাম ভদ্রলোক এখনো সেখানেই আছেন। ফেলুদা চাকরের হাতে তার কার্ডটা পাঠিয়ে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের ডাক পড়ল। আমরা একটা তক্তপোষ পাতা ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। তাতে একটি রোগা-রোগা কেন, রুগ্ন বললেই বোধহয় ঠিক বলা হবে—ভদ্রলোক বসে আছেন। আমরা ঘরে ঢোকাতেও তিনি বসেই রইলেন।
‘হঠাৎ আমার সঙ্গে ডিটেকটিভের কী প্রয়োজন পড়ল?’—ভদ্রলোকের প্রথম প্রশ্ন।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি কি মহীতোষ রায় বলে একজন অভিনেতাকে চিনতেন?’
‘চিনতুম বললে ভুল হবে। সে এল, আর আমি বরবাদ হয়ে গেলুম—এই চেনা। কিন্তু সে ত দেখছি উধাও হয়ে গেছে।’
‘উধাও নয়, খুব সম্ভবত খুন হয়েছেন।’
‘খুন? অবিশ্যি আমার তাতে যে বুক ফেটে কান্না আসবে তা নয়। সে আমার ভাত মেরেছিল, সেটাই হচ্ছে আমার কাছে সব চেয়ে বড় ট্রুথ।’
‘তার মৃত্যুর আগে মহীতোষবাবু কতকগুলো হুম্কি চিঠি পেয়েছিলেন। সেই ব্যাপারে আপনি কোনো আলোকপাত করতে পারেন?
‘আমি চিঠিগুলো লিখেছিলাম কিনা সেইটাই জানতে চাইছেন ত?’
‘আপনার তার উপরে এখনো যথেষ্ট আক্রোশ আছে দেখছি।’
‘সেটা আপনি কথাটা তুললেন বলে। মহীতোষ রায়ের ব্যাপার অতীতের ব্যাপার। এই নিয়ে আর আমি মাথা ঘামাই না। আমি তারপরে দীপ্তি থিয়েটারে কাজ পেয়ে যাই, এখনো সেখানেই আছি, যা পাচ্ছি তাতে আমার চলে যায়। মদ ছেড়ে দিয়েছি। আমি সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। কেবলমাত্র একটা সমস্যা আছে সে হল হাঁপের কষ্ট। এছাড়া আমি দিব্যি আছি। মহীতোষের কথা আপনি মনে করিয়ে দিলেন বলে। নইলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।’
‘আপনি অপ্সরা ছাড়ার পর মহীতোষবাবুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?’
‘নো স্যার। একবারও না। এমনকি মঞ্চে পর্যন্ত ওকে দেখিনি। অপ্সরা থিয়েটারে আমি যাই না।’