৩৯তম অধ্যায়
ধর্ম্মনীতি
বিদুর কহিলেন, “হে মহারাজ! যিনি সজ্জনগণকর্ত্তৃক সম্পূজিত হইয়া গর্ব্বপরিত্যাগপূর্ব্বক অর্থোপার্জ্জন করেন, তিনি অতি শীঘ্রই যশস্বী হইয়া উঠেন। সাধুগণ প্রসন্ন হইলে সাতিশয় সুখলাভ হইয়া থাকে। যে মহাত্মা অধৰ্মলব্ধ বিপুল অর্থে আসক্ত না হইয়া উহা পরিত্যাগ করেন, তিনি ত্যক্তনির্মোক ভুজঙ্গের ন্যায় সর্ব্বদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালযাপন করেন। মিথ্যাচরণদ্বারা জয়লাভ, রাজার ক্রূদ্রতা ও গুরুর মিথ্যায় আগ্রহাতিশয়—এই তিনটি ব্ৰহ্মহত্যার সদৃশ। অসূয়া মৃত্যুতুল্য, অত্যুক্তি সম্পত্তিনাশের নিদান এবং অশুশ্রূষা [শুনিতে অনিচ্ছা], ত্বরা [অধীরতা] ও শ্লাঘা এই তিনটি বিদ্যার পরমশত্রু। আলস্য, মদ, মোহ, চপলতা, গোষ্ঠী [বহু লোকের সহিত মেলামেশা], ঔদ্ধত্য, দর্প ও লুব্ধতা এই কয়েকটি বিদ্যার্থিগণের দোষ। সুখার্থীর বিদ্যালাভ হয় না এবং বিদ্যার্থীর সুখসম্ভোগের সম্ভাবনা থাকে না; অতএব সুখার্থীকে বিদ্যা এবং বিদ্যার্থীকে সুখ পরিত্যাগ [সুখার্থীর বিদ্যা ব্যর্থতায় পরিণত হয়] করিতে হইবে। রাশি রাশি কাষ্ঠ প্ৰদান করিলেও অগ্নির তৃপ্তিলাভ হয় না, শত শত নদী সমাগমেও সমুদ্রের তৃপ্তিলাভ হয় না, সমুদয় প্রাণী সংহার করিলেও অন্তকের [যম] তৃপ্তিলাভ হয় না। আশা ধৈৰ্য্য নাশ করে, অন্তক সমৃদ্ধি নাশ করেন, ক্ৰোধ শ্ৰী নাশ করে, যশ কদৰ্য্যতা বিনাশ করে, অপালন পশুসমুদয়কে বিনাশ করে এবং ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইলে সমস্ত রাজ্য উৎসাদিত হয়।
“হে রাজন! অজ, অশ্ব, কাংস্য, রজত, মধু, অক্ষ, সজ্জন, শ্রোত্রিয়, বৃদ্ধ, জ্ঞাতি ও অবসন্ন কুলীন—এই সমুদয় তোমার গৃহে সতত অবস্থান করুন। মনু কহিয়াছেন, আজ, বৃষ, চন্দন, বীণা, আদর্শ [আয়না], মধু, ঘৃত, লৌহ, তাম্রপাত্ৰসমূহ, শালগ্রাম, দক্ষিণাবর্ত্ত শঙ্খ, রোচনা [গোরোচনা] ও ধান্য-এই সমুদয় দ্রব্য সাতিশয় মঙ্গলাবহ; দেবতা, ব্রাহ্মণ ও অতিথিগণের পূজাসাধনাৰ্থ এই সমুদয় দ্রব্য গৃহে রক্ষা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। হে রাজন! আমি সমুদয় পুণ্যোপদেশ অপেক্ষা গুরুতর আর এক উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ করুন। কাম, লোভ বা ভয়প্রযুক্ত ধর্ম্ম পরিত্যাগ করা দূরে থাকুক, আপনার প্রাণরক্ষার নিমিত্তও কদাপি ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিবে না। ধর্ম্মনিত্যপদার্থ, সুখ ও দুঃখ অনিত্য, জীব নিত্য, কিন্তু উহার হেতু অবিদ্যা অনিত্য; অতএব আপনি অনিত্য বস্তু পরিত্যাগপূর্ব্বক নিত্যবস্তুতে অভিনিবিষ্ট হইয়া সাতিশয় সন্তোষে কালব্যাপন করুন। সন্তোষই পরমলাভ। দেখুন, ধনধান্যপূর্ণ বসুন্ধরার শাসনকর্ত্তা মহাবলপরাক্রান্ত মহানুভব ভূপতিগণকেও পরিশেষে রাজ্য ও বিপুল বিষয়ভোগ পরিত্যাগপূর্ব্বক শমনের বশীভূত হইতে হইয়াছে। মনুষ্যগণ বহুদুঃখজনক মৃতপুত্ৰকে গৃহ হইতে দূরীকৃত করিয়া মুক্তকেশে ক্রন্দন করিতে করিতে তাহাকে কাষ্ঠের ন্যায় চিতাগ্নিমধ্যে নিক্ষেপ করিয়া থাকে। মৃতব্যক্তির ধনসম্পত্তি অন্যে সম্ভোগ করে, পক্ষিসকল তাহার শরীর ভক্ষণ করে এবং তাহার শরীরগত ধাতুসমুদয় অগ্নিতে দগ্ধ হয়, সে কেবল পুণ্য ও পাপে পরিবৃত হইয়া পরলোকে গমন করে। যেমন পক্ষিগণ ফলপুষ্পবিহীন বৃক্ষ পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রস্থান করে, তদ্রূপ জ্ঞাতি, সুহৃৎ ও পুত্ৰগণ মৃত ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিয়া স্ব স্ব গৃহাভিমুখে প্রতিনিবৃত্ত হয়। কেবল স্বকৃত কর্ম্মসমুদয় ভস্মীভূত ব্যক্তির সহগাত্র হয়; অতএব অতিশয় যত্ন সহকারে ধর্ম্মসঞ্চয় করিবে।
“হে মহারাজ! স্বৰ্গ ও পাতালে অতি ভয়ানক ইন্দ্ৰিয়গণের মহামোহজনক অন্ধতামিস্ৰাখ্যা নরক আছে; সাবধান, যেন সেই নরক আপনাকে স্পর্শ করিতে না পারে। হে রাজন! যদি আপনি মনোনিবেশপূর্ব্বক আমার এই সমুদয় বাক্যশ্রবণ করিয়া হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন, তাহা হইলে ইহলোকে যশস্বী হইবেন ও পরলোকে নিৰ্ভয়ে স্বৰ্গলাভ করিবেন। পরমপবিত্ৰ লোভশূন্য আত্মা নদীস্বরূপ, পুণ্য তাহার তীর্থ, সত্য তাহার জল, ধূতি তাহার কুল ও দয়া তাহার তরঙ্গস্বরূপ। লোভহীন পুণ্যাত্মা ব্যক্তিগণ সেই নদীতে স্নান করিয়া পবিত্র হয়েন। হে মহারাজ! আপনি ধূতিময়ী নৌকা অবলম্বন করিয়া জন্মরূপ দুর্গ ও কামক্ৰোধারূপ জাল-জন্তুযুক্ত পঞ্চেন্দ্ৰিয়রূপ সলিলপরিপূর্ণ নদী পার হউন। যে ব্যক্তি কাৰ্য্য কি অকাৰ্য্য সকল বিষয়েই প্রজ্ঞাবৃদ্ধ,
জিজ্ঞাসা করে, তাহাকে কদাপি মুগ্ধ হইতে হয় না। ধৈৰ্য্যসহকারে শিশ্ন ও উদর রক্ষা করিবে, চক্ষুদ্বারা হস্ত-পদ রক্ষা করিবে, মনোদ্বারা চক্ষু ও কর্ণ রক্ষা করিবে এবং কর্ম্মদ্বারা মন ও বাক্য রক্ষা করিবে। যে ব্ৰাহ্মণ নিত্য উদককাৰ্য্য [সন্ধ্যাতর্পণাদি] সম্পাদন, নিত্য যজ্ঞোপবীতধারণ, নিত্য বেদাধ্যয়ন, পতিতান্নপরিত্যাগ, সত্যবাক্যপ্রয়োগ ও গুরুর কাৰ্য্যসাধন করেন, তাঁহাকে ব্ৰহ্মালোক হইতে চ্যুত হইতে হয় না। যে ক্ষত্ৰিয় বেদ-অধ্যয়ন, সংগ্রামে দেহত্যাগ, যথাস্থানে বহিঃস্থাপন, যজ্ঞসম্পাদন, প্ৰজা পালন ও গো-ব্রাহ্মণার্থ প্ৰাণ পৰ্য্যস্ত পরিত্যাগ করেন, তাঁহার স্বৰ্গলাভ হয়। যিনি বেদধ্যয়ন, যথাকলে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয় ও আশ্রিতদিগকে ধন ভাগানুসারে প্রদান এবং ত্রেতাগ্নির [অগ্নিত্ৰয়-গাৰ্হপত্য, আহবণীয়, দক্ষিণ] পবিত্র ধূম আঘ্রাণ করেন, সেই বৈশ্য চরমে সুরলোকে গমনপূর্ব্বক দিব্যসুখসম্ভোগ করিয়া থাকেন। যে শূদ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকে পূজাদ্বারা পরিতুষ্ট করিয়া স্বীয় পাপসকল দগ্ধ করিতে পারে, সে পরলোকে স্বৰ্গভোগ করে। হে মহারাজী! আমি যে নিমিত্ত আপনাকে এই চারিবর্ণের ধর্মের বিষয় কহিলাম, তাহা শ্রবণ করুন। পাণ্ডুনন্দন যুধিষ্ঠির প্রজাপালন না করিয়া ক্ষত্রিধর্ম্ম হইতে পরিচুত্যুত হইতেছেন, অতএব আপনি তাঁহাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করুন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদূর! তুমি অনুক্ষণ আমাকে এরূপ উপদেশ প্ৰদান করিয়া থাক, আমারও উহাতে বিলক্ষণ সম্মতি আছে। আমি পাণ্ডবগণকে রাজ্য প্রদান করিতে সতত অভিলাষী, কিন্তু দুৰ্য্যোধনকে স্মরণ করিলেই আমার বুদ্ধির বৈপরীত্য জন্মে। যাহা হউক, দৈব অতিক্রম করা কাহারও সাধ্য নহে, অতএব আমার মতে দৈবই প্রধান, পুরুষকার নিরর্থক।”
প্ৰজাগরপার্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।