মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
যেমতে হইল শুন সৃষ্টি সংঘটন।।
ব্রহ্মার মানস-পুত্র হৈল ছয় জন।
মরীচি অঙ্গিরা অত্রি ক্রতু জ্ঞানবান।।
পুলহ পুলস্ত নামে আর দুইজন।
এই ছয় জন হৈতে জন্মে ত্রিভুবন।।
মরীচি ব্রহ্মার পুত্র ত্রিজগতে জ্ঞাত।
তাঁর পুত্র হইল কশ্যপ মুনি খ্যাত।।
ত্রয়োদশ নিজ কন্যা দক্ষ প্রজাপতি।
কশ্যপে করেন দান হয়ে হৃষ্টমতি।।
দক্ষের দুহিতাগণ ধরে যেই নাম।
একে একে বলি শুন নৃপ গুণধাম।।
অদিতি কপিলা দনু কদ্রু মুনি ক্রোধা।
দনায়ু সিংহিকা কালা দিতি আর প্রধা।।
বিশ্বা আর বিনতা যে তের জন গণি।
তের জনে যত জন্মে শুন নৃপমণি।।
অদিতির গর্ভে হৈল আদিত্য দ্বাদশ।
যাঁহার কিরণে এই প্রকাশে দিবস।।
ইন্দ্রি আদি দেবগণ আর বিবস্বান্।
ইহারাও কশ্যপের সুত মতিমান্ ।।
বিবস্বান্ হইতে হইল সমুদ্ভূত।
বৈবস্বত মনু আর যম দুই সুত।।
এই বৈবস্বত মনু হৈতে তারপর।
জনমিল পৃথিবীতে মানব নিকর।।
হিরণ্যকশিপু হৈল দিতির তনয়।
দেবের পরম শত্রু, প্রতাপে দুর্জ্জয়।।
হিরণ্যকশিপু পুত্র হৈল পঞ্চজন।
প্রধান প্রহ্লাদ পুত্র ত্রৈলোক্য পাবন।।
তিন পুত্র হৈল তার মহা ধনুর্দ্ধর।
বিরোচন কুম্ভ আর নিকুম্ভ সুন্দর।।
বিরোচন পুত্র হৈল বলি মহাশয়।
তাঁর পুত্র বাণ বীর ভুবনে দুর্জ্জয়।।
মহাকাল নাম তার, শিবের কিঙ্কর।
সহস্রেক ভুজেতে ভূষিত কলেবর।।
দনুর নন্দন হৈল দানব সকল।
গণনে চল্লিশ জন বলে মহাবল।।
বিপ্রচিত্তি শম্বর পুলোমা অশ্বপতি।
এবম্বিধ বহু নামে দানবেতে খ্যাতি।।
ইহাদের পুত্র পৌত্র হৈল অগণন।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল ব্যাপিল ত্রিভুবন।।
চারি পুত্র জন্ম লয় সিংহিকা উদরে।
ক্রূর-কর্ম্মা বলি তারা খ্যাত চরাচরে।।
তাহাদের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ রাহু নাম ধরে।
চক্রে কাটি দুই খণ্ড কৈল চক্রধরে।।
দনায়ুর চারি পুত্র হইলেক ক্রমে।
বিখ্যাত বিক্ষর বল বীর বৃত্র নামে।।
ক্রোধ বিনাশন আদি কালার নন্দন।
দেবের অবধ্য তারা বিখ্যাত ভুবন।।
বিনতার ছয় পুত্র অরুণ আরুণি।
তার্ক্ষ্যারিষ্টনেমি আর গরুড় বারুণি।।
সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গরুড় সে কেশব-বাহন।
পক্ষীর ঈশ্বর হৈল পন্নগ-নাশন।।
কদ্রুর নন্দন হৈল অনন্ত বাসুকি।
ইত্যাদি কদ্রুর পুত্র সহস্রেক লিখি।।
অনুরম্ভা আকীরাদি বিশ্বার দুহিতা।
প্রধানা নন্দিনীগণ জগতে বিদিতা।।
অলম্বুষা মিশ্রকেশী রম্ভা তিলোত্তমা।
সুবাহু সুরতা আদি লোকে অনুপমা।।
হাহা হূহূ নামে পুত্র গন্ধর্ব্বের রাজা।
কপিলার পুত্রগণে সবে করে পুজা।।
ব্রাহ্মণ অমৃত গবী কপিলা-উদরে।
কাশ্যপ কপিল জন্মে ক্রোধার উদরে।।
মুনির উদরে জন্মে ষোড়শ কুমার।
মৌনেয় গন্ধর্ব্ব বলি খ্যাত ত্রিসংসার।।
অঙ্গিরা ব্রহ্মার পুত্র, তাঁর তিন সুত।
বৃহস্পতি উতত্য সম্বর্ত্ত গুণযুত।।
পৌলস্ত্য-মুনির পুত্র বিখ্যাত সংসার।
বিশ্বশ্রবা নামে পুত্র সর্ব্বগুণাধার।।
কুবেরাদি যক্ষ যত তাঁহার নন্দন।
রাক্ষস রাবণ কুম্ভকর্ণ বিভীষণ।।
অত্রির নন্দন হৈল অনেক ব্রাহ্মণ।
ক্রতুর নন্দন হৈল যজ্ঞের কারণ।।
ব্রহ্মার দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠে দক্ষ প্রজাপতি।
বামাঙ্গুষ্ঠে পঞ্চাশৎ কন্যার উৎপত্তি।।
ব্রহ্মার দক্ষিণ হস্তে ধর্ম্ম মহাশয়।
দশ কন্যা দক্ষের করিল পরিণয়।।
কীর্ত্তি লক্ষ্মী ধৃতি মেধা পুষ্টি শ্রদ্ধা ক্রিয়া।
বুদ্ধি লজ্জা মতি, এই দশ ধর্ম্ম-প্রিয়া।।
তিন পুত্র ধর্ম্মের, শুনহ সেই নাম।
সর্ব্বঘটে স্থিতি তাঁরা, শম হর্স কাম।।
কামের বনিতা রতি, শান্তি পতি শম।
হর্ষের রমণী নন্দা এই তার ক্রম।।
অশ্বিন্যাদি কন্যা সম্পবিংশ দাক্ষায়ণী।
বিবাহ-কারণ চন্দ্রে দিল দক্ষ-মুনি।।
ব্রহ্মার তনয় মনু বিখ্যাত ভুবন।
প্রজাপতি নামে তাঁর জন্মিল নন্দন।।
সেই প্রজাপতি-পুত্র বসু অষ্টজন।
বসুর নন্দন হৈল দেব হুতাশন।।
বিশ্বকর্ম্মা-আদি বহু বসুর কুমার।
মৃগ-সিংহ-ব্যাঘ্র-আদি সন্ততি তাঁহার।।
যত কহিলাম পূর্ব্ব সৃষ্টির সঞ্চার।
প্রত্যক্ষে শুনহ তবে নাম অবতার।।
দানব-প্রধান বিপ্রচিত্তি মহাতেজা।
জরাসন্ধ নামে হৈল মগধের রাজা।।
হিরণ্যকশিপু দৈত্য দিতির কুমার।
শিশুপাল নামে জন্মে পৃথিবী মাঝার।।
শল্য যে হইল পূর্ব্বে সংহ্লাদ যে ছিল।
অনুহ্লাদ আসি মর্ত্ত্যে ধৃষ্টকেতু হৈল।।
বাস্কল আসিয়া হৈল ভগদত্ত নাম।
কালনেমি হৈল কংস মথুরায় ধাম।।
শরভ নামেতে দৈত্য পৌরব হইল।
উগ্রসেন নামে গিয়া জনম লইল।।
দীর্ঘজিহ্ব নামে দৈত্য হৈল কাশীরাজা।
মণিমান্ হৈল বৃত্রাসুর মহাতেজা।।
কালকেতু নামে যক্ষ ছিল মৎস্যদেশে।
হরিদশ্ব হৈল রুক্মী ভীষ্মক ঔরসে।।
কীচক কলিঙ্গ বৃষসেন মহাবলে।
কালকেতুগণ আসি জন্মিল ভূতলে।।
বৃহস্পতি অংশে হৈল দ্রোণ মহাশয়।
বশিষ্ঠের শাপে বসু গঙ্গার তনয়।।
রুদ্র অংশে কৃপাচার্য্য অজর অমর।
বসু অংশে সাত্যকি দ্রুপদ নৃপবর।।
কৃতবর্ম্মা বিরাট গন্ধর্ব্ব অংশে জন্ম।
ধর্ম্ম অংশ হৈতে হৈল বিদুরের জন্ম।।
সুবাহু গন্ধর্ব্ব ধৃতরাষ্ট্র কুরুপতি।
সিদ্ধি ধৃতি মাদ্রী কুন্তী গান্ধারী সে মতি।।
ধর্ম্ম অংশে জন্মিলেন যুধিষ্ঠির রাজা।
বায়ু অংশে জন্মিলেন ভীম মহাতেজা।।
দেবরাজ অংশে জন্ম নিল ধনঞ্জয়।
অশ্বিনীকুমার হৈতে মাদ্রীর তনয়।।
চন্দ্র আসি হৈল অভিমন্যু মহাবীর।
কাম হতে প্রদ্যুন্ন বিখ্যাত যদুবীর।।
বসুদেবে দয়া করি দয়াময় হরি।
তাঁর গৃহে জন্মিলা গোলোক পরিহরি।।
শেষ অংশে জন্ম লৈল রোহিণী নন্দন।
দ্রুপদের কুলে জন্মে দ্রৌপদী তখন।।
আপনি আসিয়া কলি হৈল দুর্য্যোধন।
পৌলস্ত্যের অংশে জন্মে আর ভ্রাতৃগণ।।
একাধিক শত পুত্র ধৃতরাষ্ট্র হৈতে।
শুনহ সবার নাম, কহিব ক্রমেতে।।
সর্ব্ব জ্যেষ্ঠ দুর্য্যোধন, যুযুৎসু তৎপর।
দুঃশাসন দুঃসহ দুঃশল বীরবর।।
প্রথম দুর্ম্মুখ তথা বিবিংশতি বীর।
বিকর্ণ শ্রীজলসন্ধ সুলোচন ধীর।।
বিন্দ অনুবিন্দ শ্রীদুর্দ্ধর্ষ সুবাহুক।
দুষ্প্রধর্ষ দুর্ম্মর্ষণ দ্বিতীয় দুর্ম্মুখ।।
দুষ্কর্ণ আরো যে কর্ণ, চিত্র তারপর।
উপচিত্র চিত্রাক্ষ অদ্ভুত নামধর।।
চারু চিত্রাঙ্গদ দুর্ম্মদ সে অনন্তর।
দুষ্প্রহর্ষ বিবিৎসু বিকট শম আর।।
ঊর্ণনাভ পদ্মনাভ নন্দ-নামধর।
উপনন্দ সেনাপতি সুষেণ কণ্ডোদর।।
মহোদর চিত্রবাহু চিত্রবর্ম্মা ধীর।
সবর্ম্মা দুর্ব্বিরোচন আয়োবাহু বীর।।
মহাবাহু চিত্রচাপ নামে সুকুণ্ডল।
ভীমবেগ, বলাকী, অগ্রজ ভীমবল।।
শ্রীভীমবিক্রম উগ্রায়ুধ ভীমশর।
কনকায়ু তথা দৃঢ়ায়ুধ তারপর।।
দৃঢ়বর্ম্মা দৃঢ়ক্ষত্র সোমকীর্ত্তি বীর।
অনূদর জরাসন্ধ দৃঢ়সন্ধ ধীর।।
সত্যসন্ধ সহস্রবাক্ উগ্রশ্রবা খ্যাত।
উগ্রসেন সেনানী দুর্জ্জয়াপরাজিত।।
পণ্ডিতক বিশালাক্ষ দুরাধন বীর।
দৃঢ়হস্ত সুহস্তক বাতবেগ ধীর।।
সুবর্চ্চা আদিত্যকেতু বহাশী অপর।
নাগদত্ত অনুযায়ী নিষঙ্গী তৎপর।।
জানহ কবচী দণ্ডী আর দণ্ডধার।
ধনুর্গ্রহ উগ্র তথা ভীমরথ আর।।
বীর বীরবাহু আলোলুপ নামধেয়।
অভয় সে রৌদ্রকর্ম্মা দৃঢ়রথ জ্ঞেয়।।
অনাধৃষ্য কুণ্ডভেদী বিরাবী তৎপর।
সুদীর্ঘলোচন দীর্ঘবাহু অনন্তর।।
মহাবাহু ব্যুঢ়োরু তাহার যে অনুজ।
তাহার কনকাঙ্গদ পরেতে কুণ্ডজ।।
চিত্রক সে মহারথ হয় যে তৎপর।
ইত্যাদি ক্রমেতে এই শত সহোদর।।
কনিষ্ঠা সোদরা এক দুঃশলা সুন্দরী।
গান্ধারীর গর্ভে জন্ম শতপুত্রোপরি।।
বৈশ্যার উদরে ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে।
সুধার্ম্মিক যুযুৎসুর জন্ম হৈল শেষে।।
জ্যেষ্ঠ অনুক্রমে করিলাম এ রচন।
ভারতে যেমন আছে ব্যাসের বচন।।
শত এক সুত ধৃতরাষ্ট্রের হইল।
দুঃশলারে জয়দ্রথ বিবাহ করিল।।
অংশ অবতার কথা প্রত্যক্ষে প্রকাশ।
বিরচিল পাঁচালী প্রবন্ধে কাশীদাস।।